Ranil Shriyan Wickremasinghe

কর্মের আকুতি ও তার বেতাল প্রত্যুত্তর

রনিল বিক্রমাসিংহে

২০১৫-০৫-১৫ ইং

মিল-অমিল দুই-ই রয়েছে তরুণ সমাজ আর রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ডে। পার্থক্যটা হলো, কর্মক্ষেত্রে তরুণদের লড়তে হয় এমন মার্কেট শেয়ারের লক্ষ্যে, যেটি বৈচিত্র্যময় এবং পরিপূর্ণ না হলেও সেখানে সিংহভাগ প্রতিযোগীর সংকুলান সম্ভব। অন্যদিকে রাজনীতির ময়দানে মার্কেট শেয়ার সীমিত। ফলে নিজের ভাগ রক্ষা ও বৃদ্ধির মধ্যেই করতে হয় দিনাতিপাত। এখানে ক্লান্তির সুযোগ নেই। কেননা বিরতিহীনভাবে খেলা চলতে পারে রাউন্ডের পর রাউন্ড। বহু বছর আগে রাজনীতিতে হাতেখড়ির সময় সকাল-সন্ধ্যা এত বেশি প্রশিক্ষণ নেয়া হয়েছে যে, ঘটনাগুলো সামলাতে তেমন সমস্যা হয় না আজ। যাক, তরুণ ও রাজনীতিকদের ভাবনায় একটা মতৈক্যের জায়গা হলো কর্মের সংস্থান।

বয়সে ৩০ না পেরোনো শ্রমবাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা অনেকে মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করেন, পড়াশোনা শেষে ভালো কাজ পাব তো? তাদের চাওয়াটা বিরাট কিছু নয়। একটু উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা আর নির্ভরযোগ্য চাকরির নিশ্চয়তা। বিবাহিত ত্রিশোর্ধ্বদের দুশ্চিন্তার বিষয়বস্তু আবার ভিন্ন। তারা জানতে চান, কর্মীর যথাযোগ্য মজুরি নিশ্চিত হচ্ছে কিনা। এদের একদল হয়তো সুবিধাজনক স্থানে আপন বাড়ি নির্মাণের চেষ্টা করছেন কিংবা সন্তানকে অপেক্ষাকৃত উন্নততর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান। ফলে কিছুটা ‘ভালো’ বেতন না পেলেই নয়। কর্ম প্রত্যাশীদের এসব প্রশ্নের উত্তর আমি তৃতীয় পক্ষ তথা বেসরকারি খাতের নিয়োগদাতাদের মধ্যে খুঁজি। তাদের ঝটপট জবাব আরো বিমর্ষ করে আমাকে, কাজ করানোর মতো উপযুক্ত কর্মী কই?

কর্মসংস্থান সৃজন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যে যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবেন— সেটাই স্বাভাবিক। ফলে আমার মতামতের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের বক্তব্যে পার্থক্য থাকবে। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান ধরে এগোতে চাই। স্পষ্টত জনশক্তি রফতানির ওপর ক্রমেই বাড়ছে শ্রীলংকার কর্মসংস্থান নির্ভরতা। অর্থাত্ অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্সের তাত্পর্য বাড়ছে অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রে উন্নতির চিত্রই লক্ষণীয়। দেখা যাচ্ছে, ২০০০ সালে অভিবাসীরা পাঠিয়েছেন ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স। সংখ্যাটি ৬ বিলিয়ন ডলার দাঁড়ায় ২০১২ সালে। কার্যত গত দেড় দশকের কম সময়ে শ্রীলংকার রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে আনুমানিক পাঁচ গুণ। নিঃসন্দেহে তা বিরাট বৃদ্ধি। এদিকে ২০০০ সালে কিন্তু আমাদের সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত ছিল তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্প। ওই সময়ে এটি আয় করত ৩ বিলিয়ন, যা বর্তমানে ৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তার মানে, এখানেও বৃদ্ধি প্রায় ২৫ শতাংশ। অবশ্য জিএসপি স্ট্যাটাস না হারালে এবং বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সৃষ্টি না হলে তৈরি পোশাকে আরো প্রবৃদ্ধি হতো আমাদের। শ্রীলংকার রফতানি আয়ের তৃতীয় নির্ভরযোগ্য উত্স হলো চা। শিল্পটি থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম আয় হয়েছে গত বছর। চায়ের পর রাখতে হবে কাঁচা ও মূল্য সংযোজিত রাবার পণ্যকে। সেখান থেকে আয় হচ্ছে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০০০ সালের পর এখন পর্যন্ত এখানেও রফতানি আয় বেড়েছে প্রায় চার গুণ। আমি বিশ্বাস করি, উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে এসব খাতের সম্ভাবনার অধিক সদ্ব্যবহার সম্ভব।

মূলত এ ক’টিই শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বলতে দ্বিধা নেই, হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের (এবং আরো অনেক দেশের) প্রধান রফতানিসামগ্রী ছিল ধান, মসলা, চা, রাবার, নারকেল প্রভৃতি কৃষিপণ্য। ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্য রফতানির উপলব্ধি জাগ্রত হয় সত্তরের দশকে এসে। খেয়াল করার মতো বিষয়, উন্নয়ন মইয়ে শ্রীলংকার যাত্রারম্ভ একেবারে তলানি থেকে; যার ভালো নাম তৈরি পোশাক শিল্প। তা থেকে দ্রুত বাড়ছিল রফতানি আয়। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় জনশক্তি রফতানি। ১৯৮৩ সালের ওই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মধ্যে রেমিট্যান্স আগমনের ঘটনা ছিল দেশবাসীর কাছে খুবই সমাদৃত। তবে এরই মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের অন্ধকার দিকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৯০ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনায়। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার লংকান শ্রমিক ফেরত পাঠানো হয় কুয়েত থেকে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিকল্প অনুসন্ধান কেমন কঠিন, সেটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি তখন। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা ড. এএস জয়বর্ধন ও আমাকে জাপান পাঠালেন। দেশটির সরকার সে সময় যেভাবে হাত বাড়িয়েছিল, আজো তা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

কথা হলো, রেমিট্যান্স এখন বৈশ্বিক ঘটনা। শুধু শ্রীলংকা কেন, অনেক দেশের সুখসমৃদ্ধি ইদানীং ব্যাপকভাবে রেমিট্যান্সনির্ভর, কেউ কেউ অতিনির্ভরশীল। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, রেমিট্যান্সের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে শ্রমঘন ও নিম্ন মজুরির শিল্পোদ্যোগের পাশাপাশি পুঁজিঘন আধা-দক্ষ মানবসম্পদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়, যেন এর সহায়তায় পর্যায়ক্রমে দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলা যায়। ভারতের ও প্রযুক্তি খাতকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি সেক্ষেত্রে। লক্ষণীয়, নিম্ন মজুরির শ্রমঘন শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির ওপর তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছে ভারত। আর আমরা? উন্নয়নের কোন মডেল অনুসরণ করছে শ্রীলংকা?

দেশের অর্থনীতির দিকে যখন তাকাই, এক দশক আগের চেয়ে তেমন কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। এখনো আমাদের রফতানি আয়ের বিপুলাংশ জুড়ে আছে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়। তৈরি পোশাক ঘিরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য রাসায়নিক পণ্য তৈরি হচ্ছে আগের মতো। বিশ্ববাজারে যাচ্ছে লংকান খাদ্যপণ্য ও পানীয়। এসবের বাইরে সেভাবে কোনো প্রযুক্তি পণ্য উত্পাদন ও রফতানি করি আমরা? উত্তর হলো, না। গাড়ির যন্ত্রাংশ বানাই? না। তাহলে তো আগের অবস্থানেই আছি আমরা। জানি, অনেকের কাছে অনেক রকমের যুক্তি আছে। কিন্তু চলমান বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। এগোচ্ছে ভারত-চীন-সিঙ্গাপুর; এদিকে আমরা স্থির। অনেকের মূল ফোকাস স্থানীয় অর্থনীতির সেবা খাতে। সরকারের তীক্ষ দৃষ্টি আবার স্টক এক্সচেঞ্জের ওপর। এরই মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) থেকে অর্জিত হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, চূড়ান্ত বিচারে শ্রীলংকার প্রাপ্তি কী? সার্বিকভাবে এখনো আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো সরকারি ব্যয়। প্রায় দুই দশক (মাঝখানে সম্ভবত ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সাল বাদে) বরাদ্দের বেশির ভাগ গেছে প্রতিরক্ষা খাতে। আর বর্তমানে প্রথম স্থান অধিকার করেছে অবকাঠামো নির্মাণ। এতে বেসরকারি খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ পর্যাপ্তভাবে জোগানো যাচ্ছে না।

আমাদের আর্থিক খাত এখনো তেমন গভীর নয়, দুর্বলতা রয়েছে বেশকিছু। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বেশি উপরে উঠতে না দেয়া, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতি ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন মজবুত হবে না। ওসব গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিবেচনায় কিছু ক্ষেত্রে হয়তো নিম্নমুখী হচ্ছি আমরা। তবে আসল কথা হলো, সেগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর সেটি করা জরুরি এজন্যও যে, নইলে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চল হয়ে পড়বে; পরবর্তী ধাপে উন্নীত হতে পারবে না সমৃদ্ধি। ঠিক আছে মানছি যে, পুঁজিঘন আকর্ষণীয় কিছু শিল্পে আপাতত আমরা নামতে পারব না নানা কারণে। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিরাট সুযোগ তো বিদ্যমান। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলতে চাই, ৪০০ মিলিয়ন কেন, শ্রীলংকার আইসিটি খাতের আকার হওয়া উচিত কমপক্ষে ২ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক খাতে আরো ৬ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় বাড়ানো যায়। কাজটি করা গেলে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। ফলে নিরুপায় তাকিয়ে থাকতে হবে না বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রতি।

আরেকটি বিষয়ের আলোচনা এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেটি হলো, দক্ষ শ্রীলংকানরা থাকছেন না দেশে। দেখা যাচ্ছে, কলম্বোর নামি কোনো হোটেলে ক’বছর দক্ষতা অর্জনের পরই সার্টিফিকেট নিয়ে অনেকে ছুটছেন দুবাইয়ের মতো পর্যটন নগরে। তাদের অভিবাসনের কারণ অযৌক্তিক বলা যায় না। সেখানে বেশি মজুরিতে কাজ পাচ্ছেন তারা! তবে এতে দেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা হলো, কাজের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ পাচ্ছে না স্থানীয় বেসরকারি খাত। কেননা অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে থাকছে প্রধানত অদক্ষরা। এখানকার দক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকের বিশাল অংশই কিন্তু বর্তমানে প্রবাসী। এ ধরনের অব্যাহত মেধা পাচার আমাদের জন্য কত বড় দুশ্চিন্তার তা বলে বোঝানো যাবে না। দলে দলে উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এমন প্রবণতা ঠেকাতে দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সামাজিক ব্যয় জোগাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতে পারে আমাদের।

করণীয় বিষয়বস্তু অনেকগুলোই। নিঃসন্দেহে আমাদের চ্যালেঞ্জ বিপুল, দুর্বলতাও অনেক। তা সত্ত্বেও আমি বিশ্বাস করি, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক বা দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যবান শ্রীলংকা। ভারতীয় মহাসাগরের মাঝখানটায় আমাদের অবস্থান। কৌশলগত দিক থেকে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি আমরা সহিষ্ণু জাতি। সহনশীলতা না থাকলে তিন দশকের যুদ্ধক্ষত ও দুই দশকের পুঁজি লোকসান নিয়ে কোনো দেশ আজ এভাবে আমাদের মতো দাঁড়াতে পারত না। কথা হলো, এখান থেকে অবস্থার দ্রুত ও ক্রমশ উন্নয়ন আবশ্যক। সেজন্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেশের উন্নয়নের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের একমত হতে হবে যে, উন্নয়নের স্বার্থে জরুরি আর্থসামাজিক ইস্যুতে আমরা কেউই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করব না; ভোটাভুটি কিংবা এ ধরনের মূল রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রেখেই। সেজন্য সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় প্রথমে তাকাতে হবে দলীয় রাজনীতির প্রতি এবং এর পর কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো অত্যাবশ্যকীয় আর্থসামাজিক চাহিদার জন্য স্থান সৃষ্টি তথা পরিবর্তন আনতে হবে দলীয় রাজনীতির রূপরেখায়।

লেখক: শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী

ওয়ার্ল্ড নিউজ থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

Interview with Mr. Jesper Toft

একক মুদ্রার ওপর অধিক নির্ভরশীলতা বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে

জেসপার টফট গ্লোবাল কারেন্সি ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা। কোপেনহেগেন বিজনেস স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা নেয়া জেসপার ডেনমার্কের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। ওভারসিজ মার্কেটের চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ওয়েব ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজিতে। চায়না নেটওয়ার্ক মিডিয়া ইনকরপোরেশন পরিচালনা করেছেন ২০১২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি পেয়েছেন ডেনিশ ডিপার্টমেন্ট অব কমার্স ও ডিপার্টমেন্ট অব রিসার্চ থেকে। ব্লুমবার্গ বিজনেসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, তার বড় দক্ষতা স্ট্র্যাটেজি ও বিজনেস ডেভেলপমেন্টে। সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা ঝুঁকি, গ্রিস-ইউরোর মুদ্রা সমস্যা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন জায়েদ ইবনে আবুল ফজল ও সাকিব তনু

 JT foto 2a

সুদূর ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশ— কেন?

আসলে এসেছি আমার প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল কারেন্সি ইউনিয়ন প্রদত্ত সেবাগুলো নিয়ে আপনাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলতে। কেননা আমরা বিশ্বাস করি, মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থার ম্যাথমেটিক্যাল প্লাটফর্ম থেকে প্র্যাকটিক্যালি ব্যাপক সুবিধা তুলে নিতে পারে বাংলাদেশ। মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতায়ও যথেষ্ট কার্যকর এটি।

আমাদের বৈদেশিক বিনিময় হার তো বর্তমানে স্থিতিশীল…

কথাটা আংশিক বাস্তব। বড় বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে এবং বিনিময় হারের দিক থেকে আপনাদের মুদ্রা টাকার প্রায় পুরোপুরি স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে মার্কিন ডলারের সঙ্গে। অথচ বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হলো ইউরো অঞ্চল; তার পর চীন, ভারত ও চতুর্থ নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র। এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারের প্রতিযোগিতার প্রতি লক্ষ করুন। ইউরোর বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। ফলে ডলার ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্পন্ন হওয়ায় বাংলাদেশী রফতানিকারকদের এ সুবিধা সাময়িক। চূড়ান্ত বিচারে তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা খানিকটা কমেছে বরং। বিনিময় হারের ওঠানামায় বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা এখনো যে সমস্যা অনুভব করছেন না, সেটির আরেকটি কারণ হতে পারে— বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের সম্পন্নকৃত চুক্তিগুলো বিনিময় হার পরিবর্তনের আগের। তবে আগামী মৌসুমে ক্রেতাদের সঙ্গে নতুন চুক্তি করার সময় সমস্যা সৃষ্টি হলে অবাক হব না। তখন উৎপাদন ব্যয় আরো কমাতে বলতে পারেন ক্রেতারা। ইত্যবসরে ইউরোপে যদি পণ্যটির চাহিদা না কমে এবং বাংলাদেশ যদি ওই শর্ত মানতে নারাজ হয়, সেক্ষেত্রে এখান থেকে চলেও যেতে পারে কিছু চুক্তি। কেননা বিনিময় হার ও বাণিজ্য বিন্যাস পরস্পর তাল মিলিয়ে চলে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। মুদ্রা-সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবেলায় এটিই কি পর্যাপ্ত নয়?

অবশ্যই বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা যে কোনো অর্থনীতির একটা শক্তিশালী দিক। কিন্তু এর ব্যবহারটা একেবারে সাদামাটা ভাষায় বলতে গেলে রাবার ব্যান্ডের মতো। একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত একে অনায়াসে টানা যায়। কিন্তু তার বেশি টানতে গেলে হয় ছিঁড়ে যায়, নয়তো সমান শক্তিতে আঙুলে আঘাত করে। এর আগ পর্যন্ত হয়তো কিছুই অনুমান করা যায় না। ফলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময় হারে উদ্বায়িতা (ভোলাটিলিটি) বলে কয়ে তৈরি হয় না। আর পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলে ও সতর্ক না হলে বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ক্রিয়া (ইমপ্যাক্ট ইফেক্ট) পড়াও খুবই স্বাভাবিক। সেজন্যই আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে বলছি ট্রেড-ওয়েটেড মাল্টি কারেন্সি বাস্কেট রাখতে।

বৈদেশিক বিনিময় হারের ঝুঁকি বিষয়ে আরো বিস্তারিত বলবেন কি?

দেখুন, বাংলাদেশ গার্মেন্ট পণ্য রফতানি করে। এখানে টাকার সঙ্গে বিনিময় ঘটে ডলার-ইউরো প্রভৃতির। আমরা দেখেছি, পণ্য রফতানির বেলায় মুদ্রার যতবার বদল হয়, বিনিময় হারের বদল ঘটে তার প্রায় দ্বিগুণ বেশি। আরো মজার বিষয়, বৈদেশিক বিনিময় হারের ওই উত্থান-পতন প্রকৃত অর্থনৈতিক বিনিময়ের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্কহীন; সেটা মূলত স্পেকুলেশন-ড্রাইভেন (অনুমান নির্ভর লেনদেন)। আমি মোটেই স্পেকুলেশনের বিরোধী নই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, স্পেকুলেটিভ কারেন্সি মার্কেট (অনুমান নির্ভর মুদ্রাবাজার) ও রিয়েল ট্রেড মার্কেটের (প্রকৃত বাণিজ্য বাজার) মধ্যে সুসমন্বয় ও সুসামঞ্জস্য থাকা উচিত। কেননা বাস্তবে বাণিজ্য না থাকলে বিনিময় হার বাজার হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। অন্যদিকে বিনিময় হার বাজারের অলীক বৃদ্ধি অনেক সময় প্রকৃত অর্থনীতির ঘাড়ে বিপদ চাপিয়ে দেয়।

সেক্ষেত্রে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কেমন হতে পারে?

আমি পরামর্শ দেব, অন্তত বড় বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে বাণিজ্য বিন্যাস (ট্রেড প্যাটার্ন) বিশ্লেষণপূর্বক বিনিময় হার ঝুঁকি হ্রাসের কৌশল নির্ধারণ করুক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেক্ষেত্রে ট্রেড ভলিউম (বাণিজ্যের পরিমাণ) অনুপাতে তৈরি গ্লোবাল কারেন্সি ইউনিয়নের কারেন্সি বাস্কেট (মুদ্রা বাক্স) ব্যবহার করতে পারে তারা। এটি নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক ব্যবস্থা। আমার মনে হয়, এটা একবার ট্রাই করা উচিত। যদি দেখা যায় কাজ হচ্ছে না, তখন বাদ দিলেই হলো। নিঃসন্দেহে দ্রুত ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশেরও কাম্য। কেননা উন্নয়নের বৃহৎ নিয়ামক হচ্ছে এ প্রবৃদ্ধি। আবার তা কিন্তু বাণিজ্য বৃদ্ধি ছাড়া সম্ভব নয়। আমার প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে সহায়তা জোগাতে চায়, যাতে জাতীয় পর্যায়েই অধিক দক্ষ ও সুপরিচালিত বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা থেকে নিজ বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা থেকে সুযোগ উসুল করতে পারে বাংলাদেশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আপনাদের চুক্তি হয়েছে?

এখনো হয়নি। তাই আমি নিজে এখানে এসেছি শুধু এটা বোঝাতে যে, সেতু ও বিদ্যুেকন্দ্রের মতোই বিনিময় হারে ঝুঁকি হ্রাসমূলক আর্থিক অবকাঠামো আপনাদের উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য দরকার। বাংলাদেশ যতই বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে অঙ্গীভূত (ইন্টিগ্রেট) হবে, ততই এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হবে। আর এসব ব্যাপারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়াই উত্তম। সে লক্ষ্যেই অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আমদানি-রফতানিকারক ব্যবসায়ীদের সংগঠন সবার সঙ্গে ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতে প্রস্তুত।

আমাদের বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার বর্তমান হাল কেমন?

বর্তমানে মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে। অথচ সক্রিয় ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতিতে এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা। বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ অকার্যকর কিংবা নেতিবাচক, সে কথা বলছি না। কিন্তু কথা হলো, এ ধরনের ব্যবস্থা সাধারণত অনমনীয়। ফলে আচমকা অভিঘাতে ভঙ্গুরতা দেখা দেয়। তাছাড়া যে কোনো একক মুদ্রার ওপর অতিনির্ভরশীলতা কিছু ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে একাধিক মুদ্রায় ঝুঁকি বণ্টনই বুদ্ধিমানের কাজ।

আইএমএফ স্থাপিত আর্থিক অবকাঠামোর সঙ্গে এতক্ষণ আলোচ্য ব্যবস্থাটির সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু?

ট্রেড-ওয়েটেড মাল্টি-কারেন্সি বাস্কেট অন্য দেশের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক কিংবা সমন্বয় ছাড়া স্থাপন করা যায়। আইএমএফের বিদ্যমান অবকাঠামোর মধ্যেই এর প্রয়োগ সম্ভব। আবার ব্যবস্থাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম যেমন— দেশী মুদ্রা সরবরাহ অথবা সুদের হার নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের ওপরও এর প্রতিক্রিয়া নেই।

একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের সম্ভাবনা বা চ্যালেঞ্জ কী কী?

উন্নয়নশীল থেকে উন্নত হওয়ার পথে প্রচলিত ধাপগুলো সবাই জানেন। বাংলাদেশকেও হয়তো সেই ক্লান্তিকর সিঁড়ি বেয়েই উঠতে হতো, যদি না তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) বৈপ্লবিক ছোঁয়া এখানে লাগত। আমি মনে করি, বাংলাদেশের উন্নয়নের শর্টকাট প্লাটফর্ম হতে পারে আইসিটি। এটি একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের একটা বড় শক্তি। আর অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো, সিস্টেমকে আপগ্রেড (ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী) করা। আপনাদের বিনিময় হার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই এখনো প্রচলিত ধারায় চলছে। এখানে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। কেননা পরস্পর সহযোগী দেশগুলো এখন অনেক বেশি কাছাকাছি আর সেক্ষেত্রে ম্যাজিক গ্লু হলো ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রেশন (আর্থিক একীভূতকরণ)।

এখানকার ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

এ বিষয়ে আমার জানাবোঝা খুব বেশি দিনের নয়। ফলে ধারণাও ভাসা ভাসা। তবু ইউরোপের অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু বুঝি— স্থানীয় ব্যাংকিং খাতের বিস্তার ও গভীরতা বাড়াতে গ্রাহকের আরো আস্থা অর্জনের দরকার আছে। সে লক্ষ্যে গ্রাহক-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহে যত্নবান ও সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি বাস্তবায়ন করতে হবে বাসেল-২-এর মতো বৈশ্বিক অনুশীলন। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় দুটো বিষয়— রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স। এর সুব্যবস্থাপনায় এগিয়ে আসা উচিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। বর্তমানে বাংলাদেশে যেভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহিত হচ্ছে, তা অসম্পূর্ণ স্থানান্তর। সঠিক চ্যানেলের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে এর অধিকতর ব্যবহার সম্ভব। তাতে ব্যাংকগুলোর করণীয় কম নয়।

গ্রিসের বর্তমান পরিস্থিতি কী? কিছুদিন আগে শোনা যাচ্ছিল, একক মুদ্রা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে তারা। ওদিকে রাশান রুবলের দাম পড়েছে সম্প্রতি…

ইউরোপে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে এ মুহূর্তে। আর গ্রিক বাণিজ্য হিসাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি। ২০১৩ সালের অফিশিয়াল হিসাবেই তা ছিল প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। গ্রিস যদি ইউরো পরিত্যাগ করতে চায়, ডলার ও ইউরোকে নিয়েই থাকতে হবে তাকে। সেক্ষেত্রেও ঝুঁকি প্রভাব ও বিনিময় হারের বিপদ রয়েছে, যা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব।

রুবলের দাম ৫০ শতাংশ কমেছে এক মাসে। অর্থাৎ ৩০ দিনে আন্তর্জাতিক বাজারে তার অর্ধেক ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছে রাশিয়া। ফলে বিপাকে পড়েছে সেখানকার কোম্পানিগুলো। ওদিকে সুইস ফ্রাংকের কিন্তু দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ। তার প্রভাবও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বহু প্রতিষ্ঠানকে। মুদ্রাবাজারের এমন উদ্বায়িতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যেও রয়েছে বেশ।

বিশ্বের মুদ্রাবাজারের ভবিষ্যৎ কী?

গত ৪০ বছরে আপনারা ভেহিকল টেকনোলজির পরিবর্তন, টেলিফোনি ধারণার রূপান্তর দেখেছেন; আমি কিন্তু দেখেছি বিনিময় হার ব্যবস্থার পরিবর্তিত রূপ। আমার বিশ্বাস, এর উন্নয়ন হবে পর্যায়ক্রমে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং আমাদের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কিছুটা হলেও পরিচিতি ঘটেছে। তাদের ব্যাপারে আপনার ধারণা জানতে পারি?

আমার ফার্স্ট ইম্প্রেশন হলো, ব্রিকসের পর নেক্সট-১১-এর সদস্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাবনাময়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা অব্যাহতভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে চললে এটা ঘটত না। সেন্ট্রাল ব্যাংকিং, ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের কিছু কর্মকর্তাকে বেশ কোয়ালিফাইড মনে হয়েছে। আর বেসরকারি খাত সম্পর্কে শুধু এটুকু বলব, আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশীরা আন্তরিকভাবেই ভাগ্যকে বদলাতে চায়; নিজ অবস্থার উন্নতি চায়।

বিশেষ কোনো পরামর্শ আছে কি?

বদ্ধ অবস্থায়ও সংরক্ষিত অর্থনীতির উন্নয়ন হয়। তবে সে পরিস্থিতিতে কাঙ্ক্ষিত গতি মেলে না। আর এ গতির নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে ডেভেলপমেন্ট প্রসেসের (উন্নয়ন প্রক্রিয়ার) ওপর। ফলে উন্নয়নের গতি বাড়াতে বিশ্বের সঙ্গে আরো উন্মুক্ত হওয়া উচিত বাংলাদেশের।

আলোকচিত্রী: ডমিনিক হালদার

২০১৫-০৫-০৭ ইং

By Name

কী লাভ, কার ক্ষতি

যেকোনো সমর-সম ক্রিয়ার, এমনকি সাধারণ হুমকি-ধামকিরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। সম্প্রতি ইউরোপের সীমানায় ইউক্রেনে উদ্ভূত পরিস্থিতি ঘিরে উত্তেজনা নিয়ে কেউ কেউ বলছেন, দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো বলে। কারো কারো মতে, যেহেতু এটা রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্ব, ইউক্রেনের অস্থিরতা হলো দ্বিতীয় স্নায়ু যুদ্ধ। তবে এসব মন্তব্য ঘটনার অতিসরলীকরণ মাত্র। কেননা হিসাব-নিকাশ শুধু এ নয় যে, ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে যাবে না ইউরোপের সঙ্গে থাকবে। জাতিগত বিভেদ রেখার যেসব সমীকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে, সে ছাঁচেও ঠিক ফেলা যায় না ঘটনাটিকে। সমস্যা হলো, ইস্যুটিকে ইউক্রেন, রাশিয়া ও ইউরোপ-আমেরিকা কীভাবে নিচ্ছে, তাঅ যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। ফলে এটি নিছক আঞ্চলিক সংঘাত নাকি ২০০৮ সালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের পর বিশ্ব পর্যায়ে নতুন ভারসাম্যকরণের অবতারণা, হলফ করে বলা কঠিন।

রুশপন্থীরা মনে করেন, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার স্বাভাবিক ‘হক’ আছে। এর স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য ক্রিমিয়ায় দীর্ঘদিন রাশিয়ার শাসন বজায় ছিল; ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত নিকিতা ক্রুশ্চেভ অঞ্চলটিকে ইউক্রেনের হাতে তুলে দেয়ার আগ পর্যন্ত। চিন্তার কথা, ইউক্রেন ঘিরে পুতিনের পরিকল্পনা কী? সমর অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধ কলাকৌশলে তিনি সমৃদ্ধ। ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার সমর শক্তি অনেক বেশি। তার ওপর ব্ল্যাক সি ফ্লিট রয়েছে সেখানে; স্থানীয় সহায়তাও মিলবে পর্যাপ্ত। তবু ইউক্রেনে বেশি জোরাজুরি করলে গত তিন বছর বৈশ্বিক কূটনীতিতে অন্যতম অর্জন সিরিয়া ও ইরান ইস্যুতে পুতিনের মুষ্টি খানিকটা শিথিল হবে। এতে আন্তর্জাতিকভাবেও ঘৃণার পাত্র হবেন তিনি। আরেকটি পয়েন্ট, ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ায় পুনর্দখল নেয়ার পর স্থানীয় তাতারদের তাড়িয়ে দেয় রেড আর্মি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে ওরা আর ফিরতে পারেনি জন্মভূমিতে। ছোট-খাট সংঘর্ষ হলেও এ যুদ্ধবাজ সম্প্রদায়ের গোটাটাই হয়তো চলে যাবে রুশদের বিপক্ষে। পুতিন এসব ঝুঁকি সহজে নেবেন বলে মনে হয় না। এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপ বিশেষত জার্মানীর সম্পর্ক জটিল। সেক্ষেত্রে একটা অপশন থেকে যায় টেবিলে। সেটি হলো, ইউক্রেন চাপ ব্যবহার করে পশ্চিমাদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা দায় করা। তাহলে অবধারিতভাবে এসে যায় বৈশ্বিক পর্যায়ে পুনঃভারসাম্যকরণ এবং রাশিয়া সেটি কখন ও কীভাবে চাইছে- সে প্রশ্ন। তবে পুতিনের এ মনোবাঞ্ছা সত্য হলে বলতে হয়, বারাক ওবামা অত ‘টাফ’ না হলেও নানা কারণে দরকষাকষিতে বেশি সুবিধা পাবে না রাশিয়া।

ইউক্রেন ইস্যুতে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে ইউরোপ। অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা তার একটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম দুর্বলতা হলো, দেশটিকে ভালোভাবে বোঝে এমন দক্ষ কুটনীতিকের সংখ্যা কম। তাই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের মতো অনেক আমেরিকানকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে পুতিনকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো কয়েকজন অবশ্য সতর্ক করেছে, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করার অপচেষ্টা একটি অকার্যকর কূটনৈতিক কৌশল। যাহোক, অন্তত দুটি কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে পিছু হটবে না যুক্তরাষ্ট্র; প্রথমত. বন্ধু ইউরোপের আহ্বান; দ্বিতীয়ত. হৃত গর্ব ফিরে পাওয়ার সুযোগ।

এ যাত্রায় সফল হতে চাইলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ মাথায় রাখা জরুরি। পশ্চিমাদের দেখা উচিৎ, ন্যাটোকে না জড়িয়ে কার্যোদ্ধার এবং ইউক্রেনকে ফিনল্যান্ডের মতো উপায়ে স্থিতিশীল করা যায় কিনা। দ্রুত অগ্রগতির জন্য এ আলোচনার ভালো মাধ্যম হতে পারেন দিমিত্রি মেদভেদেভ। অবশ্য সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত দিতে হবে পুতিনকেই। সেজন্য তার অনুধাবন দরকার, ইতিহাস যেন একবিংশ শতাব্দীর ‘বৃদ্ধ আইভান দ্য টেরিবল’ হিসেবে স্মরণ না করে তাকে। ‘গ্র্যান্ড প্রিন্স’ দু’জন ভিন্ন ভিন্ন আইভান কিন্তু রয়েছে রাশিয়ার ইতিহাসে।

উদ্ভূত সংকট নিরসনে বড় দায়িত্ব ইউক্রেনীয়দেরও। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত অল্পবয়সী অধিকাংশ দেশের (বাংলাদেশকেও এখানে রাখা যায়) বেলায় দেখা গেছে, এরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় সত্তা-স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সমঝোতা করতে পারে না। কামনা করি, এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠুক ইউক্রেন। ক’দিন আগে ইংরেজি ভাষাভাষী মিডিয়ায় ‘দ্য ইউক্রেন’ সম্বন্ধ করায় ক্ষিপ্ত হতে দেখা গেছে দেশটির অনেক নাগরিককে। তাই ইউক্রেন কাভারে ব্যস্ত সব সাংবাদিককে এ বিষয়ে নির্দেশনাও দিয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও গার্ডিয়ান মিডিয়া। খালি ইউক্রেন আর দ্য ইউক্রেনের মাঝে অর্থনৈতিক পার্থক্য না থাকলেও ‘দ্য’ শব্দটির রয়েছে সাংঘাতিক রাজনৈতিক গুরুত্ব। আর আপাত সংকটের মাঝে এ দেশাত্ববোধটা এক বড় সুলক্ষণ।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

বেইজিংয়ে বাঘ শিকার

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

মূলত দুই কারণে গত শতাব্দীতে লাফিয়ে লাফিয়ে কমেছে বাঘের জনসংখ্যা। প্রথমত. বাঘের হিংস্রতা। এতে আবার শিল্পায়ন ও নগরায়নের রয়েছে পরোক্ষ অবদান। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা রয়েছে- সে কুসংস্কারেও বেড়েছে বাঘ পাচার। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর এ প্রাণীটির সংখ্যা বর্তমানে চার হাজারের কম। বাংলাদেশে নাকি রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে অর্ধসহস্রের মতো; চীনা বাঘের প্রকৃত সংখ্যা পঞ্চাশের নীচে বলেই অনুমান। এর মাঝে বেইজিংয়ে বাঘে শিকারে স্বয়ং নেমে গেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং- বন্দুক নয়, আইন দিয়ে; মানুষখেকো নয়, সমাজখেকো বাঘ শিকারে। উচ্চ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতায় আসীন সরকারি কর্মকর্তারাই হচ্ছেন বাঘ, যাদের অব্যাহত কামড়ে ক্ষতবিক্ষত দেশ!

প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিনপিং অফিসে বসেছেন চীনা ক্যালেন্ডার অনুসারে সর্পবর্ষে; ২০১৩ সালের মার্চে। এখন চলছে অশ্ববর্ষ। তার মাঝে কেবল গত বছরই শিকার হয়েছে ১৭টি বাঘ; যাদের কেউই উপমন্ত্রী পদমর্যাদার নীচে নন। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিনপিংয়ের অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতা নেয়ার আগেই। তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আর দেরি করেন নি। তবু বহির্বিশ্বের অনেক বিশ্লেষকের শঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়তো পারবেন না জিনপিং। তাদের এ ধারণার ওপর প্রথম আঘাতটা আসে সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী বো শিলাইয়ের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি মামলার বিচার শুরুর পর। সম্প্রতি জিনপিং সমালোচকদের আরো অবাক করেছেন রাঘব বোয়াল চৌ ইয়াংক্যাংকে ধরে। কয়েক মাস আগেও ভাবা যেত না, ইয়াংক্যাংকে কেউ স্পর্শ করতে পারে। ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা একবার তাকে উল্লেখ করেছিল, ‘চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি’ হিসেবে। আরেক বিশেষজ্ঞ তাকে বলেছিলেন- আধা সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি; আধা সাবেক এফবিআই প্রধান জে এডগার হুভার। ক’বছর আগেও চীনা জ্বালানি শিল্পে কার্যত একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ইয়াংক্যাংয়ের। শোনা যায়, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাজেটের এক ইয়েনও পাশ হতো না তার সম্মতি ছাড়া। গোপনীয়তার স্বার্থে চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাজেট জনসম্মুখে উপস্থাপন করা হয় না। তবে কারো কারো অনুমান, সেটি ভিয়েতনামের জিডিপি ছাড়ায়ই ইয়াংক্যাংয়ের তত্ত্বাবধানে। নিঃসন্দেহে নিজ ক্ষমতা গ্রহণের আগে ইয়াংক্যাং কর্তৃক চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরো থেকে অবসর নেয়াটা বিরাট সুবিধাজনক ছিল জিনপিংয়ের জন্য।

বলা যাবে না, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে জিনপিং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করার খেলায় মেতেছেন। সেটি চাইলে গোপনেই তিনি করতে পারতেন- অনেক শাসক যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধীদের তাড়ায়। জিনপিংয়ের বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে, দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচিতে নেমে সরাসরি সেন্ট্রাল কমিটি ফর ডিসিপ্লিন ইনসপেকশনের দ্বারস্থ হন তিনি। ওয়ান কিশ্যাং কমিটির বর্তমান সেক্রেটারি। জিনপিং সিসিপি সেন্ট্রাল কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পদে আসীন হন কিশ্যাং। গোল্ডম্যান স্যাকসের সাবেক সিইও ও চেয়ারম্যান এবং সাবেক মার্কিন রাজস্ব মন্ত্রী হ্যাঙ্ক পলসনের পর্যবেক্ষণ মতে কিশ্যাংয়ের দেশপ্রেম ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কঠিন। তদুপরি তিনি এখন জিনপিং সংস্পর্শে অনুপ্রাণিত। ফলে কিশ্যাং ইদানীং কেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে নজরদারি কর্মকর্তা পাঠাচ্ছেন স্থানীয় সরকার পর্যায়ে। প্রতিনিধিরা সরাসরি তার কাছে প্রতিবেদন পাঠান। এর মধ্য দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের নামে গোপন নথি পাঠানোর রেওয়াজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আগে বহু বড় কর্মকর্তা বেইজিংয়ের বাইরে গ্রামে পথে পা ফেলতেই চাইতেন না। কিশ্যাংয়ের তাগাদায় তাদের অনেকে এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও অবস্থান করেন। কিশ্যাং মামলা তৈরিতেও এনেছেন কিছু গুণগত পরিবর্তন। এক ইয়াংক্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র উত্থাপনের আগে আত্মীয়-স্বজন, ড্রাইভার-মালিসহ ইয়াংক্যাংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আর্থিক সম্পর্ক ছিল এমন ৩০০ জনকে জেরা করেন তার প্রেরিত কর্মকর্তারা।

যে কোনো দেশে বড় দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করার রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয় ক্ষমতাসীনদেরই। তাই আগ্রহ নিয়ে এ দায়িত্ব কেউ পালন করতে চায় না সাধারণত। জিনপিং নিশ্চয়ই বোঝেন সেটা। এও নিশ্চয়ই জানেন, বড় বাঘ চলে গেলে পার্টি ক্ষমতায় কেমন পরিবর্তন আসবে এবং চীনে পার্টি ক্ষমতা হ্রাসের অর্থ কী। তবু তার মনে সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। জনগণও ওসব দৃষ্টান্তকে গ্রহণ করছে উষ্ণ আন্তরিকতায়। অবশ্য এ ধরনের অতিঝুঁকিপূর্ণ মৃগয়া যত দ্রুত সম্পন্ন করা যায় ততই ভালো। তাতে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম বেগবান হবে। সেক্ষেত্রে চীন প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিরোধ মেটানোর চিন্তা-ভাবনা করার বাড়তি সময় পাবে হয়তো মর্কটবর্ষ থেকেই।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট

একবিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতায় ঝুঁকি

ক’দিন আগে বর্বর আইএস সদস্যদের হাতে প্রাথমে সাংবাদিক জেমস ফলি ও পরে স্টিভেন সটলফের ট্র্যাজিক মৃত্যুকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। এখানে সেটি সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ রাখাই ইচ্ছা। নমুনা হিসেবে এ ঘটনার সহায়তায় একবিংশ শতাব্দীতে সংবাদ সংগ্রহ ঝুঁকির সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক উভয় চিত্রই মূল্যায়ন করা যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুখ্যাত কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে ধরা পড়ার পর সাংবাদিক বুদ্ধি খাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে, এমন ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু সিনেমাও হয়েছে হলিউডে। একটি বড় কারণে এক দশক সন্ত্রাসীদের কাছে মাথা হারানোর ভয় ছিল কম। সেটি হলো, নিজেদের মতাদর্শ প্রচার, আরো সোজা ভাষায় বিজ্ঞাপন। বস্তুত সে ভরসাতেই সাংবাদিকরা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকারও নিতে পেরেছিলেন। আস্তানার সাংবাদিক নেয়ার ঝুঁকি সন্ত্রাসীদের আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে এক্ষেত্রে কাগজ-কলম সাংবাদিকদের রক্ষাকবচ তথা দর কষাকষির ক্ষমতা হারাতে বসেছে, পরিহাসবশতঃ সামাজিক গণমাধ্যমগুলোর প্রভাবে। উগ্র গোষ্ঠীগুলো আজ জানে, ‘স্টোরি’ প্রচারের জন্য সাংবাদিক নিয়ে আসার দরকার নেই; কাণ্ড ঘটিয়ে ইউটিউব, ফেসবুক প্রভৃতিতে তুলে দিলেই হলো। সেজন্যই দেখা যায়, আল-শাবাব, আল-কায়েদা থেকে আইএস পর্যন্ত প্রায় সব জঙ্গিগোষ্ঠীই অনলাইনে যথেষ্ট সক্রিয়।

ইদানীং পেশা ‘ফ্রিল্যান্সার’ উল্লেখ করে, মৌলিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধাবস্থার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে সংবাদ সংগ্রহে নেমে আনাড়িপনা অনুশীলন করতে দেখা যায় একশ্রেণীর নবাগত ‘সাংবাদিক’কে। একবিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতা প্রেক্ষাপটে এও এক লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন বৈকি। জেমস ফলিও ফ্রিল্যান্সার ছিলেন। তবে তাকে আনাড়ি বলা বোধহয় ভুল হবে। শিক্ষকতা থেকে সরে আসার পর প্রায় ছয় বছর যেসব স্থানে তিনি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েছেন, তার সবগুলোই অত্যন্ত বিপদজনক। ফলি বেশ কিছুদিন ছিলেন আফগানিস্তানে। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি আটকের এক ভিডিও-তে দেখা যায় তাকে। সেখানে বেশ কিছুদিন উগ্রপন্থী এক গ্রুপের হাতে অপহরণের আটকও ছিলেন। মুক্ত হয়ে চলে আসেন সিরিয়ায়। তার মাঝে ঘটে ওই ট্র্যাজেডি।

বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন ফলি। অনেকে সমালোচনা করছেন, এ যুগে মাঠে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজন কী। স্থানীয় কাউকে আউটসোর্স করলেই হতো। উপায়টা মন্দ না। কিন্তু একাধিক গুরুতর সমস্যা রয়েছে এর। প্রথমত. সাময়িকভাবে নিয়োজিত স্থানীয় প্রতিনিধিদের দৃষ্টি ও সাহস প্রায়ই দেখা যায় ধী ও লেখনী শক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এদের পাঠানো প্রতিবেদন ঠিক সংবাদপত্রোপযোগী হয় না। দ্বিতীয়ত. অনেক সময় সেগুলো অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে। তৃতীয়ত. সে অনুবাদই মেরামত করতে হয় ডেস্ককে। তার মানে মূল ঘটনার কিছু সত্য হারায় অনুবাদে; কিছুটা ডেস্কে এসে। তার পর প্রতিবেদন হয় কোনোদিকে বেশি হেলে পড়ে, নয়তো এমন নিরপেক্ষ হয় যে তার অবস্থানই টের পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদ সংগ্রাহক আউটসোর্স করার পর এই হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর সাধারণ অভিজ্ঞতা। আবার অনেকের সাধ্যে কুলোয় না দেশে দেশে স্থায়ী প্রতিনিধি নিয়োগ বা প্রেরণ। এদের মাঝে তাই আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধায় বিপদজনক স্থানে ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক প্রেরণের প্রবণতা বাড়ছে; তাদেরই একজন ছিলেন জেমস ফলি।

দ্য টেলিগ্রাফের প্রধান বৈদেশিক প্রতিবেদক কলিন ফ্রিম্যান সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে অপহৃত হন। বন্দী ছিলেন কয়েক বছর। তিনি লিখেছেন, ওমন পরিস্থিতিতে নিজের চেয়ে পরিবারকে নিয়ে ভাবনাটাই হয় বেশি। তার আরেকটি পর্যবেক্ষণ হলো, একবিংশ শতাব্দীতে অন্যদের চেয়ে বেশি চাপে থাকেন সাংবাদিকদের স্বজনরা। এসব বিবেচনায় ‘সরেজমিন প্রতিবেদন’-এর সময় শেষ হয়ে আসছে বলে মন্তব্য অনেকের। সুযোগ থাকার পরও শুধু একটু বেশি সত্য জানার জন্য বাড়তি ঝুঁকি কে নেবেন? তবে নিজ সাহসিকতা দিয়ে বাকিদের অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য, কমপক্ষে তাদের প্রাণ স্পর্শ করার মতো হয়তো কেউ না কেউ সব সময়ই থাকবেন জেমস ফলির মতো। সব কিছু জানার পরও কোন বিবেচনায় ছেলেকে সিরিয়ায় থাকতে দিলেন, এক মানবাধিকার সংগঠনে গিয়ে সম্প্রতি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হন জেমসের বাবা, জন ফলি। তিনি সজল চোখে পাল্টা জানতে চেয়েছেন, ঘর-বাড়ি জ্বলছে জেনেও কেন সেখানে দমকল কর্মীরা ঢোকে?

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

তর্কসাপেক্ষ

তোলপাড়ে আড়াল বিশ্লেষণ

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে (আবদুল করিম) খন্দকার রচিত গ্রন্থ ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ‘তোলপাড়’ কম হয় নি দেশে। সে রেশ এখন পুরোপুরি তিরোহিত- তাও বলা যাবে না। মজার বিষয়, বাসি রাজনৈতিক রেসিপির উপকরণ হিসেবে বইটি যতটা ব্যবহার হয়েছে, এর কার্যোপযোগী বিশ্লেষণ হয়েছে কম।

খন্দকার সাহেব দীর্ঘদিন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন; বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রতিষ্ঠার পেছনে তার শ্রম অনস্বীকার্য। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক। স্বভাবতই বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকে বহুলাংশে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন তিনি। তাই সমালোচনার বেলায় রাজনৈতিক তথ্য-বিবরণ-মন্তব্যের কুতর্কে প্রবৃত্ত না হয়ে ভদ্রলোকের স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ থেকে বইয়ের সাফল্য-ঘাটতি বিচার করা শ্রেয়। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, কিছু ত্রুটি-দুর্বলতা-অব্যবস্থাপনা সরিয়ে রাখলেও খন্দকার সাহেবের ভাষ্যে ফুটে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র নিঃসন্দেহে অনবদ্য। তীব্র প্রতিকূলতার মাঝে সে সময় আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যে অপ্রাকৃতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, সেটি যথেষ্ট গর্বের। অবশ্য বইয়ে খন্দকার সাহেব কম উচ্চারিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যান নি- যা অনিচ্ছাকৃতও হতে পারে; যেমন- পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ।

আমাদের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী কেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না? কেন যৌথ বাহিনীও নয় সরাসরি ‘চিরশত্রু’ ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন পাকিস্তানীরা? তথ্য অনুসারে, তখন সিলেট মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করছিলেন ওসমানী সাহেব; উপ-সর্বাধিনায়কের বারণ সত্ত্বেও। এটি কী অস্বাভাবিক নয়? ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) অনুষ্ঠিত মন্ত্রীপরিষদ সভায় আক্রমণ চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী। তাতে ভীত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক আশ্রয় নেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) রেড ক্রসের কাছে। পরদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিল মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। সর্বাধিনায়কের পক্ষে এর পরও যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়। সিলেট থেকে ঢাকার দূরত্বও ওত বেশি কী? এ বিষয়ে আমাদের আলোকিত করেন নি খন্দকার সাহেব। তবে বাজারে এ নিয়ে দুটি ধর্তব্য তত্ত্ব আছে; এক. জেনারেল ওসমানী নাকি ‘প্রটোকল সচেতন’ ছিলেন। তিনি চান নি তিন তারকা জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা’র সঙ্গে বসতে; তার প্রত্যাশা ছিল ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’কে। দ্বিতীয় তত্ত্ব যুদ্ধের মনস্তাত্বিক লড়াই সংক্রান্ত। শোনা যায়, কোনো কোনো ভারতীয় জেনারেল নিয়াজিকে ভয় দেখান, বাংলাদেশীরা পেলে পাকিস্তানীদের কচুকাটা করবে! অনেকের আরো প্রশ্ন, তখন যৌথ কমান্ড এড়িয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক আত্মসমর্পণ আয়োজনের অবস্থান সমর্থনযোগ্য কিনা। কারো কারো ধারণা, এখানে কোনো কুমতলব ছিল না ভারতীয়দের। কেননা, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব নিজ ভবিষ্যৎ পরিচালনায় বাংলাদেশকে চালকের আসনে বসান। এতে তারও অভ্যন্তরীণ চাপ কমবে। এদিকে বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে সইকারী দেশ না হওয়ায় ভারত ভিন্ন অন্যদের কাছে যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সুবিচার চাওয়া সম্ভব ছিল না পাকিস্তানীদের পক্ষে।

এসব বিস্তারিত ইস্যুতে খন্দকার সাহেবের মত পেলে ভালো হয় বৈকি। আর সে সুযোগ ফুরোয় নি। নতুন তথ্য কিংবা বিশ্লেষণের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পেলে বইয়ের পরিবার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশের নজির বিরল নয়। খন্দকার সাহেবের তেমন চিন্তা-ভাবনা থাকলে অনেক কৌতূহলী পাঠকও আশান্বিত হবেন বৈকি।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

মহাকাশে সাফল্য

ঝুঁকি মাড়িয়ে জানার তৃষ্ণা

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

রাস্তাটা নাতিদীর্ঘ ছিল না। গন্তব্যে পৌঁছুতে পাড়ি দিতে হয়েছে আনুমানিক ৪০০ কোটি মাইল। সময়ও কম পার হয় নি; এক দশকের কিছু বেশি। ১০০ কেজি ওজন নিয়ে রোজেটার সঙ্গে ল্যান্ডার ফিলি পৃথিবীর স্পর্শের বাইরে চলে যায় ২০০৪ সালের মার্চেই; নামল এই ১২ নভেম্বর। উদ্দেশ্য ছিল, ৬৭পি/শুরয়ুমোভ-গেরাশিমেনকোয় আস্তানা বসানো। সেখানে মানবজাতির পুরনো কয়েকটি জটিল প্রশ্নের হিসাব মেলানো। ‘সুবিধাজনক’ মনে হওয়ায় মহাবিশ্বের ভ্যাগাবন্ড ধূমকেতুগুলোর মধ্যে ৬৭পি’কে বেছে নেন বিজ্ঞানীরা। এখানে ‘সুবিধাজনক’ শব্দটাকে ‘সহজ’ থেকে দূরে রাখা বিশেষভাবে দরকার। কেননা রোজেটা মিশনের সাফল্য অর্জনের পথে যে মাত্রায় ঝুঁকি ছিল, সেটি মহাশূন্য যাত্রায় নিঃসন্দেহে অনন্য।

চলতি বছরটা মহাকাশ প্রযুক্তিবিদদের জন্য ঠিক সুখকর ছিল না। ভারতীয় মঙ্গলযানের সিদ্ধি বাদ দিন। বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এ বছর। ক’সপ্তাহ আগে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশ্য রওনা দিয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে পড়ে মনুষ্যবিহীন এক যান। এর পর মাটি থেকে ৪৫ হাজার ফুট ওপরে চালানো এক পরীক্ষামূলক ফ্লাইটে কয়েক টুকরো হয়ে গেল এক ভার্জিন গ্যালাকটিকো শিপ। ফলে রোজেটা তার মিশন সম্পন্ন করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল শেষ পর্যন্ত। তার ওপর ঘণ্টায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটে চলা ধূমকেতুকে ধাওয়া করে কাছে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। ১৯৭৮ সাল থেকেই কিন্তু ধূমকেতু মিশন পাঠানো হয় একাধিক। তবে সেগুলো ধূমকেতুর আশাপাশ দিয়ে উড়েছে কেবল। সঙ্গত কারণেই কাছে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায় নি কেউই।

খেয়াল করার মতো বিষয়, দুর্ঘটনায় পতিত দুটি মিশনই বেসরকারি খাত পরিচালিত। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) ও নাসার পাশাপাশি রোজেটা মিশনেও বিরাট ভূমিকা রয়েছে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অনুমান করা চলে, মিশনটি সফল হওয়ায় বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি অনেক ব্যবসায়ীই স্বস্তি ও আনন্দের নিঃশ্বাস ছেড়েছেন।

২০১৪ সালের মুদ্রামান অনুযায়ী গোটা রোজেটা মিশনে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ইউরো। স্বভাবত উঠতই, ইউরোপের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করলে আরো বেশি করে প্রশ্ন ওঠে, এত বিপুল ব্যয় কীজন্য? এর সোজাসাপ্টা উত্তর, জানার তৃষ্ণা মেটাতে। তত্ত্ব আছে যে, দূর অতীতে (কয়েক বিলিয়ন বছর আগে) পৃথিবীর বুকে সমুদ্র সৃষ্টির পেছনে অবদান রেখেছিল ধূমকেতু। সৌরজগতের জন্মের আগে থেকেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এ অংশে যাতায়াত সেগুলোর। তবে তত্ত্ব দুটির সত্যতা কখনো যাচাই করা যায় নি। এখন ফিলির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে সৃষ্টি করবেন, সৌরজগত সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায় কেমন ছিল। পানিতে হাইড্রোজেনের সঙ্গে এর আইসোটোপ ডিউটোরিয়াম অণু থাকে। ৬৭পি’র থাকা হাইড্রোজেন-ডিউটোরিয়াম অনুপাতের সঙ্গে পৃথিবীরটা মিলিয়ে দেখা যাবে, আদৌ কোনো ধূমকেতু পানি বয়ে এনেছিল কিনা? কিংবা সেই সঙ্গে প্রাথমিক প্রাণের উপাদানও?

গভীর মহাশশূন্যের এ মিশনটির নাম ‘রোজেটা’ দেয়ার কারণও তাই। কোনো নারীর নাম থেকে নয়, প্রাচীন মিশরীয় রোজেটা ফলক অনুসারে এর নামকরণ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন হায়ারোগ্লিফিক্সের মর্ম উদ্ধার করতে পারছিলেন না, তখন তাদের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা যায় রোজেটা ফলক। আর এ ফলকের কাছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিয়ে গিয়েছিল ফিলি স্মৃতিস্তম্ভ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই রোজেটা মিশনকে দেখেছেন ইএসএ’র বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা। তাদের আশা, সৌরজগতে রচিত প্রাণ বিকাশের দলিলের কিছু অংশ অন্তত পড়তে সহায়তা করবে ফিলি ল্যান্ডার। আগামী বছর এ সময়টায় সূর্যের সবচেয়ে কাছে চলে যাবে ৬৭পি। এর কিছু পরে মিশন শেষ হয়ে যাবে রোজেটারও। তবে নিঃসন্দেহে বড় অনুপ্রেরণা হয়ে রইবে এটি। কেননা মহাকাশে এখন পর্যন্ত এটিই তো সবচেয়ে দূরে মানুষের সক্রিয় হস্তক্ষেপ।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

একনায়কত্ব পরীক্ষার পাস-ফেল

ঘটনা এরই মধ্যে ঘটে গেছে। উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন প্রভাবশালী সামরিক ব্যক্তিত্ব চ্যাং সং থায়েকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেই বসে থাকেন নি, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বিশ্ববাসীর সামনে তার ফুফার চরিত্রও উন্মোচন করেছেন। সে ভাষ্যমতে, মানুষটি ছিলেন কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট। চ্যাং দণ্ডিত হওয়ার কারণ একাধিক- অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, নারীলিপ্সা, নেশাগ্রস্ততা প্রভৃতি। প্রথম দুটি দোষ উত্তর কোরিয়ার অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তির মাঝে আছে বলে শোনা যায়; পরের দুটি নাকি উনের মাঝেও কম নেই। অবশ্য চ্যাং নিজে বলে গেছেন, কুপ্রবৃত্তির বশে মহান নেতাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। যাহোক, চ্যাংয়ের ওমন মৃত্যুতে ঘাবড়ে গেছে কিছু মানবাধিকার সংস্থা; মুষড়ে পড়েছেন অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক। বেশকিছু পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী উত্তর কোরিয়ার এ বালক নেতার মতিগতি না বুঝে জো আছে?

ঘটনাটিকে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, একনায়কত্বের পরীক্ষা হিসেবে; যাতে পাস-ফেলের ওপর নির্ভর করছে রাষ্ট্রক্ষমতায় উনের থাকা না-থাকা। অর্থাৎ বিষয়টি খুবই সিরিয়াস। এক্ষেত্রে নবীন সর্বোচ্চ নেতাকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে শুরু করা যাক। ধরি, চ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ ছিল উনের হাতে। তার মানে পরামর্শদাতা ফুফার চেয়েও ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল তার। এটি একনায়কের পরিণত হওয়াকে ইঙ্গিত করছে। উত্তর কোরিয়ার প্রচলিত ক্ষমতা বলয়ের বাইরে আস্থাভাজনদের নিয়ে নিজস্ব চক্র গড়ে তুলতে চাইছেন উন। ক্ষমতা সংহতকরণের এ কৌশল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসারী রাজনৈতিক দলেও দেখা যায়।

উনের মূর্ত উদ্দেশ্যও আছে। আসলে উত্তর কোরিয়ার ‘সিংহাসনে’ বসার কথা ছিল তার বড় ভাই কিম জং নামের। এক ‘দুর্ঘটনা’য় তিনি ছিটকে পড়েন ক্ষমতার ময়দান থেকে। ভদ্রলোকের এখনকার দৈনন্দিন রুটিন হলো ছোট ভাইয়ের নিন্দা বলে বেড়ানো। তাই ফুফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে উন বড় ভাইকে সতর্কবার্তা দিলেন, ভাই হলেও খাতির করব না কিন্তু- যদি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বপ্নে দেখো। আরেকটি বিষয়, ২০১২ সালের মার্চে কাঁচা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে এক গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়; ক’দিন আগেও গুজব রটে আরেকটির। এ অবস্থায় চ্যাংয়ের মৃত্যু সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকদের জন্য এক বিশেষ বার্তা উনের পক্ষ থেকে।

উন হয়তো পারিবারিক ইতিহাস ঘাঁটছেন ইদানীং। সম্ভবত এখন পড়ছেন দাদা কিম ইল সাংয়ের জীবনী। ১৯৬৮ সালে নর্থ কোরিয়ান পিপলস আর্মির তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ এবং নিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী চো কোয়াংয়ের বিরুদ্ধে দলদ্রোহিতার অভিযোগ তোলেন সাং। তবে উনের মতো মৃত্যুদণ্ড নয় অদৃশ্য করে দেন চো-কে। দাদার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরো জানলে কিম নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন, কী যাদু-মন্ত্র বলে দুই দশক পর চো আবার ফেরত এসেছিলেন উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে। ফুফাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বার্তা গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াতেও। মিলেছে তার প্রত্যুত্তরও। চ্যাংয়ের হত্যাকাণ্ডকে নগ্ন উস্কানি হিসেবেই দেখছেন প্রেসিডেন্ট পার্ক কুন-হে।

কয়েকবার ব্যর্থতা সত্ত্বেও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা থেকে এ পর্যন্ত একেবারে খারাপ নৈপুণ্য দেখায় নি বালক নেতা। তবে তার উচিৎ ছিল বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের (যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া) সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে আঞ্চলিক রাজনীতির বাকি তিন অংশগ্রহণকারী (দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন) দেশের ওপর সাম্প্রতিক ঘটনাবলী কেমন প্রতিক্রিয়া ফেলে সেটি গভীরভাবে চিন্তা করা। আরো কিছু ইতিহাস বই পড়লে তার কাছে পরিষ্কার হবে জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বাবা শিনতারো আবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক ব্যক্তিত্ব পার্ক চুন-হের; যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট পার্ক কুন-হের বাবা। অর্থাৎ বহির্শক্তি চাইলে উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে আরো ঘন করতে পারে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্ককে। এখন পর্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও ছোট ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে বেশ চীন বিরক্ত। বিশেষ তথ্য হলো, চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন, তাদের খ্যাতি রয়েছে বাস্তবাদী কমিউনিস্ট হিসেবে। কিছু ইস্যুতে শি জিনপিংয়ের বাবা শি ঝনশুংয়ের নমনীয়তা দেং জিয়াংপিংকে অধিক সন্তুষ্ট করলেও দলের কারো কারো সন্দেহ ছিল, তিনি প্রতিবিপ্লবী কিনা। শি জিনপিং সে উত্তরাধিকার ধরে রেখে বলেই মনে হয়। ফলে উত্তর কোরিয়ার বাড়াবাড়ি চীন কতক্ষণ এবং কতটা সহ্য করবে সেটি ভেবে রাখা উচিৎ একনায়কত্বের ‘কঠিন’ পরীক্ষা দিতে বসা উনের।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ইন্টারস্টেলার

মহাযাত্রার কাব্য

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

গণিতজ্ঞ স্টিফেন হকিংয়ের পরিচিতি সাধারণ্যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞনী হিসেবে বেশি। কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত তার এক সমীকরণ সর্বকালের সৌন্দর্যমণ্ডিত গাণিতিক সূত্রগুলোর মধ্যে গণ্য। তালিকার বাকি সমীকরণগুলোর আবিষ্কারকদের কেউই জীবিত নেই। ওমন জটিল গাণিতিক যুক্তি যার পেশা ও নেশা, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছায়াছবি দেখাকে বিলাসিতা মনে হওয়ায় অস্বাভাবিক নয় তার কাছে। আবার বয়সও তার জন্য কোনো অনুপ্রেরণা নয়। ঘটনা হলো, সেসব যুক্তি সত্ত্বেও গত কয়েক সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দুটো সিনেমা দেখে ফেলেছেন হকিং; একটা তার আত্মজীবনী নিয়ে জেমস মার্শ পরিচালিত ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’, আরেকটা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইন্টারস্টেলার’।

তর্কবিতর্ক থামছে না, ‘ইন্টারস্টেলার’কে চলচ্চিত্রের কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। কারণটা চিত্রনাট্য রচয়িতারা (দুই ভাই- জোনাথান ও ক্রিস্টোফার নোলান) নন, বরং চিত্রনাট্যের পেছনের মানুষ ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আইনস্টাইন মেডেল পাওয়া পদার্থবিজ্ঞানী কিপ থর্ন। আপেক্ষিকতার ধারণার আলোকে দীপ্ত থর্নের দীর্ঘ সমীকরণের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে ‘ইন্টারস্টেলার’। ফলে ছায়াছবিটিকে সায়েন্স ফিকশন বলা চলে না। ভাগ্য হস্তক্ষেপ না করলে ছবিটি সাই-ফাই হতে পারত অবশ্য। আসল প্রজেক্টটি ছিল হলিউডের ‘বিগ সিক্সে’র অন্যতম প্যারামাউন্ট পিকচারস করপোরেশনের। এটিই স্পিলবার্গের প্রতিষ্ঠান ড্রিমওয়ার্কসের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সারে। ড্রিমওয়ার্কস ২০০৯ সালে প্যারামাউন্ট থেকে দ্য ওয়াল্টডিজনি কোম্পানিতে চলে গেলে ঘটনাক্রমে কাজ পেয়ে যান নোলান। খারাপ হয় নি তাতে। প্রযুক্তির প্রতি স্পিলবার্গের আকর্ষণ হয়তো সায়েন্স ফিকশনে পরিণত করত ছায়াছবিটিকে। এদিকে হলিউডে প্রাযুক্তিক সম্ভাবনা ব্যবহারের দিক থেকে যেসব পরিচালক পিছিয়ে আছেন তাদের মধ্যে পিটার জ্যাকসন ও ক্রিস্টোফার নোলান আলোচিত। একটু সিনিয়র বলে জ্যাকসনকে ছাড় দেন অনেকে; কিন্তু ৪৪ বছর বয়সী নোলান কেন ই-মেইল, সেলফোন ব্যবহার করেন না তা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে ব্যাপক। তবে বোধহয় এ ‘আশীর্বাদে’ই নোলানের হাতের মানবিক স্পর্শ পেয়েছে ‘ইন্টারস্টেলার’। সেজন্য নভোচারী কুপার (ম্যাথিউ ম্যাকনহের চরিত্র) অন্যান্য গল্পের নায়কের মতো প্লটে নিজের বিশিষ্ট অবস্থান ধরে রাখতে পারেন নি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠেছেন দর্শক আবেগের প্রতিনিধি।

ইন্টারস্টেলারের আবহ সঙ্গীত নিয়ে কিছু না বললেও চলবে, কেননা হ্যানস জিমার আছেন। তবে সিনেমাটি দেখার সময় অভিজ্ঞ দর্শক অনুভব করবেন, কিছু ক্ষেত্রে সাউন্ড ইফেক্ট হিসেবে কুশীলবদের সংলাপ ব্যবহারের দুঃসাহস নোলান দেখিয়েছেন সফলভাবে। পূর্বের অভিনয় ইমেজ ভেঙ্গে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য অক্ষত রেখে নতুন চরিত্র রূপ দানের বিষয়ে ‘কুখ্যাতি’ রয়েছে ছবির পরিচালকের। সেক্ষেত্রে রোবট চরিত্রে ‘ইন্টারস্টেলারে’র অসাধারণ সংযোজন টারস। টারস মানে টিএআরএস নয়, নিছক টারস। রোবটটি বিভিন্ন মানবিক গুণাবলীর আনুপাতিক সংমিশ্রণে তৈরি অ্যালগরিদমে পরিচালিত হয়। মজার বিষয়, পঞ্চম মাত্রিক পরিবেশে সে তথ্য আদান-প্রদান করতে না পারলেও সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম। পঞ্চম মাত্রিক স্থান-কালে প্রেমের ভূমিকা রাখলেও যন্ত্রের কেরামতি কার্যত অবরুদ্ধ করেছেন সম্ভবত নোলানই। নতুন নতুন অভিনয় দক্ষতা অর্জনকে মানদণ্ড ধরলে সে বিচার করলে প্রফেসর জন ব্র্যান্ডের চরিত্রে অভিনয়কারী মাইকেল কেইনের চেয়ে লক্ষ্যণীয়ভাবে উন্নতি হয়েছে তার মেয়ে অ্যামেলিয়া তথা অ্যানা হ্যাদাওয়ে। নোলানের প্রতিটি ছবিতে বিশেষ এক রঙের সূক্ষ্ম আধিক্য থাকে। ইন্টারস্টেলার এ নিয়মের মধ্যেই পড়ছে।

সিনেমাটি দীর্ঘ এবং ক্যামেরা মুভমেন্ট হিন্দি সিরিয়াল, এমনকি হলিউডে প্রচলিত সাই-ফাই ছবির মতো অস্থির নয়। তার একটি কারণ, নিজ পরিচালিত ‘ট্রানসেনডেনসে’র (জনি ডেপ অভিনীত) নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ‘ইন্টারস্টেলারে’ সময় দিতে পারেন নি নোলানের অন্যান্য ফিল্মের সিনেমাটোগ্রাফার ওয়াল্টার পিফিস্টার। তার বদলে কাজ করেছেন ‘টিঙ্কার টেইলর সোলজার স্পাই’ খ্যাত ডাচ-সুইডিশ ভ্যান হয়েতিমা। দ্বিতীয় কারণটি হলো, পরিচালকের পয়েন্ট অব ভিউ। বাংলাদেশের একশ্রেণীর চলচ্চিত্রকারের আফসোস- একাধিক ক্যামেরা ব্যবহারের জন্যই হলিউডের মুভি এত আকর্ষণীয়! দেয়ার মতো তথ্য হলো, ভিজুয়াল ইফেক্টের প্রয়োজনে একেবারে বাধ্য না হলে একাধিক ক্যামেরা চালান না নোলান। চলচ্চিত্র নির্মাণের এসব বুদ্ধিভিত্তিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তার সঙ্গে পরিবেশনগত ত্রুটিও অপসারণ করা বাঞ্ছনীয়। ‘ইন্টারস্টেলার’ ছবিটি ঢাকার এক ‘নামী-দামী’ প্রেক্ষাগৃহ এসেছে। অথচ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ক্ষীণদৃষ্টিই হোক বা দুর্বৃত্তপরায়ণ মানসিকতার জন্যই হোক- প্রদর্শন সময় ও টিকেটের দাম বিচারে মধ্যবিত্তের পক্ষে হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখা কঠিন। অথচ উন্নতি করতে চাইলে অন্যান্য ব্যবসার মতোই উৎপাদন ও বিপণনের দিকে সমান নজর রাখতে হবে চলচ্চিত্রকে।

লেখকঃ সাংবাদিক

রাশিয়া

পঞ্চম স্তম্ভে অদৃশ্য সাম্রাজ্যের বিস্তার

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ঘটনায় প্রতিক্রিয়া মানুষের ধাত ও মনোরাজ্য অনুধাবনের সুযোগ দেয়। সেদিক থেকে এটি বেশ প্রণিধানযোগ্য। ১৯৮৯ সালে কেজিবির শাখা ছিল পূর্ব জার্মানির ডেসডেনে। বার্লিন দেয়ালের পতনের পর একদল অবহিত লোক সেখানে হামলা চালায়। সেদিন বারবার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ চেয়েও সাড়া পান নি কেজিবি সদস্যরা। সম্ভবত ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দেয়া হত তাদের জীবন। সৌভাগ্যবশত তাদের মধ্যে অন্তত একজন ওই বিপদেও ঘাবড়ান নি। তিনি দ্রুত সব নথি পুড়িয়ে গেলেন এবং কৌশলে সহকর্মীদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন অফিস থেকে। ব্যক্তিটি রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন।

সনদ দেখানোর প্রয়োজন নেই। ঠান্ডা মাথায় কৌশল প্রণয়নের ক্ষমতা না থাকলে লেনিনগ্রাদের এক দরিদ্র পরিবারের সদস্য পুতিনের পক্ষে রুশ সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ সম্ভব হত না। উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে ৪৩ বছর বয়সে হয়তো যাত্রা করতেন না মস্কোর দিকেও। কথা হলো, এ বলিষ্ঠ বাস্তববাদীর যুক্তি যেন মেলে না তার গত দু’বছরের কর্মকাণ্ডে। গণভোটের মধ্য দিয়ে হলেও রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ সুনজরে দেখেন নি অনেক প্রতিবেশীই। উপরন্তু পরিস্থিতি ল্যাজেগোবরে হয়ে পড়ে ইউক্রেনের রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে নিক্ষিপ্ত মিসাইলে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এক যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস হলে। তার এক পর্যায়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে শায়েস্তা করতে। সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্যহীন, এলোমেলো পদক্ষেপ দেখে কেউ কেউ ‘উন্মাদ’ বলে অভিহিত করছেন পুতিনকে। তাদের তত্ত্ব হলো, স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার বেদনা তিনি ভোলেন নি এবং বর্তমানে ক্ষণস্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কাঁথায় শুয়ে প্রাচীন জারদের মতো রুশ সাম্রাজ্য প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নে মশগুল। যোগ্যতা ও উচ্চাভিলাষের সঙ্গে অতৃপ্তির অবস্থান মনে বিকৃতি সৃষ্টি করতে পারে বৈকি। তবু পুতিনের মতো একজন বাস্তববাদী মানুষের কাছে বিষয়টা কি খাপছাড়া মনে হয় না? সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় চিন্তা ধারায় অগ্রসর হওয়া উত্তম। পুতিনের আপাত উদ্দেশ্যহীন কর্মকাণ্ডগুলো কুশলী ধোঁকা নয়তো? কেজিবি স্কুলে তিনি নিশ্চয়ই শিখেছেন, শত্রুকে বিশ্বাস করাতে হবে- তোমার দুর্বলতা আসলে তোমার শক্তি।

এ পথে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়। কেননা এতে রয়েছে পঞ্চম স্তম্ভের মধ্য দিয়ে পুতিনের অদৃশ্য সাম্রাজ্য বিস্তারের ছাপ। লক্ষ্যণীয়, (অনিবার্য কারণ না ঘটলে) উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন আসছে ৯ মে রেড স্কয়ার থাকবেন বার্ষিক বিজয় দিবসে। এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী রাশিয়া। জ্বালানি তেল ও অস্ত্র লেনদেনে মস্কো-কারাকাস সম্পর্ক নাকি এখনো অটুট। রাশিয়া প্রায় বছর পাঁচেক আগে ইরানের সঙ্গে এয়ার ডিফেন্স মিসাইল বিক্রি চুক্তি রদ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আপত্তিতে। ক’দিন আগে সেটি আবার টেবিলে উঠেছে। কিছুদিন আগে পুতিনের মিশর সফরও ইঙ্গিত দেয় তার অদৃশ্য সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের। ওই সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি কর্তৃক কালাশনিকভ সহকারে সমাদৃত হন তিনি।

অবশ্য অভ্যন্তরে রাশিয়ার পঞ্চম স্তম্ভ নিয়েই ইউরোপ অধিক চিন্তিত বলে প্রতীয়মান। অভিযোগ, অতি-দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানে হাত রয়েছে ক্রেমলিনের। সেজন্যই হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওবান উদার গণতন্ত্র ত্যাগে ইচ্ছুক। একই কারণে গ্রীসের সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর সিরজা পার্টির আলেক্সি সিপ্রাসের সঙ্গে সাক্ষাত পাওয়া প্রথম কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম রুশ রাষ্ট্রদূত। প্রশ্ন উঠতে পারে, গত শরতে রাশিয়ায় গেলেন কেন ফ্রেঞ্চ ফ্রন্ট ন্যাশনালের নেতা মেরিন লা পেইন? সেখানকার কে-ইবা তাকে দিল কয়েক মিলিয়ন ইউরো ঋণ? ভেতরে ভেতরে অনেকে গলদঘর্ম। মেরিন বেশ এগিয়ে জনমত জরিপে। আগামীতে তিনিই যদি ফরাসি সরকারের প্রধান হন?

ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো নিয়ে কমনওয়েলথের মতো কিছু একটা গড়ার কথা বহুদিন ধরে বলছেন পুতিন। হতে পারে, ইউরোপের চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে সুবর্ণ সুযোগ মনে হয়েছে তার। ফলে ইউক্রেন অঞ্চলে এক ধরনের গৃহবিবাদ জিইয়ে রেখে প্রতিরক্ষা সংস্থা নেটোকে দুর্বল রাখতে চাইছেন তিনি। তার মূল লক্ষ্য অন্যত্র। তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মাথায় রয়েছে নিশ্চয়ই- জোসেফ স্টালিন শাসন করেছেন তিন দশক; লিওনিদ ব্রেজনেভ দুই দশকের মতো। ভ্লাদিমির পুতিনের বয়স এখনো ‘তেমন বেশি’ নয়; স্বাস্থ্যও সুঠাম। এদিকে রুশবাসী তার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত বলেও মনে হয় না। ফলে আসন্ন বছরগুলোয় পুতিন গৃহীত কৌশলের বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো কেমন ব্যবস্থা নেয় তা দেখার অপেক্ষায় নিঃসন্দেহে থাকবেন কেউ কেউ।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

মধ্যপ্রাচ্য

সমঝোতার নতুন সমীকরণ

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

মধ্যপন্থার জয় বিরল কিন্তু সৌভাগ্যজনক ঘটনা। আবার এতে উল্লাস করা কঠিন। ফলে আগে থেকে কোনো পক্ষে বসে থাকা অনেকের কাছে সেটি মনে হয় সমাধানের অযোগ্য ধাঁধাঁ। সম্প্রতি পরমাণু শক্তির ব্যবহার বিষয়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোঝাপড়ার গুরুত্ব হয়তো সেজন্যই তেমনভাবে প্রতিভাত ও আলোচিত নয় এখনো। বরং এরই মধ্যে প্রচেষ্টাটি নিন্দা কুড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের উগ্রপন্থীদের। তাই সাধারণ ইরানীদের প্রতিক্রিয়া স্বস্তির; অতিরক্ষণশীলদের কাছে- ইরানের গরু মেরে আমেরিকার জুতো দান! এক্ষেত্রে কট্টরপন্থী ইসরায়েলীদের আচরণেও অমিল ঠেকবে সামান্যই। আর সৌদি আরবের ডানপন্থীদের প্রতিক্রিয়া? সেখানকার এক উজির ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মত দিয়েছেন, ইরান অনুমতি পেল, এবার রিয়াদ পারমাণবিক চুল্লী বসাতে দেরি করে কেন?

সেক্ষেত্রে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করাই মঙ্গলজনক। যেহেতু চূড়ান্ত চুক্তি হয় নি; এর আইনি রূপরেখা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো গেছে মাত্র। পরবর্তীতে থাকল এটি বাস্তবায়নের প্রশ্ন। তা সত্ত্বেও কান খাড়া করা দরকার মূলত দুটি কারণে; প্রথমত. গ্রহণযোগ্য মীমাংসার অভাবে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে বছরের পর বছর এবং দ্বিতীয়ত. সমঝোতার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অলঙ্ঘনীয় শর্ত দেয়া হয়- সব পয়েন্টে সম্মত না হলে ইরান কোনো পয়েন্টেই সম্মত নয় বলে ধরা হবে! এর বাইরে উস্কানিদাতার অভাব কোনোকালেই ছিল না। কথাটি বারাক ওমাবার বেলায় রিপাবলিকান সহকর্মীদের নিয়ে যেমন সত্য, হাসান রুহানির কট্টর প্রতিপক্ষের বেলায়ও তা খাটে।

ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে পারস্পরিক আস্থার ঘাটতিই অধিক লক্ষ্যণীয়। সেজন্য মার্কিন নাগরিকদের প্রেসিডেন্ট ওবামাকে আশ্বস্ত করতে হয়েছে, চুক্তিটির বাস্তবায়ন ইরান কর্তৃক পরমাণু অস্ত্র তৈরির সব পথ বন্ধ করে দেবে। সমঝোতার পর পরই তিনি পুরনো মিত্র সৌদি বাদশাহকে ফোন দিয়েছিলেন কুয়াশা কাটাতে (অবশ্য ‘তাড়াহুড়ো’ করে বিস্তারিত জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি ক’দিন আগে ওয়াশিংটনে ওবামাবিরোধী ইন্তিফাদার নায়ক বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুকে)। তবু সংশয় রয়ে গেছে অনেকের, যদি মাঝপথে নৌকা দোলানো শুরু করে ইরানীরা? নিতান্ত অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না একে। দেখার বিষয়, ইরানে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির সূত্রপাত ১৯৫০’র দশকে; যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। আর এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের মনোমালিন্যের সূচনা ১৯৭৯ সালে; বিপ্লবের পর থেকে। মজার কথা, পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গোপন গবেষণার কথা জানার পর তৎকালীন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা মরহুম আয়াতুল্লাহ খোমেনীর প্রাথমিক ফতোয়া ছিল, অনৈতিক বিধায় শরীয়তের দৃষ্টিতে পরমাণু অস্ত্র হারাম। ওই অবস্থান বদলাতে সময় লাগে নি খুব। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতিও ঘটে তুলনামূলক দ্রুত গতিতে। তাই পদক্ষেপ নিতে ইরানের দিকেই মানুষ তাকিয়ে থাকবে বেশি। সেজন্য রুহানি সরকারের উচিৎ সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার কাছ থেকে প্রতিপাদন সম্পাদন এবং প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনা। শেষোক্তটি নিষেধাজ্ঞার প্রতিশ্রুত অপসারণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে সহায়ক হবে বলে ধারণা। একই সঙ্গে ওবামা প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে যেন চুক্তি বাস্তবায়নে বাগড়া না দিতে পারে কেউ।

সাম্প্রতিক সমঝোতাটি যুক্তরাষ্ট্রের এক উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অর্জন। ঘটনাটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি পরিবর্তনেরও ইঙ্গিতবাহী। লক্ষ্যণীয়, শুধু জ্বালানি তেল দিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল রাখার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা কঠিন। উল্টো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত কয়েক বছরে উপসাগরীয় তেলের ওপর নির্ভরতা ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছে আমেরিকানরা। অতিরিক্ত স্বনির্ভরতাটুকু দেশটির পররাষ্ট্র নীতিতেও প্রভাব ফেলেছে নিশ্চয়ই। না ফেললে, ইয়েমেনে ‘কষ্ট স্বীকার’ করতে হতো না সৌদি আরবকে; বাড়তি ‘আশকারা’ও হয়তো পেত ইসরায়েল। এটি সৌদি শাসকরা ভেবে দেখেছেন নিশ্চয়ই। নেতানিয়াহু’রও টনক না নড়ে পারে না। তিনি ভুলবেন কীভাবে, তার ‘আলোচিত’ ভাষণ নিয়ে খোদ ইসরায়েলে প্রতিবাদ হয়েছে; প্রায় দশ হাজার সাধারণ নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে তেল আবিবের রাস্তায় নেমেছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক সাবেক প্রধান। ইরান নিয়ে ইসরায়েলবাসী নিঃশঙ্ক বিষয়টি তা নয়; বরং ইরান প্রশ্নে নেতানিয়াহুর কট্টর অবস্থান সমর্থন করতে পারেন নি তারা। মধ্যপ্রাচ্যের এমন পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে সমঝোতার নতুন সমীকরণ কী প্রভাব ফেলে আগামীতে তার জবাবই খুঁজতে হবে ইরানের আচরণ এবং বিশ্বশক্তির অবস্থানে।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

আরবে বসন্তের বাতাস

জলবায়ু সব সময়ই চরম আরবে। দিনের বেলার প্রচন্ড গরম। বেশ ঠান্ডা রাতে। চরমভাবাপন্ন আবহওয়ার কারণে এ অঞ্চলটিতে ঋতুর সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে তিনটি- গ্রীষ্ম, শরৎ বা হেমন্ত এবং বসন্ত। প্রতি ঋতুর স্থায়িত্ব গড়ে চার মাস। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, মানসিকতা, আরও বড় করে দেখলে সমাজের ওপর ঋতুর প্রভাব রয়েছে যথেষ্ঠ। তবে ঋতু পরিবর্তন বা এর স্থায়িত্বের সঙ্গে খুব বেশি মেলানো যায় না সমাজ পরিবর্তনকে। সাম্প্রতিক আরব বসন্ত অন্তত তা-ই বলছেন।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে জেসমিন বিপ্লব শুরু হলো তিউনিসিয়ায়। বসন্ত শুরু হলো আরবে। আবহাওয়া অনুকূল না হওয়ায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবেদিন এবন আলি। ঋতু পরিবর্তনের এ বিষয়টি ধরতে পারলেন না মিশর শাসক হোসনী মোবারক। অবশ্য হতে পারে তিনি ভেবেছিলেন, বসন্ত আর কয়দিন থাকবে? কয়েকটা মাস ধৈর্য্য ধরি। তাহরির স্কয়ারে উৎপত্তি লাভ করা বসন্ত সওয়া গেলো না ১৮ দিনের বেশি। ফেব্রুয়ারীর ১১ তারিখ ক্ষমতা ছাড়তেই হলো তাকে। এরই মধ্যে বসন্তের ছোঁয়া লাগল লিবিয়াতে। দেশটি অবশ্যই আরব। তবে আফ্রিকান প্রভাবের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যায় না সেখানে। কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফী আফ্রিকান স্পিরিট নিয়ে ঠেকাতে চাইলেন আরব বসন্ত। বিক্ষোভের সুযোগ না দিয়ে জনগণকে সোজা পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধের ময়দানে। গ্রীষ্মকাল আর দেখা হলো না গাদ্দাফীর। ২৩’শে আগষ্ট প্রতিপক্ষ গোত্র ও সাধারণ মানুষের সহায়তায় গঠিত ও পশ্চিমা মদদপুষ্ট ন্যাশনাল ট্রানজিশনারি কাউন্সিলের (এনটিসি) বাহিনী দখল করে নিলো বাবআলআজিজিয়া। আরব বসন্ত গাদ্দাফীর প্রাণ কেড়ে নিলো গত ২০ অক্টোবর।

আরবে একনায়কতান্ত্রিক শাসন নতুন নয়। কিন্তু অভূতপূর্ব এ বসন্ত শঙ্কিত করে তুলল অনেককে। কেউ কেউ দুঃখজনক পরিণতি বরণের চেয়ে আগে ভাগে সরে যাওয়া উত্তম মনে করলেন। এদের মধ্যে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশিরও রয়েছেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ২০১৫ সালে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। ইরাকে নুর আল মালিকির বিরুদ্ধে কম-বেশি প্রতিবাদের খবর পাওয়া যাচ্ছিল কয়েক মাস ধরে। আরব বসন্ত দেখে তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেলো। তিনি বুঝতে পারলেন, ২০১৪ সালের পর কঠিন হবে ইরাক শাসন করা। বেশি আতংকে ছিলেন সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ। জানুয়ারীতে ছোট-খাট বিক্ষোভ হলো রিয়াদে। আন্দোলন যাতে বেগ না পায়, সে জন্য বাদশাহ কয়েকটি খাতে ভর্তুকির ঘোষণা দিলেন। কিছু শর্ত গোপন রেখেও বললেন সৌদি নারীরা ২০১৪ সালের পৌর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কথাও শোনা গেলো তার মুখে।

বসন্ত হটিয়ে দিলো ১৯ বছরের জরুরী অবস্থা, আলজেরিয়া থেকে। লেবাননে বেশি কিছু না হলেও বসন্তে সেখানকার শ্রমিকের বেতন বাড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে বসন্তের প্রভাব ঠেকাতে আংশিকভাবে সফল হয়েছে জর্ডান, বাহরাইন, কুয়েত ও মরোক্কো। তবে ঠেকাতে গিয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহ। এ ক্ষেত্রে বসন্তের আগমন ব্যহত করতে নৃশংস উপায় বেছে নিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। ধরপাকড়, হয়রান করেও কিছু হচ্ছে দেখে গণহারে নরহত্যার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। দেশটি থেকে প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে কারো না কারো নিহত হওয়ার খবর। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বসন্তের ঝড় ঠেকাতে পারবেন কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বৈকি। এদিকে প্রায় ১০ মাস পর মিশরে নতুন করে দেখা দিয়েছে বসন্ত। জনগণ আবার তাহরির স্কয়ারে চলে এসেছে গণতন্ত্রের দাবিতে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সমঝোতা হয়েছে; আগামী জুনে নির্বাচন হবে দেশটিতে।

জাতীয়তাবাদের কথা শুনিয়ে অনেক শাসকই দীর্ঘদিন শাসন করেছেন বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র। তবে আরব ঐক্যের সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের দিকটি ভাবতে পারেন নি এরা। তাদের হয়তো ধারণাও ছিল না, উইকিলিকসের মত একটি প্রতিষ্ঠান একের পর এক ফাঁস করতে থাকবে তাদের অপকর্ম; ফেইসবুকের মতো সাইটগুলো শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরিণত হবে ও এতে আরবে বইবে বসন্তের বাতাস; আর তাতেই কুপোকাত হয়ে যাবেন তারা।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

এ পথ থেকে ফিরবো না!

বন্দে আলি মিয়ার একটা গল্প পড়েছিলাম ছেলেবেলায়। অনেকেই পড়ে থাকবেন তা। নদীবিধৌত এক এলাকায় কাহিনী। নতুন চর জাগলেই তা দখলের জন্য আদা-জল খেয়ে লাগেন দুই জমিদার। কার্যসিদ্ধির প্রথম উপায় মামলা। এটিতে কাজ না হলে স্বীয় শক্তমত্তা প্রদর্শনপূর্বক চর দখল। তবে আকস্মিকভাবে নয়, পরস্পরকে জানান দিয়ে; নিজ নিজ গ্রামে ঘোষণা করে- অমুক তারিখ তমুক সময় চর দখল দেয়া হবে। এ উপলক্ষ্যে লাঠিয়াল হিসেবে খোঁজ করা হয় বলবান পুরুষদের। তাদের খাওয়ানো হয় ভালো মতো। উৎসাহিত করতে পরিবারগুলোকে দেয়া হয় কিছু টাকা-পয়সাও। টাকায় কাজ হয়; লাঠিয়ালরা নিরুদ্বেগে জান বাজি রাখেন জমিদারের স্বার্থ উদ্ধারে। একবার এক গ্রামের জমিদারের লাঠিয়ালরা মেরে ফেলল অপর পক্ষের লোককে। মামলায় লাশটি যেন বেওয়ারিশ হিসেবে থানায় লিপিবদ্ধ হয়, সেজন্য তখনকার দিনে এ ধরনের সহিংসতায় লাশের মাথা কেটে ফেলার রীতি ছিল। তাতে দুর্বল হয়ে পড়তো মামলাটি। দুর্ভাগ্যবশত প্রথমোক্ত জমিদারের লাঠিয়ালরা সেটি করতে ব্যর্থ হন। এতে স্বভাবতই মামলার ফল নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন জমিদার। এমন অবস্থায় নায়েব পরামর্শ দেন, নিজ পক্ষের একটা লাশ দেখাতে পারলে, মামলায় শক্তিশালী হবে তাদের অবস্থানও। জমিদার উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, খাসা বুদ্ধি। প্রশ্ন হলো, কাকে লাশ বানানো হবে? গ্রামটির সীমানায় থাকতেন নিঃসন্তান, সম্বলহীন, রোগগ্রস্ত ও বৃদ্ধ দম্পতি। জমিদারের বিবেচনায় এ কাজে সেই উপযুক্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক রাতে জমিদারের লাঠিয়ালরা তাকে ডেকে নিয়ে যান চরে। তাকে স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রস্তাব দেন জমিদারটি- তোমার আয়ু শেষ, টাকা-পয়সা নেই, হাঁপানিতে কষ্ট করছ; গ্রামের উপকার হবে, ১০০ টাকাও পাবে। মরতে অসুবিধা কী? বৃদ্ধের সোজাসাপ্টা জবাব ছিল, জমিদারদের রাজনীতি বুঝতে চান না, তবে কষ্ট হলেও বেশীদিন বাঁচতে চান তিনি।

গল্পটি মনে পড়লো, রোববার ঢাকা ও সিলেটে দুই ব্যক্তির নিহত হওয়ার খবর দেখে। রাজধানীর মতিঝিলে হাতবোমা বিস্ফোরণে মারা গেছেন এক যুবক। এরই মধ্যে ঘটনাটি নিয়ে সরকার-বিরোধী উভয় পক্ষ থেকেই বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া হয়েছে। অবশ্য তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে পরিবার। তবে দলগুলো গতানুগতিকভাবে লাশ নিয়ে খেলা শুরু করেছে। কেউ নিজের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে; কয়েকজন বিপদের আশংকায় হয়তো চাইছে আরেকজনের দিকে ঠেলে দিতে। এমন টানাহেঁচড়ায় শোক প্রকাশও কঠিন। এ দিকে সিলেটে বাসে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। মাঝপথে এতে গান পাউডারসমেত আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েক তরুণ। ভয় পেয়ে তাড়াহুড়া করে নামছিলেন যাত্রীরা, আহত হলেও মৃত্যু যেন না হয়- এ আশায়। অন্যদের সঙ্গে হয়তো নামতে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধও। তবে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারেন নি। ততক্ষণে দাউ দাউ করে জ্বলছে বাস। আগুন ধরে গেছে শরীরে। পরনে শীতের কাপড় থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতই। জানালা দিয়েও একবার নামার চেষ্টা করেছিলেন বোধকরি। তবে পারেন নি। বিভৎসভাবে বাসের ভেতরেই পুড়ে কয়লা হয়ে যান বৃদ্ধটি। মৃতের পক্ষে জীবিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা প্রায় অসম্ভব। নইলে দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে নিজের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরতে পারতেন তিনি।

বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিরাট পরিবর্তন এসেছে সাম্প্রতিককালে। মধ্যপ্রাচ্যের রুক্ষগুলোয়ও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবীতে রাজপথে নামছে মানুষ। এককালে ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপে’র উদাহরণ টানা হতো আফ্রিকা থেকে। স্বৈরতন্ত্র থেকে সেখানকার অনেক দেশই এখন পা বাড়াচ্ছে আলোচনা ও অহিংসার পথে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, এখানকার রাজনৈতিক দলের ইস্যুগুলো এতই বড় ও মহৎ এবং সমাধানের পথ এতটাই সংকীর্ণ যে, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ তথা সহিংস পদ্ধতি ভিন্ন উপায় নেই। অবশ্য এটা দেশের একপেশে চিত্র। এ অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাংলাদেশ ভাল করছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে। আগামী দশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি আমরা। শক্তিশালী ও বড় উদ্যোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে এখানে। তৈরী হচ্ছে বিশ্বমানের জনসম্পদ। ব্যাপকভাবে বেড়েছে রফতানি আয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা দেশের ইমেজের ওপর ব্যবসার অনেক বিষয় নির্ভর করে। প্রশ্ন জাগে, বিদেশে ব্যবসায়ীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে, তারা কী জবাব দেন? আন্দাজ করা যায় উত্তরের ধরন, অসংস্কৃত আত্মীয়কে বন্ধুদের সঙ্গে মানুষ যেভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় অনেকটা তেমনই। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতেও তো এমন সাংঘর্ষিক রাজনীতি বন্ধ করা জরুরি। এরপরও যদি কেউ ভাবেন, মানুষের সামনে দলীয় আদর্শ উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরা দরকার, গতবার মেক্সিকোতে জলবায়ু সম্মেলনে যা হয়েছিল সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেন। সম্মেলনটিতে জলবায়ু সংক্রান্ত একটি কার্যকর চুক্তির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে আগুনে আত্মাহুতি দেন দক্ষিণ কোরিয়ার এক ব্যক্তি।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

সময়ের ব্যবহার ও এর ব্যবস্থাপনা

সময় প্রসঙ্গে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কথা আসেই। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শব্দটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন তিনি। অনেকের ধারণা রয়েছে, যে ব্যক্তি এতটা বিশ্লেষণাত্মকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, তিনি নিশ্চয় সারা জীবনই সময়ের সদ্ব্যবহার করেছেন? মজার বিষয় হলো, খেয়ালী এ মানুষটিকে তার ঘনিষ্ঠজনেরা বরাবরই উল্লেখ করে এসেছেন সময়ের ব্যাপারে উদাসীন হিসেবে। তবে তার আক্ষেপ ছিল, জীবনকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলেন না বলে। এ জন্য সময়ের অব্যবস্থাপনা ও খ্যাতিকেই দায়ী করতেন তিনি। ক্যারিয়ারে সফলতা লাভের পরও অনেকের মাঝেই দেখা যায় এমন আক্ষেপ। যদি সত্যি টাইম মেশিন তৈরি হতো, এরা কী করতেন? সম্ভবত মধুর ও সফলতার স্মৃতিতেই যেতে চাইতেন তারা। আবার যারা জীবনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না, তাদেরও আক্ষেপ রয়েছে- জীবনটা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলাম না বলে। কী হবে যদি তারা কোনো উপায়ে টাইম মেশিনে চড়ায় সুযোগ পেতেন? হয়তো জীবনের যেসব সিদ্ধান্তকে তারা ভুল বলে মনে করেন, সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা চালাতেন। আর চেষ্টা করতেন যাতে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়।

সময় যেন বিফলে না যায় সে জন্য অনেকেই দৈনন্দিন ডায়েরীতে লিখে রাখেন, আজ সারাদিন কী করবেন তিনি। যথাযথভাবে সময় ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে অনেক ব্যক্তি, আগামীকাল কী করবেন, গতকাল কী করেছেন- এসব দিকেও রাখেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বিবেচকের কাছে সময় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; ব্যস্ত মানুষের কাছে দুষ্প্রাপ্য সম্পদ। কোন কাজে কাজে কতটা সময় লাগছে, এটি জানা তাই মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার জনগণ কীভাবে তাদের সময়ের ব্যবহার করে থাকে, সেটিও রাষ্ট্রের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এটি জানতে অনেক রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক সংস্থা তত্ত্বাবধানে সময় ব্যবহার জরিপ হয়ে আসছে বিভিন্ন দেশে। মূলত জনগণকে দিকনির্দেশনা জোগানো ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতেই চালানো হয় এসব। জরিপের ভিত্তিতে দেয়া ওসব নির্দেশ্নার সব ফলই যে ইতিবাচক, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে একবার সময় ব্যবহার জরিপে দেখা গেলো সেখানকার পুরুষরা দিনে ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট ব্যয় করছেন টিভি দেখায়। পরে টিভি দেখায় নিরুৎসাহিত করতে, ইণ্টারনেটের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানো হল। এতে দেখা গেলো, টিভি ছেড়ে মানুষজন দৈনিক সাড়ে ৫ ঘণ্টা ব্যয় করছেন ইন্টারনেটে। অবশ্য সব ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে তা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বিশেষত অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশ উপকারী এ ধরনের জরিপ।

সম্প্রতি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সময় ব্যবহার জরিপ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ব্যবস্থাপনায়। এ লক্ষ্যে ৫ দিনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে তারা। এতে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ কীভাবে সময়কে ব্যবহার করে তার প্রকৃত চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করা হবে। এ থেকে নীতিনির্ধারণের দিকনির্দেশনাও মিলবে। ভালো হতো যদি এতে উল্লেখ থাকত- রাজধানীবাসী দৈনিক তাদের কতটা সময় পার করেন যানজটে; শিক্ষার্থীরা কতটা সময় ব্যয় করেন পড়াশুনা; জনকল্যাণে কতটা সময় ব্যয় করেন রাজনীতিকরা ও কতটা সময়ে দেন নিজেকে প্রভৃতি। আমাদের এখানে জরিপটি হচ্ছে বেশ ছোট পরিসরে, এ থেকে এতো তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আগামীতে আরও বড় আকারে জরিপটি করা হলে, এসব তথ্য তাতে মিললেও মিলতে পারে।

নিজেদের ভুল ত্রুটি চিহ্নিত করে তা শুধরানোর জন্যও সময় ব্যবহার জরিপটি কাজে দেবে। জীবনে পিছু ফেরার সুযোগ নেই। তাই সময়কেও আনা দরকার যথাযথ ব্যবস্থাপনায়। একে মানুষের স্বাধীনসত্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ বলে মনে হতে পারে অনেকের। দার্শনিক নীটশে অবশ্য মনে করতেন, মানুষের যেভাবেই সময়কে ব্যবহার করুক তা মূল্যবান; তবে কথা হলো, সময়ের অপব্যবহার ব্যক্তিসত্তায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। ফলে জীবনে স্থিতিশীলতা আনতে সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। তাছাড়া যত বেশি সুষ্ঠুভাবে সময় ব্যবহার করা যাবে, জীবনকে ততটাই বড় মনে হবে- আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ওয়েবে সামন্ত যুগের ষড়যন্ত্র

প্রথম এলিজাবেথের পর ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন প্রথম জেমস। তিনি ছিলেন প্রটেসট্যান্টবাদের সমর্থক। কুসংস্কারে অগাধ আস্থা ছিল তার। তিনি বিশ্বাস করতেন, এ পৃথিবীতে বাস করছে অসংখ্য ভূত-ডাইনীরূপী মানুষ। তার আরেকটি প্রিয় বিষয় ছিল ষড়যন্ত্র তত্ত্বে। প্রথম জেমস ছিলেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। দুর্বল এ শাসক সন্দেহ করতেন, স্কটল্যান্ড তার বিরুদ্ধে ক্যু করে বসতে পারে। জেমসের সময় লন্ডনে মহামারী প্লেগ দেখা দেয় একবার। এক পরামর্শক তাকে বলেন- থিয়েটার থেকে ছড়াচ্ছে এসব। সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনের সব থিয়েটার বন্ধের হুকুম দেন জেমস। গ্লোব থিয়েটারের মালিক নাট্যকার শেকসপীয়ার তখনো বেঁচে। এলিজাবেথের সময় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেত গ্লোব। জেমসের সময় সেটি তো বন্ধ হয়েছিলই, তার ওপর নাটক প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা। জেমসকে পটানোর পরিকল্পনা নিলেন শেকসপীয়ার। লিখলেন- ম্যাকবেথ। এতে ভবিষ্যত বলতে পারে এমন ডাইনী আছে; আছে স্কটল্যান্ডের সেনাপতিদের ষড়যন্ত্রও। নাটকটি মঞ্চস্থ হলো রাজদরবারে। সেটি দেখে বিমোহিত ইংল্যান্ডের রাজা। তিনি সব থিয়েটার খোলার নির্দেশ দিলেন দ্রুত।

নিছক সন্দেহ থেকে নয়, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করার অন্য কারণও ছিল জেমসের। ১৬০৫ সালে তার বিরুদ্ধে করা হয় বিখ্যাত গান পাউডার প্লট। এটির পরিকল্পনাকারী ছিলেন গুইডো ফকস ও রবার্ট কাটসবি (প্রাচীন ও অভিজাত পরিবারের সন্তান তিনি। তার প্রায় সারা জীবনই কেটেছে বিভিন্ন ব্যর্থ বিপ্লবে অংশ নিয়ে ও ফেরারি অবস্থায়)। তারা চেয়েছিলেন, প্রটেস্ট্যান্ট রাজাকে সরিয়ে ক্যাথলিক কাউকে বসানো। কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থকও ছিল তাদের। ফকস ও কাটসবি বস্তা বস্তা গান পাউডার রেখেছিলেন হাউজ অব লর্ডসের বেজমেন্টে। মতলব ছিল, অধিবেশন চলাকালে এতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে; মারা যাবেন রাজাসহ প্রটেস্ট্যান্ট নেতারা। অজ্ঞাতনামা এক চিঠিতে প্রকাশ হয়ে পড়ে ষড়যন্ত্রটি। বারুদে আগুন ধরানোর অপেক্ষায় থাকা ফকস গ্রেফতার হন। পালিয়ে বাঁচেন কাটসবি। আদালতের রায়ে শিরোচ্ছেদ হয় ফকসের। রাজা জেমসের নির্দেশে মস্তকটি ঝোলানো হয় ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির প্রধান ফিটকে। ফকসের গুণমুগ্ধ চিত্রশিল্পীরা এঁকে রাখেন শুধু তার ঝুলন্ত মাথাটি। পরবর্তীতে এসব চিত্রের অনুকরণে তৈরি হয় মুখোশ। ইন্টারনেটে বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে বর্তমানে এটি ব্যবহার করছে হ্যাকার দল- অ্যানোনিমাস।

এরই মধ্যে ইয়াহু, বিং, ফেইসবুক, নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টেমেন্টের সার্ভার হ্যাক করেছে তারা। ওয়েব ডিকশনারিতে তারা যুক্ত করেছে নতুন শব্দ, হ্যাকটিভিজম। মাঝখানে এফবিআই ও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোপন ফোনকল হ্যাক করে তা প্রকাশও করে দলটি। এতে অনেকে ভাবছেন, উইকিলিকসের ভালো উত্তরসূরী হতে পারবে অ্যানোনিমাসের হ্যাকাররা। অবশ্য এটি হল্প করে বলা যায় না। উইকিলিকসের শ্লোগান ছিল ‘উই ওপেন গভর্নমেন্ট’। ওদিকে ‘ডু অ্যাজ ইওর উইশ’ হলো অ্যানোনিমাসের বচন। তাছাড়া সোপা-পিপা আইনের বিরুদ্ধে মুখোশ পরে তাদের প্রতিবাদ করতে দেখা গেলেও তাদের মূল লক্ষ্য সম্ভত ফেইসবুককে চাপে রাখা। অন্তত তাদের হ্যাকিংয়ের ধরন দেখে তাই মনে হয়।

ধারণা করা হয়, অ্যানোনিমাস আসলে একজন হ্যাকার জেনারেলের অধীনে কয়েকশ’ অভিজ্ঞ হ্যাকারের দল; যারা কাজ করে যৌথভাবে। এতে তারা যখন কোনো সাইট বা সার্ভারে অ্যাট্যাক করে যে, তখন কে মূল হোতা তা চিহ্নিত করার আগেই পদচিহ্ন মিলিয়ে যায় তাদের। তবে এ হ্যাকার দলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এবার যৌথ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ও ফেইসবুকের সমন্বয়ে। আবার তাদের ধরতে সহায়তা করছে শুনে ফেইসবুকের বিরুদ্ধে অভিযানে নামার ঘোষণা দিয়েছে অ্যানোনিমাস। তারা এর নাম দিয়েছে- অপারেশন গ্লোবাল ব্ল্যাকআউট। পরিকল্পনা অনুযায়ী, অচিরেই কোনো এক দিন এক সঙ্গে বন্ধ করা হবে ফেইসবুকের ৬০ হাজার সার্ভার। কারও কারও ধারণা, অ্যানোনিমাসের ক্ষেত্রে অপারেশন গ্লোবাল ব্ল্যাকআউট হয়ে উঠতে পারে গান পাউডার প্লট। তবে আসলেই তেমনটি ঘটবে কিনা, কে বলতে পারে!

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

নাশিদের পতন, ওয়াহিদের উত্থান; মালদ্বীপের কী?

বহির্বিশ্বে মালদ্বীপের পরিচিতি এতদিন অনেকটাই ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ঝুঁকিপ্রবণ দেশ হিসেবে। এটির সিংহভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে। দেশটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও নেই তেমন। এ কারণে অন্য দেশের রাজনৈতিক গোলযোগে যেমন অহরহই প্রতিবেশির ডাক পড়ে- সে রকম দৃষ্টান্ত খুবই কম এখানে। একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করতেন, আদৌ মালদ্বীপে নিজস্ব সেনাবাহিনী রয়েছে কিনা। জলবায়ু সংক্রান্ত বা সার্ক সম্মেলন ছাড়া দেশটির খবরও মিলত কম। দীর্ঘদিন পর মালদ্বীপ আলোচনায় এলো এসব কারণের বাইরে- দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়ায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশিদ। তিনি ছিলেন দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। নাশিদের পদত্যাগে ক্ষমতা নিয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ওয়াহিদ হাসান। নাশিদ বলছেন, মালদ্বীপে অভ্যুত্থান ঘটেছে; আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। এদিকে নতুন রাষ্ট্রপতি ও দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হচ্ছে সেগুলোর সারমর্ম অনেকটা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নাশিদের দেয়া বিদায়ী ভাষণের মতই- রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে নাশিদ অব্যাহতি নিয়েছেন দেশের কল্যাণার্থে। তবে আসলেই কী ঘটেছে ও ঘটে চলেছে, তা অনেকটা ঘোলাটে এখনো। ঘোলাটে এ কারণে যে, বর্তমান পরিস্থিতি কাদের জন্য সুযোগ করে দিলো বা বিষয়টি আদৌ সুযোগ কিনা, সেটি পরিষ্কার নয়।

সাম্প্রতিক ঘটনার সূচনা মালদ্বীপ ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অপসারণকে নিয়ে। অপসারণের পর তাকে গ্রেফতারের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি নাশিদ। কিন্তু বিষয়টিকে সংবিধানের লঙ্ঘন হিসেবে নিয়ে হুকুম অমান্য করেন তারা। উল্টো এ নিয়ে ‘আলোচনায়’ বসেন নাশিদের সঙ্গে। এ অবস্থায় নাশিদের অবশ্য কিছু করার ছিল না। ‘আলোচনা’য় সেনাবাহিনী, বিরোধী দলের সঙ্গে তার উপরাষ্ট্রপতিও ছিলেন। ওদিকে তার সমর্থকদের সক্রিয় দেখা না গেলেও, বিরোধীদল রাজপথে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল তখন। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয় শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যও।

অনেকে বলছেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার মূল্য নাশিদকে দিতে হলো এভাবে অপসারিত হয়ে। সত্য যে, আগে দেশের জন্য অনেক আত্মত্যাগ করলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে শক্ত হাতে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন তিনি; এমনকি সেনাবাহিনীকেও। তবে এটিই তার পতনের একমাত্র কারণ বলা যায় না। কেউ কেউ বলছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা মামুন আবদুল গাইয়ুমের ষড়যন্ত্র হতে পারে এটি। তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন। প্রধান বিচারপতির গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তপ্ততা কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটে নিয়েছেন তিনি। অবশ্য এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দেয়া সহজ নয় বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষে। আগে একবার তিনি অভ্যুত্থানের আভাষ পেয়ে বিদেশি শক্তির সহায়তা চেয়েছিলেন। কারো কারো মতে, সম্প্রতি মালদ্বীপে ইসলামী উগ্রপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের মনক্ষুণ্ণ করবে, এমন কিছু কাজ এরই মধ্যে করে ফেলেছেন নাশিদ। এরাই চান না তিনি ক্ষমতায় থাকুন। কথা হলো, দেশটির সাধারণ মানুষের ইসলামী মনোভাব রক্ষণশীল হলেও উগ্রপন্থা বলা যায় না একে। মজার বিষয় হলো, এত সব বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে মধ্যে কেন যেন বোঝা যাচ্ছে না আরেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফাতিমা দিয়ানা সাইদের ভূমিকা।

মালদ্বীপের ঘটনায় একটি বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। তা হলো, শক্তিশালী হয়ে উঠেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ অবস্থায় অনেকের প্রশ্ন- নাশিদের পতন, ওয়াহিদের উত্থান; মালদ্বীপের কী? মালদ্বীপের গণতন্ত্রের ভাগ্যে কী রয়েছে, সেটি অনুমানের সুযোগ কম। তবে এটা বোঝা যায়, এখন থেকে দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব বাড়বে; আগে তেমন ছিল না যেটি। এ ক্ষেত্রে দেশটির গণতন্ত্রের জন্য সুখবর হলো, উদ্ভূত রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগে ক্ষমতা নিতে পারত সেনাবাহিনী। নিজেদের যথেষ্ট শক্তিশালী না মনে করেই হোক বা সদিচ্ছা থেকেই হোক, সেটি করেন নি তারা।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

বাংলা সিনেমার মান ও বাণিজ্যিক সফলতা

সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলা ছবি দেখতে দর্শকের ভীড় জমছে হলে। এটি শুভবার্তা তো বটেই। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো- এটি নাকি আর্ট ফিল্ম। এ দেশ কেন, সারা বিশ্বেই এ ধরনের সিনেমার দর্শক কম। একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, শৈল্পিক চলচ্চিত্র মানেই নীরস; আর বাণিজ্যিক ছবি মানে হালকা কিছু। এ দেখে অনেকে রায় দিয়েছে, ‘বাণিজ্য ও শিল্প খাপ খাইবার নয়’। সাধারণ মানুষ দেখে না সিনেমাটোগ্রাফি কেমন হয়েছে। তাদের কাছে মূল বিবেচ্য হলো- সেটির কাহিনী ও চরিত্রদের অভিনয়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে কেউ কেউ তুলে ধরেন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ধারাকে। এখানকার দর্শকদের অভিযোগ, হালের ছবিগুলো মানসম্মত নয়। এদিকে পরিচালক-প্রযোজকদের উষ্মা, অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য আর্ট ফিল্ম ঠিক আছে কিন্তু ও করে তো পেট চলে না! দর্শককে দোষ দেয়া যাবে এ ক্ষেত্রে। ছবি ব্যবসা সফল করার দায়িত্ব তাদের নয়। বরং পরিচালক-প্রযোজকদের কৃতিত্ব এখানে যে, তারা কী উপায়ে উভয় রুচির দর্শককে হলে টানবেন।

অসম্ভব কাজ মনে হয় না? চলচ্চিত্রের এক দিকপাল আলফ্রেড হিচকক একই সমস্যায় পড়েছিলেন। সস্তা ছবি তৈরিতে তার রুচিতে বাধত; আবার ব্যবসা সফল করতে না পারলে তাকে ছেড়ে দিতে হতো চলচ্চিত্র নির্মাণ। ভেবে-চিন্তে তিনি ঠিকই বের করলেন মধ্যপন্থা; তার অধিকাংশ সিনেমা ব্যবসা সফল ও দর্শক-সমালোচক কর্তৃক প্রশংসিত। হিচককের সিনেমা দর্শন ছিল, স্কিপ্ট দিয়ে আকর্ষণ করতে হবে কৌতুহলী মানুষকে; ছুঁতে হবে সাধারণ দর্শকের মন। একই সঙ্গে অভিনয় ও সিনেমাটোগ্রাফী হতে হবে এমন, যেটি দর্শকরা পছন্দ করবেন আবার সমালোচকেরো চিন্তার খোরাক জোগাবে। হিচককের দেখানো এ পথ অনুসরকারীর সংখ্যা কম নয় এখন। তার সিনেমাদর্শনে বিশ্বাসীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন, জর্জ লুকাস, রিডলি স্কট (বর্তমানে স্যার রিডলি স্কট), জেমস ক্যামেরন, স্টিভেন স্পিলবার্গ ও ক্রিস্টোফার নোলান। প্রধানত এরাই হলিউডের চলচ্চিত্রে মিলন ঘটিয়েছেন বাণিজ্য ও শিল্পের। ১৯৯৭ সালে টাইটানিক ও ২০০৯ সালে অ্যাভাটার মুক্তি দেন ক্যামেরন। এ দুটি ছবির প্রশংসা করেছেন বড় বড় সমালোচকরা। আর টাইটানিক ও অ্যাভাটার থেকে ক্যামেরন আয় করেছেন ৫০০ কোটির ডলারের কাছাকাছি। একই কথা খাটে, স্পিলবার্গের ই.টি., লুকাসের স্টারওয়ার্স, রিডলি স্কটের গ্ল্যাডিয়েটর সম্বন্ধেও। শংকা ছিল, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারা লুকাস-স্কটদের মধ্যেই শেষ। নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে বাণিজ্য-শিল্পের সমন্বয় করা কঠিন। তখনই ডার্ক নাইট, ইনসেপশনের মতো ব্যবসা সফল ও শৈল্পিক ছায়াছবি নিয়ে বাজারে আসেন ক্রিস্টোফার নোলান। ইনসেপশন সিনেমার প্লট ভাষাতত্ত্বের একটি জটিল তত্ত্বে নিহিত। সিনেমাটি সমালোচকদের এতটাই নাড়া দেয় যে, সে বছর তাকে সম্মানজনক রাইটার্স গিল্ড অ্যাওয়ার্ডও দেয়া হয়। তার সিনেমাদর্শনের সঙ্গে হিচককের মিল রয়েছে। তিনি বলেন, দর্শককে ফাঁকি দেয়া যায় না; তাদেরকে নতুন গল্প সূচারূভাবে উপস্থাপনার মাধ্যমে তাদেরকে বৈচিত্র্য দিতে হবে, বাস্তব-কল্পনায় ভাসাতে হবে। আপন সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্য ও শিল্পের মাঝে সমন্বয় সাধনের এ গুণ সত্যজিৎ রায়েরও ছিল। আমাদের জহির রায়হান, খান আতারাও সীমিত পরিসরে চেষ্টা করেছেন এটি। তার কয়েক দশক পরই এ ধারার চলচ্চিত্রনির্মাণ ব্যাহত হয়। হালের অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতার প্রতিভা থাকলেও ঘাটতি রয়েছে ওই গুণটির। এ ক্ষেত্রে অনেক বাংলাদেশী চলচ্চিত্রনির্মাতা দাঁড় করান আরেকটি খোঁড়া যুক্তি- বাংলা সিনেমার বাজার তো আর হলিউড, বলিউডের মতো ব্যাপক নয় যে অধিক বিনিয়োগ করে মানসম্মত ছবি বানালেই তার অর্থ উঠে আসবে। তাদের চোখ মেলে দেখা উচিৎ, এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশেই রয়েছে বাংলা সিনেমার বিপুল দর্শক। তাদের কথাবার্তা মাঝে মাঝে বাংলাদেশ বিমানের পরিচালকদের মতো শোনায়। দেশি-বিদেশি বেসরকারি এয়াইলাইনসগুলো যখন চুটিয়ে ব্যবসা করছে তখন একমাত্র এদের কাছেই মেলে বিমান পরিবহনের নানা সংকটের চিত্র। একই হাল বাংলাদেশী চলচ্চিত্রেরও। এখানকার টিভি বিজ্ঞাপন, নাটক মোটামুটি মানসম্মত; অথচ এ থেকে যোজন দূরে পড়ে রয়েছে সিনেমা। এর প্রতিকার কী মিলবে না!

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে

নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়েছে বিরোধী দল। নীতিগত দিক থেকে যন্ত্রটি ব্যবহারে তাদের সমস্যা নেই অবশ্য। তবে প্রশ্ন রয়েছে এর নির্ভুলতা ও দক্ষতা নিয়ে। তার বলছে, কারসাজি করে নির্বাচনের ফল পাল্টানোর সুযোগ রয়েছে এতে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো গুটিকয়েক কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয় ইভিএম। সে ক্ষেত্রেও তোলা হয়েছিল প্রশ্নগুলো। তখন যে আশংকা করা হয়েছিল, ফল প্রকাশের পর দেখা গেলো বাস্তবে সেসবের কিছুই ঘটে নি। এটির সাহায্যে পরবর্তীতে হলো আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। একই শংকা ব্যক্ত করা হয় সেখানেও। এ নির্বাচনেও দেখা যায় নি ইভিএমের উল্লেখযোগ্য কোনো ত্রুটি। বরং যন্ত্রটি ব্যবহারে সে সময় সাড়া পড়ে জনগণ বিশেষত তরুণদের মধ্যে। ওসব অভিজ্ঞতা পুঁজি করে সম্প্রতি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হলো প্রতিটি কেন্দ্রে। ব্যাপকভাবে ব্যবহার হওয়ায় বর্তমান যন্ত্রটির কিছু সমস্যা অবশ্য দেখা গেলো এতে। যেমন, প্রার্থীর চিহ্নের পাশের লেখাটা বেশ ছোট। ফলে বয়ষ্কদের এটি পড়তে সমস্যা হয়। এতে করে ভুল প্রার্থীতে ভোট পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি তেমন সচেতনতামূলক কর্মসূচী না থাকায় কিছু ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছিলেন অশিক্ষিতরাও। সার্বিকভাবে বিচার করলে অবশ্য দেখা যায়, এসব বিঘ্ন পরাজিত হয়েছে মানুষের কৌতুহলের কাছে ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আনন্দে। তবে এ কথা সত্য, ইভিএম সম্পর্কিত প্রচারণা পর্যাপ্ত ছিল না এবারে। এ প্রযুক্তি একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত পরিচয় করিয়ে দেয়ার যে ধরনের ব্যাপক কর্মসূচী দরকার, ঘাটতি ছিল তাতে। আশা করি, এসব অভিজ্ঞতা পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় কাজে আসবে।

যে কোনো যুক্তিপূর্ণ ব্যক্তিই স্বীকার করবেন, শতভাগ নিরাপদ কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় নি আজ পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে ইভিএমের শতভাগ কার্যকারিতা বা নির্ভুলতার প্রশ্ন তোলাও অর্থহীন। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অনেক পর্যবেক্ষকও লক্ষ্য করেছেন এটির কার্যকারিতা। তাদের মতো হলো, সামগ্রিকভাবে এটি গ্রহণযোগ্য। এরপরও বিরোধী দলীয় কেউ কেউ গিয়েছেন গভীর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের দিকে। এরা বলছেন, যন্ত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে জাতীয় নির্বাচনে এর সাহায্যে কারচুপির আশ্রয় নেবে সরকার। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বরাবরই বলে আসছে, ইভিএমে কারসাজির বিষয়টি বিরোধী দলীয় প্রযুক্তিবিদরা প্রমাণের চেষ্টা করতে পারেন কমিশনে গিয়ে। এ আহ্বানে অবশ্য এখন পর্যন্ত তাদেরকে সাড়া দিতে দেখা যায় নি।

তবে অভিজ্ঞতা থেকে ইভিএম ব্যবহারে যেসব খুঁত নজরে এসেছে সেদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার ইসিকে। যেমন, ইভিএমের ব্যবহৃত চিপে পরিবর্তন করা যায় ফলাফল। এতে যুক্ত করা উচিৎ ওয়ানটাইম ডিসপোজেবল চিপ। যন্ত্রটির আরেকটি ত্রুটি, ভোট আসলে কোথায় পড়ল তার ডকুমেন্ট থাকে না এতে। এ ক্ষেত্রে অটোমেটেড টেলার মেশিনের (এটিএম) মতো ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে যাতে ভোট দেয়ার পর ছোট কাগজে ভোটার ও ভোট সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য বিবরণী হিসেবে বেরিয়ে আসবে ইভিএম মেশিন থেকে। এ ক্ষেত্রে খরচ বাড়লেও বৃদ্ধি পাবে মানুষের আস্থা। দেশেই ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন তৈরি হচ্ছে এখন। এ অবস্থায় কঠিন হবে না স্থানীয়ভাবে এমন যন্ত্র তৈরি।

বিরোধী দলেরও উচিৎ হবে না, ইস্যু করতে গিয়ে ইভিএমের মতো একটি ভুল বিষয়কে ইস্যু করা। আমাদের নির্বাচনগুলোয় যে পরিমাণ খরচ হয় ও ভোট দিয়ে গিয়ে মানুষকে যত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, সেসব দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে তাদের। ব্যাপকহারে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হলে নির্বাচনের খরচ তো কমবেই, মানুষও ভোট দিতে পারবে সহজে ও স্বল্প সময়ে। এটি পরীক্ষিতভাবে গ্রহণযোগ্য প্রযুক্তি। তারচেয়ে বড় কথা, জনস্রোত এখন ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। এ অবস্থায় যন্ত্রটি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখাটা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নয়।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

মাত্রাজ্ঞান হারানোর খেসারত দিচ্ছেন পাকিস্তানের রাজনীতিকরা

ঘটনার সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্রস্থ পাকিস্তানী দূত হোসেন হাক্কানীকে দেয়া প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিরি এক চিরকুট। এটির বিষয়বস্তু ছিল- পাকিস্তানী গণতন্ত্রের ধারায় সেনাবাহিনী খুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; তাদেরকে চাপে রাখতে মার্কিন সহায়তা প্রয়োজন। বাস্তবিকই ওই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা রাজনীতিকদের পক্ষে কঠিন ছিল। পাকিস্তানে মার্কিন ঘাঁটি ও তাদের ড্রোন হামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গন থেকে। এরই মধ্যে দেশটির সামরিক-বেসামরিক কোনো প্রশাসনকে না জানিয়ে ঘরের ভেতরে বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় ইউএস নেভী কমান্ডো। আরেকটি বিষয় রয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের চেয়ে জনগণের প্রতি বেশি কমিটেড (এ কারণে বোধকরি সুযোগ পেলেই তাদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে চান তারা)। ফলে বিন লাদেনের এমন হত্যায় পাকিস্তানীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে বিষয়টি আরও উস্কে দেয় সেনাবাহিনী। মন্তব্য করা হয়- আরেকবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তার দায় নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এ বক্তব্যে যতটা না ক্ষোভ না, অভিমানই ছিল বেশি। মাত্রাও বজায় ছিল এতে। এটি অবশ্য ধরতে পারেন নি রাজনীতিকরা। তারা ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার ইঙ্গিত বুঝি দিচ্ছে সামরিক প্রশাসন। ব্যস, চোখ-কান বুঁজে তারা উঠেপড়ে লাগলেন ওবামা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিন লাদেন ধরার অভিযান সেলিব্রেটও করতে দিলেন না ওয়াশিংটনকে। কড়া মন্তব্য করলেন প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি- পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে তারা; এখন ক্ষমা চাইতে হবে। মনে শান্তি এলো না এতেও। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারকে পাঠানো হলো যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি গিয়ে শাসালেন হিলারি ক্লিনটনকে। সেদিন কোনো জবাব দেন নি হিলারি। কয়েকজন পাকিস্তানী রাজনীতিক আরও আগ বাড়িয়ে ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্র এক সময় তাদের মিত্র ছিল বটে তবে জিগরি দোস্ত হলো চীন। ওয়াশিংটন জানত এদের দৌড়। বোধকরি সুযোগ খুঁজছিল তাই। সেটি অবশ্য করে দিলেন প্রেসিডেন্টই- ‘বিশ্বস্ত’ হাক্কানীকে দিয়ে ওই চিরকুট পাঠিয়ে। এ ভদ্রলোকের নাকি ভালো সম্পর্ক ছিল সিআইএ ও আইএসআইয়ের সঙ্গে (পরেরটি অবশ্য জানতেন না জারদারি)। এর পরের ঘটনা অনেকটা এমন। কিভাবে যেন ফাঁস হয়ে গেলো চিরকুট। নিজেই ইস্তফা দিলেন হাক্কানী। সেনাবাহিনী গেলো সুপ্রীম কোর্টে। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে আগে থেকেই ব্যবধান বাড়ছিল। এবার সেটি রুপান্তরিত হলো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে। আসলে ফাঁসটি খোলা ছিল। এতেই গলা এগিয়েছেন জারদারি। ফাঁস নিয়েই এখন চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রীকেও ফাঁসাতে।

অনেকে বলছেন, আবার ক্ষমতা দখল করতে পারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এমন সম্ভাবনা কম অবশ্য। বর্তমান সেনাপ্রধান তেমন উচ্চাভিলাসী নন। তাছাড়া পারভেজ মোশাররফের মতো এক সঙ্গে রাজনীতি, কুটনীতি, সেনাবাহিনী চালানো- তার ধাতে সইবে না। আইএসআই প্রধানের বেলায়ও খাটে একই কথা। তাছাড়া আগ্রহ থাকলে এ পরিস্থিতিতে আদালতে না গিয়ে শুরুতেই ক্যু করে ফেলতে পারতেন তিনি। এ অবস্থায় কেউ কেউ বলছেন ইউসুফ রাজা গিলানিকে সরিয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির আইতজাজ আহসানকে করা হতে পারে প্রধানমন্ত্রী। এটিও জোর দিয়ে বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যদি বদলাতেই হয় বেটার অপশন হলো ক্রিকেটার-টার্ন-পলিটিশিয়ান ইমরান খান। তবে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন আসলেই কোনো সমাধান কিনা বা এ পদে কাকে নেয়া হবে সেটি অনেকাংশে নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। জিগরি দোস্ত চীন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেই নাক গলায় না। আবার সেনাবাহিনী ও সুপ্রীম কোর্টের যৌথ চাপ সামলানো সম্ভব নয় ক্ষমতাসীনদের। এখন যুক্তরাষ্ট্রে মুখ ঘোরানো ভিন্ন উপায় কি! এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি সম্পর্কটি যেমনই যাক, নিজের স্বার্থ থেকেই এগিয়ে আসতে হবে মার্কিনীদের। পরিস্থিতির গুরুত্বানুযায়ী এ বিষয়ে আসতে পারেন হিলারি নিজেও; হিনাকে জবাবটা দিতে হবে তো।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

টি-২০ ক্রিকেটের পর বিপিএল ফুটবল!

বিশ্বকাপজয়ী ইতালি ফুটবল দলের অধিনায়ক ক্যানোভারো, আর্জেন্টিনার সোরিন ও ক্রেসপো, লিভারপুলের ফাওলার, ফ্রান্সের পাইরেস নিশ্চিত করেছেন তারা আসছেন কলকাতায়। আসার কথা রয়েছে জে-জে ওকোচা, মরিয়েন্তেস, মানিশের মতো আরোও কয়েকজন ফুটবলারেরও। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ধারে-কাছেও নেই এখনকার ফুটবল। এতে মনে হতে পারে, বিশ্বখ্যাত এ ফুটবলাররা আসছেন প্রদর্শনীতে অংশ নিতে। এতকাল এ-ই হয়ে এসেছে। অবশ্য ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) ফুটবলে খেলতে আসছেন তারা। তাদের অনেকে ভারতের নাম জানতেন। তবে দেশটিতে পশ্চিমবঙ্গ বলে একটা স্থান রয়েছে ও সেখানে বিপুল ফুটবলমোদীর বাস, সেটি জানা ছিল না। ক্যানোভারোদের উদ্বুদ্ধ করতে ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগ ম্যাচের ভিডিও নাকি পাঠানো হয় খেলতে আসার আমন্ত্রণের সঙ্গে। ঘটনাটি ভারতের ফুটবল দর্শক ও ফিফা র‍্যাংকিংয়ের ১৫৮তম (একই অবস্থান বাংলাদেশেরও) অবস্থানে থাকা দেশটির জাতীয় দলকে করে তুলেছে উজ্জীবিত।

ক্রিকেটের মতো না হলেও আইপিএল ফুটবলের জন্য প্রথম বছরের সম্ভাব্য বাজেট মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের। ক্রিকেট অধিক জনপ্রিয় জেনেও বিপুল অর্থের বিনিয়োগকে পাগলামি মনে হতে পারে কারও কারও। তবে বিনিয়োগকারীরা ফুটবলে জেনে-শুনেই; আইপিএল টি-২০ ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা থেকে। তারা বুঝছেন এ অঞ্চলের মানুষ যতটা ক্রীড়ামোদী তাতে যথাযথভাবে উপস্থাপন বড় খেলাকে পুঁজি করে লাভ ওঠানো কঠিন নয়। আইপিএলের কথা বললে এখন থেকে বিপিএল প্রসঙ্গ উঠবেই। কয়েক দিন পরই শুরু হবে ঘরোয়া এ টি-২০ ক্রিকেট। এর টিকেট বিক্রিও শুরু হয়েছে এরই মধ্য। ভেন্যু নির্ধারিত হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। এ ক্ষেত্রে আইপিএলের সঙ্গে তুলনা করে কিছু বলা দরকার। সেটি লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, ভেন্যু নির্ধারণে আইপিএলে প্রাধান্য দেয়া হয় হোমগ্রাউন্ডকেই। মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ও কলকাতা নাইট রাইডারসের মধ্যে খেলা- ভেন্যু হয় কলকাতা নয়তো মুম্বাই। এতে যে মাঠে খেলা হবে, তার নিজস্ব কিছু দর্শক থাকবেই। এ ক্ষেত্রে ম্যাচটি যদি রাজস্থানে হতো? দর্শক কমে যেতো অনেকটাই। কলকাতা কি মুম্বাই থেকে একই আবেগ রাজস্থান পর্যন্ত ধরে রাখা মোটেই সহজ নয়। বিপিএলেও এটি করা যেতে পারে (অবশ্য এবার নয়, সামনের বছর থেকে)। কিছু অবকাঠামোগত অসুবিধা থাকলেও আমাদের বিভাগীয় স্টেডিয়ামগুলো একেবারে অচলনসই নয়।

বিপিএলের সব খেলাই এবার অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ফলে খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট দলের ভক্তদেরও যেতে হবে সেখানে। বলা হতে পারে, যারা যেতে চান না তাদের জন্য তো টেলিভিশন রয়েছে। তা ঠিক। মাঠে দর্শক না এলে কেবল টিভিতে খেলা দেখিয়ে কিন্তু টুর্নামেন্ট সফল করা যাবে না। টেস্ট ক্রিকেটও লোকে টিভিতে দেখে; মাঠে দর্শক উপস্থিতি থাকে কম। তবে টেস্ট ক্রিকেটের আমেজ টি-২০’র ব্যবসা চলবে না। বহু অর্থ ব্যয়ে (ও আরও খরচের চিন্তা মাথায় রেখে) গঠন করা হয়েছে বরিশাল বার্নার্স, চিটাগং কিংস, ঢাকা গ্লাডিয়েটরস, খুলনা রয়েল বেঙ্গল, দুরন্ত রাজশাহী ও সিলেট রয়ালস। বিপিএলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য নিশ্চয়ই বিনিয়োগ করেন নি উদ্যোক্তারা। তবে তাদের মনে রাখা দরকার, এ ধরনের ক্রিকেট লীগ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হতে প্রয়োজন বিচক্ষণ পদক্ষেপ ও ধৈর্য্য। আইপিএলে বিনিয়োগকারীদের অভিজ্ঞতা তো তাই বলছে। এটি শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। প্রথম ২-৩ বছর এখানে লোকসানও করেছেন মুকেশ আম্বানি, বিজয় মালায়া, ল্যাকান মারডকের (রুপার্ট মারডকের বড় ছেলে) মতো বিনিয়োগকারী। অবশ্য বিপিএল উদ্যোক্তারা এসব হিসাব করেই নেমে থাকবেন। তাদের মতো আমরাও চাই উদ্যোগটি সফল হোক, জমে উঠুক বিপিএল। সে ক্ষেত্রে বিপিএল টি-২০ ক্রিকেটের পর এক সময়কার জনপ্রিয় ফুটবল খেলাকেও হয়তো পুনর্জীবন দিতে পারবেন বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ভালো কিছুর আশায়

সদ্য পরিচিত ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম বা পদার্থবিজ্ঞানী হতেও পারেন, নাও পারেন। তবে যিনি আমাকে ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার এ কথাটাই শুধু একদম বিশ্বাস হতে চাইল না যে, তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সুযোগ ছেড়ে দিয়ে পড়ে রয়েছেন বাংলাদেশে- তাও আবার চট্টগ্রামে। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো! ভদ্রলোককে দেখেও কিন্তু পাগলাটে ধরনের বিজ্ঞানী মনে হচ্ছে না। বরং আচার-আচরণে বেশ সৌম্য। যাহোক, একটু বাজিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে- দৌড় কতদূর। ইউরোপে সার্নের বিজ্ঞানীরা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (এলএইচসি) ‘ঈশ্বর কণা’র অস্তিত্ব আবিষ্কারে আদাজল খেয়ে নেমেছে তখন। তাই জিজ্ঞেস করলাম, হিগস মেকানিজম (হিগম ফিল্ড থেকে যেভাবে ভর উৎপন্ন হয়) সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী? প্রথম পরিচয়ের কোনো রকম আড়ষ্টতা, ধারণাগত জড়তা ছাড়াই প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম শুরু করলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যাখ্যা। একটা কাগজ জোগাড় করে দেখাতে লাগলেন হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র। দ্রুতই ফিরলেন আইনস্টাইনের ভরশক্তি সমীকরণে। এ সূত্রটি আইনস্টাইন লেখেন ১৯০৫ সালে; প্রমাণ করতে পেরিয়ে যায় তিরিশের দশক। ভরশক্তি সমীকরণের আদৌ কোনো ব্যবহারিক দিক রয়েছে কিনা, সেটি বোঝাতে গিয়ে আইনস্টাইন বলেছিলেন- ঘটনাটি আসলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো বিরান শহরে পাখি শিকার করার মতো; যেখানে পাখি রয়েছে মাত্র দু’চারটি। হয়তো এমন পরিবেশে পাখি শিকারে নেমেছে এলএইচসিও। তাজ্জব হলাম তার জ্ঞানের গভীরতা দেখে। পরে আরো মুগ্ধ হলাম এটা জেনে যে, তিনি আদতে একজন জ্যোতির্পদার্থবিদ ও গণিতজ্ঞ। ক্যামব্রিজে তার অনেক সহকর্মীই পরবর্তী সময়ে কাজ করেছেন স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে।

গণিত ছিল তার অস্থিমজ্জায়। ফলে আকৃষ্ট হন পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে যেমন অর্থনীতিতে ব্যবহার্য গণিতের প্রতিও। সোশ্যাল চয়েস থিওরি নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। এগিয়ে নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারোর জেনারেল পসিবিলিটি থিওরেমকে। অন্যদের মতো কেবল কার্টেসিয়ান কোঅর্ডিনেশন আর সেট থিওরির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেন নি তত্ত্বটিকে। জামাল নজরুল ইসলাম সোশ্যাল চয়েসকে ব্যাখ্যা করেছেন জ্যামিতি ও ভেক্টর বিশ্লেষণ দিয়ে। অর্থনীতি ভাসা ভাসা যতটুকু বুঝি, তাতে মনে হয়েছে ওনার ভেক্টর বিশ্লেষণটি খুবই কাজে আসতে পারে অর্থনীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে; বিশেষত সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় এবং আয় পুনর্বণ্টনের মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচারে। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা ছিল। পরে সৌভাগ্যক্রমে ও কাতকাতালীয়ভাবে তার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল আরেকবার। তবে সমীকরণটির সম্ভাবনা নিয়ে কোনো কথাবার্তা হয় নি। সোশ্যাল চয়েসের গাণিতিক ব্যাখ্যা নিয়ে তিনি শুধু মজা করে বললেন যে, অ্যারোর সমীকরণ পড়লে বোঝা যায়- কেন বাংলাদেশে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে নির্বাচনের মাধ্যমে আসা ভিন্ন কারো ক্ষমতায় বসা প্রায় অসম্ভব। বলেছিলাম, সমীকরণটি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বসেন না কেন? ছোট্ট করে জানালেন, এখানে গণিত বোঝার লোক কম; সেটি প্রয়োগ করার মানুষ তো বিরল। ক্যামব্রিজ ছেড়ে জামাল নজরুল ইসলাম দেশে এসেছিলেন বিরাট কোনো পদ অধিকারের জন্য নয়; খ্যাতির মোহও তার মাঝে অনুপস্থিতই ছিল। তিনি সে অর্থে বড় গড়ে তুলতে চান নি। চেয়েছিলেন, এ দেশের মানুষ বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে নিজেরাই গড়ে উঠবে; তিনি সে প্রক্রিয়ায় সহায়তা জোগাবেন মাত্র। তা যে মনের মতো হয় নি, সেটি নিয়েও তার হতাশা ছিল না; ছিল- দুঃখ। একবার মনে হয়েছিল, অনেকের মতো জামাল নজরুল ইসলামেরও তরুণদের ওপর কোনো ক্ষোভ রয়েছে কিনা। প্রসঙ্গ তোলা মাত্র থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, তোমাদের আর দোষ কী? আমরাই পারিনি তোমাদের বোঝাতে। অবশ্য হাল ছাড়িনি; আমি আশাবাদী। এ বয়সেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাই। কে জানে, এসবের মধ্যে দিয়েই হয়তো দেশে ভালো কিছু হয়ে যাবে একদিন; বিজ্ঞানমনষ্কতা বাড়বে সবার।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

From 2011-15

জীবাণূমুক্ত মুদ্রা!

একটা সময় পর্যন্ত দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে ধাতব মুদ্রা ভিন্ন ভাবা যেতো না। এখন অবশ্য পরিস্থিতি তেমন নয়। এখন রয়েছে কাগুজে মুদ্রা; আছে অদৃশ্য ডিজিটাল মানি। গত শতকেই ধাতব মুদ্রা হারিয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল কারও কারও। ওসব মিথ্যা করে দিয়ে এখনো টিকে আছে ধাতব মুদ্রা। তবে অস্বীকার করা যাবে না, ধীরে ধীরে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমছে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার।

আসলে ধাতব মুদ্রা ব্যবহারের বিশেষ কিছু অসুবিধা রয়েছে। প্রথমে ধরা যাক, এর ওজন। ব্যাংক থেকে কেউ যদি ৫০ হাজার টাকা তুলতে যান। তিনি যদি মুদ্রা সংগ্রাহকও হন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ১, ২ এমনকি ৫ টাকা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রাও নিতে চাইবেন না। ৫ টাকা মূল্যমানের দুই ধরনের ধাতব মুদ্রা রয়েছে দেশে। এগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ওজন হলো ৭ দশমিক ৮৭ গ্রাম। এখন কেউ যদি ৫ টাকা মূল্যমানের ৫০ হাজার টাকার ধাতব মুদ্রা নিতে চান তাকে ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি পর্যন্ত বহন করতে হবে কমপক্ষে ৭৮ কেজি ধাতু। ১ বা ২ টাকার ধাতব মুদ্রা হলে এ ওজন আরোও বেড়ে যাবে। অথচ ১ হাজার টাকার নোট নিলে বহন করতে হবে সর্বোচ ৬০ গ্রাম! ধাতব মুদ্রা ব্যবহারের অন্যান্য সমস্যা হলো, এটি সহজে জাল করা যায় বা বিভিন্ন দ্রব্য তৈরিতে এগুলো ব্যবহার করা যায় সহজেই।

এখন ধাতব মুদ্রা ব্যবহারে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হিসেবে যেটিকে উল্লেখ করা হচ্ছে তাহলো, ধাতব মুদ্রার দ্বারা রোগের জীবাণু পরিবাহিত হয়ে জনস্বাস্থ্যে হুমকি সৃষ্টি। দেখা গেছে নিম্নবিত্তের মাঝে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার বেশি। এ দেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ধাতব মুদ্রা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় রিকশাচালক, মাছবিক্রেতা, ফেরীওয়ালা, মুদি দোকানদারের মাঝে। পরিবেশগত কারণেই এতে সহজে ধাতবমুদ্রাগুলো জীবাণূ বহন করে অনেক বেশি। তার সঙ্গে একটি বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। দেখা গেছে, ফেরোম্যাগনেটিক (যেসব ধাতু চৌম্বক দ্বারা সহজে আকৃষ্ট হয় ও যেগুলোকে সহজে চৌম্বকে পরিণত করা যায়) পদার্থে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কলোনি (স্ট্রেইন আকারে) স্থাপনের প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে কাগজের চেয়ে ধাতব মুদ্রার মাধ্যমে রোগজীবাণু পরিবাহিত হয় বেশি। এসব দিক বিবেচনা করে অনেক দেশেই ধাতব মুদ্রা ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিশেষত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে কয়েকটি দেশে আবার ব্যবহার করা হয়, জীবাণুমুক্ত ধাতব মুদ্রা। কিছুদিন আগে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারও। বলা হয়েছিল, ২ বিলিয়ন টাকা মূল্যমানের জীবাণুমুক্ত ১ ও ২ টাকার ধাতব মুদ্রা ছাড়া হবে বাজারে। এখন পর্যন্ত দরপত্র সংক্রান্ত জটিলতায় এ বিষয়ে অগ্রগতি থেমে রয়েছে। তবে আশা করা যায়, দ্রুতই এর নিষ্পত্তি হবে।

কথা হলো, জীবাণুমুক্ত ধাতব মুদ্রা কী? ধরলাম, কোনো উপায়ে জীবাণুমুক্ত করে ধাতব মুদ্রা ছাড়া হলো বাজারে; ঘুরে-ফিরে সেটি আবার যাবে সে রিকশাওয়ালাদেরই হাতে। সে ক্ষেত্রেও কী এটিতে কোনো জীবাণু থাকবে না? একেবারে থাকবে না তা নয়। তবে থাকবে অনেক কম পরিমাণে। সাধারণত দু উপায়ে এ ধরনের মুদ্রা তৈরি করা হয়। এক, ফেরোম্যাগনেটিক পদার্থের পরিমাণ কমিয়ে। দুই। অতিবেগুণী রশ্মি প্রয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে পলিমারের মুদ্রার প্রচলন করা যায় কিনা, তা নিয়ে গবেষণা এখনো চলতে। দেখা গেছে, এগুলোও একটি নির্দিষ্ট সময় পর জীবাণু আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। তারপরও সাধারণ ধাতব মুদ্রার তুলনায় ওগুলো স্বাস্থ্যের জন্য কম ক্ষতিকর।

স্পষ্টতই ধাতু ও কাগজের মুদ্রা উভয় কম-বেশি সক্ষম ও নির্বীজ জীবাণু বহন করে সর্বাবস্থায়। তাহলে কী, পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত কোনো মুদ্রা নেই? এ অবস্থায় অনেকেই বলেন, ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বাড়ানোর কথা- কারণ জীবাণু দ্বারা এটির আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার নিয়ে সংশয় রয়ে যায় একটি কারণে। আর তাহল, ডিজিটাল মুদ্রায় বায়োলজিক্যাল রোগজীবাণুর ঝুঁকি না থাকলেও এ ক্ষেত্রে জটিলতা হলো ‘আর্টিফিসিয়াল ভাইরাস’।

নিয়াজ মাখদুম

বাংলাদেশী নারীর জয়যাত্রা

সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন চীন থেকে বাংলাদেশ হয়ে সফর করেন ভারত। অনেক বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা অনুমান করছেন- ২০৫০ সালের মধ্যে এটিই হয়ে উঠবে এশিয়ার ‘নিউ সিল্করুট’। সফরকালে এ দেশের নারী জাগরণে নিজের আনন্দ ও বিস্ময়ের কথা জানিয়েছেন হিলারি; ধন্যবাদ জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের কথা। এভাবে বিভিন্ন উপায়েই বিশ্বাঙ্গনে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। কয়েকদিন আগেই টাইমস ম্যাগাজিনের প্রভাবশালীদের তালিকায় প্রথম সারিতে স্থান পেলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সালমান খান। ক্রিকেট, তৈরি পোশাকের কারণেও আমাদের ব্র্যান্ড ইমেজ দাঁড়াচ্ছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশী নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণের ঘটনাটি আরও উজ্জ্বল করেছে গড়ে উঠতে দেশের ভাবমূর্তি।

একটা সময় পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনেকের ধারণা ছিল- এখানকার নারীদের অবস্থা সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার মতোই হবে। সে ধারণা দূর হতে থাকে নানা আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা মাথায় নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ সহায়তায় গ্রামীণ পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও গার্মেন্ট শিল্পে বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান জোগানোর ঘটনায়। পাশাপাশি উচ্চতর দক্ষতাপূর্ণ কর্মক্ষেত্রেও নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত নারীরা। তাদের অনেকেই সাফল্য দেখাচ্ছেন সংসার ও কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে। এসব পরিবর্তনে অলীক ধারণা দূর হতে থাকলেও, সেটি গুড়িয়ে দিয়েছে বাঙ্গালী নারীর এভারেস্ট জয়ের মতো ঘটনা। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আজ ফলাও করে প্রচার হচ্ছে এটি। আফ্রিকান বলি কেন, এশিয়ারই বা কতজন নারী আজ পর্যন্ত এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছেন? অথচ সেটিই করে দেখালেন নিশাত মজুমদার। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বকে বার্তা দিলেন বাংলাদেশী নারীর যোগ্যতা ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে; অনুপ্রাণিত করেলেন স্থানীয়দের।

তুলনা করা সমীচীন হবে না, তবু চিন্তার খোরাক জোগাতে একটা হিসাব তুলে ধরা যায় এ ক্ষেত্রে। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০১০ সালে এভারেস্টের শীর্ষে উঠেন মুসা ইব্রাহীম- ১৯৫৩ সালে হিলারি-তেনজিংদের এভারেস্ট জয়ের প্রায় ৫৭ বছর পর। তারপর মুহিতও উঠেছেন এভারেস্টে। নিশাত এ কাজটিই করে দেখালেন আনুমানিক ২ বছরের মাথায়। নারী হিসেবে প্রথম, এক জাপানী এভারেস্ট জয় করেন ১৯৭৫ সালে। এ ক্ষেত্রে নিশাত সারা বিশ্বের নারীদের চেয়ে পিছিয়ে ৩৭ বছর; আর মুসা-মুহিতদের চেয়ে ২০ বছর এগিয়ে!

হিলারি-তেনজিংয়ের সময় একটি সুবিধাজনক দিক ছিল, ওই সময় পর্বতারোহনে শরীরের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও আর্থিক বিপত্তি ছিল এখনকার চেয়ে কম। তখন প্রযুক্তির ব্যবহারো ছিল কম; কম্পাস, অল্টিমিটার, অক্সিজেন বোতল, ক্লাইম্বিং গিয়ার, খাদ্য-পানীয় ছাড়া প্রয়োজনও হতো না বেশি কিছুর। তবে ব্যয় কম হলেও সে সময় পর্বতারোহণে ঝুঁকি ছিল বেশ। এখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে; এদিকে যন্ত্রপাতি ছাড়াও পর্বতারোহণের অনুমতি পেতে নেপাল সরকারকে দিতে হচ্ছে জনপ্রতি (অবস্থাভেদে) ১০ থেকে ২৫ হাজার ডলার। আমাদের মধ্যবিত্ত ও সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা পর্বতারোহীদের জন্য কম চিন্তার বিষয় নয় এগুলো। তাদের চিন্তা করতে হয়, স্পন্সর মিলবে কিনা? মিললেও সেখান থেকে কতটা অর্থ জোগাড় হবে? প্রভৃতি। এ ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়েও নারীদের চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। ফলে ধারণা করে নেয়া যায়, এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার আগে সেটিও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে হয়েছে নিশাতকে। তার ওপর এভারেস্ট জয়ের আগে তার প্রচার-প্রচারণাও দেখা যায় নি খুব একটা; যেটি দেখা গেছে আরেক বাংলাদেশী নারী পর্বতারোহী ওয়াসফিয়া নাজরীনের ক্ষেত্রে। যাত্রাপথের এসব অন্তরায় দূর করে সফলভাবে এভারেস্ট শীর্ষে উঠেছেন নিশাত; বাংলাদেশ ও এর নারীকে সঙ্গে নিয়েই। এখন দেখার রইলো, নাজরীন কবে নাগাদ এভারেস্ট জয় করতে পারেন। আগে উঠতে পারলেন না বলে তার আফসোস করার কিছু নেই। তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশী নারীদের বিশ্বের সামনে তুলে ধরাই তার পর্বতারোহণের উদ্দেশ্য। এমন অবস্থায় দ্রুত ও দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করতে পারলে তার উদ্দেশ্য বিফল হবে না; যদি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর আসে- এভারেস্ট চূড়ার দখল ছাড়তে চাইছে না বাংলাদেশী নারীরা!

নিয়াজ মাখদুম

টিপস অ্যান্ড ট্রিকস

হোটেল-রেস্টুরেন্টের ওয়েটিং স্টাফ নিয়ে একটা জোকস হয়তো সবারই জানা। এক ওয়েটার কয়েক মাস ধরে বেতন নিচ্ছেন না; মালিকের সঙ্গে দেখাও করছে না। ডেকে পাঠানো হলো ওয়েটারকে। মালিক জিজ্ঞেস করলেন, বেতন নিচ্ছ না কেন? যেন আকাশ থেকে পড়লেন ওয়েটার- বেতনও দেয়া হয় জানতাম না তো? আমি তো কেবল টিপস আশা করেছিলাম! আর তা তো আমি পাচ্ছিই। বেতনের চেয়ে টিপস যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি হলে বেতনের দরকার কী? আর টিপস দেয়া যদি কাস্টমারের জন্য হয় বাধ্যতামূলক? নিউইয়র্কের কিছু হোটেলে কিন্তু এমন নিয়ম আছে। আপনি বসে থাকলেও টিপস দিতে হবে। কিছু খেলেও তা দিতে হবে- অর্ডারকৃত খাবারের প্রকৃত মূল্যের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ করে। কোনোক্রমেই ১০ শতাংশের নীচে টিপস দেয়া যাবে না। সার্ভিস ভালো লাগলে ২৫ শতাংশের বেশি দিতে পারেন। তবে মাথায় রাখতে হবে, এ থেকে ওয়েটারের কাছ থেকে কমিশন কিন্তু রাখবে হোটেল কর্তৃপক্ষ।

সর্বত্র এমনটাই ঘটবে, তাও নয়। আসলে এটা নির্ভর করে ওয়েটার-মালিক সম্পর্কের ওপর। অনেক ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে ওয়েটারদের সব টিপস জমা থাকে মালিকের কাছে। কাজ শেষে তিনি সবাইকে তা গুরুত্বভেদে ভাগ করে দেন। নিজেও রাখেন খানিকটা। এতে করে যে মানুষটা খাবার সার্ভ করে না, তৈরি করে- সেও পায় টিপস। এক ধরনের আয়বন্টনও হয় এতে। পশ্চিমা রেস্টুরেন্টে টিপস পাওয়ায় ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হলো, সেখানকার কাস্টমাররা প্রায় নিয়মিত ও ভালো পরিমাণে টিপস দেন ওয়েটারকে। সম্প্রতি জানা গেলো, টেক্সাসে দুই কাস্টমার মিলে এক ওয়েটারকে দিয়েছেন ৫ হাজার ডলার টিপস; ওই ওয়েটার নাকি তাদের সামনে আফসোস করছিলেন- এ পরিমাণ অর্থ থাকলে তিনি একটা গাড়ি কিনতে পারতেন!

টিপস দেয়ার রীতি এ দেশে কী করে- জানা মুশকিল। একে ঔপনিবেশিকতার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগও কম। পর্তুগাল, স্পেন, ব্রিটেন, ফ্রান্সে টিপস দেয়ার সংস্কৃতি ছিল না। যতদূর জানা যায়, ইউরোপ এটি ‘আমদানি’ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তারপরের অবস্থা অনেকটা এমন- কয়েক দিন আগে ইতালির রোমে হানিমুনে যান ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ। সেখানে ‘টিপস সংস্কৃতি’ নেই। ফলে রেস্টুরেন্টে খেয়ে টিপস দেন নি তিনি। আর এতেই ক্ষুব্ধ ওয়েটার ঘটনাটি জানান গণমাধ্যমে। রোমের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন- টিপসের সংস্কৃতি কী এখানে আছে? ওয়েটারের জবাব ছিল- কিন্তু মার্কিনিরা তো টিপস দেয়! যাহোক, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে টিপস অবশ্য সংস্কৃতি। হংকং, তাইওয়ান, ম্যাকাওতে টিপস চালু থাকলেও একে এশিয়ার সংস্কৃতিতে ঢালাওভাবে ফেলা যায় না। জাপানে টিপস প্রদান ইতিবাচক তো নয়ই- বরং রীতিমতো অপমানজনক।

সম্প্রতি টিপস আদায়ের ট্রিকসও শেখানো হচ্ছে ইউরোপের কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে; যাকে বলা যায় কাস্টমার পটানোর বিদ্যা। আর তাতে প্রথম পাঠ হলো- মানিব্যাগের পাশাপাশি কাস্টমারের মনের অবস্থাও বোঝার চেষ্টা করুন। বিষয়টিকে ভুল বুঝবেন না। এখনো মন্দা চলছে ইউরোপে। ফলে ওয়েটারদের শেখানো হচ্ছে, কোনো কাস্টমারের সামনেই যেন জাঁকালো পোশাক, অলংকারাদি প্রভৃতি পরে না যাওয়া হয়; কারণ কাস্টমার আর্থিক সমস্যায় থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি জাঁকালো পোশাক দেখে বিরক্ত হতে পারেন। এসব দেশে অবশ্য ওয়েটিং স্টাফ প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমারদের ‘ইউজার ম্যানুয়াল’ও দেয়া হয়; যাতে লেখা থাকে- আপনি অমুক রেস্টুরেন্টের ওয়েটারের কাছ থেকে কতটা সেবা পেতে পারেন।

আমাদের দেশে কিছু মানসম্মত ও অভিজাত রেস্টুরেন্ট বাদ দিলে এসব বিষয়ে ওয়েটার ও কাস্টমার উভয়েই উদাসীন। এখানে একজন ওয়েটার ১০-১৫ জনকে একসঙ্গে সার্ভ করলেও কাস্টমারের কোনো আপত্তি নেই। আবার কাস্টমারের চড় খেয়েও ‘রা’ করেন খুব কমই ওয়েটার। অথচ এসব বিষয়ে দ্রুত নজর দেয়া প্রয়োজন। এজন্য ওয়েটিং স্টাফ প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাহলে এ ক্ষেত্রে দেশেও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে; বিদেশে যারা পড়াশুনার পাশাপাশি কাজ করতে আগ্রহী সুবিধা হবে তাদেরও।

ফাহমিদা ফেরদৌস

কলুষিত মাংস আর ভোক্তা সচেতনতা

কোনো নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নয়, কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন ভোক্তারা। পশ্চিমা দেশে কাঁচা মাংসের গ্রেড হলো চারটি- প্রাইম, চয়েস, সিলেক্ট ও স্টান্ডার্ড। সম্প্রতি ইউরোপের চয়েস ও স্ট্যান্ডার্ড গ্রেডের কিছু ভোক্তা ১০০% বীফ লেখা মোড়কীকৃত মাংস কিনে দেখেন, সেটি খেতে নরম আর খানিকটা মিষ্টি। শুরুতে সন্দেহের তীর ছোঁড়া হয়- মেয়াদোত্তীর্ণ মাংস গছিয়ে দিয়েছে দোকানী। বিক্রেতা এমন অভিযোগ অস্বীকার করলে দানা বাঁধে সংশইয়। মাংসের মেয়াদ আছে অথচ খেতে মিষ্টি আবার চর্বিও নেই। তার মানে ঘোড়ার মাংস মেশানো নেই তো এতে? শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো এ শঙ্কাই সত্য। অতিমুনাফার আশায় একশ্রেণীর মাংস ব্যবসায়ী গরুর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ঘোড়ার মাংস। এমন ঘটনায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। অবশ্য হৈ চৈ এখন ফ্রান্সেই হচ্ছে বেশি। ডিএনএ পরীক্ষা থেকে শুরু করে নানা হুলস্থুল পড়ে গেছে সেখানে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, ঘোড়ার পাশাপাশি শতভাগ গরুতে গাধার মাংস পাওয়ায়ও। সুপার চেইন শপের আকার ও কর্মপরিধি বিস্তৃত হয়েছে ইউরোপে। বেড়েছে মাংস জাতীয় ফাস্টফুড পরিভোগও। তাই জনরোষে পড়ার আগেই কাঁচা প্যাকেটজাত মাংস সরবরাহকারী একাধিক বড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছে ফরাসি সরকার। সব কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নাকি ‘কালেক্টিভ অ্যাকশনে’ যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নও।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ঘোড়ার মাংস নিয়ে বিশেষত ফরাসি ভোক্তাদের আপত্তি কোথায়? ম্যাগডালিয়ন যুগ (আনুমানিক ১৬ হাজার বছর আগে) থেকেই তো ঘোড়ার মাংস খাচ্ছে এরা। মধ্যযুগে পোপ এটি নিষিদ্ধ করেছিলেন বটে। তবে সে আইনও শিথিল হয়ে আসে বিশেষত ফরাসি বিপ্লবে। রুচি পরিবর্তন নয়, এ সময়ে সাধারণ ফরাসিরা ঘোড়ার মাংসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ‘রাজনৈতিক সচেতনতা’বশত। তখন ঘোড়া ছিল আভিজাত্য তথা বড়লোকের প্রতীক। বিপ্লবের শুরুতে তাই কমনার’রা ঘোড়ার মাংস খাওয়া শুরু করে ধনীর ওই সম্পদ ধ্বংসের অভিপ্রায়ে। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সে খাদ্য সংকট দেখা দিলে, ঘোড়ার মাংস হয়ে পড়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আমিষের অন্যতম উৎস। বিষয়টির সঙ্গে পরিশীলন যুক্ত করেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধকালে সৈনিকদের আরবীয় ঘোড়ার মাংসে তৈরি সুস্বাদু সুপ পরিবেশনের আদেশ দেন তিনি। এর একটা সুন্দর নামও বেরোয় তার৫ মাথা থেকে- বুফ আ লা মদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালেও ইউরোপে বেড়ে ওঠে ঘোড়ার মাংস বিক্রি। প্রাচীন ভারতেও ঘোড়ার মাংস খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। জাপানে তো এখনো একটি বিশেষ খাবার হলো শাকুরা নিকি; যেটি তৈরি হয় ঘোড়ার মাংস দিয়ে।

বর্তমানে অনেক দেশেই ঘোড়ার মাংস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে এ যুক্তিতে যে, যুদ্ধ-যোগাযোগ-বিনোদনে ঘোড়া আসলেই মানুষের সঙ্গী। ফলে এর মাংস খাওয়া নৈতিকভাবে সমর্থযোগ্য নয়। এমন সহানুভূতি ইউরোপে প্রবল বা এ কারণেই গরুতে ঘোড়ার মাংস পাওয়ায় তারা চটেছে, বিষয়টি এমনও নয়। ফরাসি ভোক্তাদের প্রথম অভিযোগ হলো, ঘোড়ার মাংসই যদি মেশাবে তাহলে প্যাকেটের গায়ে ১০০% বিফ লিখল কেন? এটা প্রতারণা। দ্বিতীয় উদ্বেগ হলো, ঘোড়ার মতো যেসব প্রাণীকে মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে লালন-পালন করা হয় না, জ্বরের মতো অসুখেও তাদের ওপর প্রয়োগ করা হয় ফিনাইল বিউটাজন নামক রাসায়নিক। স্বভাবতই এমন ঘোড়ার মাংস খেলে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে মানবদেহে। বিশেষত ওই ধরনের মাংস প্রচুর ও নিয়মিতভাবে খাওয়া হলে কিডনি বিপর্যয় দেখা দেয়াও অস্বাভাবিক নয়। তবে কোনো কোনো ব্যবসায়ী বলছেন, এমনটি ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে; এটি বাড়াবাড়ি রকমের ভোক্তা সচেতনতা! ফরাসি ভোক্তাদের তড়িৎ জবাব, খাদ্য ও ওষুধের মানের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয় তারা। আফসোস জাগে এটি ভেবে যে- আহা, কবে এমন সচেতন হয়ে উঠবেন স্থানীয় ভোক্তারা? অতটা না হোক তার চেয়ে কম হলেও তো চলত আমাদের।

ফাহমিদা ফেরদৌস

হোমো আরবানাস বৃত্তান্ত

দু’পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করেছিল হোমো হ্যাবিলিজ। ব্যবহার বেশি ছিল বলে দেহের অনুপাতে অস্বাভাবিক বড় ছিল হাত। হোমো হ্যাবিলিজ-এর অর্থও তাই হাতের কাজে পটু যে মানুষ। পারফরম্যান্সের দিক থেকে এর কৃতিত্ব ছাপিয়ে যায় হোমো (মানুষ) গ্রুপের অপর সদস্য হোমো ইরেক্টাস (খাড়া মানব)। সমাজ ব্যবস্থার সূচনাটা এদের হাতেই; মানব জাতির অভিবাসনও বাড়ায় এরা। তবে শেষে এসেও চমক দেখায় হোমো স্যাপিয়েন্স (জ্ঞানী মানুষ)। এরা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে বাড়িয়ে তোলে মস্তিষ্কের ব্যবহার। আর সে বলেই ৪০ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা শুরু করে বাণিজ্য- তার পরে ব্যবসা; ১০ হাজার বছর আগে কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে সভ্যতা। এতে পরিবর্তন ঘটে মানুষের বৈজ্ঞানিক নামের; হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স (জ্ঞানী রুচিশীল মানুষ) হয় তখন। এসব তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খতা নিয়ে বির্তক থাকলেও বৈজ্ঞানিকদের মাঝে মতবিরোধ কম যে, বিবর্তনবাদ এক গতিশীল প্রক্রিয়া এবং তা অব্যাহত রয়েছে এখনো। সম্প্রতি পারমাণবিক জিন গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, আমাদের জৈবিক বিবর্তন চলমানই রয়েছে। দেখা গেছে, খাদ্যাভাসজনিত কারণে যেসব অঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বেশি যেখানে অতি ধীরে হলেও মানবদেহে এমন কিছু জিনগত পরিবর্তন আসছে যাতে কোলেস্টেরল, রক্তচাপ ও রক্তে চিনির পরিমাণ নিজে থেকেই কমে যায়! এদিকে কয়েকজন জৈব-সমাজ বিজ্ঞানী (বায়ো-সোশিওলোজিস্ট) লক্ষ্য করেছেন, বিভিন্ন দিকের মধ্যে মানুষের জীবনধারা তথা তার সামাজিক সম্পর্কের বিবর্তনই ঘটছে বেশি; বিশ্বজুড়ে মানুষ দ্রুত পরিণত হচ্ছে নগরবাসীতে। এমন মানুষের নতুন বৈজ্ঞানিক নামও ঠিক করে ফেলছেন তারা- হোমো আরবানাস অর্থাৎ নগরবাসী মানুষ। এদের কয়েকটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যও চিহ্নিত হয়েছে। নিতান্ত প্রয়োজনেও হোমো আরবানাস দ্রব্য বিনিময় প্রথায় যেতে চায় না। অথচ তারা শত্রুর সঙ্গেও শিথিল সম্পর্ক রাখে; অতীতের জ্ঞানী মানুষের মতো শারীরিক শক্তি প্রয়োগে লেগে পড়ে না।

বৈজ্ঞানিক ওই নামটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বিষয়ে নাকি কথা-বার্তা চলছে এখন। যদি সেটি সম্পন্ন হয়েই যায় আমাদের জন্য ভালো-মন্দ দুটো খবরই অপেক্ষা করছে সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে নগরায়ন। ফলে নামটি স্বীকৃতি পেয়ে গেলে আমাদের রাজধানী ঢাকা হোমো আরবানাসের অন্যতম বৃহৎ আবাসস্থল হিসেবে খ্যাতি পাবে। দুঃখজনক উত্তর আসবে, ‘সবচেয়ে বাসযোগ্য নগরী কোনটি’- প্রশ্নটি উঠলে। কী বলব আমরা? অনেক দেশের ‘জ্ঞানী মানুষ’কেই ‘নগরবাসী মানব’ হতে ‘জ্ঞানী ও রুচিশীল মানুষে’র ধাপটি পেরিয়েছে। সম্ভবত কোনোক্রমে ওটি ডিঙ্গিয়েই ‘নগরবাসী মানবে’ পরিণত হয়েছে আমাদের মতো কিছু ‘সৌভাগ্যবান’। আর তাই ভীড়ে নির্বিকারভাবে অন্যকে মাড়িয়ে যাই আমরা; মোবাইল ফোনে উচ্চস্বরে কথা বলি বাসে। পরমহংস কথাটাই ভাবার্থ- যাকে জগতের কোনো কিছুই ব্যাকুল করে তোলে না। এখানকার অনেক নগরবাসীই সে অর্থে পরমহংস! তারা যত্রতত্র ময়লা ফেলা বা ফুটপাথে মোটরসাইকেল তুলে দিতে গ্লানি অনুভব করেন না। রাস্তায় হকার দেখলে তাদের মনে হয়- ঠিকই আছে, এরা কী করবে? আবার পাঁচ টাকার জন্য রিকশাওয়ালা বা বাস কন্ডাক্টরের সঙ্গে তুলকালাম বাঁধানোর পরও ভাবলেশহীন হয়ে যায়। এ নগরের যানজট মনে হয় স্থান ও সময় নিরপেক্ষ; পূর্বাভাষের ধারধারে না। ঢাকার হোমো আরবানাস লোডশেডিংয়ে; গ্যাস-পানির দুর্ভোগ মাসখানেক অতিক্রম না করলে তারা ক্ষুব্ধও হন না সেভাবে। বছর শেষে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি বা সরকারি সেবা নিতে গিয়ে হয়রান হওয়াটাও তাদের জীবনে স্বাভাবিক বৈকি। কথা হলো, এভাবে আর কতদিন? নাকি হাইওয়েগুলোতে আরেকবার জ্যাম বাঁধিয়ে মাটির টানে কি গ্রামে ফিরে যাব আমরা? বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, সেটি সম্ভব নয়। উল্টো চলতি শতাব্দীতে দ্রুততর হবে নগরায়ন। তার কারণ- মানুষের অভাব অসীম ও সম্পদ সীমিত আর নগরে সম্পদ ব্যবস্থাপনা গ্রামের চেয়ে সার্বিকভাবে (পরিবেশ ইস্যু বাদ দিয়ে) আনুমানিক ২০ শতাংশ দক্ষ। আর তাই প্রাকৃতিক উৎস যে হারে ফুরিয়ে আসবে; নগরায়নও হবে যতটা দ্রুততর। এ অবস্থায় পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে নগর পরিকল্পনার ওপর নতুন করে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। জানি না, হোমো আরবানাসের কল্যানার্থে আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে ওই অবস্থানের খানিকটা নিচু থেকেও দেখতে পারছেন কিনা।

ফাহমিদা ফেরদৌস

ব্যয় ও শক্তি সাশ্রয়ী সংরক্ষণ

দুই পর্বতশ্রেণী হিমালয় ও কারকোরামের মাঝে এবং সিন্ধু নদের উঁচু উপত্যকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক লাদাখ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এখানে। গ্রীষ্মে গরমও থাকে মন্দ নয়। তবে শীতে মাঝে মধ্যেই তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের নীচে। ফসলের আবাদ কঠিন বলে শীতে লাদাখের ধান, গম, আলু, পেঁয়াজ ও শাকসবজির জোগানটা আসে বাকি সময়ে সংরক্ষিত ভাণ্ডার থেকে। প্রজন্মান্তরে এমন সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু রেখেছে তারা; যাতে গৃহেই বাঁধাকপি, মূলা, গাজরের সবজি রেখে দেয়া যায় ৫-৬ মাস পর্যন্ত। জমি থেকে এনেই ধুয়ে বাঁধাকপি রাখা হয় বাড়ির নীচতলায়; অন্ধকারাচ্ছন্ন কিন্তু মোটামুটি বাতাস চলাচলের উপযোগী স্থানে। ছত্রাকপ্রবণ সবজি পেঁয়াজ সংরক্ষিত হয় দড়িতে ঝুলিয়ে। বেশি পচনশীল সবজি লাদাখবাসীরা রাখেন মাটির নীচে; কম পচনশীলটি মেঝেতে ফেলে। এভাবে কিন্তু নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার কিছু দেশেও টমেটো সংরক্ষণ করা হয় মাসাধিককাল। মাটি থেকে তোলার পরও ওই টমেটো দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটা সংরক্ষিত ছিল। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগা সত্ত্বেও লাদাখের প্রান্তিক চাষীদের কাছে সবজি সংরক্ষণের এমন শক্তি ও ব্যয় সাশ্রয়ী পদ্ধতি আজও জনপ্রিয়। ভূগর্ভে টমেটো সং রক্ষণের এমন এক পদ্ধতির কথা জানা যায় নাইজেরিয়ার মতো আফ্রিকার কিছু দেশেও।

হিমাগার এবং আরও উন্নত পদ্ধতি চালু থাকার পরও প্রাকৃতিক উপায়ে সবজি সংরক্ষণের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসছে এজন্যও যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গোটা বিশ্বে লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে সবজি উৎপাদন এবং তার বিপরীতে জ্বালানি-বিদ্যুতের চাহিদা। এদিকে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত কেবল সংরক্ষণের অভাবেই অপচয় হচ্ছে বিপুল সবজি। এ ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়ী উপায় জানা না থাকায় আবার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বেশি। মাঝে মধ্যে কম দামে এসব বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। আর ভোক্তার? নিরুৎসাহিত হয়ে কৃষক সবজি উৎপাদন কমিয়ে দিলে পরবর্তী মৌসুমে ভোক্তাকে তা কিনতে হচ্ছে বেশি দামে; কিছু ক্ষেত্রে অযৌক্তিক দামে। আমাদের দেশে নাকি মোট উৎপাদিত শাকসবজির ২৫ শতাংশই বিনষ্ট হয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায়। গতকালের বণিক বার্তায়ও রয়েছে এমন খবর। অথচ শীতকালেই যে পরিমাণ শাকসবজি উৎপাদিত হয়, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া গেলে সারা বছর ধরে সেটি পরিভোগ কঠিন নয় বলে অনেকের ধারণা; যা করে দেখিয়েছে করছে মালয়েশিয়ার মতো অনেক দেশ। বড় কথা, দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সবজি সংরক্ষণের।

ভালো হতো, সারা দেশে সবজি (এর সঙ্গে ফলও থাকতে পারে) প্রক্রিয়াকরণ খোলা গেলে। এজন্য উন্নয়ন ও গবেষ্ণার ওপর জোর দিতে হবে। তাতে পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতও। অথচ এদিকে স্থানীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের নজর কমই বলে মনে হয়। সরকারের উচিৎ, এ বিষয়ে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেখা গেছে, গবেষণা ও উন্নয়ন সঠিক পথে চললে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে খাদ্য সংরক্ষণের প্রবণতাও কমে যায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের। হিমাগারের সংখ্যা বাড়িয়ে সবজি সংরক্ষণ করাটা কার্যকর কৌশল বলে বিবেচিত হতো, যদি দেশ জ্বালানি-বিদ্যুতের সংকটে না থাকত। বিদ্যামান প্রেক্ষাপটে এটি ভাবার সুযোগ কম। মনে হচ্ছে, এ অবস্থায় সার্বিকভাবে কৃষক পর্যায়ে সবজি সংরক্ষণের ওপর জোর দেয়াই ভালো। এ ক্ষেত্রে মধ্যসত্বভোগীরা যেন সাপ্লাই চ্যানেল নির্বিঘ্ন রাখতে পারেন সে দিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। প্রচলিত ব্যয় সাশ্রয়ী উপায়ে সবজি সংরক্ষণ বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে আসতে পারে এনজিও। এভাবে পল্লী কর্মসংস্থানেও নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে তারা।

ফাহমিদা ফেরদৌস

রাজা, নেতা আর সাধু

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৪৮ সালের জানুয়ারীতে; যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। ফোরম্যান জেমস মার্শাল তার কারখানার অদূরে নদীর পানিতে ভেসে আসা চকচকে ধাতুর সন্ধান পান। খবরটা জানান কেবল বস জন শাটারকে। দু’জনে মিলে পরীক্ষার পর নিশ্চিত হন ধাতুটা স্বর্ণই। একদম নিখাদ। বুদ্ধিমান শাটার জানতেন দশ জন জেনে গেলে পরিস্থিতিতে সামাল দেয়া কঠিন হবে। ফলে মার্শালের ওপর নির্দেশ জারি হয়, কাকপক্ষী যেন টের না পায়। কেউ না জানলেও এমন ঘটনা নিজের পক্ষে হজম করা শক্ত। তবে উচ্চাভিলাসী মানুষ ছিলেন না শাটার। আমেরিকান রিভারে পাওয়া স্বর্ণ ঘিরে তার কল্পনার দৌড় ছিল, এগুলো বেচে যে ডলার পাবেন, তা দিয়ে কয়েকশ’ একর জমি কিনবেন। চাষবাস করবেন সেখানে। ভালো কয়েকজন কর্মী পেলে গরু এবং ঘোড়ার খামার দেয়ার ইচ্ছাও আছে তার। ভবিষ্যৎ নিয়ে সলা-পরামর্শ চললো মার্শালের সঙ্গে। মার্শাল জানালো তার কয়েক বন্ধুকে। শত একর জমি কেনার পয়সা কোত্থেকে আসবে- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেরুলো নদীতে স্বর্ণ পাওয়ার খবর। শুরু হয়ে গেলো ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত গোল্ডরাশ।

গোল্ডরাশের স্পিরিট নানা দেশ-মহাদেশ ঘুরে এখন এশিয়ায়; আরো সুনির্দিষ্ট অবস্থান- আমাদের প্রতিবেশী ভারতের উত্তর প্রদেশে। না, সেখানে নদীর তীরে স্বর্ণের তাল পান নি কেউ। খবর চেপেও রাখতে হয় নি। দণ্ডিয়া খেরা গ্রামের সাধু শোভন সরকার স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছেন তার আশ্রমের মাটির তলায় হাজার টন স্বর্ণ মজুত! স্বপ্নে নানা কিছু বাংলাদেশের কিছু ধ্যানী ব্যক্তিও পান। অবশ্য সে প্রাপ্তি অধিকাংশ সময় ধন্বন্তরী ওষুধ ও ধাতু মিশ্রণের অভূতপূর্ব ফর্মূলা ঘিরেই। মাঝে মাঝে কলস-দু’কলস স্বর্ণের স্বপ্ন দেখলেও তার সঙ্গে ইতিহাসের যোগসূত্র এখানে তেমন দেখা যায় না। ওদিক থেকে শোভনের স্বপ্ন বস্তু ঘনিষ্ঠ ও আধুনিক। তার ওপর অর্থনীতির ছোঁয়া আছে। হাজার টন স্বর্ণের বাজার মূল্য তো কম নয়। ওগুলোর ঐতিহাসিক মূল্যও যোগ করতে হবে তার সঙ্গে। একবারে না হলেও আন্তর্জাতিক নিলাম কেন্দ্রগুলোয় ধীরে ধীরে তোলা হলে, সুযোগ মতো বড় দানও মারা যাবে।

শোভন সরকারকে স্বপ্নে এ স্বর্ণের খোঁজ দিয়েছেন রাও বক্স সিং। তিনি ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হন। এত বছর পরে রাও বক্স কেন স্বর্ণের খোঁজ দিলেন তা একটা প্রশ্ন বটে। হয়তো যোগাযোগের ভালো উপায় তিনি পান নি এতদিন। কিংবা তার ভয় ছিল, স্বপ্নে বলে দিলেন আর ওই ব্যক্তি নিজ স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যবহার করলো স্বর্ণ। আরেকটি সম্ভাবনাও কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না। হয়তো কোনোভাবে ভারতের স্বর্ণ চাহিদা ও বাজেট ঘাটতির নিয়ে নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ টের পেরেছেন তিনি।

সমৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তা অবশ্য উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদবেরও কম নেই। রাজ্য উন্নয়নের চিন্তায় তার ঘুম হারাম হয়ে যাবার জোগাড়। ফলে গোপনে নাকি তিনি দেখাও করেছেন শোভন সরকারের সঙ্গে। একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, রাও বক্স সিংয়ের স্বর্ণ রাজ্যের উন্নয়নে গেলে আপত্তি নেই শোভনের। এদিকে গ্রীন সিগন্যাল পেয়েই খোন্তা-কোদাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ও জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। আর পুরো ঘটনা চোখে চোখে রাখছে কেন্দ্র সরকার। তবে নিছক স্বপ্নাদেশ নয়। ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও আছে কিছু। স্বপ্নে ভুল করে হাজার টন বলে বসতে পারেন রাও বক্স। ঘুমের ঘোরে শুনতে ভুল হতে পারে শোভন সরকারেও। হাজার না হোক, শত- এমনকি অর্ধশত টন স্বর্ণও যদি ওঠে মাটির তোলা থেকে খারাপ কী? অর্থনৈতিক দিক থেকে মন্দ না। সমস্যা একটা আছে, তা রাজনীতি ঘিরে। ধরা যাক, স্বর্ণ পেয়েই কেন্দ্রীয় নির্বাচনে যোগ দিতে চাইলেন অখিলেশ সিং যাদব। কিংবা শোভন সরকার বলে বসলেন, টেকনোক্র্যাট একটা মন্ত্রীত্ব তার চাই-ই চাই। তখন? ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক অভিলাষ তো অনেকখানেই দেখা যায়।

ফাহমিদা ফেরদৌস

From 2011-15

সুচির সামনে সুযোগ

সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা অনেক দেশেই রয়েছে। দীর্ঘকালীন সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতাও কম নয়। তারপরও এ ক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম মিয়ানমার। কারণ এ দেশটির মতো মোটামুটি সফল সামরিক শাসনপন্থা থেকে গণতন্ত্রের প্রতি ঝোঁকার নাটকীয়তা অন্যত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

গোড়া থেকেই বিশেষত পশ্চিমা দেশের চাপ সহ্য করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরাসরি ক্ষমতায় ছিলেন বহুদিন। এভাবে ক্ষমতায় থাকার প্রধান কারণ ছিল- মিয়ানমার-চীন সম্পর্ক ও দেশটির বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। মজার বিষয় হলো, ১৯৪৯ সালে যখন কমিউনিস্ট পার্টি চীনের ক্ষমতায় বসল, তখন দুই প্রতিবেশির মধ্যে সম্পর্ক ছিল অনেকটাই বৈরী। এর মধ্যে মিয়ানমারে এলো সামরিক শাসন; অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠতে লাগল চীন। প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের জ্বালানি চাহিদা বাড়ছিল তখন। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যের বাজার থেকে অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রও কিনতো জ্বালানি। তবে চীনের উত্থান টের পেয়েই বোধকরি মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে নিজেদের আধিপত্য ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে মার্কিনীরা। বাধ্য হয়ে চীন জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে ইরানের মতো দেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কম, সেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ায়। এ জ্বালানির ৮০ শতাংশ তখন আসতো মালাক্কা প্রণালী হয়ে। যাতে প্রতিপক্ষ হিসেবে তার অবস্থান শক্ত করতে না পারে সে লক্ষ্যে চীনের ওপর চাপ বাড়াতে মালাক্কা প্রণালীর নিকটবর্তী ইন্দোনেশিয়ার আচেহ দ্বীপে সামরিক উপস্থিতি বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। ততদিনে সামরিক শাসন জেঁকে বসেছে মিয়ানমারে। ক্ষমতায় আসা এ জেনারেলরা রাজনীতিকদের চেয়ে বেশি বাস্তজ্ঞান রাখতেন। তারা বুঝেছিলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে বাইরের সহায়তা লাগবেই। এ দিকে চীন তখন চাইছে যেকোনো উপায়ে তার জ্বালানি তেলের রুট নির্বিঘ্ন করতে। এতে পুরনো আবেগ ভুলে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে দু’দেশের মধ্যে। ১৯৮৯ সালে নামমাত্র মূল্যে মিয়ানমারকে আনুমানিক ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দেয় চীন। বন্ধুত্ব হওয়ার পর চীন দেখলো, মার্কিনীদের চাপ ঠেকানোর ক্ষমতা ছাড়াও অনেক গুণ রয়েছে তার বন্ধুর; খনিজ, বনজ ও মৎস সম্পদে ভরপুর এ দেশটি। এতে কয়েক দশকে মোটামুটি দ্রুতই মিয়ানমারের বিভিন্ন খাতে বাড়ছিল চীনা বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় দেশটির জেনারেলরা উপলব্ধি করলেন কিছু পরে। তারা দেখছিলেন, বন্ধু চীনের প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে, প্রচুর চীনা বিনিয়োগ সত্ত্বেও মিয়ানমারের চেহারে তেমনভাবে ফিরছে। তাছাড়া একমাত্র বন্ধু হওয়ায় মাঝেমাঝেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনোপলির সুযোগ নিতে চাইছে দেশটি; বোঝানোর চেষ্টা করছে চীন ছাড়া মিয়ানমার অচল। অথচ তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে বিভিন্ন দেশ। সমস্যা হলো, ওইসব দেশ গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া অন্যদের সঙ্গে অর্থনৈতিক-কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে অনিচ্ছুক। এসব নানা দিক হিসাব-নিকাশের পর মিয়ানমারের জেনারেলরা সিদ্ধান্ত নিলেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন; তবে তার ওপর সামরিক শক্তি যাতে ছড়ি ঘোরাতে পারে সে ব্যবস্থাও রাখা হবে। তার ধারাবাহিকতায় জাতীয় নির্বাচনের ডাক দিলেন তারা। একে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে মুক্তি দেয়া হলো ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসীর (এনএলডি) নেত্রী অং সান সুচিসহ অনেক রাজনৈতিক বন্দীকে। তবে নির্বাচনটি সাজানো বলে মন্তব্য করে, এতে যোগ দিলেন না সুচি।

সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে কয়েকটি আসন খালি হয়েছে। এ জন্য স্বাভাবিকভাবেই ডাকা হয়েছে উপনির্বাচন। খুশির খবর হলো, এতে অংশ নিতে এনএলডির বাতিল হয়ে যাওয়া নিবন্ধন এরই মধ্যে নবায়ন করেছেন সুচি। আসলে তিনি উপলব্ধি করেছেন, আবেগ দিয়ে রাজনীতি চলে না; ফলে যতটা সুযোগ পাওয়া যায় তার মধ্যে দিয়েই মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাতে হবে। তবে জেনারেলরা দেশটিকে এখনই পূর্ণ গণতন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেবেন বলে মনে হয় না। তা সত্ত্বেও আপাতত যে সুযোগটি মিলেছে এর সঙ্গে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক সহায়তাকে সমন্বয় করা গেলে আসছে দশকে মিয়ানমারে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে না আপোষহীন, সংগ্রামী ও জনপ্রিয় সুচির পক্ষে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

সেলাই ছাড়া পোশাক-আশাক!

নতুন কাপড় থেকে সেলাইয়ের সুতা বেরিয়ে আসার ঘটনা জীবনে একবারও ঘটে নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কথা-বার্তা নেই, সেলাই ফেঁসে গেলো এমন অভিজ্ঞতাও বিরল। সেলাইহীন চামড়া পরার বিকল্প ছিল না প্রস্তর যুগে। এর পর মানুষ কৃষিকাজ শিখল। শিখল কাপড় উৎপাদন ও বুনন। কাপড়ের টুকরা সেলাই করে জোড়া দিয়ে পোশাক তৈরি জনপ্রিয় হয়নি তখনই। সে সময় সেলাইয়ের প্রয়োজনটা ছিল পোশাককে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে ও সামরিক ক্ষেত্রে পোশাকের সঙ্গে বর্মের মতো উপকরণ জুড়ে দিতে। শীতপ্রধান দেশে পশু চামড়া পোশাক হিসেবে ব্যবহার করতেও লাগত সেলাই। এসবের বাইরে তৎকালীন সভ্যতাগুলো যেমন মিশর, ইরাক, ইরান, আমেরিকা ও ভারতে সাধারণ মানুষের পরিধেয় বস্ত্রে সেলাই দেখা যায় না তেমনভাবে। তার একটি বড় কারণ ছিল, সেলাই করা পোশাক আঁটোসাঁটো; পড়তে সেলাইহীন পোশাকের চেয়ে আরামদায়ক নয়। সেলাইকর্ম সূচিশিল্পে পরিণত হয় মধ্যযুগে; যখন প্রয়োজনের চেয়ে পোশাক হয়ে ওঠে ফ্যাশনের বস্তু। এরপর গত কয়েক শতাব্দীতে সেলাই করে পোশাক বানানোই জনপ্রিয় হয়ে পড়ে ক্রমে। এতে সেলাই ছাড়াও যে জামা-কাপড় তৈরি করা যায়, সেটি আমরা ভুলে গেছি যেন! সেলাইহীন পোশাকের চল পুনরায় বেড়ে উঠেছে অগ্রসর দেশগুলোয়। সেলাইহীন টি-শার্ট, জার্সি থেকে আন্ডার গার্মেন্ট সেখানে হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। আমাদেরও আনন্দের খবর রয়েছে এ ক্ষেত্রে। সম্প্রতি দেশেই চালু হচ্ছে সেলাইবিহীন পোশাক তৈরির মেশিন বলে খবর রয়েছে বণিক বার্তায়।

সেলাইহীন পোশাকের ক্ষেত্রে কয়েকটি কাপড়ের টুকরা অ্যাডহেসিভ সহযোগে আল্ট্রাসাউন্ডের সহায়তা জুড়ে দেয়া হয়। তবে এ দেশে আল্ট্রাসাউন্ডের বদলে ব্যবহৃত হবে তাপ। তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের দেশে বেশ শ্রমঘন। এ অবস্থায় কেউ কেউ আশংকা প্রকাশ করছেন, মেশিনটি জনপ্রিয় হয়ে পড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যেতে পারে। তবে তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। কারণ জার্সি ও আন্ডার গার্মেন্ট সেলাই ছাড়ার তৈরি করা গেলেও, উন্নত প্রযুক্তির কারণে এসব পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের নির্ভর করতে হবে বিদেশী অর্ডারের ওপর। সেটি পাওয়া সহজ হবে না। প্রচলিত প্রযুক্তিতে তৈরি পোশাক উৎপাদনে আমাদের বিশেষ সুবিধা ছিল- সস্তা শ্রম। উন্নতর প্রযুক্তিতে যে এমন সুবিধা পাওয়া যাবে না, তা মাথায় রাখা প্রয়োজন। এ অবস্থায় সাময়িক সমাধান হতে পারে স্থানীয় বাজার। তবে এখনো প্রাথমিক ও মাঝারি মানের আন্ডার গার্মেন্ট তৈরি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্য স্থানীয় বাজারে চালাতেও কষ্ট করতে হবে অনেক। তবে আমাদের ক্রীড়ামোদীদের জন্য বাজারে জার্সি ছাড়া হলে, সেটি ভালোই চলবে বলে আশা করা যায়। কিছুদিন পর শুরু হবে বিপিএল। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে সেলাইহীন জার্সি সরবরাহ করতে পারেন উদ্যোক্তারা। স্থানীয় বাজারের মনোভাব পরোক্ষভাবে যাচাই হয়ে যাবে এতে। কোনো কারণে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে না পারলে, এ অভিজ্ঞতা কাজে দেবে। সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে স্থানীয় বাজারে চালাতে চাইলে, এসব পণ্যের মান ধরে রেখে দাম রাখতে হবে সাধ্যের নাগালে। অগ্রসর দেশে জার্সি সাধারণত ড্রাইওয়াশ ও কাপড় পরিষ্কারের অন্যান্য কম ক্ষতিকর পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এ দেশে কাপড় পরিষ্কারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় (সেটি হোক জার্সি, আন্ডার গার্মেন্ট বা অন্য কিছু) কড়া ডিটারজেন্ট। নিম্নমানের সাবান দিয়েও পরিষ্কার করা হয় পোশাক। অনেক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা জামা-কাপড় ভিজিয়ে রাখা হয় সাবান-ডিটারজেন্টের পানিতে। অনিয়ন্ত্রিত গরম পানির ব্যবহারও রয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। এমন অবস্থায় জার্সিতে ব্যবহৃত অ্যাডহেসিভ অকার্যকর হয়ে পড়লে, ড্রাইওয়াশ করালেন না কেন বলে- ভোক্তাকে অভিযুক্ত করা কঠিন। বরং এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুতকারীদেরই নিশ্চিত করতে হবে পোশাকের নির্ভরযোগ্য অ্যাডহেসিভ।

ফাহমিদা ফেরদৌস

ইতিহাস, শিল্প ও বিজ্ঞানে মুদ্রা

সামাজিক বিজ্ঞানের একটি উপশাখা হলো নুমিসম্যাটিকস। এর অধীত বিষয়, বিনিময়ের যেকোনো মাধ্যম। হোক তা কাগুজে নোট, মেটাল কয়েন বা বিটকয়েন (ডিজিটাল পয়সা)। সিগারেটসহ কিছু ‘সুলভ’ কিছু মাদকদ্রব্যের বিশেষ কয়েকটি ব্যবহারও নুমিসম্যাটিকসের অন্তর্গত। অবাক হওয়ার কিছু নেই। জেলখানার ‘অর্থনৈতিক কর্মকান্ড’ তথা দ্রব্য বা সেবার বিনিময় মাধ্যম হিসেবে এসব বস্তুর ব্যবহার রয়েছে বলে এগুলো নুমিসম্যাটিকসের অংশ। ‘নুমিসম্যাটিকস’ শব্দটিকে ফরাসী ধরা হলেও এটি মূলত মৃত ল্যাটিন। এর উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে; গ্রীক দ্বীপ অ্যাজাইনাতে। নুমিসম্যাটিকসের মাতৃশব্দ নোমসমাস। এটিকে আদতে শব্দ নয় বাক্যাংশ (ফ্রেজ), মূল ল্যাটিনে যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘আই ডিসপেন্স, ডিভাইড, অ্যাসাইন, কিপ অ্যান্ড হোল্ড’; অর্থাৎ আমি বন্টন করি, বিরোধ ঘটাই এবং নির্দেশ, সুরক্ষা ও আশ্রয় দেই। মুদ্রার এমন গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না।

কত বিচিত্রই না একেকটি মুদ্রার ইতিহাস! পরাক্রমশালী রোমান সেনাপতি জুলিয়াস সীজার বিপদে পড়েছিলেন ফ্রান্স অভিযানে গিয়ে। সিজার নিজেই বলতেন, সেখানে প্রায় হারতে বসেছিলেন তিনি। ফ্রান্স সংগঠিত দেশ নয় তখনো। ব্রিটেন জয়ের পর সিজারের ধারণা হলো, এটি আক্রমণ করি না কেন। শুরুর দিকে প্রায় বিনা বাধায় ফ্রান্সের খানিকটা অংশ জয় করলেনও। তবে এর পরই বাধা এলো ভারসিংগেটরিক্স নামে এক তরুণ গ্যল নেতার কাছ থেকে। গ্যলদের সঙ্গে ওই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সিজার জয়লাভ করেছিলেন বটে। তবে রোমান সেনাবাহিনী হতোদ্যম হয়ে পড়ে গ্যলদের সঙ্গে যুদ্ধে। সিজারও রোমে ফিরে শক্তি সঞ্চয়ের পর পুনরায় মনোযোগী হন সামরিক অভিযানে। ভারসিংগেটরিক্সের নৈপূণ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন সিজার। অবশ্য তার ফাঁসির আদেশ দেয় রোমের সিনেট। তারপর যে কারণেই হোক ভারসিংগেটরিক্সের নামে মুদ্রা চালু করেন জুলিয়াস সীজার। তার মৃত্যুর পর সিজারবিরোধীরা বাতিলও করে মুদ্রাটি। তবে কয়েকটি ফরাসি জাদুঘরে আজও সংরক্ষিত আছে ভারসিংগেটরিক্সের নামাঙ্কিত মুদ্রা।

ফরাসিদের সম্বন্ধে বলা হয়, এরা যেকোনো বস্তুকে বাইফোকাল লেন্স দিয়ে দেখে। একটি লেন্স ইতিহাস ও শিল্পকলার; অন্যটি বৈজ্ঞানিক (অধিকাংশ সময়ে গাণিতিক)। এ প্রেক্ষাপটে ফরাসিদের মুদ্রা প্রদর্শনীর বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। তাদের জাদুঘরগুলোয় মুদ্রা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এ সম্পর্কিত ইতিহাস যেমন লেখা থাকে তেমনি আগ্রহীদের জন্য মুদ্রার নানা বৈজ্ঞানিক দিকও তুলে ধরার চেষ্টা থাকে। এতে যিনি ইতিহাস পছন্দ করেন তার কাছে প্রদর্শনীকে আকর্ষণীয় মনে হয়; আবার বিজ্ঞানমনষ্করাও আগ্রহ হারান না। অনেক ফরাসি মুদ্রা প্রদর্শনীতে নাকি টস করে জাল মুদ্রা নির্ণয়ের ‘বার্নুলি ট্রায়াল’ শেখানো হয়; বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ইউলারের ‘ফিনাইট-টাইম সিঙ্গুলারিটি’ও (তত্ত্বটি ‘বিগ ব্যাং’ থিওরি রচনায় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে অনুপ্রাণিত করেছিল) শেখানো হয় সংক্ষিপ্তাকারে। ঐতিহাসিক বস্তু প্রদর্শনকালে সেটির রেপ্লিকাসহ সিডি-ডিভিডি-বুকলেট বিক্রয় ফরাসি সংস্কৃতিতেও পরিণত হয়েছে এরই মধ্যে।

সম্প্রতি রাজধানীস্থ জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক মুদ্রা প্রদর্শনী। বেশ কয়েকদিন ধরে চলবে এটি। এতে দেখানো হচ্ছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ধাতব ও কাগুজে মুদ্রা। এমন উদ্যোগের প্রশংসা না করে উপায় কী? স্থানীয় ইতিহাস এতটা সহজে জানবারই বা সুযোগ কোথায়? তবে নতুন প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে যুক্ত করে একে আরও কার্যকরের পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে আয়োজকরা রাজধানী ও রাজধানীর আশেপাশের স্কুল থেকে শিশুদের এখানে আনার ব্যবস্থা করতে পারেন। অবশ্য স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকেও নেয়া যেতে পারে এমন উদ্যোগ। এটি করা গেলে শিশুরা সহজে ও স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা নিতে পারবে। এর সঙ্গে পরবর্তী মুদ্রা প্রদর্শনীতে রেপ্লিকা মুদ্রা রাখা যায় কিনা, সেটিও ভাবা যেতে পারে। তাতে ইতিহাস সম্বন্ধে মানুষের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা যাবে; বাণিজ্যও হবে খানিকটা।

রুয়াইদা হাসান

গল্পের ঘোরে বেহেড

জোর-জবরদস্তিমূলক নীল চাষের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় ঢাকায়। মঞ্চে আলোক সম্পাত ছিল অপ্রতুল; শব্দ ব্যবস্থাপনাও ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের। তা সত্ত্বেও উপস্থিত ছিলেন বহু দর্শক; যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্থানীয় কৃষকের ওপর ব্রিটিশদের বর্বর নির্যাতনের দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল নাটকের এক পর্যায়ে। নিবিষ্ট মনে সেটি দেখছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। দেখতে দেখতে বাস্তবজ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়লেন তিনি। চিৎকার করে উঠলেন; জুতা ছুড়ে মারলেন নীলকরের ভূমিকায় অভিনয়কারীর মুখে। ঈশ্বরচন্দ্র যথেষ্ট যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তবুও নাটকটির দৃশ্যায়ন তাকে এতোটাই আন্দোলিত করে যে কল্পনা ও বাস্তবতাকে মিলিয়ে ফেলেন তিনি। যার পরিণাম- ওই ‘দুর্ঘটনা’।

গল্প শুনে ও সেটি বিশ্বাস করে এমনটি ঘটানোর নজির আরও রয়েছে। এ নিয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। তাতে দেখা গেছে কিছু মানুষের অদ্ভূত ক্ষমতা রয়েছে। গল্প শুনিয়ে মানুষকে আচ্ছন্ন করতে পারেন তারা। আর যিনি সম্মোহিত অবস্থায় চলে যান, পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা ভুলে যান তিনি; ওই গল্পকেই ‘প্রকৃত বাস্তব’ মনে হয় তার কাছে। মনোবিজ্ঞানে এ ক্ষমতার নাম দেয়া হয়েছে রিয়েলিটি ডিস্টর্টিং পাওয়ার। মজার বিষয়, কিছু গবেষক দেখেছেন এটি সহজাত হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আবার সরাসরি সংস্পর্শে না থেকেও বিপুল মানুষকে প্রভাবিত করতে কাউকে কাউকে অর্জনই করতে হয় এটি। যেমন রাজনৈতিক নেতা, সাধু-সন্ন্যাসী, গল্প লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক প্রভৃতি।

এমন ব্যক্তিরা সৃষ্টি করতে পারেন রিয়েলিটি ডিস্টর্শন ফিল্ড। ফলে এরা কিছু বললে, তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। এতে মনে সৃষ্টি হয় এক ধরনের ‘ডিপ ইমপালস’ বা গভীর অনুপ্রেরণা। এটি মানুষকে স্বতঃপ্রণোদিত করে তোলা ভালো-মন্দ, নিরপেক্ষ বিভিন্ন কাজে। মানসিকভাবে এসব ‘উদ্দীপ্ত’ মানুষ সমাজের উপকার করবে না ক্ষতিকর- সেটি নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। এক শ্রেণীর ‘উদ্দীপ্ত’ মানুষ সুখানুভব করেন অপরকে কষ্ট দিয়ে; অন্যরা নিজেকে বঞ্চিত করে, কষ্ট দিয়ে। রিয়েলিটি ডিস্টর্শন ফিল্ডের প্রভাবে যারা সম্মোহিত হন তারা এ থেকে বেরুতে পারেন না সাধারণত। গল্প তথা কল্পনাই তাদের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় তখন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ব্যাটমান সিরিজের তৃতীয় ও সর্বশেষ ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’ ছবির প্রদর্শনী চলাকালে মুখোশধারী এক আততায়ীর গুলিতে নিহত ও আহত হন বেশ কয়েকজন। এ ঘটনায় নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখেছেন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিক্যান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামা ও মিট রমনি; অনেকের বিমূঢ়তা কাটে নি এখনো। শুরতে কারও কারও শঙ্কা ছিল, আততায়ীর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্ক রয়েছে কিনা। এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তেমন কিছু নয়; নিজেকে ব্যাটম্যান সিরিজের ভিলেন ‘জোকার’ ভেবেছিলেন আততায়ী। জোকার যেমন খুন বা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বলত, হোয়াই সো সিরিয়াস, সান- তারও এমনটি বলার ইচ্ছা ছিল। তবে ‘দুর্ভাগ্য’ ডায়ালগটি দেয়ার আগেই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

কেউ কেউ বলছেন, এ ঘটনায় বিরাট ক্ষতি হয়ে গেলো পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের (ছবিটির প্রযোজনায় যুক্ত আছেন তিনি)। কলোরাডোর ঘটনায় অনেক দেশেই ছবিটির প্রিমিয়ার স্থগিত রাখা হয়েছে এরই মধ্যে। তবে অনেকের ধারণা, এটি নোলানের এক ধরনের সাফল্যও। গল্প শুনিয়ে মানুষকে সম্মোহিত করতে পেরেছেন তিনি। অবশ্য ঘটনাটির নিন্দাই জানিয়েছেন সবাই। দোষীর বিচারের পাশাপাশি মার্কিন তরুণ সমাজের সাইকি পরিবর্তনে এসব ছায়াছবি কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে জোর গবেষণা চালানোর কথাও বলা হচ্ছে। তারা দেখতে চাইছেন, মানুষ সর্বোচ্চ কতটা রিয়েলিটি ডিস্টর্শন পাওয়ার অর্জন করতে পারে। আর ওই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে গল্পের ঘোরে বেহেড মানুষকে ক্ষতিকর কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা যায় কিনা।

ফাহমিদা ফেরদৌস

নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে নকিয়া!

ফিনিশ প্রতিষ্ঠান নকিয়ার যাত্রা ১৮৬৫ সালে। কোম্পানীটি ১৯৭০’র দশকে তৈরি করে প্রথম নেটওয়ার্কিং ডিভাইস নকিয়া ডিএক্স২০০। সাড়া জাগাতে পারে নি সেটি। ১৯৯২ সালে বিক্রির হিড়িক পড়ে যায় প্রথম জিএসএম সেলফোন নকিয়া১০১১ বাজারে এলে। তবে প্রতিষ্ঠানটি অভূতপূর্ব সাড়া পায় নকিয়া ১১০০ মডেলে। এটি দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেক সেলফোন ব্যবহারকারীরই প্রথম ফোনোসেট; বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রিত সেলফোনের মডেলও নাকি এ ১১০০। এ মডেলটির সঙ্গে সঙ্গে সেলফোনের বাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে নকিয়া। এখনো প্রায় লক্ষাধিক মানুষ কাজ করছে এতে। তারা ফোনসেট বিক্রি করছে ১৫০টি দেশে। এরই মধ্যে পরিবেশ দূষণ রোধে ইতিবাচক ভূমিকার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও লাভ করেছে তারা; পেয়েছে এনার্জি স্টার (অনেকের মতে এটি শক্তি বা জ্বালানি দক্ষতা নির্ণয়ের সর্বোচ্চ মানদণ্ড) সার্টিফিকেট। তারপরও বিশেষত বছরদুয়েক ধরে নকিয়া তেমন সুবিধা করতে পারছে না বাজারে। কর্মী ছাটাই অব্যাহত রয়েছে; বন্ধ করা হয়েছে অনেক আউটলেট। নামছে হেলসিংকি, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নকিয়ার শেয়ারদর। স্পষ্টত নানা পদক্ষেপ নিয়েও লোকসান থামানো যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলেন, তার কারণ মূল সমস্যার দিকে নজর দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।

প্রথম সমস্যা হলো, ব্যবসা বেশি বড় হয়ে পড়ায় খুঁটিনাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই দৃষ্টি দিতে পারছে না নকিয়া। ১৯৯০’র দশকে সেলফোনের বাজারে আসার পর তাদের দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সনি-এরিকসন, সিমেন্স ও মটোরোলা। পরবর্তীতে নকিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে সিমেন্সের; গড়ে তোলা হয় নকিয়া-সিমেন্স নেটওয়ার্ক নামের যৌথ উদ্যোগ। এরই মধ্যে নকিয়ার বাজার বাড়ছিল; ধীরে ধীরে কমছিল মটোরোলা ও সনি-এরিকসন সেলফোন বিক্রি। তখন স্যামসাং মোবাইলস বাজারে এসেই প্রধানত বাহারী স্মার্টফোন দিয়ে এক রকম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় নকিয়ার সামনে। তবে এদিকে দৃষ্টি দেয়ার আগেই ২০০৭ সালে বাজার মাত করে তোলে আইফোন। উচিৎ ছিল, অ্যাপলের সঙ্গে শত্রুতায় না গিয়ে স্যামসাংয়ের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। তা না করে আইফোনের গায়ে দাঁত বসাতে গিয়েই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় নকিয়া। অ্যাপলের বাজার বাড়তে থাকে; যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপে সংকুচিত হয় নকিয়ার বাজার। তার স্থান দখলে এগিয়ে আসে স্যামসাং।

নকিয়ার দ্বিতীয় সমস্যা, ‘বন্ধু’ মাইক্রোসফট। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে উইন্ডোজ ফোন তৈরির চুক্তি হয় ২০১১ সালে। তবে প্রায় সব বাজারেই কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে ব্যর্থ হয় নকিয়া লুমিয়া। নকিয়া মোবাইলসের ওপর আগেই ছিল মাইক্রোসফটের নজর। এ ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও রয়েছে। মাইক্রোসফট নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে নকিয়াকে বিপদে ফেলে দিয়েছে যাতে কম দামেই কেনা যায় এটিকে। এর সত্যতা জানার উপায় নেই। অবশ্য নকিয়া মোবাইলস কিনতে দুইবার প্রস্তাব দেয়া হয় মাইক্রোসফটের পক্ষে থেকে। তৃতীয় সমস্যা, নকিয়া সিমেন্স নেটওয়ার্ক কেলেংকারি। এ প্রতিষ্ঠানটি নাকি ইরানের বাজারে নকিয়া মোবাইলসকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে স্থানীয় বৃহত্তম সেলফোন অপারেটরের কাছে বিক্রি করে সিপিআই প্রযুক্তি। এর সহায়তায় নজরদারী থেকে শুরু করে সেলফোন ব্যবহারকারীর তথ্যও পরিবর্তন করা সম্ভব। ঘটনাটি ফাঁস হয়ে পড়লে দ্রুত পড়তে থাকে বিশেষত নকিয়া স্মার্টফোনের বিক্রি। অনেক ক্রেতাই ভুল ধারণা পোষণ করতে থাকেন- নকিয়া কিনলেই প্রাইভেসী থাকবে না।

প্রশ্ন হলো, এমন পরিস্থিতি আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা নকিয়া? পারলেও কেমন সময় লাগবে? অনেকে মনে করেন, দুটি পথে হৃত বাজার পুনুরুদ্ধার করতে পারে নকিয়া। এক. স্যামসাংয়ের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে গিয়ে। দুই. উইন্ডোজ মোবাইল দিয়ে বাজার মাত করার আশা পরিত্যাগ করে অ্যান্ড্রয়েড সেলফোন উৎপাদনের মাধ্যমে। এর জন্য সময় লাগবে কিছুটা। নকিয়ার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ‘যেভাবেই’ হোক বছরখানেকের মধ্যেই পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে নকিয়া। এ প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সংশয় অবশ্য রয়েছে কারও কারও।

ফাহমিদা ফেরদৌস

বিবর্তনের ধারায় টেলিভিশন

রোববারের বণিক বার্তায় খবর রয়েছে, দেশে সিআরটি টেলিভিশন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ অর্থনৈতিক বিবর্তনে (মানুষের চাহিদার প্রেক্ষিতে) অভিযোজন ঘটাতে পারছে না এটি; ক্রমেই পরিণত হচ্ছে অলাভজনক প্রযুক্তিতে। এর স্থান করে নিচ্ছে এলসিডি-এলইডি-প্লাজমা টিভি। এতদিন সিং ভাগ সিআরটি আমদানি করা হতো মালয়েশিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের একটি বন্ধ হয়েছে মার্চে। আরেকটি সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যবসা গুটাবে বলে ঘোষণা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে সিআরটি উৎপাদন করা হয়তো যেতো। কিন্তু এ দেশেও সিআরটি টিভির জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে। নতুন প্রজন্ম ঝুঁকছে এলসিডি-এলইডি-প্লাজমা টিভি কেনায়।

ডারউইন বলেছিলেন, প্রকৃতিতে টিকে থাকে কেবল যোগ্যতমই। দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের এ তত্ত্বটি প্রাযুক্তিক বিবর্তনেও প্রযোজ্য। রঙ্গিন সিআরটি টিভির এক রকম ভক্তই ছিল ১৯৮০-৯০ দশকের প্রজন্ম। এদিকে রুচির বিবর্তনে একবিংশ শতাব্দীতে এসে ধীরে ধীরে সরে পড়ছে এটি। স্লিম ও ফ্ল্যাট এলসিডি-এলইডির সামনে টিকতে পারছে না পুরনো যুগের মোটা, ভারী ও বেশি জায়গা দখলকারী সিআরটি। আরও কয়েকটি কারণে রয়েছে সিআরটি টিভির এমন প্রস্থানের। টিভিতে যে ধরনের কাচ ব্যবহৃত হয়, সেটি বাঁকিয়ে ৩০ ইঞ্চির বেশি ডিসপ্লে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। তার মানে, এ দৈর্ঘ্যের বেশি সিআরটি মনিটর বানানো যায় না। এদিকে সাম্প্রতিককালে ৩০ ইঞ্চির বেশি টিভি না থাকাটাই অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিমুখতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। সিআরটি থেকে উচ্চমাত্রার তরঙ্গ বিকরিত হয়, যেটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপর এ ধরনের টিভির গড় আয়ু কম। নিকট অতীতে বিদ্যুতের নতুন সংযোগ নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হতো। তবে লোডশেডিং নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না; টিভিতে কতটা বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে সেদিকেও দৃষ্টি ছিল না অধিকাংশেরই। এসব বিবেচনায় কিন্তু সিআরটির চেয়ে উপযুক্ত এলসিডি-প্লাজমা টিভি। আরেকটি বিষয় রয়েছে। তাহলো, পরিবেশ সচেতনতা। সিআরটির যুগে বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও পণ্যের পুনঃব্যবহারযোগ্যতা- এসব শব্দের ব্যবহার ছিল না তেমন। ফলে সিআরটির পুনঃব্যবহারযোগ্যতা আছে কিনা বা এর ইলেক্ট্রন গান বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি করছে না- কে ভাবতেন! আর এখন প্রযুক্তিপণ্য কিনতে গেলে অনেকে প্রথমেই বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে- এ টিভি-ফ্রিজ পরিবেশবান্ধব তো?

এসব সত্ত্বেও কিছু কিছু মানুষের মন থেকে কখনোই হারিয়ে যাবে না স্মৃতিময় সিআরটি টিভি। তাদের কাছে আসলে টিভি বা রঙ্গিন টিভি বলতে তো তা-ই। অবশ্য ভাষার বিবর্তনের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে, অধিকাংশ মানুষ এখনো টিভি বলতে সিআরটি ডিসপ্লেকে বুঝে থাকেন। বলার সময় তারা সিআরটিকে এমনভাবে উল্লেখ করেন যাতে মনে হয় এলসিডি-প্লাজমা, টিভি নয়- ভিন্ন কিছু। ফলে বাজার থেকে হারিয়ে গেলেও সিআরটি রয়ে যাবে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের অমোচনীয় চিহ্ন। এর থাকাটা কেমন হবে, সে বিষয়ে অনুমান করা যায়। ফাউন্টেন পেনের চল উঠে গেলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ব্যাকরণ বইতে রচনা দেখা যেতো- ‘একটি ফাউন্টেন পেনের আত্মজীবনী’। সিআরটি বিলুপ্ত হলেও এটি ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য লেখা থাকবে- একটি রঙ্গিন টিভির আত্মকাহিনী।

এটি ছাড়াও ভিন্ন রূপে কিন্তু সিআরটি প্রযুক্তি তার ব্যবহারোপযোগীতা প্রমাণ করতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুসারে, প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটলেও একেবারে ধ্বংস হয় না। বরং পিছিয়ে পড়া অনেক প্রজাতি কিছু ক্ষেত্রে হাজির হয় নতুন কিছু নিয়ে। সিআরটির ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে পারে। কারণ এলসিডি-প্লাজমার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে সিআরটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যেমন কয়েক বছর চলার পর এগুলোর রঙ ফিকে হয়ে আসে; টিভি পুরোপুরি চালু হতেও কিছু সময় লেগে যায়। এ ক্ষেত্রে সিআরটি ডিসপ্লের ইনপুট লেগ সামান্যই। আবার সিআরটি টিভির সমমানের অ্যাসপেক্ট রেশিও আছে খুব কম এলসিডি-এলইডি-প্লাজমার। ছবি জীবন্ত মনে হবে কিনা সেটি কিন্তু নির্ভর করে কোন টিভির অ্যাসপেক্ট রেশিও কত বেশি, তার ওপর। এসব চিন্তা করলে মনে হয় সিআরটি টিভি হয়তো আগামীতে আবার ফিরে আসবে; স্লিম ফিগার ও দীর্ঘায়ু নিয়ে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সহকারে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

হাসির খবর

হেরোটোডাসের পরিচিতি মূলত- ইতিহাসের জনক। তবে নিজেকে দার্শনিক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টাই তিনি করতেন বেশি। তার ব্যক্তিত্বটা ছিল সিরিয়াস ধরনের। হাসি-ঠাট্টা তেমনটা পছন্দ করতেন না; হাস্যোৎফুল্ল মানুষকে দেখতেন অবজ্ঞার চোখে। তার মতে তিনটি কারণে হাসতে পারে মানুষ। এক. ঘাবড়ে গিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্দেহভাজন ব্যক্তি অপরাধী নন- কিন্তু নিজের ওপর তেমন আস্থাও নেই তার। ফলে অভিযোগ তোলা হলে অনেক সময় ঘাবড়ে গিয়ে তারা হাসেন নার্ভাস হাসি। দুই. পাগলামীর কারণে। হেরাটোডাসের মতে, এ ধরনের হাসি নিয়ে চিন্তা করাও অনর্থক। তার পর্যবেক্ষণে তৃতীয় যে কারণে মানুষ হাসে তা হলো- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।

হেরাটোডাসের যুগে হাসিকে দেখা হতো মানুষের হালকা ও নেতিবাচক আবেগ হিসেবে। যে কারণে অ্যারিস্টটল তার ‘পোয়েটিকস’ বইতেও লিখেছেন- ট্রাজেডী হচ্ছে উচ্চতর আবেগ। আর কমেডী? অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিতে- ভাঁড়ামোতাড়িত রাগ মোচন। অবশ্য তিনি মানব সমাজে হাসির প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তাতে। এটির দার্শনিক ও সামাজিক গুরুত্ব বাড়ে ইংল্যান্ডে আলোকিত যুগ চলাকালে। দার্শনিক টমাস হবস উচ্চ প্রশংসা করে লেখেন, হাসি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কৌশল; এটি ব্যক্তির নিজের ওপর আস্থাশীলতারও প্রমাণ। হবসের মতকে এগিয়ে নেন জার্মান দার্শনিক শোপেনআওয়ার। তার প্রসিদ্ধ বই ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড রিপ্রেজেন্টেজশন’-এ হাসি সংক্রান্ত দীর্ঘ অধ্যায় লেখার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে নীটশে আরেক ধাপ এগিয়ে ঘোষণা করেন, হাসির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। যুক্তি ও নৈতিকতার আবদ্ধে ক্লান্ত মানুষ থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করে ইতিবাচক হাসিকে। এদিকে অপরের দুর্দশায় অনেকে যে হাসি হাসেন, সেটিই হলো নেতিবাচক। এমন হাসি সমাজে সাংঘর্ষিক উপাদান বাড়িয়ে তোলে।

হাসি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তার বেশ কিছু মজার পর্বেক্ষণ রয়েছে এ ক্ষেত্রে। যেমন, শিশুরা দৈনিক (এমনকি ঘুমিয়েও) হাসে গড়ে ৩০০ বার; প্রাপ্তবয়স্করা ২০ বার। সে ক্ষেত্রে হাসির মাত্রা ও কম্পাংক (দিনে কতবার) আবার নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। হাসি নিয়ে ফ্রয়েডের একটি বিখ্যাত তত্ত্ব রয়েছে যাকে বলে ‘রিলিফ থিওরি’। এতে তিনি বলেছেন, হাসির মাধ্যমে দুশ্চিন্তা ও সাইকিক এনার্জি (যে শক্তি মানকে উত্তপ্ত করে তোলে) থেকে মুক্ত হয় মানুষ; মনের অবচেতনে। এ তত্ত্ব প্রকাশের পর থেকে হাসি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মনোভাব পরিবর্তিত হয় অনেকটাই। তারা বোঝার চেষ্টা করেন, হাসির সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আসলে কতটুকু; হাসিকে কাজে লাগিয়ে মনোরোগের প্রতিরোধ ও আরোগ্য সম্ভব কিনা প্রভৃতি। এদিকে হাসি নিয়ে ভিন্ন ধরনের গবেষণাও শুরু হয় রিলিফ থিওরি প্রকাশের পর। কেউ কেউ বোঝার চেষ্টা করেন- মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী হাসে কিনা। সমস্যা হলো, মানুষের হাসি সহজেই বোঝা যায়। অন্যদের হাসি চিহ্নিতকরণের উপায় কী? শেষ পর্যন্ত অনেক পরিশ্রমের পর এক ধরনের সনোগ্রাফ আবিষ্কৃত হয়েছে, যে যন্ত্রটি বিশ্লেষণ করে দেখেছে মানুষ বাদে ইঁদুর ও কুকুরাও হাসে। নানা মিথ থাকলেও এ পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিতভাবে ফেল করে হায়েনা। এক সময় হাসি গবেষণায় এগিয়ে আসেন ভাষাবিদরা। তারা দেখেন, মানুষের হাসির সাধারণ প্যাটার্ন হলো দুটি। এক. ‘হা হা হা’; দুই. ‘হো হো হো’। তবে তারা বিশ্লেষণ করে পান, ওই দুটি ছাড়া ‘হা হা হো’ বা ‘হো হো হা’ করেও হাসতে পারে মানুষ। তবে স্বরতন্ত্রের গঠনই এমন যে, ‘হা হো হা হো’ শব্দ করে হাসা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।

সম্প্রতি ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী গবেষণায় দেখেছন, প্রকৃতপক্ষে হাসির উৎপত্তি মস্তিষ্কের অনেক গভীরে সাবকর্টেক্স অঞ্চলে যেটি আবার নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের রিফলেক্স অ্যাকশন, ভাষাজ্ঞান ও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যৌক্তিকবোধ। আবার নিরাপদ উত্তেজক দ্রব্য প্রয়োগ করে এটির দক্ষতা বাড়ানো-কমানো সম্ভব। এ গবেষণার মধ্যে দিয়ে অবসাদগ্রস্ততা, অনিদ্রা, আলঝেইমারের মতো রোগ প্রতিরোধ নিয়ে একসঙ্গে কয়েক ধাপ পেরোলেন বিজ্ঞানীরা। তাদের প্রত্যাশা, গবেষণাটি সঠিকভাবে চললে আগামীতে অনেক মনোরোগেরই সহজ চিকিৎসা পদ্ধতি মিলবে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

স্থানিক সংক্রমণের আর্থিক ঝুঁকি

প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার ভাইরাস ছিল চলৎশক্তিহীন। এ যুগের ভাইরাস-ম্যালওয়ার চলাফেরায় সক্ষম; কয়েকটিতে রয়েছে উচ্চতর বুদ্ধিমত্তাও। সাম্প্রতিককালের ফ্লেইম ম্যালওয়ারের কথা ধরা যাক। একে বলা যেতে পারে উচ্চপ্রশিক্ষত ও ছদ্মবেশী স্পাই। সাধারণত ভাইরাস-ম্যালওয়ারের কোডিং হয় জটিল ও বড়। এ ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র ফ্লেইম; তার কোডিং লম্বা নয় মোটেই।

প্রস্তুতকারীরা অনেক সময় এমন সব ভাইরাস-ম্যালওয়ার তৈরি করেন যেটিকে তুলনা করা যায় চাঁদাবাজি করতে যুদ্ধাস্ত্রসহ কোনো সন্ত্রাসীকে পাঠানোর সঙ্গে। এরা ইন্টারনেটের শৃঙ্খলা দায়িত্বে নিয়োজিত সাইবার পুলিশের চোখে পড়ে যায় সহজে। আর অপরাধ সংগঠিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এগুলোকে নেয়া হয় রিমাণ্ডে তথা নিরাপদ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। সেখানে বাস্তব জগতের মতো জেরা হয় না; কোড খুলে বিশ্লেষণ করা হয় কেবল। এর মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয় হোতাকে। কাজটি কঠিন কিছু নয়। বর্তমানের সাইবার পুলিশের অধিকাংশই হয় ‘অবসারপ্রাপ্ত’ হ্যাকার নয়তো কোড অ্যানালিস্ট। আবার সাইবার অপরাধীদের মাঝে তাদের সোর্সও রয়েছে। এসব অপরাধীরা একাকী কাজ করতে পারে না বাস্তব জগতের মতোই। ১৯৮০’র দশকে স্টিভ ওজনিয়াকের সভাপতিত্বে ক্যালিফোর্নিয়ায় হ্যাকারদের বিরাট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অবশ্য তখন বিষয়টিকে সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো না। অপরের ক্ষতি করার ইচ্ছাও ছিল না ওজনিয়াকদের। পরবর্তীতে একশ্রেণীর কোড অ্যানালিস্ট সাইবার অপরাধী হয়ে উঠলেই কঠোর অবস্থান নেয় মার্কিন সরকার। এতে অধিকাংশ হ্যাকার আশ্রয় নেয় আন্ডারগ্রাউন্ডে (বাস্তবিক অর্থেও); গড়ে তোলে অনেকগুলো হ্যাকার ক্লাব। আর এসব স্থানেই রাখা হয়ে সাইবার পুলিশ সোর্স। এদের কাজ হলো, অপরাধ কার্যক্রম ও অপরাধীর গতিবিধির ওপর নজর রাখা। তারা নিয়মিত রিপোর্ট করে কোন হ্যাকার কী ধরনের কোড লিখতে পছন্দ করেন প্রভৃতি; যেমন করে ছিনতাইয়ের ধরন দেখে পুলিশ ধারণা করে নেয়- কে হতে পারে সম্ভাব্য অপরাধী? এভাবে ভাইরাস-ম্যালওয়ারকে রিমান্ডে নেয়ার পর সেটির প্রস্তুতকারককে সাইবার পুলিশের পক্ষে বের করা কঠিন নয়। এ ক্ষেত্রে অপরাধীর আস্তানাও চিহ্নিত করা হয় অপরাধ উৎসের রিয়েল আইপি অ্যাড্রেস লোকেটের মাধ্যমে। এ সহজ হিসাবটি ফ্লেইমের ক্ষেত্রে মোটামুটি অচল। কারণ সাইবার পুলিশ কেবল নয় ম্যালওয়ারটিকে দীর্ঘদিন গোপনে পর্যবেক্ষণ না করলে ঝানু সিস্টেম অ্যানালিস্টের পক্ষেও বোঝা কঠিন- এটি ক্ষতিকর না নিরীহ।

আকস্মিকভাবে ইরানে ফ্লেইম আবিষ্কার করে ইন্টারনেট সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি। এটির প্রস্তুতকারকে চিহ্নিত করা যায় নি এখনো। কয়েক দিন আগে এটির আরও অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। কোড অ্যালিস্টরা ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ইন্টারনেটের সংস্পর্শে আনতেই দেখা গেলো ম্যালওয়ারটি আত্মহত্যা করছে অর্থাৎ নিজেই নিজেকে ধংস করে ফেলছে। তার মানে এটির প্রস্তুতকারক ধরা পড়ার ভয়ে পরবর্তীতে সুইসাইডাল কোডও দিয়ে রেখেছিল ইন্টারনেটে।

ম্যালওয়ারটির কার্যক্রম আর্থিক তো বটেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে কয়েকটি শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্রতিষ্ঠানের মনে। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে নেটওয়ার্কনির্ভর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে যতটা প্রচেষ্টা নিতে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা ততটাই উদাসীন বলে ধারণা। অথচ বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফ্লেইমের মতো ম্যালওয়ার ঘটাতে পারে অকল্পনীয় ক্ষতি। এরই মধ্যে শুক্রবারের বণিক বার্তায় খবর রয়েছে, ভাইরাস ও ম্যালওয়্যারের স্থানীয় আক্রমণের ঝুঁকির দিক থেকে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। একে ‘আঞ্চলিক সংক্রমণ’ বলেও উল্লেখ করা যেতে পারে। আঞ্চলিক হলেও অস্বীকার করা যায় না, যতটা সতর্কভাবে অপারেটিং সিস্টেম, ওয়েব ব্রাউজার ও ইমেইল ব্যবহার করা উচিৎ, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তা করি না আমরা। অনেক দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও রাখা হয় ফায়ারওয়াল ব্যবস্থা। এ ধরনের উদ্যোগ কম এখানে। দ্রুত এসব গাফিলতি দূর করা প্রয়োজন। অতীতে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ‘স্ট্রোক’ শব্দটির সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষের পরিচয় ছিল না। সে সময় এতে কারও মৃত্যু হলে সেটিকে দেখা হতো খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও আকস্মিক মৃত্যু হিসেবে। নিরাপত্তা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন না থাকলে এটি ঘটতে পারে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও।

ফাহমিদা ফেরদৌস

চাঁদে ভ্রমণ,বাণিজ্য না দুটোই?

শূন্যে ভাসার আকাঙ্ক্ষা মানুষের অতিপ্রাচীন। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারতীয় সভ্যতার নানা শিল্পকলার এর প্রমাণ রয়েছে অনেক। সম্ভবত এ আকাঙ্ক্ষা বেশি ছিল মায়া, ইনকা ও অ্যাজটেকদের। দশকখানেক আগে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন এরিক ফন দানিকেন। তিনি প্রমাণের চেষ্টা করেন, মায়া-ইনকাদের দেবদেবীরা আসলে ছিলেন অ্যালিয়েন। দানিকেনের এ তত্ত্বের সঙ্গে মোটেই একমত নন মূলধারার প্রত্নো-ঐতিহাসিক ও প্রযুক্তিবিদরা। তারা বলেন, দানিকেন বুঝতে ভুল করেছেন, মায়া-ইনকা সভ্যতায় প্রাপ্ত ওসব দেবদেবীর শিল্পকলা কোনো অ্যালিয়েনের ছবি নয়; প্রাচীন মানুষের শূন্যে ভাসার আকাঙ্ক্ষাটিরই চিত্রিত রূপ!

বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য প্রথম নাইটহুড পান স্যার আইজ্যাক নিউটন। শূন্যে ভাসার আকাঙ্ক্ষা ছিল তারও। আসলেই তা সম্ভব কিনা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্রিটিশ নেভির গোলাবর্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তার বিশ্লেষণ দেখান ন্যাচারালিস প্রিনকিপিয়া ফিলোসোফিয়া ম্যাথমেটিকাতে। এতেই প্রথম নিউটন চালু করেন একটি শব্দ- ‘জিরো জি’ (জিরো গ্রাভিটেশনাল ফেনোমেনন)। অংক করে তিনি দেখান, ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট ওপরে যেতে পারলেও যেকোনো দর্শনার্থী শূন্য মাধ্যাকর্ষ শক্তি তথা বাতাসে ভেসে থাকার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। বলাবাহুল্য, ওই সময়ে নিউটনের জিরো জি’র চিন্তা ছিল স্রেফ পাগলামি। বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে অনেক উঁচুতে উড্ডয়নে সক্ষম বিমান আবিষ্কারের পর। প্রথমে রাশিয়ান ও আমেরিকানরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মূলত নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা বিশ্বকে দেখাতেই শুরু করে মহাকাশ যাত্রা। বাণিজ্যিকভাবে প্রধানত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মহাকাশ যাত্রা শুরু হয় একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে; ভার্জিন গ্যালাকটিকোর ‘জিরো জি’ সেবার মধ্য দিয়ে। এখন আরেক মহাশূন্য ভ্রমণ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সও নাকি চালু করতে চাইছে একই ধরনের ট্রিপ। এরই মধ্যে সোমবারের বণিক বার্তায় খবর এলো, ২০১৫ সাল থেকে ১৫ কোটি ডলারে চাঁদে যাওয়ার টিকেট বিক্রির সম্ভাবনাটি যাচাই করে দেখছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এক্সক্যালিবার অ্যালমাজ। তবে ভার্জিন গ্যালাকটিকোর চেয়ে এক্সক্যালিবারের টিকেটের দাম অত্যাধিক বেশি। এছাড়া ‘জিরো জি’ অভিজ্ঞতা যত মোহনীয় কল্পনা করা হয়, বিষয়টি ততটা মজারও নয়। অনেকে এও বলেন, ভারজিন গ্যালাকটিকোতে চড়ার চেয়ে উচ্চগতির রোলার কোস্টারে ওঠা ভালো। সে ক্ষেত্রে এক্সক্যালিবারের টিকেটের দাম এত বেশি হওয়ার কারণ কী? প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা গ্যালাক্টিকোর মতো শুধু চন্দ্রপৃষ্ঠ দেখিয়েই ভ্রমণকারীদের ‘তৃপ্ত’ করতে চাইছে না; চাঁদের মাটিতে পর্যটকদের পা ছোঁয়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। এতে খরচটা তো বেশি পড়বেই! এ ক্ষেত্রে বাকি প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, এক্সক্যালিবার কী চাঁদের মাটিতে পর্যটকদের পা ছোঁয়াবে নাকি সেখানে রেখেও আসবে তাদের? ডজনখানেক মানুষের জন্যও যে ধরনের লেস (এলইএস বা লুনার এস্কেপ সিস্টেম) দরকার সেটিও কী আছে প্রতিষ্ঠানটিতে? অগ্রাহ্য করার মতো নয় এসব যুক্তি।

পর্যটকের কাছে যেমনই মনে হোক, মহাকাশ পর্যটনকে নিছক বিনোদন হিসেবে দেখতে চান না অধিকাংশ বিজ্ঞানী। তাদের কাছে বিষয়টি অনেকটা, ক্যাপ্টেন জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়া ‘ভ্রমণে’র শামিল। আগামী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে খনিজ সম্পদের সঙ্কটে ভুগবে পৃথিবী। আর চাঁদে রয়েছে সহজে উত্তোলনযোগ্য (ও পরিবহনের প্রায় অযোগ্য) লোভনীয় সব খনিজ পদার্থ। ধাতু উত্তোলনের লক্ষ্যেই নাকি কয়েক বছর আগে সীমিত পরিসরে চাঁদের জমি নিলামে তোলে নাসা। তাদের বক্তব্য, সেখানে জ্বালানি পাওয়া গেলে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকিয়ে রাখা যাবে। পরে কয়েকজন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের স্পেস-টাইম কার্ভেচার থিওরি উদ্ধৃত করে বলেন, মানব সভ্যতার ‘বৃহত্তর স্বার্থে’র খাতিরে উচিৎ হবে না চাঁদ থেকে খনিজ পদার্থের আহরণ। বরং পৃথিবীতে থেকে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেই কী করে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়া যায়, সেসব পদ্ধতি খুঁজতে হবে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলছেন, এ দুই পথেই অগ্রসর হওয়া যাক- জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের উপায় খোঁজা হোক; পাশাপাশি অতিমূল্যবান কিছু ধাতু আহরণ করা হোক চাঁদ থেকে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

দুর্ভোগে চট্টগ্রাম

অতিবর্ষণজনিত ভূমিধসের আশঙ্কা করা হয়েছিল গতকালের বণিক বার্তার সম্পাদকীয়তে। মর্মান্তিক যে, এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারে ভূমিধসে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির খবর মিলেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সিংহভাগই আবার দরিদ্র জনগোষ্ঠী। পরিস্থিতি এমন যে, তাদের সান্ত্বনা জানানোর মতো অবস্থাও নেই এখন। এ ক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে পর্যাপ্ত উদ্ধার ও ত্রাণ কার্য অব্যাহত রাখা দরকার। একই সঙ্গে উপদ্রুত এলাকাবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়েও সরিয়ে ফেলতে হবে।

২০০৭ সালের ১১ই জুন প্রায় একই ধরনের ভূমিধস ঘটে চট্টগ্রামে। সে সময়ে অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছিলেন, পাহাড় থেকে অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটা এবং সে স্থানে পাহাড়ী জমির উপযোগী ভূমিক্ষয় প্রতিরোধী বৃক্ষ রোপন করা না হলে অতিবর্ষণজনিত ভূমিধস রোধ করা কঠিন। এছাড়া কাটা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানরতদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরামর্শও দেন তারা। সত্য যে, আমাদের মতো দেশে যেখানে বাসযোগ্য জমির দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে, সেখানে পুনর্বাসনের বিষয়টি সহজ নয়। এটি বাদ দিয়ে অন্যান্য উপায় অবলম্বন করলেও হয়তো ভূমিধস রোধ করা যেতো। অথচ ২০০৭ সালের দুর্ঘটনার পরও এ ক্ষেত্রে যে উদাসীনতা দেখানো হয়েছে, তার প্রমাণ চট্টগ্রাম বিভাগের একাধিক স্থানে এ সাম্প্রতিক ভূমিধস। শোনা যায়, কেউ কেউ পাহাড়ের পাশে কংক্রিটের দেয়াল তৈরি করে বাসিন্দাদের এ বলে আশ্বস্ত করতে চাইছিলেন যে, স্থানটি অনিরাপদ নয়। আর সে কারণেই নাকি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও অনেকে ওসব ঝুঁকিপূর্ণ বাসস্থান ছেড়ে যান নি। যারা কংক্রিটের দেয়াল তৈরি করেছিলেন নিঃসন্দেহে সেটি ইতিবাচক মোটিভেশন থেকেই করা হয়েছিল। তারা সম্ভব জানতেন না, অতিবর্ষণে কাদামাটিতে একবার বড় আকারে ধস দেখা দিলে সেটিকে সাধারণ কংক্রিট দিয়ে রোধ করা প্রায় অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো, এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে একেবারেই না থাকা। থাকলেও পাহাড়ের কাটা স্থানে পর্যাপ্ত ভূমিক্ষয়রোধী বৃক্ষ রয়েছে কিনা, সেটি নিশ্চিত করা। এগুলো যথাযথভাবে করা হলে হয়তো জানমালের এত ক্ষয়-ক্ষতি দেখতে হতো না আমাদের। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এদিকে জরুরিভিত্তিতে দৃষ্টি দিতে হবে। এরই মধ্যে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন তাদের ভোগান্তি লাঘবের প্রতিও খেয়াল রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে উদ্ধার ও ত্রাণকার্য বিষয়ে চলনসই ধারণা দিতে হবে স্বেচ্ছাসেবকদেরও।

টানা ছয় দিনের রেকর্ড বর্ষণে বন্দরনগরী জলাবদ্ধতা বিরাজ করছে এখনো। জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম; বজ্র ও বিদ্যুতে স্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে এটি। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখায় বাড়ছে জনদুর্ভোগ। রানওয়েতে পানি ওঠায় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বিমান চলাচল। সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রায় অচল; একই পরিস্থিতি সমুদ্রবন্দরেরও। এদিকে পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে আসার খবর মিলছে না। বরং আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, অতিবর্ষণ চলতে পারে আরও কয়েকদিন। এ অবস্থায় বন্দরনগরীর প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে- জলাবদ্ধতা। যদিও ধীরে ধীরে পানি নেমে যাচ্ছে তবুও এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাহীন পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা লক্ষ্যণীয়। নানা তরফ থেকে বারবার বলা সত্ত্বেও এবং সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার পরও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ নগরীতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কী করে- বোঝা মুশকিল। অন্যান্য বিভাগীয় শহরে যখন দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার ঘটনা কমে এসেছে তখন চট্টগ্রামের এমন ঘটনা দুর্ভাগ্যজনকও বটে। সত্য যে, কয়েকদিন ধরে নগরীতে রেকর্ড বর্ষণ হয়েছে; আবার পানি নিষ্কাশনে সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তুতিরও ঘাটতি ছিল। এ ক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার সঙ্গে সঙ্গে পচনশীল ও অপচনশীল আবর্জনার মিশ্রণও অধিক স্থায়ী জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী বলে জানা যায়। এটি দূরীকরণে সিটি করপোরেশন তো বটেই জনসচেতনতাও বাড়িয়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে নগরোন্নয়নে সিটি কর্পোরেশন ও এর বাসিন্দাদের কমিটেড থাকারও কোনো বিকল্প নেই।

পুতিন-যুগের তৃতীয় পর্ব

গত বছর ডিসেম্বরে রাশিয়ার পার্লামেন্টারি ইলেকশনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ভ্লাদিমির পুতিন নিয়ন্ত্রিত ইউনাইটেড রাশিয়া। এ নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল দেশটির অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলে। পুতিনবিরোধীরা প্রহসনমূলক নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেন এটিকে। ফেসবুক, টুইটারের মতো কিছু সাইটতে পার্লামেন্টারি ইলেকশনে কারসাজি হয়েছে বলেও জনমত গঠনের চেষ্টা করা হয়। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রেমলিনের সামনে বিক্ষোভও প্রকাশ করেন কিছু মানুষ। এরই মধ্যে পুতিন ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তৃতীয়বারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে চান তিনি। সমালোচকরা ভেবেছিলেন, পুতিনের দিন শেষ; ২০১২ সালের নির্বাচনটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ঘটনা ঘটে গেলো এর উল্টো। ৩ মার্চ ৯৯ শতাংশ রাশিয়ান ভোট দিলেন প্রেসিডেনশীয়াল ইলেকশনে; এর মধ্যে পুতিন পেলেন ৬৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রবেশানুমতি না মিললেও এ নির্বাচনে ব্যাপক কারসাজি হয়েছে- এমন অভিযোগ বিরোধীরাও তেমন জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। তাদের কেউ কেউ বলছেন, পুতিন ভয় দেখিয়ে ভোট কেড়েছেন। আবার কারও কারও মতে, সূক্ষ্ম-কারচুপি হয়েছে এতে। রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে কিছু ঘাটতি হয়তো ছিল পুতিনবিরোধীদের। তাহল, শহরে পুতিন ইমেজ ততটা মহিমান্বিত না হলেও রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে তিনি বেশ জনপ্রিয়। এসব ভোটারা ঝেঁকে ভোট দিয়েছেন পুতিনকে। তাদের অনেকের ধারণা, বিশ্বের বুকে অতীতের মত বুক উঁচিয়ে চলতে চাইলে রাশিয়ায় পুতিনের শাসন দরকার।

এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক- পরপর দুইবার প্রেসিডেন্ট থাকার পরও আবার কেন ক্ষমতায় আসতে চান পুতিন? সমালোচকরা বলছেন, একে ক্ষমতার লোভ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। পুতিনের মতো হলো, তিনি দেশে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিকতা দেখতে চেয়েছিলেন, সে কাজ সম্পূর্ণ হয় নি। ফলে ক্রেমলিনে আসতেই হচ্ছে তাকে। তবে সমীকরণটি এতটাও সরলরৈখিক নয় বোধকরি। পুতিনের শাসনামলে দেশটিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ আসতে শুরু করে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বও বাড়ছিল তাদের। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মেদভেদেভের আমলে প্রশাসনে শৈথিল্য ও অর্থনীতিতে গতি কিছুটা কমে এসেছে। পুতিনের শাসনামলে মিত্রদের রক্ষায় কম-বেশি শক্ত ভূমিকাই ছিল রাশিয়ার। অথচ মেদভেদেভের আমলে একে একে দেশটির প্রভাব কমছিল লিবিয়াসহ বসন্তাক্রান্ত কয়েকটি আরব দেশে। সম্প্রতি আরেক মিত্র সিরিয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে পুতিনের উত্তাপ অনুপস্থিত মেদভেদেভের পররাষ্ট্রনীতিতে। সিরিয়া ইস্যুতে তাদের চেয়ে বরং চীনেরই কঠোর অবস্থান দেখা গেলো; যদিও এ দেশটির সঙ্গে সিরিয়ার সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক নেই। অথচ রাশিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার বৈদেশিক সম্পর্ক পুরনো ও বিস্তৃত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রাশিয়ার প্রভাব বজায় রাখতেও কৌশলগত কারণে সিরিয়া তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

এখন পুতিন তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সম্ভবত নাখোশ হবেন তার পশ্চিমা প্রতিপক্ষরা। এমনিতেই সিরিয়ার সঙ্গে ইরান ইস্যু যুক্ত হওয়ায় জটিলতা বাড়ছিল। এ অবস্থায় পুতিন রাশিয়ার হাল ধরলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। সমস্যা হলো, পুতিন ক্রেমলিনে আসবেন চলতি বছরের জুনে। এর আগেই সিরিয়ার ভাগ্যে কিছু ঘটে গেলে করারা থাকবে না। আবার সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বর্বরতার প্রতি সমর্থন জানানো রাশিয়ার যে নৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠছিল দুর্বল হয়ে পড়বে সেটি। অনেকের ধারণা এমন পরিস্থিতিতে পুতিনের কৌশল হবে, রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বেগবান করা; সিরিয়াকে বাদ দিয়ে ইরানকে সমর্থন জোগানো; ইউরোপ, চীন, ভারত ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করা। কেউ কেউ বলছেন, ডমিনো ইফেক্টের ভয় না করে, নেতৃত্ব নিয়েই পুতিনের উচিৎ হবে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কটিকে অধিকতর ফলপ্রসূ করে তোলা। সিরিয়ায় যাই ঘটুক না কেন ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তির যুদ্ধ বেঁধে গেলে, তার ফল হবে ভয়াবহ। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ইরানকে পূর্ণ সহায়তা দিলে, পরিস্থিতি যুদ্ধে মোড় নাও নিতে পারে; কেবল স্নায়ুযুদ্ধের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটতে পারে এর। কাজটি পুতিন সফলভাবে করতে পারবেন কিনা, সেটিই তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এখন।

ফাহমিদা ফেরদৌস

সড়ক-মহাসড়কে হালকা যান

বিশেষত গ্রামের দিকে বাহন হিসেবে চালক ও যাত্রী উভয়ের কাছেই বেশ জনপ্রিয় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নছিমন, করিমন, আলম সাধু ও ভটভটি। চালকের কাছে এর জনপ্রিয়তার কারণ- সহজ কাজের সুযোগ। এটি চালনার জন্য কোন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার দরকার নেই; নেই গীয়ার মুখস্থ রাখার ঝামেলা। ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার চালানো মনোযোগ দিয়ে দেখলেই হলো। সঙ্গে বাইসাইকেল ও ট্রাইসাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা থাকলে আরও ভালো; ভটভটিতে ভারসাম্য রক্ষায় কাজে লাগে। ইঞ্জিন সম্বন্ধে বেশি জ্ঞান রাখার প্রয়োজন নেই এ ক্ষেত্রে। খুচরা যন্ত্রাংশ নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। ভাবনাটা শুধু চাকা পাংচার হয়ে গেলে। তবে বিপত্তিটা ঘটে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে। মোটরসাইকেলের মতো হালকা যানে যে ধরনের অ্যারোডিনামিক ডিজাইন মেনে চলা হয়, তাও অনুপস্থিত ভটভটিতে। এ কারণে এতে দুর্ঘটণার ঝুঁকি অনেক বেশি। অবশ্য অনেক চালক ও যাত্রীরও ভুল ধারণ রয়েছে যে, বাস-ট্রাকের চেয়ে নিরাপদ এটি। বাস-ট্রাক তো উল্টে গেলে চারপাশ থেকে আবদ্ধ, অসহায় যাত্রীর পক্ষে বাঁচার জন্য কিছু করা কঠিন। অথচ খোলা ভটভটিতে আর যাহোক লাফ দিয়ে বাঁচার একটা সুযোগ তো মেলে!

কোনো কোনো যাত্রী ভটভটিতে চড়া পছন্দ করেন অন্য কারণে। গ্রামাঞ্চলে এটি সহজলভ্য বাহন। অনেকে বাসে চড়তে চান না অস্বস্তিকর পরিবেশের জন্য। সেদিক থেকে ভটভটি বেশ খোলামেলা। ডিজেল হলো শ্যালো ইঞ্জিনচালিত এসব যানের জ্বালানি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আবার হয়ে থাকে সেচকার্যে ভর্তুকি দেয়া ডিজেল। স্বভাবতই এতে পেট্রল বা সিএনজি চালিত বাহনের চেয়ে ভাড়া পড়ে কম। পণ্য পরিবহনেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় ভটভটি। ধরা যাক, কেউ ৫০ আঁটি ছন বা বিচালি হাটে গিয়ে বেচতে যান। এখন তিনি যদি মনুষ্যচালিত ভ্যানে তা পরিবহন করতে চান খরচ তো বাড়বেই এসব বহনও করতে হবে কয়েকবারে। এতে খরচ যা হবে মুনাফার অর্থ থেকে তা পরিশোধ করতে গেলে অবশেষ প্রায় কিছুই থাকে না। একবারে পণ্য পরিবহন করতে অর্থাৎ সময় বাঁচাতে মিনি ট্রাকের কথা ভাবতে পারেন তিনি। সমস্যা হলো, গ্রামে এ ধরনের যান পাওয়া বেশ কঠিন। আর যদি পাওইয়া যায়ও, পণ্য পরিবহনে খরচ পড়ে যায় অনেক। অথচ হাতের কাছেই রয়েছে ভটভটির মতো হালকা বাহন; যাতে কম খরচে পরিবহন করা যায় প্রায় মিনি ট্রাকের ধারণ ক্ষমতাতূল্য পণ্য।

এতসব সুবিধার পরও বাস্তবতা হলো, এ ধরনের যান মোটরসাইকেলের চেয়েও দুর্ঘটনাপ্রবণ। কিছু ক্ষেত্রে সড়ক-মহাসড়কে যানজট সৃষ্টির জন্যও দায়ী এটি। এসব বিবেচনায় গত বছর সড়ক উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, ধীরে ধীরে এ ধরনের হালকা যান চলাচল বন্ধের। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ঘোষণা দেয়া হয়, আগামী তিন মাসের মধ্যে দেশের মহাসড়কগুলোয় বন্ধ করা হবে ব্যাটারি ও ইঞ্জিন চালিত হালকা যান। এর কয়েক দিন পর নাটোরে ঘটল মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ট্রেন ক্রসিং পার হতে নিহত হলেন ভটভটিতে থাকা একই পরিবারের ছয় সদস্য। ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙ্গুলে দেখিয়ে দিলো, কেবল মহাসড়ক নয় সারা দেশ থেকেই নির্মূল করতে হবে এ ধরনের বিপদজনক যান।

এ ক্ষেত্রে চালক বা বাহনের লাইসেন্স বাতিল করা সমাধান হতে পারে না। কারণ এ ধরনের হালকা যানের ডিজাইনেই রয়েছে ত্রুটি। তবে দেশব্যাপী ভটভটি যে মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে অনেকের সন্দেহ জাগতে পারে- মহাসড়কেও দ্রুত এসব যান চলাচল সম্ভব কিনা। এ ক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে- ভর্তুকির ডিজেল অন্য কোথাও যাতে ব্যবহৃত হতে না পারে সেটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। এতে ভটভটি মালিকরা বাধ্য হবেন, ভাড়া বাড়াতে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেলে প্রতিযোগিতায় এমনিতেই পিছিয়ে পড়বে এটি; এক সময় হয়তো হারিয়েও যাবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যে বিরাট সংখ্যক মানুষ এসব হালকা যান সংশ্লিষ্ট কাজে নিজেদের কর্মসংস্থান জুগিয়েছিলেন তাদের কী হবে? সম্ভবত এরা পুনরায় ফিরে যাবেন কৃষিকাজে। এতে তাদের আয় কিছুটা কমলেও তারা পরোক্ষভাবে অবদান রাখবেন কৃষিশ্রমিকের মজুরি হ্রাসে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

পুরনো অবস্থান ও কৌশল আর নয়

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ডাকে মহাসমাবেশ হয়ে গেলো সোমবার। ওতে আসলেই নাশকতার আশঙ্কা ছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে অনেকের মনে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সমালোচিত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের মহাসমাবেশ ঠেকানোর কৌশল নিয়ে। ওই সমাবেশে দুটি বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট এখন। প্রথমত, সরকারি দলের দুশ্চিন্তা বেড়েছে বিরোধীদের নিয়ে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগে বিরোধী দলের যেমন ‘টাইপড’ ভূমিকা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা। সন্দেহ নেই, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসায় পর কোনঠাসা বিরোধী দলকে অপ্রত্যাশিতভাবেই সহায়তা জুগিয়েছে সরকারের কিছু অজনপ্রিয় পদক্ষেপ ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। কোনঠাসা অবস্থানে থাকার কারণেই বোধকরি বিরোধী দল উপলব্ধি করছে, এক-দুই দশক আগের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের রাজনীতির প্রতি মনোভাব অনেকটাই পরিবর্তিত এখন। জনগণ সংঘাত-সঙ্ঘর্ষ আর প্রতিহিংসা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। দেশের অর্থনীতি যখন ইতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে তখন এসব খানিকটা বিরক্তিকরও বটে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের ধারাটি সরকারি দল বুঝতে পেরেছে কিনা, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিরোধী দল এটিকে কতটা আমলে নিয়েছে তা বোঝা যাবে সামনেই।

এরই মধ্যে বিরোধী দল আগামী ১০ জুনের মধ্যে তত্ত্ববধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহালের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকারকে। নইলে আবারও আন্দোলন-সমাবেশে নামবেন তারা। সে অধিকার তাদের আছে; এতে কাজ হয় না তাও বলা যাবে না। কথা হলো, এ ধরনের একটি জটিল ও স্পর্শকাতর ইস্যুর সমাধানে সরকার-বিরোধী কোনো পক্ষেরই আলোচনায় বসা ভিন্ন গত্যন্তর নেই। তত্ত্ববধায়ক ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা সম্বন্ধে তাদের ভালো জানার কথা। কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রপতি ও তারও আগে নির্বাচন কমিশন এ বিতর্ক নিরসনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিরোধী দলের অনমনীয় অবস্থানের কারণে ফলপ্রস্যূ হয় নি পদক্ষেপগুলো। সত্য যে, নির্বাচন কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতায়িত ও নির্বাচনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রযুক্তি ব্যবহার করেও মিলেছে মানুষের সাড়া। এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেটির সমাধান রাজপথে করা কঠিন।

বিরোধী দলীয় নেতা ১২ মার্চ মহাসমাবেশে দেশের অর্থনীতির সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো নিয়ে কতগুলো মন্তব্য করেছেন; কিছু আশ্বাসও দিয়েছেন মানুষকে। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে জনপ্রতিনিধিদের আরও ক্ষমতা প্রদান করা হবে; মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মাঝে রাখা হবে দ্রব্যমূল্য। সে দাম উল্লেখ না করায় উক্তিটিকে বিজ্ঞোচিতই বলতে হয়। কারণ দেশে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে কোনো পণ্যের দাম নির্দিষ্ট করে দেয়াটা আসলেই কঠিন। মহাসমাবেশে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, নতুন সংযোগসহ কলকারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে তিনি ক্ষমতায় এলে। তিনি আরও বলেছেন, ‘কীভাবে দেব, সে টেকনিক আমাদের আছে। এখন বলব না। সময় হলেই বলব’। তিনি যেভাবে কথাটি বলেছেন, তাতে আমরা বিশ্বাস করতে চাই- এর সারবত্তা রয়েছে। এদিকে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে হিমশীম খাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় সরকারের উচিৎ, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানকল্পে আন্তরিকভাবেই বিরোধী দলের সহায়তা নেয়া। মেয়াদপূর্ণ করতে বর্তমান সরকারের লাগবে আরও প্রায় দুই বছর। উক্ত সময়ে জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদোধী দলেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। একে রাজনৈতিক কৌশল হাতছাড়া হয়ে গেলো ভাবা ঠিক হবে না। তারা উদারতা দেখালে তা জনমনে একটা প্রভাব নিশ্চয়ই ফেলবে। সেটি পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে যথেষ্টই সহায়তা জোগাবে তাদের।

আন্দোলন-সমাবেশের সে গতবাঁধা সরকার অপদস্তের কৌশল মানুষ আর বিরোধী দলের কাছ থেকে দেখতে চায় না। সরকারের সেই পুরনো অবস্থানও তারা প্রত্যাশা করেন না আর। সবাই চায়, জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যমত্য দেখতে; যেখানে সরকারি ও বিরোধী দল কাজ করবে একসঙ্গে।

নিয়াজ মাখদুম

বাংলাদেশ ও শচীনের দিন

শুক্রবার মিরপুর শেরেবাংলা নগর স্টেডিয়ামে ক্রিকেটপাগল প্রায় ২৬ হাজার দর্শক প্রাণভরে উপভোগ করলেন বাংলাদেশ বনাম ভারতের ম্যাচ। এর বাইরে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ টিভিতে দেখেছেন খেলাটি। অনুমান করা যায়, এটি তাদের কাছেও ছিল সমান উপভোগ্য। এ ম্যাচের একদিকে শচীন টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরী; আরেক দিকে বাংলাদেশের অপ্রত্যাশিত কিন্তু বলিষ্ঠ জয়। দুদিক থেকেই ঐতিহাসিক এ ম্যাচটি ছিল, উত্তেজনাকর।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীন এ সেঞ্চুরিটিই খুঁজছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। দর্শক ও মিডিয়ার চোখও ছিল এটির ওপর। দেখা যাক, কোথায় সফল হন তিনি? বিশেষত ভারতীয় ক্রিকেট দলের অস্ট্রেলিয়া সফরকালে এ আকাঙ্ক্ষা তুঙ্গে উঠেছিল। সেখানে ব্যর্থ হওয়ায় অনেকে বলছিলেন- বুদ্ধিমানের কাজ হবে শচীন যদি ওয়ানডে ছেড়ে দিয়ে টেস্টে এ কাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরী হাঁকানোর চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে শুরু হলো, এশিয়া কাপ। শঙ্কা আরও তীব্র হচ্ছিল। এ চ্যাম্পিয়নশিপের পর শচীন আর ওয়ানডে খেলতে পারবেন তো! যা করার তাকে এশিয়া কাপেই করে দেখা হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি এটি করে দেখালেন। সৌভাগ্যের বিষয়, তা ঘটল ঢাকাতেই। কারও কারও এ ক্ষেত্রে কিছুটা আক্ষেপ থাকতে পারে অবশ্য- কেন এ সেঞ্চুরীটি ঘটল বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই! খেলাটি শুরুর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অনেক সদস্যও কামনা করেছিলেন, শচীনের শততম সেঞ্চুরী যেন ঢাকাতেই হয়; এটি যেন হয় বাংলাদেশ ভিন্ন অন্য দলের বিরুদ্ধে। তবে খেলা শেষে এ ধরনের আক্ষেপ কারও ছিল বলে মনে হয় না।

মিরপুর স্টেডিয়ামে এখানকার দর্শকদের ক্রীড়াসুলভ যে মনোভাবটি দেখলাম, তা অতুলনীয়। কে বলবে, এদেরই কেউ কেউ গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ক্ষিপ্ত হয়ে ঢিল ছুঁড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলকে লক্ষ্য করে! শচীন ৮০ রান করার পরই দর্শকদের কাউন্টডাউন শুরু হলো। এ দেশে সাকিব আল হাসান জনপ্রিয় ক্রিকেটারদের অন্যতম। অথচ দেখা গেলো, তিনি বল করছেন স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক গল ফাটাচ্ছে ‘শচীন’, ‘শচীন’ বলে। সেঞ্চুরী করার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকরা দাঁড়িয়ে গেলেন তার সম্মানে। অন্য কোথাও নিজ দলের সঙ্গে খেলায় বিপক্ষ দলের একজন খেলোয়ারকে দর্শকরা এতটা সম্মান দেখান কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। টিভি কমেন্টেটররাও অভিভূত হয়েছিলেন এটি দেখে। একজন তো বলেই ফেললেন, শচীন তার হোমগ্রাউন্ড মুম্বাই স্টেডিয়ামে খেলছে।

হতে পারতো, শচীনের সেঞ্চুরী ও বাংলাদেশের পরাজয় দেখেই বাড়ি ফিরছেন দর্শকরা। তা হয় নি। বরং শচীনের শততম সেঞ্চুরীর কারণে ঐতিহাসিক এ ম্যাচ শেষে তারা ফিরেছেন প্রফুল্লচিত্তেই। তারা উচ্ছ্বসিত হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দুঃসাধ্য সাধন দেখে। অথচ ওই ম্যাচে ভারত যে টার্গেট আমাদের দেয়, অসম্ভব না হলেও পরে ব্যাটিং করে কিছুটা কঠিনই ছিল তা টপকানো। স্বপ্নের মতো তা-ই ঘটালো আমাদের দামাল ছেলেরা। ৪০ ওভারের আগ পর্যন্ত আশা থাকলেও স্পষ্ট ছিল না সেটি। তখন সাকিব ও নাসিরের দৃঢ়তায় রান জমছিল বেশ। মনে হচ্ছিল, এ ধারায় চলতে থাকলে ম্যাচ জেতা কঠিন হবে না। এরই মধ্যে আউট হয়ে গেলেন সাকিব। তখন একবার শঙ্কা জেগেছিল, আগে যেমনোতি দেখা গেছে তেমন উইকেট পতনের উৎসব না শুরু হয়ে যায়। তারপরন মুশফিক এলেন। তার পেটানো দেখে আরও ঘাবড়ে গেলেন সবাই। এই বুঝি গেলো আরেকটা উইকেট। তবে এসব শঙ্কা দূর করে শেষ পর্যন্ত মুশফিকের হাত ধরেই এলো বাংলাদেশের জয়সূচক রান। সারা দেশ ভাসলো আনন্দে। টিভি ছেড়ে রাস্তায় মানুষের জমায়েত বাড়তে থাকলো। আর যারা ছিলেন মিরপুর স্টেডিয়ামে? দেখে মনে হচ্ছিল, তারা সেখান থেকে বেরুতে চাইছেন না; বেরুলেই যদি শচীনের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরী আর আমাদের বিজয়ের বেশ কেটে যায়! তারা সবাই বোধকরি চাইছিলেন, কিছুক্ষণ থেকে আরও কিছু স্মৃতি জমাতে। পরে মানুষের কাছে গল্পও তো করা যাবে- ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন ব্যাটসম্যানের শততম সেঞ্চুরী আমি কাছ থেকে দেখেছি; দেখেছি পিছিয়ে পড়েও বাংলাদেশকে জিততে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

From 2011-15

সাইবার ওয়ার!

সম্প্রতি সাইবারস্পেসে সক্রিয় হয়ে উঠছে ভারত ও বাংলাদেশের হ্যাকাররা। ভারতীয়রা নিজেদের অভিহিত করেছে ইন্ডিশেল গ্রুপ। আর বাংলাদেশী হ্যাকারদের দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সাইবার আর্মি, বাংলাদেশ ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারস, এক্সপায়ার সাইবার আর্মি প্রভৃতি নামে। এরা বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক গুলিবর্ষণের প্রতিবাদেই আক্রমণ চালানো হয়েছে ভারতের সাইবারস্পেসে। ছোটরা কিছু করে দেখালে আমরা যেমন মজা পাই ও উৎসাহ দেই, এ ক্ষেত্রেও অনেকের মাঝে দেখা গেছে তেমন মনোভাব। বাংলাদেশী হ্যাকারদের দাবি, অ্যানোনিমাসসহ কয়েকটি পাকিস্তান, সৌদি আরবভিত্তিক হ্যাকার গ্রুপও সমর্থন জানিয়েছে তাদের কাজে। এ বিষয়ে অবশ্য নিঃসন্দিহান নয় অনেক আন্তর্জাতিক হ্যাকারই। তাদের মতে, বিএসএফের সাইট বিকল করেছে বটে, কিন্তু এটির ম্যাট্রিক্সের কোনো ক্ষতি করতে পারে নি বাংলাদেশী হ্যাকাররা। নির্বিচারে প্রায় ২০ হাজার ভারতীয় সাইট অচল করেছে তারা। এ দিকে ইন্ডিশেল বাছাই করে আক্রমণ চালিয়েছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সাইটে। চেষ্টা করেও এ আক্রমণ নাকি ঠেকাতে পারে নি বাংলাদেশ সাইবার আর্মি।

কথা হলো, যে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশী হ্যাকাররা ভারতীয় সাইবারস্পেসে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেটি রাজনৈতিক সমস্যা। এভাবে চাপ দিয়ে ভারতীয় রাজনীতিকদের কাছ থেকে দাবি আদায় কঠিন। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ভিন্ন এ সমস্যা দূর করার বিকল্প নেই। আইন অনুসারে হ্যাকিং অপরাধের কাতারে গণ্য। আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়াও বেশ কঠোর এ ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকেই প্রাথমিকভাবে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়ে থাকে। তাছাড়া নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিচার করলে এসব হ্যাকররা নিজ দেশের জন্যই বড় হুমকি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আক্রমণ করার মতো সুবিধাজনক টার্গেট না পেলে এরা স্থানীয় নেটওয়ার্কেই আক্রমণ চালায়। বাংলাদেশে এর আগে র‍্যাব ও হাইকোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাইটগুলোয় সাইবার অ্যাটাক হয়েছিল। ই-কমার্স, এম-কমার্সের পরিধিও বাড়ছে দেশে। এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অনলাইনেই কর আহরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। অনলাইনে ট্রেনের টিকেট কাটার সুবিধাও চালু হয়েছে সম্প্রতি। এ অবস্থায় নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ও অভিভাবক হিসেবে সরকারের দায়িত্ব বাংলাদেশের হ্যাকারদের সামলানোর। আমাদের হ্যাকারদের আক্রমণের ধরন দেখলে বোঝা যায়, এরা প্রফেশোনাল নয়; এখনো অ্যামেচার। তবে প্রফেশনাল হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে না হ্যাকিংয়ে। দ্রুত আইন করে এদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া না হলে, ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে পড়বে বিষয়টি। তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য কিছু খাতে যে সুনাম আমরা কুড়িয়েছি বহির্বিশ্ব, তাও ম্লান হবে খানিকটা।

আইন প্রণয়নের আগে চিহ্নিত করা প্রয়োজন এসব হ্যাকারকে। দেখা দরকার, এরা আবাসী না পরবাসী বাংলাদেশী। অনেকের মতে, প্রবাসীরা এতে যুক্ত থাকতে পারে; তবে এরই মধ্যে স্থানীয় গ্রুপও রয়েছে যারা নেটওয়ার্ক হ্যাকিংয়ে সক্ষম। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সাইবার ফরেনসিক টেস্টে দেখা যায় বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট ও মালদ্বীপের ভারতীয় হাইকমিশনের সাইটে আক্রমণ চালিয়েছিল একই হ্যাকার গ্রুপ। সাইবার ওয়ারফেয়ারে বহুল উচ্চারিত শব্দ মার্সেনারি হ্যাকার। অর্থাৎ কেউ কোনো একটা নেটওয়ার্ক হ্যাক করতে চান, কিন্তু সে ক্ষমতা তার নেই। এমন পরিস্থিতিতে অর্থের বিনিময়ে মার্সেনারি হ্যাকার ভাড়া করা যায় ইন্টারনেটে। সাম্প্রতিক সাইবার ওয়ারে এমনটি ঘটেছে কিনা, খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

হ্যাকার চিহ্নিতকরণের পরে কাজটি হবে, এদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন। মেধাবী এ জনসম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে পারি আমরা। তার সঙ্গে অবশ্য আইন প্রণয়নের কাজটিও চালিয়ে যেতে হবে দ্রুত। পাশাপাশি গড়ে তুলছে হবে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

কামরুজ্জামান অভি

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের যাত্রা

সম্প্রতি যাত্রা শুরু করেছে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস। এটি পরিচালিত হবে দিল্লী স্কুল অব ইকোনোমিকস (ডিএসই), আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকসের (এলএসই) আদলে। অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা করেছে অথচ এলএসই’র নাম শুনেন নি, এমন মানুষ বিরল। এলএসই প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটা কিন্তু মজার। এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’। তার কৌতুহল ছিল বিচিত্র সব বিষয়ে। আর এসব শিখতে তিনি বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ বন্ধুদের। অর্থনীতি সম্বন্ধে শ’র শিক্ষক ছিলেন সিডনি ও বিয়াট্রিস ওয়েব। ১৮৯৪ সালের কথা। ওয়েব দম্পতির সঙ্গে তিনি আড্ডা দিচ্ছিলেন- বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতকরণ নিয়ে। শ’র শৈশবটা আনন্দের ছিল না। এ জন্য প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকেই দায়ী করে এসেছেন আজীবন। তার মতে ব্রিটেনের শিক্ষা ব্যবস্থা কারা আইনে চলে যেখানে শিক্ষকরা হলেন ছাত্র পেটানো কেরানি। তারওপর এসব শিক্ষক যা শেখান, অধিকাংশ সময়ে তুলে ধরা হয় না তার বাস্তব দৃষ্টান্ত। এতে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকশিত হতে পারে না। তিনি উদাহরণ টানলেন, রেলইঞ্জিন সম্বন্ধে ব্রিটেনের শিক্ষকরা যা শেখান, তাতে মনে হয় ওটি ভিনগ্রহের কোনো বস্তু। তাদের বদলে কোনো রেলইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে এ ক্লাস নেয়া হলে ঢের ভালো শিখতে পারবে শিক্ষার্থীরা। কথাগুলো মনে ধরেছিল ওয়েব দম্পতির। কয়েক মাস পর তারা শ’র কাছে আসেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স নামে ভিন্ন ধারার বাস্তবমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে। সারা জীবন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করলেও শ’ বন্ধুর পীড়াপীড়িতে রাজী হন। তাদের তিনজনের দান করা অর্থে ১৮৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এলএসই।

একই শিক্ষাদর্শনের ভিত্তিতে ১৯৪৯ সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গড়ে তোলা হয় ডিএসই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেক বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদেরও স্বপ্ন ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। শেষ পর্যন্ত কয়েক বছর আগে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর স্বীকৃতিও নেয়া হয়। সম্প্রতি অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েই শুরু হলো এর কার্যক্রম। এটি আমাদের জন্য সুখবর। প্রতিষ্ঠানটিতে আপাতত স্নাতক পর্যায়ের কোর্স রাখা হচ্ছে না; থাকছে স্নাতোকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ।

আশা করা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মান ধরে রাখতে রাখলে অর্থনীতিতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য অনেকেই বিদেশে যেতে নিরুৎসাহিত হবেন এখন। এতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে উন্নত দেশগুলোর মতো খন্ডকালীন ভিত্তিতে। শিক্ষক হিসেবে বাংলাদেশীদের পাশাপাশি থাকবেন বিদেশী অর্থনীতিবিদরাও। এভাবে ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস জমিয়ে তুলতে পারলে রোধ হবে এ দেশ থেকে মেধাপাচার। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এলএসই’র আদলে সুপরিসর কনফারেন্স হলও থাকছে এতে। এ ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই জরুরি একটি বিষয় হলো, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। অনেক বিষয়ে অনলাইনে ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত মিললেও এমন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যে কারণ বৃহৎ ডিজিটাল আর্কাইভের পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ক বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার এলএসই’তে। অনেকের শঙ্কা, দেশের শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যমান রাজনীতির প্রভাব পড়তে পারে এখানে। একে রাজনীতি থাকবে কিনা, এ বিষয়ে এখনো কিছু জানান নি ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের গভর্নিং কাউন্সিল। তবে এ ধরনের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে দেশে ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে সেটিকে রোধ করা দরকার।

ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকসে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে, অর্থনীতির প্রায়োগিক দিকের প্রতি। দেশে যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে এ ধরনের অর্থনীতি শিক্ষার। প্রত্যাশা রইল, এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি অগ্রদূতের ভূমিকা নেবে। এভাবে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা গেলে প্রতি বছর সাশ্রয় হবে বিভিন্ন প্রকল্পের বিদেশি অর্থনৈতিক পরামর্শদাতাদের বিপুল কনসাল্টেশন ফী। তাছাড়া দক্ষ মানবসম্পদ রফতানিতে ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশের। প্রতিষ্ঠানটি তা পুষিয়ে উঠতেও সহায়তা জোগাবে, সবার প্রত্যাশা।

ফাহমিদা ফেরদৌস

মাঝখানে লাভ হলো আমেরিকার

কয়েকদিন আগে হরমুজ প্রণালীতে রাডার বিধ্বংসী মাঝারি পাল্লার ব্যালাস্টিক মিসাইল মেহরাবের পরীক্ষা চালায় ইরান। সামরিক-রাজনৈতিক কোনো চোখ রাঙ্গানিই তাতে ছিল না প্রাথমিকভাবে। প্রধানত যৌথ মহড়ার অংশ হিসেবে ডজনখানেক মেহরাব ওড়ানো হয় সে সময়। তবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায় কিনা, সে ভাবনা বোধকরি ছিল কোনো কোনো ইরানী রাজনীতিকের। যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা চাপে রাখতেই তারা বলে ফেললেন, আক্রান্ত হলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়া হবে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ একবার ইরানকে উল্লেখ করেছিলেন, শয়তানী শক্তি হিসেবে। এ ক্ষেত্রে ওবামা প্রশাসন খানিকটা নমনীয় হলেও ইরানের ওপর চাপ কিন্তু কমে নি। কয়েক মাস আগে তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়, পরমাণু অস্ত্র রয়েছে তেহরানে। তবে ধোপে টেকে নি এটি। প্রমাণ দেখাতে না পেরে, পিছু হটেছে মার্কিনীরা। মাঝে ব্রিটেন বলেছিল, পড়াশুনা শিখে দেশে গিয়ে মিসাইল বানায় আর হ্যাকিং করে ইরানীরা; ইউরোপে তাদের অভিবাসন বন্ধ করা হোক। এরই মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি দূতকে হত্যার ‘ইরানী নীলনকশা’ ফাঁস করে দিলো মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। তবে উভয় পক্ষ থেকে সংযত মন্তব্য করায় খেই হারায় বিষয়টি। এসবের বিপরীতে ইরানীরা জবাব দিতে পারে নি বলা চলে। সফলতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মাসখানেক আগে একটি মার্কিন ড্রোনকে ধরাশায়ী করতে পারাটা। ইরানীরা দাবি করে গোপনে ছবি তুলতে এলে তাকে হ্যাক করে মাটিতে নামানো হয়। আমেরিকানরা অবশ্য বলে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই বিকল হয়ে পড়ে ওটি। অবশ্য মহাকাশে ইরানের স্পাই স্যাটেলাইট আইরিশের বিষয়টি চেপে যান তারা। ড্রোন ভূপতিত করার আনন্দেই হয়তো, হরমুজ বন্ধের অতিউৎসাহী ঘোষণা দিয়েছিল দেশটির সরকার। ওবামাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত। তবে হুঁমকিতে তিনি না পেলেও বেশ ভীত হন মার্কিন তেল (জ্বালানি) ব্যবসায়ীরা। এর প্রতিফলন দেখা যায় ওয়ালস্ট্রীটে সংশ্লিষ্ট কোম্পানীগুলোর দরপতনে। বিশ্ব বাজারেও হরমুজ পয়েন্ট দিয়ে আসা তেলের দাম বাড়ে ব্যারেলপ্রতি ২-৩ ডলার। মোট সরবরাহকৃত তেলের ২৫ শতাংশ যায় এখান দিয়ে (যার মধ্যে সিংহভাগ ইরানী তেল রয়েছে)। নির্দিষ্ট একটি পয়েন্টে তেল প্রবাহ এটিই সর্বাধিক। তবে ইরান সমস্যায় পড়েছে ভিন্ন কারণে। লিবিয়াও অন্যতম বৃহৎ তেল রফতানিকারক দেশ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকট উঠছে দেশটি। দৈনিক তেল উৎপাদনও স্বাভাবিক হয়ে আসছে সেখানে। বিশ্বে প্রতিদিন সরবরাহকৃত তেলের পরিমাণ ৮৫ মিলিয়ন ব্যারেলের মতো। হরমুজ পয়েন্ট হয়ে যায় আনুমানিক ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল। এদিকে ৭ মিলিয়ন ব্যারেলের কাছাকাছি উৎপাদন করছে সংকটপরবর্তী লিবিয়া। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় সেটির দামও কম। এতে বেশি দামের ইরানী তেলের ব্যাপারে খানিকটা আগ্রহ হারিয়েছেন অনেক ক্রেতা। ইউরোপ বা আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকলে কী হতো বলা যায় না। তবে এটা স্পষ্ট ভয় দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়ে ইরান। হরমুজ দিয়ে তার তেলও তো যায়! মজার বিষয় হলো, এটিকে সুযোগ হিসেবে নেয় আমেরিকা। ইরান তাকে যে ভয়টি দেখাতে চেয়েছিল, সেটিই সে দেখায় ওমান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে। আমেরিকানরা এ দেশগুলোকে বোঝা সক্ষম হয়, সত্যিই যদি ইরান হরমুজ বন্ধ করে দেয়- তেল সরবরাহ ব্যাহত হলে এসব দেশের উপায় হবে কী? এ ক্ষেত্রে একটি উপায় ছিল ট্রান্স-অ্যারাবিয়া পাইপলাইন বসানো। কিন্তু তাতে ঝক্কি-ঝামেলা অনেক; সময়ও লাগবে কয়েক বছর। সৌদি আরব, ওমান ও আরব আমিরাত হয়ে (অভ্যন্তরীণ লাইন বাদে) ৭৪১ কিলোমিটার মূল পাইপ স্থাপন করতে হবে লোহিত সাগর পর্যন্ত। কথা হলো, এটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। আগে কিছু একটা তো করা দরকার স্বল্পমেয়াদেই। এ দ্বিতীয় পছন্দটা বেশ সহজ। উপসাগরে নিজেদের প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধি করলেই হলো। ইরানের হুমিক্তে বেশি ভয় পেয়েছিল বোধকরি আমিরাত। খানিকটা তড়িঘড়ি করেই তারা ৩৫০ কোটি ডলারের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করেও ফেলল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এরই মধ্যে ভয় দেখাতে গিয়ে মার্কিনীদের উপকার হচ্ছে, বুঝতে পেরে ইরান নতুন করে ঘোষণা দিলো- হরমুজ প্রণালী চালু থাকবে। আমিরাতও বোধকরি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে এতক্ষণে। অবশ্য কিছু করার নেই এখন। আমিরাত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দিয়ে মাত্র কয়েক শত ব্যালাস্টিক মিসাইল কিনেছে; যেখানে ইরানের শুধু কোস্টাল ডিফেন্স ক্রুজ (সিডিসি) মিসাইলই রয়েছে কয়েক হাজার। আমিরাতের মাথায় রাখা উচিৎ ছিল, যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ইরান আক্রমণ করে নি কেন। আসলে এ ক্ষেত্রে আমেরিকানরা ষোড়শ শতাব্দীর একটি ঘটনার কারণেই হয়তো সতর্ক পদক্ষেপ ফেলতে চায়। ওই সময় সমুদ্রের পরাশক্তি একটি পর্তুগীজ নৌবহর হরমুজ প্রণালী হয়ে বন্দর আব্বাস দখল করতে গিয়ে বন্ধী হয় নিজেরাই।

ফাহমিদা ফেরদৌস

From 2011-15

জিদে চিড়া ভিজলো না বলে-

কিম জং ইলের পর উত্তর কোরিয়ার দায়িত্ব নেন তার ছোট ছেলে কিম জং উন। তাকে ঘিরে একেক জনের প্রত্যাশা ছিল একেক রকম। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশা ছিল- সুইজারল্যান্ডে পড়াশুনা করা উন পিতাকে অনুসরণ করবেন না; তার শাসনামলে পশ্চিমের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কোন্নয়ন ঘটবে। ইলের সময়ে প্রধানত দক্ষিণ কোরিয়াকে চাপে রাখতেই বেশ কয়েকবার সামরিক মহড়া চালানো হয় কোরীয় উপদ্বীপে। সে সময় পারমাণবিক শক্তিও অর্জন করে বিশ্বের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক এ দেশটি। উন ক্ষমতা নেয়ায় সেটি রহিত হবে এবং উন সামরিক শাক্তির বদলে অর্থনৈতিক শক্তি অর্জনেই বলে ভেবেছিলেন দক্ষিণ কোরীয় নেতারা। কেউ কেউ এমন কল্পনাও করছিলেন, এবার মুক্ত অর্থনীতিতে প্রবেশ করবে উত্তর কোরিয়া; আর তাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করবেন এশিয়ান মিরাকল দক্ষিণ কোরিয়ার ধনাঢ্য বিনিয়োগকারীরা। তেমন কিছু দেখা যায় এখনো।

উনকে ঘিরে উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষের কী প্রত্যাশা ছিল ও আছে, জানা যায় নি তাও। সেটি জানা বেশ কঠিন। দেশটিতে সরকারি অনুমতি ব্যতীয় গণমাধ্যমে মত প্রকাশ করা দণ্ডনীয়; তা প্রচার করা তো বটেই। তবে উন ক্ষমতায় আসার পর গণমাধ্যমে সাধারণ মানুষের যে প্রতিক্রিয়া নেয়া হয়েছিল তাতে বোঝা গেলো, তারা চান- কিম জং ইল যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন উন তার চেয়েও বেশি উচ্চতায় তুলে ধরবেন উত্তর কোরিয়ার ঝাণ্ডা। সেটি কীসের ঝাণ্ডা- সামরিক না অর্থনৈতিক সেটি অবশ্য খোলাসা হচ্ছে না এখনো। এদিকে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা চেয়েছিল- উন তাদের বেতন-ভাতাদি বাড়াবেন; পদস্থ কর্মকর্তারা সম্ভাবত চেয়েছিলেন- তাদের তরুণ নেতা এমন কিছু করে দেখাবেন যাতে দক্ষিণ কোরিয়াসহ সমগ্র বিশ্ব চুপ মেরে যায়। বর্তমানে দেশটির নীতিনির্ধারণে আরেকটি পক্ষ রয়েছে, যারা সাধারণ মানুষের সামনেও তেমনভাবে আসেন না। এরা হলেন, কিম জং উনের বোন ও তার স্বামী। বলা হয়, তরুণ উনের ওপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব তাদেরই।

সম্প্রতি দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয় হতে ও জনগণের আস্থার্জনে এদের প্ররোচনাতেই নাকি মহাশূণ্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঘোষণা দেন উন। আর ঘোষণাটি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে যায় গোটা বিশ্বে। এতে যথারীতি প্রথমেই নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র; পরে রাঙ্গায় চোখ। দক্ষিণ কোরিয়া যে ভয় পেয়েছে তা তাদের বক্তব্য শুনেই বোঝা গেলো। আতংক প্রকাশ করল জাপানও। উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংয়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যেই ছোঁড়া হচ্ছে রকেটটি। ওই বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যতা পেলো না জাপানীদের কাছে- স্যাটেলাইট ক্যাপস্যুলে নেতার পোস্টার না দিয়ে যদি পারমাণবিক বোমা বসিয়ে দেয় উত্তর কোরীয়রা? ফলে ঝুঁকি না নিয়ে অব্যাহত নিন্দাবাদ চালানোর পাশাপাশি তারা প্রস্তুত রাখল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা তাদের ক্ষেপনাস্ত্র বিধ্বংসী মিসাইল ব্যাটারিগুলোকে।

মজার বিষয়, এত বড় ঘটনায় অন্য দেশের ক্ষেত্রে ঘটলে ব্যাপক প্রক্রিয়া দেখিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এবার তেমনটি দেখা গেলো না। সম্ভবত তারা নজর রাখছিল, উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ও কারিগরি সহযোগী রাশিয়ার ওপর। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এলেও এবারে রাশিয়া কিন্তু তাদের এক প্রকার বারণই করেছিল সরাসরি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে না যেতে। কয়েকজন রাশিয়ান বিজ্ঞানী বলেছিল, মহাশূণ্যযান কেন দূরপাল্লার মিসাইল তৈরিতেও সক্ষমতা হয় নি উত্তর কোরিয়ার। উন রকেট সায়েন্স তেমন বোঝেন না; বুঝতে চানও না। তিনি জেদ ধরলেন, তিনি যেহেতু ঘোষণা দিয়েই ফেলেছেন যত শীঘ্র সম্ভব রকেট ওড়াতে হবে।

রকেট ওড়ানো হল। উৎক্ষেপণের ১০ মিনিটের মাথায় বিস্ফোরিত হলো সেটি। তার এক টুকরা উদ্ধার করা গেলো। কিন্তু নেতা কিম ইল সাংয়ের পোস্টার সম্বলিত রকেটের টুকরাটি খুঁজতে বেগ পেতে হচ্ছ এখনো। আর কী লাগে? কিম জং উনের আনাড়িপনা ও জেদ নিয়ে হাসাহাসি পড়ে গেলো পশ্চিমে; দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান ফেলল স্বস্তির শ্বাস। জিদে চিড়া ভেজাতে না পেরে উন হলেন ‘বিব্রত’।

নিয়াজ মাখদুম

অভিমান নয় তো?

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে জিমি সিডন্সের পর ২০১১ সালের জুলাইয়ে দায়িত্ব নেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার স্টুয়ার্ট ল। দায়িত্ব নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাফল্য পান নি তিনি; বরং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-দর্শক নির্বিশেষে তার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন তখন। কারণ একই বছরের আগস্টের তার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ দল টেস্ট ও ওয়ান ডে ম্যাচে হারে জিম্বাবুয়েতে। বিসিবি, নির্বাচকমণ্ডলী ও কোচের মধ্যে সমন্বয়হীনতার আভাষও মেলে সে সময়। দলের মধ্যেও ঘটে শৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো কয়েকটি ঘটনা। কয়েকজন ক্রিকেটার বাজে আচরণও করেন স্টুয়ার্টের সনে। এদিকে দলীয় শৃংখলা বজায় রাখতে কিছু ক্ষেত্রে গো ধরে বসেন তিনি। আর এতেই নাকি তার ওপর নাখোশ ছিলেন বিসিবি সভাপতি।

অধিকাংশ মানুষ এসব ভেতরের রাজনীতি বোঝেন না, বুঝতে চানও না। তারা শুধু দেখতে চান, বাংলাদেশ দল জিতেছে। ফলে জিম্বায়ুয়ের কাছে হারায় সাধারণ দর্শকদের অনেকেই কোচ হিসেবে স্টুয়ার্ট লকে পুনর্বিবেচনা করে দেখার দাবি জানিয়েছিলেন। এ দেশের ক্রিকেটপাগল দর্শকের সঙ্গে কম-বেশি মিল রয়েছে ইতালিয়ান ফুটবলপ্রেমীদের। তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা প্রচলিত আছে। সেগুলো হলো, এরা কেবল দলের জয় দেখতে চান; কোনো কারণে দল পরাজিত হলে তাতে সত্যিই খেলোয়াড়-কোচের গাফিলতি ছিল কিনা, তাও শুনতে চান না; ফলে দল পরাজিত হলে এরা অবলীলায় মুন্ডুপাত করেন খেলোয়াড় ও কোচের। খানিকটা হলেও এ ধরনের গঞ্জনা স্টুয়ার্টের জুটেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জিম্বাবুয়ে সফরে।

তখন কোনো রকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান নি তিনি। সম্ভবত পদত্যাগের সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন তখনই। তবে পরাজয় মেনে নিয়ে দায়িত্ব ত্যাগ করা আত্ম-অবমাননার শামিল। ফলে তিনি হয়তো চাইছিলেন নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই পদত্যাগ করবেন। তার ক্ষমতার স্বাক্ষরতা স্টুয়ার্ট রাখলেন ২০১২ সালের এশিয়া কাপে। এতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করল বাংলাদেশ দল। ক্রিকেটারদের পাশাপাশি প্রশংসা হলো কোচেরও। ওই সাফল্যের রেশ কাটতে না কাটতেই গত সোমবার কোচের পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেছেন স্টুয়ার্ট ল। বলেছেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। একজন পেশাদার ব্যক্তিগত আবেগে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন- কতটা বিশ্বাসযোগ্য এ কথা? অবশ্যই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোটা মানুষের জিওন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছেড়ে না গিয়ে এখানেই পরিবারকে নিয়ে থাকতে পারতেন তিনি? তাছাড়া এমন তো নয় যে, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কোচের দায়িত্ব পালন করতে করতে তিনি ক্লান্ত। তাই সাফল্য ছেড়েও এখন উতলা হয়েছেন পরিবারের সঙ্গে থাকতে? ফলে সন্দেহ হচ্ছে, এ দেশের খেলোয়াড়-দর্শক-বিসিবির ওপর অভিমান করেন নি তো স্টুয়ার্ট?

অনেকে বলছেন, তিনি চলে যাচ্ছেন জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়াতে কোচের চাকুরি পাওয়ায়। এমন যদি হতো তিনি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের কোচ হচ্ছেন, তাহলে উক্তিটি আরও বিশ্বাসযোগ্য হত। কারও কারও ধারণা, এশিয়া কাপের সাফল্য স্টুয়ার্টকে লোভী করে তুলেছে। তিনি এবার বেশি দামে অন্য দেশের কোচ হবে। মন সায় দেয় না এতেও। বাংলাদেশী দর্শকদের যে উষ্ণতার কথা বারাবার উল্লেখ করতেন তিনি, আরও বেশি আয়ের প্রলোভনে ত্যাগ করবেন সেটি? কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় ক্রিকেটের নোংরা রাজনীতি ঢুকে পড়ছে। এ পরিবেশে স্টুয়ার্টের পক্ষে থাকা সম্ভব ছিল না। এশিয়া কাপের আগেই তো বিসিবি সভাপতি ও প্রধান নির্বাচকের মাঝে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল। শেষ পর্যন্ত জটিলতা নিরসনে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। এ ধরনের কিছু ‘সমস্যা’ স্টুয়ার্টের সঙ্গেও এক বা একাধিক ব্যক্তির হয়ে থাকতে পারে।

একেবারে উড়িয়ে দেয়া যান না এমন অভিযোগ। এসবের সত্যতা যাচাই করাও জরুরি তাই। স্টুয়ার্ট ল যাচ্ছেন, তার পরে অন্য কেউ আসবেন ক্রিকেট দলের কোচ হয়ে। তার ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। ফলে কোনো সমস্যা থাকলে এখনই সেটি দূরীকরণে মনোযোগী হওয়া দরকার।

ফাহমিদা ফেরদৌস

ক্রীড়া অর্থনীতি

পেতে চাইলে বিনিয়োগ করুন অলিম্পিকসে

আজই শেষ হচ্ছে লণ্ডন অলিম্পিকস (মূলত সামার অলিম্পিকস; একই স্থানে কিছুদিন পর শুরু হবে প্যারাঅলিম্পিকস), ২০১২। এরই মধ্যে এটি থেকে অর্থনীতিবহির্ভূত তো বটেই অর্থনৈতিক প্রত্যাশা-প্রাপ্তির খেরোখাতা নিয়েও বসে গেছেন আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা। এত বড় একটা আয়োজন ঘিরে ব্যবসাপাতি ভালো হওয়ার কথা। আয়োজকদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠা নিরুদ্বেগ বলছে, মন্দ হয় নি ব্যবসাটা। তবে সেটি আশানুরূপ কিনা, জানা যায় নি এখনো। প্রতিটি অলিম্পিক গেমসেই স্বতন্ত্র কিছু খোঁজা হয়- সম্ভবত যাতে সুবিধা হয় মনে রাখতে। লণ্ডনেও তেমন ঘটনাও রয়েছে বেশ কিছু। বেইজিং অলিম্পিকসে আশানুরূপ ভালো করে নি টিম ইউএসএ। তার কারণ হিসেবে অনেকে তুলে ধরনের অদ্ভূত সব যুক্তি (অধিকাংশই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব)। চীন নাকি সিংহভাগ ভেন্যুতেই এমন ব্যবস্থা রেখেছে যাতে পদক না পায় যুক্তরাষ্ট্র; পেলেও তা যেন স্বর্ণপদক না হয়। অবশ্য মূলধারার মিডিয়া বলছিল, অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনে নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারছে না চাপা থাকা মার্কিন ক্রীড়াবিদরা। তবে সেসব উক্তি অগ্রাহ্য করে সুইমিং পুলে অসামান্য নৈপূণ্য দেখান মাইকেল ফেলপস। লণ্ডনে ইতিহাস গড়েছেন তিনি; অলিম্পিকসে রেকর্ডসংখ্যক মেডেল জিতে।

বেইজিংয়ে একশ্রেণীর মার্কিন মিডিয়ার দেয়া যুক্তির একটা উপযোগীতা অবশ্য মিলল এবারের অলিম্পিকে। ১৯৯৪ সালের পর থেকে অলিম্পিকস ও ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সুবিধা করতে পারছে না এক সময়কার হকির দুই পরাশক্তি ভারত ও পাকিস্তান। লণ্ডনে ভারত বিদায় নিয়েছে কারও সঙ্গে না জিতে। আর পাকিস্তান দেশে ফিরেছে ৭-০-তে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হেরে। হারার পেছনে ‘ভালো’ যুক্তি দেখানো হয়েছে, নতুন টার্ফে নাকি এশিয়ানদের পক্ষে হকি খেলা কঠিন!

লণ্ডনে সার্বিকভাবে ভালোই করেছে চীন। স্টেফানি রাইসদের (রায়ান লকটিকেও) বিস্মিত করে স্বর্ণ জিতেছে ইউ শিয়েন। তবে ওই সবগুলো পদকও যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে থাকার জ্বালা-যন্ত্রণা মেটাতে পারবে কিনা, বলা মুশকিল। গতির নতুন রেকর্ড না গড়লেও এরই মধ্যে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন উসাইন বোল্ট; দেখিয়ে দিয়েছেন জ্যামাইকান নারী অ্যাথলিটরাও। দীর্ঘদিন পর হোমগ্রাউন্ডে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পদক এবার পেলো গ্রেট ব্রিটেন। অবশ্য সেখানকার অলিম্পিক কমিটি ইচ্ছা, আরও পাওয়া উচিৎ ছিল। এদিকে প্রত্যাশা সম্পূর্ণ পূরণ করতে না পারা ইলিনা ইসিনবায়েভার মতো কেউ কেউ বলেছেন, এতেই চলবে। রাশানদের সম্বন্ধে বলা হয়, জিমন্যাসটিকস না থাকলে তারা স্বর্ণপদক পেতো না। মারিয়া শারাপোভা সম্ভবত এটি ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন; পারেন নি। লণ্ডন ট্রাকেই দৌড়ালেন প্যারাঅলিম্পিক থেকে আসা প্রথম মানব অস্কার পিস্টোরিয়াস। অলিম্পিকসে প্রথমবারের মতো এবার দেখা গেলো সৌদি নারীদের। এতে উইমেন্স বক্সিং ইভেন্টও শুরু হলো এখানে।

তবে লণ্ডন অলিম্পিকসকে ভিন্নভাবে দেখতে চান যুক্তরাজ্যের ক্রীড়া অর্থনীতির অধ্যাপক ডেভিড ফরেস্ট। তিনি এক গবেষণায় দেখেছেন, এতে পদকপ্রতি রাষ্ট্রীয় ব্যয় হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। বিষয়টি মজার বটে। ডেভিড হিসাব করে দেখছেন, বিশ্ববাজারের দাম অনুযায়ী এবারের অলিম্পিকসে প্রতিযোগীদের দেয়া স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক তৈরিতে খরচ পড়েছে যথাক্রমে ৫৫ হাজার, ২৮ হাজার ও ৫ শত টাকার কাছাকাছি। ব্রোঞ্জ পদকের দাম এত কম পড়ার অন্যতম কারণ, এটিতে প্রচুর পিতল ছাড়াও রয়েছে সামান্য দস্তা ও টিন। এটি কিন্তু ব্রোঞ্জবিজয়ীদের আরেকবার মনোভঙ্গের কারণ হতে পারে।

ডেভিড পরবর্তী গবেষণা চালান, এসব পদক অর্জনে প্রতিটি দেশকে কী মাত্রায় আর্থিক ব্যয় স্বীকার করতে হয়। তাতে উঠে এসেছে মজার সব তথ্য। দেখা গেছে, অশ্ব পরিচালনা, শুটিং, টেবিল টেনিস, ভারোত্তোলন, তায়কোয়ান্ডো, ওয়াটার পোলো প্রভৃতি ক্রীড়ায় পদক পেতে খরচ করতে হয়েছে সবচেয়ে কম; স্বর্ণ-রৌপ্য-ব্রোঞ্জ পদকভেদে গড়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে অতীতের তুলনায় বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে সাঁতার ও সিনক্রোনাইজড সাঁতার। উভয় ক্ষেত্রে পদক পেতে খরচ করতে হচ্ছে গড়পড়তা ৮৫ কোটি টাকার মতো। তবে সবচেয়ে খরুচে হয়েছে সম্ভবত হকি খেলা। অনেক দেশ ১২০ কোটি টাকা খরচ করেও পায় নি কোনো পদক। এদিকে মোটামুটি ৪৫ কোটি টাকা খরচ করলেই প্রবলভাবে বেড়ে যাচ্ছে জুডো ও তায়কোয়ান্ডোতে খোদ স্বর্ণপদক পাওয়ার সম্ভাবনা। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, এসব হিসাবই করা হয়েছে এক অলিম্পিক থেকে অন্যটির মধ্যবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দকৃত শুধুই রাষ্ট্রীয় ব্যয় হিসাব ধরে; ভেন্যুতে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া প্রভৃতি খরচ যোগ করা হয় নি এতে। অলিম্পিকফেরত, ওয়াইল্ড কার্ডধারী আমাদের ক্রীড়াবিদদের জন্য সান্ত্বনার বস্তু হতে পারে গবেষণাটি। তবে ডেভিড অবশ্য বলছেন, কেবল উন্নত দেশগুলোই বেশি বিনিয়োগ করবে আর তিনরঙ্গা পদক থলেতে ভরবে, বিষয়টি তেমন নয়। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেরও অলিম্পিকসে পদক জয়ের সুযোগ রয়েছে যদি তারা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শুটিং, কুস্তি, জুডো ও জিমন্যাস্টিকসে সুবিধামত বিনিয়োগ বাড়াতে পারে।

কিছু বিষয় ডেভিডের গবেষণায় বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, পদক জিততে তো ক্রীড়াবিদের প্রতিভা, শারীরিক সামর্থ্য ও জোরালো মনোবলও প্রয়োজন। এটি অস্বীকারের উপায় নেই অবশ্য। স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত অনেক দেশেই রয়েছে এমন দৃষ্টান্ত। তবে সেগুলো ব্যতিক্রম। পদক অর্জন করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগও হতে হয় যথাযথভাবে। পশ্চিমা দেশসহ চীন-জাপানের দিকে তাকালেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে অলিম্পিকসে বিনিয়োগের বিষয়টি। অলিম্পিকসে এখনো কিছু পাই নি আমরা। এ অভাব দূর করতে অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয়ের সঙ্গে পর্যাপ্ত বিনিয়োগেও মনোযোগী হওয়া দরকার।

ফাহমিদা ফেরদৌস

খেলার মাঠে সহিংসতা

২০০০ সালের ঘটনা। সিডনি অলিম্পিক চলছে। টিভিতে পুরুষ হকি দেখাচ্ছিল একদিন। নেদারল্যান্ড বনাম জার্মানীর টান টান উত্তেজনার খেলা। গ্রুপের অন্য দল পাকিস্তান এরই মধ্যে দ্বিতীয় পর্বে উঠেছে। তাদের সঙ্গী হতে এ খেলায় জিততে হবে জার্মানীকে। নেদারল্যান্ডকে ড্র করলেও চলবে। ভালোই খেলছিল দু’পক্ষ। খেলা শেষ হওয়ার তখন ১০ মিনিটের মতো বাকি। নেদারল্যান্ড গোলপোস্টের কাছে পেনাল্টির আবেদন করল জার্মানরা। রেফারি গ্রাহ্য করলেন না এটি। কয়েকজন জার্মান খেলোয়াড় বাকবিতন্ডা জুড়ে দিলেন তার সঙ্গে। রেফারির পক্ষে কয়েকজন নেদারল্যান্ডের খেলোয়াড়কেও দেখা গেলো। এক পর্যায়ে বাকযুদ্ধ শুরু হলো জার্মানী বনাম রেফারি বনাম নেদারল্যান্ডের মধ্যে। মাঠে দর্শক তেমন ছিলেন না- ৫০ জনের বেশি হবে না। হঠাৎ রেফারি ক্ষিপ্ত হয়ে উভয় দলেরও দু’জনকে দেখালেন লাল কার্ড। কিছুক্ষণ মাঠ স্তব্ধ। একটু পর দেখা গেলো হকিস্টিক উঁচিয়ে জার্মানী ও নেদারল্যান্ডের খেলোয়াড়রা তেড়ে আসছে রেফারির দিকে। সে বেচারা প্রাণ বাঁচাতে ভোঁ দৌড়। অনেক খেলায়ই এমন ঘটনা ঘটে। তবে কিছু ক্ষেত্রে উত্তেজনা মোড় নেয় সহিংসতায়। অবশ্য সহিংসতা বাড়তে বাড়তে কিছু খেলার অলিখিত সংস্কৃতিতে পরিণত হতেও দেখা যায়। যেমন আইস হকি। এতে কেবল চোখ ছাড়া প্রতিপক্ষের শরীরে স্থানে আঘাত করা যায়; হকিস্টিক দিয়েও। একবার ৬ জন আইস হকি খেলোয়ার নিহতও হন এভাবে। এ ক্ষেত্রে সহিংসতা রোধে নেয়া হয়েছে অনেক ব্যবস্থাই। হকিস্টিক এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে আঘাতপ্রাপ্তরা না মারা যান। কঠোর আইন করা হয়েছে; আরও বাড়ানো হয়েছে খেলোয়াড়ের দেহসুরক্ষা। দর্শক ও খেলোয়ারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যাতে তারা ক্রীড়াসুলভ মনোভাব দেখান। এসবের পরও অনেক সময় স্টেডিয়ামে খেলোয়াড় ও দর্শকরা মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আচরণ দেখে মনে হয়, পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধারে খেলা দেখতে ও খেলতে এসেছেন তারা।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আগ্রাসন মৌলিক ও অন্তর্গত মানব বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, খেলার মাঠে সহিংসতার পেছনে দর্শক-সমর্থকদের উস্কানিই বেশি। তাতে খেলোয়াড়রা সাড়া না দিতে পারলেই বোধকরি সমর্থকরা নিজেরা দায়িত্ব নেন; নেমে যান রণক্ষেত্রে। প্রতিপক্ষের সমর্থক ও খেলোয়াড়ের ওপর চড়াও, দাঙ্গা এবং নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা এভাবে ঘটে। এমনই একটি ঘটনা দেখা গেলো গত বুধবার মিশরের পোর্ট সৈয়দ স্টেডিয়ামে। সমর্থকদের বাঁধানো সহিংসতায় নিহত হলেন অন্তত ৭৪ জন। অনেক সময় উত্তেজিত সমর্থকদের মাঝে বাধা হিসেবে থাকে শক্ত রেলিং। সে ব্যবস্থা ছিল না এতে। শুরুতেই উত্তেজনা দমন করতে পারলেও হয়তো এতদূর গড়াত না পরিস্থিতি। এ ক্ষেত্রে মিশরের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের অভিযোগ, এটি সেনাবাহিনীর কারসাজি; নইলে দাঙ্গা দমনে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতটা নিস্পৃহ ছিল কেন। অবশ্য মাঠে অ্যাকশনে না গিয়ে ভালোই হয়েছে সম্ভবত। ২০০১ সালে ঘানায় এ ধরনের দাঙ্গায় টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হলে মানুষজন আতংকিত হয়ে বেরুনোর চেষ্টা করেন ও পদপিষ্ট হয়ে মারা যান ১২৬ জন। আসলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শক্ত রেলিং ও পর্যাপ্ত নির্গম পথ রাখা হয় স্টেডিয়ামে।

এ দেশেও ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাকে কেন্দ্র করে মাঠ ও মাঠের বাইরে খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের সৃষ্টি করা সহিংসতার ঘটনা রয়েছে। দৃষ্টান্ত রয়েছে এভাবে দু’গ্রামে দাঙ্গা বাঁধারও। এ ক্ষেত্রে মানুষ নিহত হওয়ার খবর অবশ্য কম। তবু এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিৎ আমাদেরও। আর এ ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার দর্শক ও খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্রীড়াসুলভ মনোভাব তৈরি ও খেলার মাঠে সেটির প্রদর্শন।

ফাহমিদা ফেরদৌস

হাইব্রিড মাছের বাম্পার উৎপাদন

সাতক্ষীরা অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিড কৈ চাষে খামারিদের আগ্রহ বাড়ছে বলে খবর রয়েছে গতকালের বণিক বার্তায়। এ ধরনের মাছ উৎপাদনে খামারিদের আকর্ষণের কারণ কয়েকটি। সাধারণত এসব প্রজাতি দেশীটির চেয়ে আকারে বড় হয়। এগুলো বাড়েও দ্রুত। তাছাড়া বাজারে এখন মাছের বিপুল চাহিদা। অথচ মাছের তেমন সরবরাহ আসছে না প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে। হাইব্রিড মাছ চাষে খরচ খানিকটা বেশিই হয়। অবশ্য মুনাফা আরও বেশি হওয়ায় পুষিয়ে যায় এটা। নিয়ম করে দিনে কয়েকবার খাবার দিতে হয় এ মাছকে। তবে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম এগুলোর। বিদেশী মাছের সঙ্গে স্থানীয় জাতটির সংকরণে উৎপন্ন এসব মাছের চাষ দেশে বাড়ছে লক্ষ্যণীয়ভাবেই। খামারিরা এ থেকে লাভও করছেন প্রচুর। অবশ্য লাভ হবে না কেন- এক মৌসুমে প্রতি হেক্টর থেকে পাওয়া যায় টনখানেক হাইব্রিড জাতের কৈ!

ভোক্তা চাহিদার সঙ্গে বিশেষত হাইব্রিড তেলাপিয়া, পাঙ্গাস ও মাগুরের উৎপাদনও বাড়ছে দেশে। সত্য বলতে, এখানকার নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে আমিষের প্রধান উৎস এখন- ফার্মের মুরগি ও ডিম এবং চাষের মাছ। শুরুতে খাবার হিসেবে ফার্মের ডিমের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও বর্তমানে কেউ কেউ এটি গ্রহণ করে আমিষের ভালো বিকল্প না পেয়ে। আবার কারও কারও রুচিতে এমন পরিবর্তন এসেছে যে, তাদের কাছে দেশীর চেয়ে ফার্মের মুরগী ও ডিমই ভালো। নরম ও বেশি মাংস পাওয়া যায় এসব মুরগী থেকে। এতে তা রান্নাও করা যায় নানাভাবে। ফার্মের ডিম দেশীটির চেয়ে বেশ বড়। এসব কারণে আগে ফার্মের মুরগী ও ডিমের সমালোচনা করা হলেও স্থানীয় ভোক্তাদের একটি বিরাট অংশ এটির ক্রেতা এখন। প্রকৃতপক্ষে ফার্মের মুরগী আমাদের রুচিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে; একটি প্রজন্মকে করেছে এর ওপর নির্ভরশীল।

ফার্মের মুরগীতে অনেকটা সহজেই অভ্যস্ত হয়েছিলাম আমরা। হাইব্রিড মাছের ক্ষেত্রে অবশ্য এটা দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত এ জন্য চাহিদা আরও বাড়তে হবে, যখন আমিষের অন্যান্য উৎসের তুলনায় এটি হয়ে উঠবে সহজলভ্য। সে যাইহোক, ফার্মের মুরগী নিয়ে শুরুতে যে ধরনের মিথ ছিল, সেটি দেখা যাচ্ছে হাইব্রিড মাছের ক্ষেত্রেও। বলা হচ্ছে, এগুলোর আকারই যা একটু বড়, কিন্তু একেবারে স্বাদহীন। অবশ্য সমালোচনার পরও এ জাতের মাছের চাহিদা ও বিক্রি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে উপায়ও নেই। ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় দেশী কৈ পাওয়া যায় খুচরা বাজারে। এ দিকে হাইব্রিড জাতের কৈয়ের দাম কেজিপ্রতি মোটামুটি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। সত্য যে, একেবারে স্বাদহীন না হলেও এসব মাছের স্বাদ কম। তার কারণ, যেসব জাতের সঙ্গে স্থানীয় মাছের সংকর ঘটানো হয়, সেগুলোর উৎপত্তিস্থলের পরিবেশ। এ অবস্থায় আমাদের রুচি অনুযায়ী হাইব্রিড জাতের স্বাদে পরিবর্তন আনাটা জটিল কিছু নয়। এজন্য দরকার গবেষণার মাধ্যমে বিদেশী ও স্থানীয় জাতটির কয়েক প্রজন্মের উন্মেষ। এ ক্ষেত্রে গ্রেগর মেন্ডেলের সূত্র প্রয়োগ করে গন্ধ বদলানোও কঠিন হবে না।

গবেষণায় জোর দিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল, উচ্চ উৎপাদনশীল ও কম রোগের ঝুঁকিযুক্ত এসব মাছ চাষে খামারিদের উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। সীমিত পরিসরে নদ-নদী, খাল বিলেও এমন মাছের চাষ সম্ভব। এর আগে লাখো বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে পোল্ট্রি শিল্পে। সে তুলনায় মাছ চাষের অবদান কম। এটি বাড়িয়ে তোলা যায় ব্যাপকভাবে হাইব্রিড মাছের চাষ করে।

নিয়াজ মাখদুম

সহিংসতার ছাত্ররাজনীতির অবসান হোক

কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে খানিকক্ষণ কথাই বলতে পারেন নি অর্জুন। একই বিশ্বরূপ আমরা দেখছি এ দেশের ছাত্ররাজনীতিতেও। মাঝে মাঝে শিক্ষাঙ্গনে এমন ঘটনা ঘটছে যে তাতে আতংকে কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমাদের। দলীয়-উপদলীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে মারা পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। ধারালো অস্ত্র, লাঠি-সোঁটা এখন বুকশেলফের নীচেই থাকে; কখন কোনটার দরকার হয়! রাজনীতি করা শিক্ষার্থীদের কাছে বোমা-আগ্নেয়াস্ত্রও থাকে- প্রতিপক্ষকে হাতের নাগালে না পেলে ব্যবহারের জন্য।

মাসখানেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপদলীয় রাজনৈতিক কোন্দলে নিহত হলেন এক শিক্ষার্থী। কিছুদিন পরপরই সংঘর্ষ দেখে দিচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকমাসের মধ্যে বড় সংঘর্ষের খবর না থাকলেও ঢাকা-রাজশাহীতেও রয়েছে দলীয়-উপদলীয় কোন্দল। এরই মধ্যে ঘটে গেলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। দুই দলের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে নিহত হলেন দুই জন; আহত অনেক। অগ্নুৎপাত, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস কখন হবে, এটি যথাযথভাবে আভাষ দেয়ার প্রযুক্তি নাকি এখনো আবিষ্কার হয় নি। এ দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির অবস্থাও খানিকটা তাই। এগুলো কখন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরণ ও লাভার উদ্গীরণ শুরু করবে, অনুমান করা যায় না। আক্ষেপ হয়- এত তুচ্ছ কারণেও সহিংসতা ঘটে! মতাদর্শের কারণে সংঘাত বাধে না, বলা যাবে না। তবুও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘর্ষের কারণ- খেলার মাঠ-ক্যান্টিন-টিভি রুমের আধিপত্য, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, সিট দখল, অমুক উপদলের বড় ভাইকে তমুক কেন ‘সম্মান’ দেখালো না, এতদিন আমাদের সঙ্গে থেকে এখন কেন ওই দলে ভীড়ল, কেন আমাদের দেয়াল-ব্লকে লিফলেট-পোস্টার সাঁটানো হলো, কিছু ক্ষেত্রে হৃদয়ঘটিত জটিলতা প্রভৃতি। শিক্ষাঙ্গনে পেশীশক্তি ভিন্ন এসবের সমাধান হচ্ছে না দেখে বিবেচক যে কারো কষ্ট হবে। সহপাঠির পিঠে লাঠি ভেঙ্গে, বন্ধুকে কুপিয়ে, রুমমেটকে গুলি করেই কী এসব সমস্যার সমাধান করছে আজকের শিক্ষার্থীরা!

হলফ করে বলা যায় না, ভারতীয় উপমহাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে কখনোই সহিংসতা ছিল না। তবে একটা সময় পর্যন্ত রাজনীতিতে দলীয়-উপদলীয় কোন্দলকে ঘিরে সঙ্ঘর্ষ তেমন ছিল না। জাতীয় রাজনীতিকদেরও বিচক্ষণতা ছিল। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভালো-খারাপ দুটোই করা সম্ভব, ফলে জাতীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা থেকে শিক্ষার্থীদের খানিকটা দূরে সরিয়ে রাখা হত তখন। ছাত্ররাজনীতির দুর্বলতা ও এর সাংঘর্ষিক দিকটি ফুটে উঠল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়; সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় রাজনীতির অঙ্গ ও সহযোগী হিসেবে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হলে। ছাত্ররাজনীতিতে ব্যাপকভাবে অভ্যন্তরীণ সংঘাতও দেখা দেয় এ সময়। পরবর্তীতে বোধকরি মতাদর্শগত অবস্থান ভুলে গিয়ে তাদেরই অনুসরণ করে বাকিদলগুলো। কথা হলো, এমন ধারার রাজনীতির সমাপ্তি কী দেখা যাবে না শিক্ষাঙ্গনে? কন্টিনাম হাইপোথিসিসের মত অসীমকাল চলতে থাকবে এটি। অনেকে বলেন, এ সমস্যার সহজ সমাধান হলো জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়া; এটিকে পুরোপুরি শিক্ষামুখী করে ফেলা। এটি করতে গেলে এগিয়ে আসতে হবে রাজনীতিক-শিক্ষক-অভিভাবক- শিক্ষার্থী সবাইকেই।

বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই ১০০ বছরের বেশি পার করে নি। এ দিকে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান শুরু হয়েছে ১০৯৬ সাল থেকে। এর মধ্যে অসংখ্য বিপ্লব-সহিংসতা ঘটে গেছে দেশটিতে। কিন্তু কখনও অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবস্থায় তাতে জড়িয়ে পড়েছে, শোনা যায় না। তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনগুলো ততটা রাজনীতি সচেতন নয়- কেউ বলতে পারবেন না। অথচ আমাদের দেশে ভাংচুর, মারামারির খবর শোনামাত্র যে প্রশ্নটি জাগে তা হলো- কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে? এ ধরনের ঘটনা আর দেখতে চাই না আমরা; যে কোনো মূল্যে সহিংসতা বন্ধ করে শিক্ষাঙ্গনে জ্ঞানার্জনের পরিবেশ দেখতে চাই।

ফাহমিদা ফেরদৌস

From 2011-15

দ্য লেডী

কিছু মানুষ প্রচলিত পথে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ কেন থমকে দাঁড়ান? বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে কী এক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে মোহাবিষ্টের মতো একাগ্রচিত্তে খুঁজতে থাকেন মহত্তর কিছু; কেন এমন হন মানুষগুলো? তার উত্তর আজও মেলে নি মনোবিজ্ঞানের কাছে। জীনতত্ত্বেও এখনো রহস্যজনকই এটি। শুধু মায়ানমার কেন, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রে এমনই এক ব্যক্তি- অং সান সুচি। রক্তে মানুষের জন্য কিছু করারা তাগিদ সবসময় থাকলেও রাজনীতির মাধ্যমেই তা করতে হবে, তেমন মনোভাব তার ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন গণতন্ত্রে, বলতেন- নিজেদের জন্য ভালোটা নির্ধারণের অধিকার রয়েছে জনগণের।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে পিতা জেনারেল অং সান ও চাচা নিহত হওয়ার পর মায়ের সঙ্গে সুচি চলে আসেন নয়াদিল্লীতে। সেখানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে যান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা তার ছিল না তখনো। অক্সফোর্ডে পড়ছিলেন দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে। পড়তে গিয়ে পরিচয় মাইকেল অ্যারিসের সঙ্গে। অ্যারিস অক্সফোর্ডে পড়াতেন প্রাচ্যের ইতিহাস; তার পান্ডিত্য ছিল নেপাল, ভুটান ও বার্মা সম্বন্ধে। ফলে দু’জনের ঘনিষ্টতা জন্মাতে সময় লাগে নি। তারা বিয়ে করেন ১৯৭২ সালে। জীবনীকারদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসময় বেশ সুখী জীবন কাটাচ্ছিলেন সুচি। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার ইচ্ছা ছিল। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে ডক্টরেটও সম্পন্ন করেন সে কারণে। এরই মধ্যে সুচির জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে ১৯৮৮ সালে- দীর্ঘদিন পর অসুস্থ মাকে দেখতে ইয়াঙ্গুনে গেলে। ততদিনে রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) গঠিত হয়েছে মায়ানমারে। দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী ছিলেন তার মা। নেত্রী হিসেবে তেমন যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না তিনি; কর্মীরাও ছিলেন হতোদ্যম। তারা উদ্যোম ফিরে পেলেন সুচি ইয়াঙ্গুনে আসার পর। বাবা জেনারেল অং সানের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পাশ্চাত্য সভ্যতার অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল তার মধ্যে। তখনও তিনি নিশ্চিত ছিলেন না, রাজনীতিই করবেন কিনা। এ মানসিক সংকট থেকে তাকে উদ্ধার করে তদকালীন সামরিক জান্তা- এনএলডির এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সেনা আগ্রাসন চালিয়ে ২ হাজার মানুষকে হত্যার মধ্যে দিয়ে। ঘটনাটির প্রতিবাদে ও গণতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে রুখে দাঁড়ান সুচি। তার জনপ্রিয়তা বাড়ছিল তখন। এ সময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে গৃহবন্দী করা হয় তাকে।

তারপর লন্ডনের বাড়িতে আর যাওয়া হয় নি সুচির। স্বামী-সন্তানের সঙ্গে দু-একবার দেখা হয়েছে মাত্র। জান্তা হয়তো চেয়েছিল জনবিচ্ছিন্ন হলে এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়বেন তিনি। এরই মধ্যে অ্যারিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়ও যেতে দেয়া হয় নি তাকে। সৌভাগ্যবশত এসব শোক সহ্য করেও গণতন্ত্রের পথে অবিচল ছিলেন তিনি।

সুচির বয়স এখন ৬৬’র কাছাকাছি। গত প্রায় ৩০ বছর ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন গান্ধীর অনুসারী, মায়ানমারের অবিসংবাদিত এ নেত্রী। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তার অহিংসাবাদের সামনে হার মানতে চলেছে দেশটির জান্তা। এ ক্ষেত্রে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা ও নিজেদের শুভবুদ্ধিরো অবদান রয়েছে খানিকটা। সম্প্রতি এসব কারণে ২০ বছরেরও বেশি সময় পর গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয় সুচিকে। নতুন করে নিবন্ধনের সুযোগ দেয়া হয় তার দল এনএলডিকে। তার ধারাবাহিকতায়ই কয়েকদিন আগে ৪৫টি আসনের উপনির্বাচনে অংশ নিলো তার দল। সরকারি ঘোষণা না এলেও, বেসরকারি ফলাফলে অধিকাংশ আসনে জিতেছে তার দল। অনেকের শঙ্কা, কারচুপি করে নির্বাচনের ফল না আবার পাল্টে দেয় সরকার। তেমন কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না। বরং এটা বলা যায়- ঘোরতর শত্রু জুলিয়াস সীজারের বিষয়ে দেরীতে হলেও সিসেরোর যে উপলব্ধি এসেছিল সেটিই এখন অনুভব করছে মায়নমারের জান্তা। সিসেরোর মতোই তারা সম্ভবত বুঝতে পেরেছে, সময় কিছু মানুষের ওপর নিজে থেকে দেশ-কালকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়; সুচি তেমনই একজন।

নিয়াজ মাখদুম

আরও সহজতর এখন হৃদরোগ নিরাময়

কিডনি ও ফুসফুস মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এগুলোর কার্যপ্রণালী একাধারে জটিল ও সূক্ষ্ম। অঙ্গগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। আবার দেহের সবচেয়ে জটিল অঙ্গও এটি। কারণ মস্তিষককে নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। একটি সুবিধা হলো, কিডনি ও ফুসফুসে মতো অংশে সমস্যা দেখা দিলে স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্ক প্রাথমিক নিরাময়ের জন্য ব্যবস্থা নিয়ে থাকে; ঔষধের অপেক্ষায় না থেকে পেশির সংকোচন-প্রসারণ ঘটিয়ে, এনজাইম ও হরমোন নিঃসরণ করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হয় প্রাথমিকভাবে। এদিকে দেহের ‘জ্বালানি’ তথা সরবরাহকারি অঙ্গ হৃদযন্ত্রের কার্যপ্রণালী কিডনির মতো জটিল না হলেও এটি নিয়ন্ত্রণে মস্তিষ্ককে বিশেষ ঝামেলা পোহাতে হয়। তার কারণ হৃদপেশির ওপর মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নেই। এতে করে হৃদপিন্ড কোনো কারণে তার নির্ধারিত কার্যক্রম সম্পাদনে অসমর্থ হলে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় বাইরের সাহায্য বা চিকিৎসার। এতে সমস্যা দেখা দিলে মস্তিষ্ক সাধারণত সূক্ষ্ম ব্যথার মাধ্যমে তা জানিয়ে দেয় পুরো স্নায়ুতন্ত্রকে। অবশ্য অনেক সময় এতটা তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে যে ব্যথা বা অন্য কোনোভাবে সংকেত দেয়ার উপায় থাকে না। এ কারণে হৃদযন্ত্রের যেকোনো সমস্যাই মারাত্মক ও অল্প সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া না হলে এ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুও ঘটে থাকে।

হৃদরোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠবেন যে কেউ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর যত মানুষ ক্যান্সারে মারা যান তারচেয়ে বেশি মারা যান হৃদযন্ত্রের জটিলতায়। এ রোগে মৃত্যুর হার বছরপ্রতি আনুমানিক দুই কোটি। বহু হৃদরোগী রয়েছে আমাদের দেশেও। তাদের অনেকে জানেন, তবে বিপুল সংখ্যকই জানেন না যে, তারা রয়েছে হৃদরোগের ঝুঁকিতে। রোগটি নিয়ে এ দেশে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। তাহলো, হৃদরোগ বড়লোকের রোগ; এটি গরিবের হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। কথাটির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। তাতে যোগ না দিয়ে, এ সংক্রান্ত কিছু কৌতূহলোদ্দীপক পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে এখানে। জানা যায়, ধনীদের চেয়ে মধ্যবিত্তরা বেশি আক্রান্ত হন হৃদরোগে। তাদের চেয়ে কম হলেও এ ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত হৃদরোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বটে। তবে হৃদরোগে মানুষের মৃত্যুর হার বিচারে, এ ক্ষেত্রে নিম্নআয়ের মানুষের ঝুঁকি উচ্চ আয়ের মানুষের চেয়ে দশগুণ বেশি।

বাংলাদেশে প্রতি বছর অনেক মানুষ বিভিন্ন হৃদরোগে মারা যান সময়মতো ও পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে। সাধারণভাবে দেশের চিকিৎসাসেবার মান ও পরিমাণের প্রসঙ্গ উত্থাপন না করাই ভালো। সবাই সে সম্বন্ধে যথেষ্ট অবগত। দুঃখজনক হলো, কয়েকটি উন্নত বেসরকারি হাসপাতাল থাকলেও সাধারণ মানুষ চিকিৎসা নিতে পারেন এমন পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন হৃদরোগ চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে ওঠে নি দেশে। এদিকে তেমন জটিল না হলেও হৃদযন্ত্রের অপারেশন সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। এতে করে এ ধরনের রোগের নিরাময় ব্যয়বহুল; তারপর অনেক সময়ই চিকিৎসার পরও থেকে যায় সমস্যা। এ ক্ষেত্রে একটি সুখবর পাওয়া গেলো চলতি সপ্তাহে। সেটি হলো, এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন বিজ্ঞানী টিকা আবিষ্কার করেছেন যেটি শরীরে নেয়া হলে বিশেষত হার্ট অ্যাটাকের নিরাময় সম্ভব; এতে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান হৃদযন্ত্রে জমে থাকা চর্বির স্তর সরাতে পারবে অল্প সময়ে ও সহজে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে পরিষ্কারভাবে জানা না গেলেও, বলা হচ্ছে, এটি হৃদরোগের প্রায় ব্যথামুক্ত চিকিৎসা। সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলছেন, অনুমতি ও স্বত্ত্ব পাওয়া গেলে টিকাটির বাজারজাতকরণ শুরু হবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে। এটি সবার জন্যই নিঃসন্দেহে বড় আনন্দের খবর।

দাম যেমনই হোক আর সময় যতই লাগুক, এ দেশের রোগীরাও টিকাটি থেকে উপকৃত হবেন বলেই মনে হয়। বাণিজ্যও হতে পারে যদি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ওই প্রতিষেধকটির স্বত্ত্ব কিনতে পারে বাংলাদেশী কোনো ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। একই বিন্যাসে (তবে ভিন্ন ধারায়) গবেষণা চালিয়ে স্থানীয় বিজ্ঞানীরা হৃদরোগের প্রতিষেধক তৈরি করতে পারলে আরও ভালো। সে ক্ষেত্রে স্বত্ত্ববাবদ প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাশ্রয় হবে ও কমবে হৃদরোগে চিকিৎসা ব্যয়। তার সঙ্গে ব্যাপকভাবে এ ধরনের ঔষধ রফতানির সুযোগ তো থাকলই।

ফাহমিদা ফেরদৌস

ভূমিকম্পে আতংক নয়

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ থেকে উৎপত্তি লাভ করা কয়েক দফা ভূমিকম্পে গতকাল কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। কয়েক হাজার মাইল দূরবর্তী বিভিন্ন শহর থেকেও বোঝা গেছে এর শক্তিমত্তা। ভৌগলিকভাবেই আমাদের দেশ রয়েছে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে। অতীতে রিখটার স্কেল বা এ ধরনের কোন ভূমিকম্প পরিমাপক যন্ত্র ছিল না বলে সেগুলোর সবক’টির ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায় না। সাম্প্রতিককালে এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আতংকও।

গতাকাল দুপুরে ঘটা ওই ভূমিকম্পটি ছিল মোটামুটি মাঝারি মানের। এতে অনেকে টেরও পান নি। আবার যারা টের পেয়েছেন তারা আতংকে বেরিয়ে আসেন রাস্তায়। দেশের কয়েকটি স্থানে এ সময় জলাশয়ের পানিও ফুঁসে ওঠে বলে জানা যায়। তবে এর আঘাতে উৎপত্তিস্থল ইন্দোনেশিয়ার মানুষজন হয়ে পড়েন বেশ উৎকন্ঠিত। তাদের দুশ্চিন্তা যত না বেশি ভূমিকম্প নিয়ে তার চেয়েও বেশি ছিল সুনামি নিয়ে। ২০০৪ সালের প্রলয়ংকরী সুনামির অভিজ্ঞতা তাদের মন থেকে মুছে যায় নি এখনো। এ ক্ষেত্রে খানিকটা হলেও সুনামির ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশেও। তার কারণ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী। এ উপসাগরটির সঙ্গে আবার যোগ রয়েছে ভারত মহাসাগরের। বিশ্বে ঘটা বড় বড় ভূমিকম্প তথা সুনামির অন্যতম উৎপত্তি স্থল এটি। তার প্রধান কারণ, এ মহাসাগরটি যেসব টেকটোনিক প্লেটের ওপর অবস্থিত তার প্রায় সবগুলোই সতত সঞ্চারমাণ। এতে করে তাদের পারস্পরিক ঘর্ষণে সুনামি ঘটার ঝুঁকিও বেশি। এ ক্ষেত্রে কিছু বিশেষগের আবার দ্বিমত রয়েছে। তারা মনে করেন ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডে সুনামি ঘটার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে কক্সবাজার, চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তেমনটি নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ছোট-মাঝারি ভূমিকম্পের পরই বড়টি সংঘটনের ঝুঁকি থেকে যায়। এর বিপরীত মতও রয়েছে। সেটি যারা বিশ্বাস করেন, সেসব বিশেষজ্ঞ বলেন, ছোট-মাঝারি ভূমিকম্প বড়টির ঝুঁকিই কমিয়ে দেয় বরং। তবে বোধকরি যে মাত্রাতেই ঘটুক না কেন ভূমিকম্প আতংকিত করে তোলে মানুষকে। তার প্রধান কারণ, প্রাকৃতিক এ দুর্যোগটির কাছে মানুষ একান্তই অসহায়। তাছাড়া ভূমিকম্পের প্রলয়ংকরী রূপ সম্বন্ধেও সবাই কম-বেশি জানেন। গত বছর জাপানের ভূমিকম্প ও তার পর সুনামিতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি তাদের অনেকে দেখেছেনও। সুনামির ক্ষেত্রে সুবিধা হলো, এ ব্যাপারে আগাম তথ্য জানা যায়। ভূমিকম্পের নিশ্চিত পূর্বাভাষ দেয়ার মতো কোনো যন্ত্র এখনো আবিষ্কারই হয় নি। আমাদের দেশে ভূমিকম্প নিয়ে বড় দুশ্চিন্তা হল, এখানে কোন দালান যে ভূমিকম্প সহনীয় করে নির্মাণ করা হয়েছ আর কোনটি হয় নি, তা নিশ্চিত হবার উপায় নেই। তাছাড়া মানুষের আতঙ্ক কাটাতে পদক্ষেপপ এ দেশে নেয়া হয় না যথাযথভাবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও প্রাথমিক প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে মানুষের আতংক দূর হতো অনেকাংশেই।

এদিকে বিজ্ঞানীরা কিন্তু তৎপর আছেন, প্রথমে ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাষ ও পরে তা প্রতিরোধের উপায় আবিষ্কারের। এরই মধ্যে অলৌকিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে ন্যূনতম প্রতিরোধের উপায় উদ্ভাবনের লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র গবেষণাগার প্রতিষ্ঠাও করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক)। ওতে কর্মরত বিজ্ঞানীদের এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো, সূর্যের আয়ু ফুরিয়ে গেলেও পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার পদ্ধতি বের করা। তারা বলছেন, আগামী কয়েক বিলিয়ন বছর পর সূর্যের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে পৃথিবীকে বর্তমান কক্ষপথ থেকে বের করে আনতে পারলেই বেঁচে যাবে মানবজাতি। এ ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে চাঁদের মতো উপগ্রহ বা গ্রহাণু ব্যবহার করা যেতে পারে। তাদের এমন যুক্তি তাত্ত্বিকভাবে মেনে নিয়েছেন অনেক বিজ্ঞানীই। যাহোক, ক্যালটেকের ওই বিজ্ঞানীরা আশাবাদী এ শতাব্দীতেই ভূমিকম্প ও প্রতিরোধের কার্যকর উপায় আবিষ্কারে। তবে সেটি কবে সম্ভব হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই যাচ্ছে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

From 2011-15

বাংলাদেশকে নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ

অর্থনীতির স্বার্থে রাজনীতিতে কিছুটা ছাড় দিন

গতকালের বণিক বার্তাসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) উদ্বেগের খবর এরই মধ্যে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকবে। দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সংস্থাটির আহ্বান, তারা যেন সংযম প্রদর্শন করে এবং অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের উদ্যোগ নেয়। তার সঙ্গে সর্বশেষ রাজনৈতিক সংঘাতের নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্তের ব্যবস্থা নিতে সরকারকেই বলেছে তারা। বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতারে সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় বর্জনের দাবি রয়েছে বিবৃতিতে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নেয়া পদক্ষেপসমূহে যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন না হয়, সে বিষয়েও তাদের দুশ্চিন্তা স্পষ্ট। কার্যত গত কয়েকদিন ধরে ‘গণতান্ত্রিক কর্মসূচি’ নামে দেশে যা চলছে তার নিন্দা সচেতন মানুষ না করে পারেন না। গাড়িতে পেট্রোল ছুঁড়ে ঘুমন্ত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও কিছু ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বৃদ্ধির উপায় হিসেবে নেয়া হয়েছে কষ্টকর কৌশল। আরো দুঃখজনক হলো, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার পরও নাকি এখনো বিরোধী দল অনড় আর সরকার কঠোর। দেশে মানুষ এ স্থবিরতার অবসান চায়। সেজন্য দ্রুতিই উভয় পক্ষ সমঝোতায় আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

অবরোধ-হরতালে ব্যবসাবাণিজ্যে আনুমানিক ১৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে সহযোগী এক দৈনিকে। পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম বলে অনেকের অভিমত। এদিকে রাজধানীর চালের মজুদ ফুরিয়ে আসার খবর রয়েছে শুক্রবারের বণিক বার্তায়। এরই মধ্যে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় জানিয়ে দিয়েছেন, চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অসহায় হয়ে পড়ছেন তারা। ব্যবসায় ক্ষতি হয় এমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি না দেয়ার পক্ষেই মত তাদের। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অবস্থান এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, বিদেশিরা যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত সেখানে আমরাই কেবল উপলব্ধি করতে পারছি না- বিশেষত কৃষির ক্ষুদ্র উৎপাদকদের কী হাল দাঁড়াবে টানা এ সহিংস কর্মসূচিতে? রাজনীতি তাহলে কাদের জন্য? খেয়াল করার মতো বিষয়, বিদেশিরা যেখানে আমাদের সম্ভবনা নিয়ে প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে, সে আশার মৃত্যু ঘটছে আমাদের হাতেই। অভ্যন্তরীণ পর্যটন প্রায় বন্ধ। একাধিক দেশ তাদের নাগরিকদের সতর্কবার্তা দিয়েছেন, নিয়মিতভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলেও এবারকার অস্থিতিশীলতার মাত্রা খানিকটা বেশি। এমন পরিস্থিতি আমাদের রাজনীতিকদের বোধোদয় হোক; জাতিসংঘের আহ্বানে অন্তত সাড়া দিয়ে আত্মঘাতী সহিংসতা থেকে তারা ফিরে আসুন- এমনটাই প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক স্বার্থটিও মাথায় রাখা প্রয়োজন।

অজানাকে জানতে যাত্রা

ছোটবেলায় মেরি-গো-রাউন্ডে চড়তে পারতেন না নীল আর্মস্ট্রং। মাথা ঘুরাতো; বমি হতো। একবার তো অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিলেন। সহপাঠীরা গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে এক ধরনের খেলা খেলতো। এটিও অংশ নিতে পারতেন না তিনি। দীর্ঘদিন এসব শৈশবানন্দ থেকে বঞ্চিত থাকার পর রোখ চেপে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলেন যত সমস্যাই হোক, মেরী-গো-রাউন্ডে চড়বেনই। শুরুতে কষ্ট হতো। তবে ধীরে ধীরে ভারসাম্যহীনতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলেন আর্মস্ট্রং। শিখলেন এমন পরিস্থিতিতে শারীরিক কসরত দেখানোও। শিক্ষাটি কাজে আসল টাইটান২-তে চড়ার পর। টাইটান২ হলো চন্দ্রজয়ী স্পেস শাটল অ্যাপোলো ১১ বহনকারী রকেট। চড়ার সময় নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন ও মাইকেল কলনিসের রক্ত চাপ ছিলো ১১০-১১৫’র মধ্যে। রকেট ছাড়ার কিছু পর কাঙ্ক্ষিত গতির তারতম্য মিলল। শাটলে সৃষ্টি হলো কিছুটা বাড়তি ভারসাম্যহীনতা। প্রচন্ড মাথাব্যথাসহ বমি করতে লাগলেন সবাই; আর্মস্ট্রং ছাড়া। ওই অবস্থায়ও নাসার কন্ট্রোল প্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন তিনি।

আগেই নির্ধারিত ছিল চাঁদের কক্ষপথে কোথায় থামবে অ্যাপলো ১১। টাইটানের গতিজনিত সমস্যায় নির্দিষ্ট সময়ে হেরফের হয়ে গেলো দুই সেকেন্ড। এতে যেখানে নির্ধারিত স্থান পড়ে গেলো শ’খানেক মাইল পেছনে। এখানে নামার প্রশ্নই আসে না। এখানে লুনার মডিউল ঈগল নামলে পৃথিবীতে ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। ঘটল আরেক বিপত্তি। বাজ অলড্রিন ‘আবিষ্কার’ করলেন লুনার মডিউল কম্পিউটার ঠিকমতো কাজ করছে না। এখানে বলে রাখা দরকার, যে কম্পিউটারটি দিয়ে অ্যাপোলো ১১ চালানো হয় সেটি ছিল আজকের একটি কম দামী অ্যান্ড্রেয়ড সেটের চেয়েও কম দক্ষ। টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব একটা উন্নত ছিল না তখন। এসব কারণে নভোচারীদের কাছে চন্দ্রাভিযান ২০১২ সাল থেকে দেখলে এক ধরনের ডেথ মিশনই ছিল। যাহোক, ত্রুটিটি জানানো হলো নাসাকে। সেখান থেকে জবাব এলো, তাদের করার কিছু নেই। পৃথিবীতে ফিরে আসো- এ কথাটা বলতে গলায় বাধছিল নাসার। কিন্তু আর্মস্ট্রং এত দূর এসে চাঁদে না নেমে ফিরে যেতে রাজি নন। নাসার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি। বললেন, নাসা অ্যাপোলোর কন্ট্রোল ছেড়ে দিক; তিনি একে ম্যানুয়ালি কন্ট্রোল করবেন। ৯৯ শতাংশ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এটি। অবশ্য কিছুই করার ছিল না তখন। শেষ পর্যন্ত মিনিট দশেক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মাঝে লুনার মডিউল চন্দ্রপৃষ্ঠে নামার পর নাসার কাছে বার্তা এলো, ঈগল হ্যাজ ল্যান্ডেড অন দ্য মুন। নাসার আনন্দময় মুহূর্তগুলোর অন্যতম এটি। তবে সমস্যা ছিল, কে প্রথম চাঁদে নামবে? কলিন্সের নামার সুযোগ ছিল না। গুজব রয়েছে, সামরিক বাহিনীর লোক হওয়ারই নাকি আর্মস্ট্রংকে প্রথমে নামার সুযোগ দেয়া হয়। বাস্তবতা হলো, তাৎক্ষণিকভাবে ওই সময়ে নাসার দুজন যুক্তিবিদকে (এথিসিস্ট) জিজ্ঞেস করা হয়, কাকে আগে নামতে দেয়া উচিৎ। তারা দুজনেই রায় দেন আর্মস্ট্রংয়ের পক্ষে। এ যুক্তিতে যে, তিনিই অপেক্ষাকৃত বেশি বিনয়ী; মানবজাতির এত বড় সাফল্যের কৃতিত্ব ‘গর্বিত’ ব্যক্তিকে দেয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত হলো, আর্মস্ট্রংই নামবেন।

আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গেই যেন চাঁদের মাটিতে নেমেছিল কয়েকশ’ কোটি মানুষ। অন্যদের মতো তার স্বপ্নও ছিল, মানুষ একদিন অন্যান্য গ্রহও জয় করবে। ফলে ‘হিরো’ হয়ে পৃথিবীতে নামার পরই তাকে দেখা গেছে মঙ্গলসহ অন্যান্য গ্রহাভিযানমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে। ভয়েজার-১ উৎক্ষেপণ নিয়েও প্রবল উৎসাহ ছিল তার। ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টাইটান ৩-তে চড়ে প্রকৃতপক্ষেই অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে ভয়েজার-১। চলতি ৫ সেপ্টেম্বর খবর রয়েছে, এটি জায়ান্ট প্লাজমা বাবল (সৌরজগতের সীমানা) পেরিয়ে মিল্কিওয়েতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে শীঘ্রই। এও আরেক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। মিল্কিওয়েতে ‘পা রাখা’র সঙ্গে সঙ্গেই সৌরজগত ত্যাগকারী প্রথম মানসৃষ্ট বস্তু হবে ভয়েজার-১। আর্মস্ট্রং মারা গেছেন গত মাসে। বেঁচে থাকলে উচ্ছ্বলতা প্রকাশ করতেন তিনি। তবে সেটি না করলেও সমস্যা নেই। তার তো বটেই মানবজাতিরও এক বড় স্বপ্ন তো সৌরজগত পার হয়ে এগিয়েই চলেছে। দুর্ঘটনা না ঘটলে এটি চলবে আরও বহু বছর। একই সঙ্গে ফেরি করবে মানব সভ্যতার কিছু স্যাম্পল, শিশুর কান্না, নীল তিমির ডাক; যদি কোনো অ্যালিয়েন এসবে সাড়া সেয়। তবে এ ক্ষেত্রে ‘অনেকে’র জন্য দুঃসংবাদ হলো, ভয়েজার-১ এ দুই ব্যক্তির ভয়েস রেকর্ড রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘ মহাসচিব (তৎকালীন)। অ্যালিয়েনরা যদি ভয়েজার-১-র দেখা পায় সম্ভবত এদের কন্ঠস্বরই শুনবে প্রথমে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

সুবিচারের প্রত্যাশায়

ফাহমিদা ফেরদৌস

বাংলাদেশের সমকালীন অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখা হলে তাতে নিশ্চয়ই দুই শ্রদ্ধেয় অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ও শাহ আবু মোহাম্মদ শামসুল (শামস) কিবরিয়া সাহেবের কর্মের একটা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হতো। তাতে এও উল্লেখ্য থাকতো, উভয়েই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে প্রয়াত। একজন মারা গেছেন মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায়; আরেকজন নিহত হয়েছেন হীন গ্রেনেড হামলায়। তাও প্রথমোক্তের মৃত্যুর একটা সান্ত্বনা পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বিতীয়জনকে যেভাবে মেরে ফেলা হয়েছে তাতে সহানুভূতি প্রকাশের আগেই তুলতে হবে সুবিচারের প্রশ্ন। কিবরিয়া সাহেব নিহত হয়েছেন ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারী। আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে। তাকে হত্যায় কারা যুক্ত ছিল, হত্যার উদ্দেশ্যই বা কী ছিল- সেসব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে; নানা তথ্য জানা গেছে। তবে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় নি হন্তারকদের। হয়নি তাদের বিচার- এমনকি উনি যে দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতার থাকার পরও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ও শামস কিবরিয়া কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়নের ভার অর্থনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো। তবে দূর থেকে উভয়ের জীবন ও কর্মের একটা মূল্যায়ন করাই যায়। দু’জনেই তরুণ বয়সে বাংলা ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। এর মাঝে বেশ কিছুদিন জেলও খাটেন কিবরিয়া সাহেব। স্পষ্টত তার শিক্ষা জীবন ছিল সাইফুর রহমান সাহেবের চেয়ে উজ্জ্বলতর। স্নাতক, স্নাতোকোত্তর উভয় পর্যায়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। এর আগে কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন কিনা, জানা যায় না। অবশ্য দুজনের জীবন বা কর্ম কোনোটিকেই একই তুলাদণ্ডে মাপার সুযোগ নেই। একজন অর্থনীতি, আরেকজন ছিলেন ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র। হয়তো এর প্রতিফলনই আমরা দেখতে পাই পরবর্তী সময়ে। ভিন্ন পথে হাঁটা সত্ত্বেও একটি বৈশিষ্ট্য দুজনের মাঝে দেখা যায়। সেটি হলো, রাজনীতিক হয়েও অর্থনীতিকে যথাসম্ভব দলীয় প্রভাবের বাইরে রাখার চেষ্টা করা।

নীতি গ্রহণে সাইফুর রহমান সাহেব মুক্ত বাজার অর্থনীতির অনুসারী ছিলেন, এ কথা বলা যায় নিশ্চয়ই। সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় তার ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়। অন্যদিকে কিবরিয়া সাহেব ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চাইতেন বলে ধারণা। তাই নীতি গ্রহণে তাকে আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা যায় নি কখনো। সবাইকে পেছনে ফেলার চেয়ে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার একটা প্রবণতা ছিল তার মাঝে। দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধারণার বাস্তবায়নে তার উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। বাংলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা যে দিকটির পুনঃ পুনঃ উল্লেখ করেছেন, তাহলো এটি ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি পণ্য উৎপাদনে ঘাটতিতে থাকা অঞ্চলে। আজ বিশেষত আমাদের কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি ও সামাজিক উন্নয়নের সাফল্য উন্নয়নশীল এমনকি অনেক উদীয়মান অর্থনীতির সামনেও দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এর পেছনে শামস কিবরিয়া, বেগম মতিয়া চৌধুরীর মতো ব্যক্তিদের অবদান অস্বীকার করা যাবে না।

হৈ চৈ ফেলে নিজ কর্ম জাহিরের জন্য যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন তা ছিল কিবরিয়া সাহেবের মাঝে অনুপস্থিত। সেজন্যই বোধহয় এক মার্কিন সিনেটরও তারবার্তায় কিবরিয়া সাহেবকে উল্লেখ করেছিলেন ‘সফট-স্পোকেন বাংলাদেশী ডিপ্লোম্যাট (মৃদুভাষী বাংলাদেশী কূটনীতিক)’ বলে। মেরেই ফেলতে পারে এমন শত্রু তিনি সারা জীবনে তৈরি করেন নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে হত্যা করা হবে- এমন ধারণাও বোধকরি ছিল না সচেতন-সতর্ক কিবরিয়া সাহেবের। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য মেলে তাতে মনে হয়, ঘাতকরা আওয়ামী লীগের ওপর একটা বড় আঘাত হানতে চেয়েছিল আর সেক্ষেত্রে তারা সহজ শিকার হিসেবে বেছে নেয় কিবরিয়া সাহেবকে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, গত ৯ বছরেও মামলাটির কোনো সুরাহা হয় নি; সুবিচার পায় নি তার পরিবার। প্রত্যাশা থাকবে, অবিলম্বে এদিকে দৃষ্টি দেবে সরকার। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে দল ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও কিবরিয়া সাহেবের মতো মানুষের হত্যা মামলার বিচার দীর্ঘায়িত হওয়াটা কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্যও খুবই হতাশাজনক।

লেখকঃ নিবন্ধকার

amazingoshin.ff@gmail.com

দেশে বায়ু বিদ্যুতের ভবিষ্যত

নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের মধ্যে ইদানীং বেশ সমালোচিত হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ। রাশিয়ার চেরনোবিলে ভয়াবহ পারমানবিক দুর্ঘটনার পর এ নিয়ে আতংকিত হয়ে ওঠেন সবাই। বিশ্বজনমত হয়ে পড়ে নেতিবাচক। মানুষের এমন মনোভাব অবশ্য এক দশকের বেশী ছিল না। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের থ্রিমাইল আইল্যান্ডে ছোট একটি দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্রমবর্ধমান শক্তি চাহিদা মেটাতে ঝুঁকতেই হয় পারমাণবিক শক্তির দিকে। কিছুদিন আগে দুর্ঘটনা ঘটে জাপানের ফুকুশিমায়। এতে আবার জনমত গেছে পারমাণবিক শক্তির বিপক্ষে। ফলে বিভিন্ন দেশ এটির বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য অন্যান্য শক্তি উৎস যেমন সৌর, বায়ু ও সমুদ্র শক্তির ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে সৌর শক্তিকে। কোনো কারণে আকাশ আচ্ছন্ন না থাকলে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু ছাড়া অন্যত্র প্রাচুর্য রয়েছে সৌর শক্তির। একসময় সমুদ্র শক্তির প্রতি মানুষের আগ্রহ জন্মেছিল বেশ। পরে দেখা গেলো একে বাগে আনা কঠিন। সমুদ্র শক্তিকে কাজে লাগানোর মতো বেশ কিছু প্রযুক্তি বর্তমানে বাজারে এলেও এগুলো অনেক কম অর্থসাশ্রয়ী। তাছাড়া এসবের ব্যবহারও সীমিত। বায়ুশক্তির ইদানীং আগ্রহ দেখাচ্ছে অনেক দেশই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কাঙ্খিত হারে বিদ্যুৎ সরবরাহ পেতে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল থাকতে হয়। যে দেশে এ ধরনের প্রযুক্তি প্রচলন করা হবে সেখানে নদী বা সমুদ্রের উপস্থিতি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য খোলা জায়গায়ও লাগে অনেকটা। এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এসব স্থানে থাকে ট্যুরিস্ট স্পট। নদীবহুল দেশের সংখ্যাও প্রচুর নয় আবার। তাছাড়া অনেক দেশে প্রবল তুষারপাতের কারণে বায়ুবিদ্যুত প্ল্যান্ট স্থাপন করা যায় না। কারণে সে ক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কিছুটা বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তবে এসব দিক বিবেচনা করলে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ এবং আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয়। আফ্রিকার বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলেই বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি কৃষিতে সেচ জোগাতেও ব্যবহার করা হয় বায়ুকল।

বায়ুকলের প্রতিটি পাখাকে বলা হয় টারবাইন। এ বিদ্যুৎ ব্যক্তিগতভাবেও ব্যবহার করা যায়। আবার বিচ্ছিন্ন-অবিচ্ছিন্নভাবে গ্রীডেও যুক্ত করা যেতে পারে এটি। তবে জাতীয় গ্রীডের মত বড় ক্ষেত্রে যুক্ত করতে চাইলে বেশ উঁচুতে ২ মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন যুক্ত করতে হয় যন্ত্রটিতে। একটি বিশেষ সুবিধা রয়েছে বায়ুতে, যেটি সৌর বিদ্যুতে নেই। সৌর বিদ্যুতের প্যানেলে পর্যাপ্ত সরবরাহ পেতে এটিকে সূর্যের দিকে সারাক্ষণ মুখ করিয়ে রাখতে হয়। এ সমস্যা বায়ুকলে নেই। এ ক্ষেত্রে বায়ুগতির দিকের সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটির মুখ এমনিতেই ঘুরে যায়।

বায়ুচালিত এ ধরনের যন্ত্রের ধারনাটি কিন্তু ভারতীয়দের উদ্ভাবন। বিভিন্ন শিলালিপিতে প্রাপ্ত ছবি ও লেখা দেখা ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছিল বায়ুকল। অবশ্য তখন এর সাহায্যে কেবল সেচকার্য চালানো হতো। পরবর্তীতে বায়ুকল বিস্তৃতি লাভ করে চীনে। বর্তমানেও বিশ্বের সবচেয়ে বায়ু শক্তি ব্যবহারকারী দেশ এটি। দেশটি চলতি বছর প্রায় ৪৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করেছে এর সাহায্যে। প্রতিবেশী ভারতও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। ২০১১ সালের তাদের বায়ুবিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছে আনুমানিক ১৩ হাজার মেগাওয়াট। শুধু এরা কেন, বায়ুবিদ্যুতের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে বিশ্বের সর্বত্রই। বিশ্বে ২ লাখ মেগাওয়াট বিদুত এভাবেই উৎপন্ন হচ্ছে এখন। মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ২ দশমিক ৫ শতাংশ এটি। ২০১৮ সাল নাগাদ বিশ্বে বায়ুবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হবে ৮ শতাংশ, বলে আশাবাদ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে প্রথম বড় আকারে বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হয় ২০০৫ সালে ফেনীর সোনাগাজীতে। ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকায় দশমিক ৯ মেগাওয়াটের এ কেন্দ্রটি বিকল হয়ে যায় অচিরেই। পরে কক্সবাজারেও প্রচুর টাকা ব্যয়ে আরেকটি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তবে এখান থেকেও আশানুরুপ ফল পাওয়া যায় নি। প্রকৃতপক্ষে সাশ্রয়ী খরচে বড় আকারে এ ধরনের কেন্দ্র স্থপন করতে চাইলে এগিয়ে আনতে হবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকেই। এটি উন্নত প্রযুক্তি নয় এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করতে পারবে না। এভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে ব্যাপকভিত্তিতে আমাদের অববাহিকা অঞ্চলে বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি কিলোওয়াট-ঘন্টা হিসেবে বিদ্যুতের দাম কমে যাবে অনেক।

ফাহমিদা ফেরদৌস

সালফারযুক্ত কয়লা

ইটভাটায় ব্যবহারোপযোগী প্রতি টন দেশী কয়লার দাম ৯ হাজার ৭০০ থেকে ১০ হাজার টাকা। এ টাকায় ইট তৈরী হলে দাম খানিকটা বাড়ে। তবে ভারত থেকে আমদানী করলে টনপ্রতি খরচ কমে ১ হাজার টাকার মতো। এতে পরিবেশের কথা ভুলে গিয়ে সেখান থেকেই কয়লা আমদানি করছে বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশন। প্রতি বছর আমদানি করা হচ্ছে আনুমানিক ১২ লাখ টন কয়লা। তবে নিয়ম মেনে সেটি আমদানি করা হলে পরিবেশবাদীদের অভিযোগ হয়তো কিছুটা কমত। সমস্যা হলো, ভারত থেকে যে ধরনের কয়লা আমদানি করা হচ্ছে তাতে সালফারের পরিমাণ সরকার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বিধান রয়েছে, ব্যবহৃত কয়লায় দশমিক ৫ শতাংশের বেশি সালফার থাকতে পারবে না। আমাদের দেশে নির্দিষ্ট সীমাটি কিছুটা শিথিল। পরিবেশ অধিদফতরের নিয়মানুসারে সেটি ১ শতাংশ। লিগনাইট, ফ্লেম, গ্যাস ফ্লেম, গ্যাস, ফ্ল্যাট, ফোর্জ, নন ব্যাংকিং, অ্যানথ্রাসাইট- এসব বিভিন্ন প্রকারের কয়লাতে অবশ্য ১ শতাংশের বেশি কয়লা পাওয়াও যায় না প্রাকৃতিকভাবে। এর মধ্যে লিগনাইটে থাকে আরও কম- দশমিক ৫ শতাংশের নীচে সালফার। বলা হচ্ছে ভারত থেকে যে ধরনের কয়লা আমদানি করছে ইটভাটার মালিকরা তাতে সালফারের পরিমাণ নাকি ৫ থেকে ৭ শতাংশ। তথ্যটি দিয়েছে স্থানীয় একটি পরিবেশবাদী সংগঠন। এটি সত্য হলে, তা একাধারে পরিবেশের জন্য বিপর্যয়কর। আবার উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া গেলে সেটি এক ধরনের সুবিধাও বটে।

দুশ্চিন্তার কারণ হলো, আমদানিকৃত এ কয়লা পোড়ানোর ফলে বাতাসে সালফারজাত (বিশুদ্ধ সালফার যাকে এলিমেন্টাল সালফারও বলা হয় তা একবারেই বিষাক্ত নয়। বরং ডিএনএ গঠনের অপরিহার্য উপাদান এটি।) যৌগ মিশে যাচ্ছে। সেটি বায়ুমণ্ডলে থাকা বাষ্পীভূত পানিতে (জলীয় বাষ্প) মিশে প্রথমে সালফার মেঘ (সালফিউরাস এসিড) সৃষ্টি করে। ঝড়-বৃষ্টির সময়ে বজ্রপাতে সালফিউরাস এসিড পানিতে মিশে তৈরি করে ক্ষতিকর সালফিউরিক এসিড। আপেক্ষিক গুরুত্ব কিছুটা বেশি হওয়ায় সালফার উৎস থেকে বেশি দূরে যায় না। এতে দেখা যায়, নির্গমন স্থান থেকে অল্প দূরেই এসিড বৃষ্টি ঘটাচ্ছে এ সালফারজাত যৌগটি। আরেকটি ক্ষতিকারণ দিক রয়েছে এর। বাতাসে ভেসে থাকা সালফার যৌগ মানুষের শ্বাসকষ্টসহ কয়েকটি ফুসফুসের রোগের জন্য দায়ী এর মধ্যে ক্যান্সারও রয়েছে। আয়ুষ্কাল কমিয়ে দেয় সালফার। এ কারণে কয়লা খনির শ্রমিকদের গড় জীবনকাল অন্য শ্রমিকদের চেয়ে কম। পানিতে সালফার যৌগ মিশলে, সেটি জলজ পরিবেশকেও দূষিত করে ব্যাপকভাবে। আরেকটি বিষয় হলো, গভীরতর খনি থেকে তোলা কয়লায় মিশ্রিত থাকতে পারে ইউরেনিয়াম, থোরিয়ামের মত ভারী তেজস্ক্রিয় মৌল। এগুলো অনেকটা অদৃশ্য থেকেই প্রভাব ফেলে মানবদেহে।

এখন ভারত থেকে আমদানিকৃত কয়লায় ন্যূনতম ৫ শতাংশ সালফার পাওয়া গেলেও সেটিকে সুযোগ হিসেবে নিতে পারেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। কয়লা থেকে সালফার বিশোধনের মাধ্যমে তা দিয়ে সালফিউরিক এসিড, সার, ঔষধ প্রভৃতি তৈরী করা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুসারে আমরা প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ১২ লাখ টন এ ধরনের কয়লা আমদানি করি। এতে ৫ শতাংশ হারে থাকা সালফার পরিশোধন করলে পাওয়া যাবে আনুমানিক ৬৮ হাজার টন সালফারজাত যৌগ। এ থেকে ১ লাখ টন সালফিউরিক এসিড তৈরি করা কঠিন হবে না। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে সেটি আমদানি করতে হয়। দেশেই তা করা গেলে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব। তাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির সঙ্গে সালফিউরিক এসিড আমদানিও কমে যাবে অনেক।

ফাহমিদা ফেরদৌস

লন্ডনে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বেহাল অবস্থা

আটলান্টিক মহাসাগরের দুই তীরে ইউরোপ এবং আমেরিকা রাষ্ট্রীয় ঘাটতি ও ঋণভারে জর্জরিত। সমস্যা দূর করতে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে এসব দেশ নিয়েছে প্রণোদনা, ভর্তুকি ও সরকারি খাতে ব্যয় সংকোচনের নীতি। সমস্যা হল, যেখানে এমন বৈষম্যমূলক সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে সেখানেই দেখা দিচ্ছে প্রতিবাদ। সাধারণ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট নামে অভিনব বিক্ষোভ করছে, সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের প্রতিবাদে। ইউরোপ জুড়ে চলছে বিক্ষোভ। গ্রীসে ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে। ছোট-বড় বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে ফ্রান্স, স্পেন, তুরষ্ক ও পর্তুগালে। শান্ত নয় বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানীও। মাঝে মাঝে সেখানেও বিক্ষোভ-সমাবেশের খবর পাওয়া যায়। ২০১০ সালের শেষ দিকে বড় ছাত্র বিক্ষোভ হয়ে গেলো সেখানে। ওই আন্দোলনের পেছনে দেশটির বড় দুই রাজনৈতিক দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রাটিক ইউনিয়ন ও ফ্রী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ইন্ধনের কথা শোনা যায়। এঙ্গেলা মের্কেলের সরকার আন্দোলনটি দমন করতে সক্ষম হলেও, যেকোন সময় বিক্ষোভের শংকা রয়েছে তাদের। গত বছর জার্মানীর সঙ্গে প্রায় একই সময়ে লন্ডনের রাস্তায় নামে ব্রিটিশ শিক্ষার্থী। উভয় আন্দোলনের কারণ ছিল একটি- টিউশন ফী বাড়ানো ও বিশ্ববিদ্যালয় বাজেটের সংকোচন। তবে জার্মানীর আন্দোলনটি শান্তিপূর্ণ থাকলেও ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় পর্যবসিত হয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। কয়েকজন বেপরোয়া শিক্ষার্থী প্রিন্স চার্লসের গাড়িতেও হামলা চালায়।

গত বছরের মত একই কারণে আবারও বিক্ষোভ হয়েছে লন্ডনে। অবশ্য এবারের বিক্ষোভটি বেশ শান্তিপূর্ণই বলা চলে। তবে এতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যণীয়। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ থেকেও অনেকে এসে যোগ দেয় এতে। লন্ডন পুলিশের ভাষ্যমতে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা ছিল ‘মাত্র আড়াই হাজার’। তবে এর বিপরীতে চার হাজার পুলিশ মোতায়েনের ঘটনা উক্তিটির সত্যতা সম্বন্ধে সন্দিহান করে তোলে। মিডিয়ায় অবশ্য এসেছে বিক্ষোভকারী ছিল বার থেকে পনের হাজার। এদের মধ্যে অনেকেই এসেছিলেন অকুপাই লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ আন্দোলনে যোগ দিতে। পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হন এরা। বিক্ষোভ শুরু হয় লন্ডনের মুলেট স্ট্রীট থেকে; শেষ হওয়ার কথা ছিল ওয়াট স্ট্রীটে। তবে পুলিশের বাধার মুখে বেশি এগুনো যায় নি; শেষ হয়ে যায় ট্রাফালগার স্কয়ারেই।

লন্ডনে উত্তাল ছাত্র আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের স্বজনরাও। শহরটিতে এ ধরনের কিছু ঘটলে দুশ্চিন্তা না হওয়ার কারণ নেই। পুরো ইংল্যান্ডে যতজন বাংলাদেশী বাস করেন তাদের প্রায় ৫৫ শতাংশই থাকেন লন্ডনে- বিশেষত পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট, ক্যামডেন, হ্যারিঞ্জি, হ্যাকনি, নিউহ্যাম, ওয়েস্টমিনিস্টার ও রেডব্রিজ এলাকায়। এদের অনেকে দেশটিতে এসেছেন উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে; এর সঙ্গে আয়-উপার্জনের বিষয়টি থাকছেই।   সরকারি হিসেবে, ইংল্যান্ডে মোট বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ পঞ্চাশ হাজারের মত। এর মধ্যে বাংলাদেশী শিক্ষার্থী রয়েছে আনুমানিক পনের হাজার। তবে বেসরকারি বিভিন্ন জরিপ সংস্থার মতে, ব্রিটেনে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে মোট বিদেশী শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ লাখ। এ সংখ্যাটি থেকে সরকারি হিসাব বিয়োগ করলে দেখা যাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী রয়েছে দেশটিতে; যার মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যাও প্রচুর। শিক্ষার্জন এদের উদ্দেশ্য নয়। এদের অধিকাংশই চায় নির্দিষ্ট সময়ে কাঙ্ক্ষিত সীমায় অর্থকড়ি উপার্জন করে দেশে ফিরতে। সমস্যা হল, এমনিতেই বিশ্বমন্দায় পড়ে দেশটিতে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গেছে। এর ওপর বসবাসরত বাংলাদেশীদের বেকারত্বের হার ব্রিটিশ নাগরিকদের তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। বেকারত্ব আবার যুবকদের মধ্যে বেশি। এক জরিপে দেখা গেছে, ইংল্যান্ডে অবস্থানরত ২৫ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশীদের মধ্যে আনুমানিক ৩৫ শতাংশই বেকার। এরা পার্কিলট, হোটেল ও অন্যান্য স্থানে কম মজুরীর (সপ্তাহে প্রায় ১৫০ পাউন্ড; যেটি অন্যদের তুলনায় খুবই কম) পার্টটাইম চাকুরী করে জীবন নির্বাহ করেন। যারা পড়াশুনার পাশাপাশি চাকুরী করেন, তাদের অনেককে দেখা যায় পরবর্তী সময়ে দুটি বিষয়ের যেকোন একটি বেছে নিয়েছেন। কেউ কেউ পার্টটাইম চাকুরী করেই পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যান। এদের সংখ্যা অবশ্য কম। খরচ বাঁচিয়ে দেশেও অর্থকড়ি পাঠাতে হয় কাউকে কাউকে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার আগের এক হাজার পাউন্ড বাৎসরিক টিউশন ফী বাড়িয়ে কোন কোন কোর্সের ক্ষেত্রে সেটি ধার্য করা হয়েছে নয় হাজার পাউন্ড হারে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয়রা কিছু সুবিধা পেলেও বিদেশী ছাত্রদের ব্যাপারে ছাড়া কম। তাছাড়া কিছু দিন ধরে গবেষনাকাজের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থও হ্রাস করা হয়েছে। এ অবস্থায় পড়াশুনা দূরে থাক, অনেকের পক্ষে টিকে থাকাই কঠিন। আশার কথা, হ্যামলেট টাওয়ারের বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত মেয়র উদ্যোগ নিয়েছেন, ক্লাসে উপস্থিতি হারের ভিত্তিতে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়ার। কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে লন্ডনস্থ বাংলাদেশী হাই কমিশন থেকে। চাপে পড়ে এরই মধ্যে বৈধ-বিদেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কথা বলেছে সেখানকার সরকারও। সংশয় অবশ্য রয়ে গেছে, অবৈধ শিক্ষার্থীদের নিয়ে।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

শুরু হলো, শেষও যেন হয় বাংলাদেশের খেলায়

দশম নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে ২০১৩ সালে। তৃতীয়বারের মত স্বাগতিক দেশ হিসেবে এতে থাকছে ভারত। এরই মধ্যে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে চারটি দল অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত ও নিউজিল্যান্ড। তবে খেলা হবে আটটি দল নিয়ে। ফলে বাকি রয়েছে চারটি দল বাছাই করা। তা শুরুও হয়ে গেলো ঢাকায় ১৪ নভেম্বর ২০১১ থেকে। এতে শেষ চারে উন্নীত হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে দশটি দল- দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, নেদারল্যান্ডস, জিম্বাবুয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, আয়ারল্যান্ড, জাপান ও বাংলাদেশ। পুরুষদের বেলায় এদের অনেকেই আন্তর্জাতিক টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া। সেখানে এদের পারফরম্যান্স সম্বন্ধে ক্রীড়ামোদীরা অবগত। এ ক্ষেত্রে নারীরাও তুলনামূকভাবে সমান শক্তিশালী তা নির্দ্বিধায় বলা যায় না অবশ্য।

শুরু হওয়া টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ঘিরে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে অনেকের মাঝে। একে তো বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ; তাও পাকিস্তানের সঙ্গে। রাজনৈতিক বৈরিতা নয়, বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল এ ক্ষেত্রে ভুলতে পারছে না গত বছর চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ১০ উইকেটে হারের ঘটনা। দলটির অধিনায়ক জানিয়েছেন, প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব তারা। প্রতিযোগি পাকিস্তান দলের মনোভাব কী, সেটি অবশ্য জানা যায় নি সংবাদ সম্মেলনে। তবে বাংলাদেশকে হারানোর বদলে তাদের অধিক মনোযোগ বোধকরি, যে করেই হোক নকআউট পর্বে খেলা। টুর্নামেন্টটির দ্বৈত তাৎপর্য আছে যে! এতে যারা কোয়ালিফাই করবে তারা কেবল ২০১৩ সালে নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপই খেলবে না, তারা খেলার সুযোগ পাবে ২০১২ সালে শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিতব্য আইসিসি নারী ক্রিকেট টি২০ বিশ্বকাপেও। প্রতিযোগী দশজনের দু-একটি বাদে সব দলের শক্তি ও মান কাছাকাছি পর্যায়ের; প্রচুর অনুশীলনও করেছে প্রত্যেকে। যে কোন খেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সঙ্গে ভাগ্যও কিছুটা জড়িত থাকে; কথাটি বেশি করে সত্য ক্রিকেটের ক্ষেত্রে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মূল লক্ষ্য স্থির করা উচিৎ নকআউট পর্যন্ত। তাহলে প্রত্যাশার চাপ অন্তত সামলানো যাবে।

পুরুষ ক্রিকেটের ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৫৯৮ সাল থেকে, ইংল্যান্ডে। নারী ক্রিকেটকেও নতুন ভাববার কারণ নেই। প্রথম নারী ক্রিকেট ম্যাচের খবর পাওয়া যায় ব্রিটেনের দ্য রিডিং মার্কারি পত্রিকায় প্রকাশিত ২৬ জুলাই ১৭৪৫ সালের এক প্রতিবেদনে। সেটি হয়েছিল ব্রামলি ও হামবলডনের মধ্যে। মজার ব্যাপার হল এটি কিন্তু টেস্ট ম্যাচ ছিল না। কার্যত নারীরা টেস্ট ম্যাচ খেলতে আরম্ভ করেন ১৯৩৪ সালে। নারীদের জন্য ১৯৫৮ সালে গঠিত হয় ইন্টারন্যশনাল উইমেন্স ক্রিকেট কাউন্সিল (বর্তমানে আইসিসির আন্তর্ভুক্ত)। এর বিপরীতে দেখা যায়, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স যে সংস্থাটিই পরবর্তীকালের আইসিসি, তা ১৯০৯ সালে গঠিত হয়। প্রথম নারী ক্রিকেট ক্লাব ‘অরিজিনাল ইংলিশ লেডি ক্রিকেটারস’ গঠিত হয়েছিল ১৮৯০ সালে। প্রায় একই সময়ে দেশভিত্তিক নারী ক্রিকেট দল ছিল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও সাউথ আফ্রিকায়ও। অবশ্য এমন তুলনা পাওয়া যায় না ভারতীয় উপমহাদেশে। এ দেশে পুরুষ ক্রিকেটের সূচনা অনেক আগে হলেও ২০০৭ সালে গঠিত হয় প্রথম জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। সূচনা দেরিতে হলেও দলটির সাফল্য ছিল তাৎক্ষণিক। একই বছর এসিসি (এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল) কাপের ফাইনালে মালয়েশিয়ার জহর স্টেডিয়ামে নেপালকে পরাজিত করে তারা। কাকতালীয় বলা যায়, একই দেশ থেকে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের পুরুষ ক্রিকেটের।

২০০৮ সালে ইউমেন্স এশিয়া কাপ-২০০৮ এ চতুর্থ স্থান দখল করে বাংলাদেশী নারীরা। তখন থেকে পর্যন্ত দলটির কয়েকটি বড় অর্জন ছিল। এসবের মধ্যে আলোচিত ঘটনাটি ছিল, ২০১১ সালে ফেভারিট হিসেবে ফাইনালে উঠেও পাকিস্তানের কাছে হেরে যাওয়া। এবারে বাছাই পর্বে খেলতে গিয়ে সেখান থেকেই নতুন করে শুরু করার কথা হয়তো ভেবেছেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। তবে প্রতিশোধের সঙ্গে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনের কথাও বলেছেন তিনি। অবশ্য বর্তমান দলটির শক্তিতে নির্ভর করে এমনটি বলা ভুল হবে না। পেসার নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বোলিংয়ের আমাদের মূল শক্তি স্পিন। এ ছাড়া ব্যাটিং লাইনআপও শক্তিশালী। ফিল্ডিংয়ের মান খারাপ নয়। এ অবস্থায় প্রত্যাশা নিয়েই তাকিয়ে থাকবে সারা দেশ। সবাই চাইবে, বাংলাদেশের খেলা দিয়ে শুরু হয়েছে টুর্নামেন্ট, আমাদের দিয়েই যেন তা শেষ হয়।

ফাহমিদা ফেরদৌস

অনুমান করা যায় নি সমস্যাটি

গত ৭০ বছরের মধ্যে প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছে থাইল্যান্ডে। মারা গেছেন চারশ জনের মতো। রাজধানী ব্যাংক কয়েক সপ্তাহ ধরে পানিবন্দী। বন্যার পানি ঢুকেছে বিমানবন্দরে। শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি সামনেও নাকি হাঁটু পানি। এ বন্যা নিয়ে বাংলাদেশের অনেকেই ছিলেন উদ্বিগ্ন। তাদের দুশ্চিন্তার প্রধান কারণ- দেশটি থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করি আমরাসহ অনেক দেশ। এ অবস্থায় সেখানে উৎপাদন ব্যাহত হলে আন্তর্জাতিক চালের বাজার অশান্ত হয়ে পড়বে। চালে দৃষ্টি রাখতে গিয়ে অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন দেশটি থেকে বিভিন্ন কম্পিউটার যন্ত্রাংশও রফতানি করা হয়। ১৫ নভেম্বর বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন দেখে এটি মনে পড়ল। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, থাইল্যান্ডের বন্যায় ঈদের পর থেকে এ দেশের কম্পিউটার বাজারে হার্ডড্রাইভের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। যন্ত্রাংশটির চাহিদা মাসে প্রায় ৫০ হাজার পিস। আমদানি কমে যাওয়ায় এখন দাম বেড়েছে স্বাভাবিকভাবে। মজুত যা ছিল সেটি শেষ হয়েছে অক্টোবরেই। এখন যেসব ব্যবসায়ীর কাছে পণ্যটি আছে, তারা হাঁকাচ্ছেন চড়া দাম।

মোট হার্ডড্রাইভের ৪৫ শতাংশ তৈরী হয় থাইল্যান্ডের বিভিন্ন কারখানায়। বাজারের হার্ডড্রাইভ ৩১ দশমিক ২ শতাংশ হার্ডড্রাইভ তৈরী করে ওয়েস্টার্ন ডিজিটাল। অন্যান্যদের মাঝে সিগেট ২৯ দশমিক ২, হিটাচি ১৮.১ (এটি আবার সম্প্রতি কিনে নিয়েছে ওয়েস্টার্ন ডিজিটাল), তোশিবা ১০.৮, স্যামসাং ১০.৭ (চলতি বছরের এপ্রিলে স্যামসাংয়ের হার্ডড্রাইভ ডিভিশন কনে নেয় সিগেট) শতাংশ হার্ডড্রাইভ তৈরী করে। মূলত এদের কাছ থেকেই ডেল, অ্যাপল, এইচপি, আইবিএম, ফুজিতসু মাইক্রোসফটের মত প্রতিষ্ঠানগুলো কিনে নেয় যন্ত্রাংশটি। এর মধ্যে ওয়েস্টার্ন ডিজিটাল ও সিগেটের অধিকাংশ কারখানা থাইল্যান্ডে। সিগেটের ক্রয়কৃত স্যামসাংয়ের কিছু কারখানা অবশ্য রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। বিক্রি না করলে এ সময় টেক্কা দিতে পারত স্যামসাং। যাক, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। ভূমিকম্প ও সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত আরেক বড় জাপানি প্রতিষ্ঠান তোশিবার পক্ষে হঠাৎ করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না। এতে করে আমদানিকারক সব দেশেই হার্ডড্রাইভের দাম বেড়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যন্ত্রাংশটির হার্ডড্রাইভের দাম ৩০ শতাংশের মত বাড়বে এতে। বিশেষজ্ঞদের অনুমানের ধারেকাছেও না গিয়ে বাংলাদেশে হার্ডড্রাইভের দাম বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ! আঁতকে ওঠার মত। বাজারে ৫০০ গিগাবাইট (জিবি) হার্ডড্রাইভের বিক্রি হচ্ছে ৮ হাজার টাকায়। এক টেরাবাইটের (টিবি) দাম ৭ হাজার টাকা। ৩২০ জিবি হার্ডড্রাইভ নাকি পাওয়াই যাচ্ছে না। অথচ গত মাসের প্রথম দিকেও দাম কমছিল। শেষের দিকে কিছুটা বাড়লেও সেটি এখনকার মতো ছিল না। তখন ৩২০ জিবি হার্ডড্রাইভ বিক্রি হয়েছিল ৩৬০০ টাকায়। হিটাচি কোম্পানীর তৈরী ১ টিবির দাম নেয়া হচ্ছিল ৫৬০০; ৫০০ জিবি ৪২০০ ও ২ টিবি ৮৭০০ টাকা। ২ টিবির হার্ডডিস্কটি নতুন এসেছে ও এর সরবরাহ কম- সে হিসেবে এর দাম ৮৭০০ টাকা হতে পারে। তাই বলে ৫০০ জিবির দাম ৮০০০ টাকা হয় কি করে! আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে সত্য; তবুও অধিকাংশ স্থানেই সেটি ২৮ শতাংশের বেশি বাড়ে নি। কেবল বাংলাদেশে এটির দাম বেড়েছে ১৬৩ আর ভারতে ১৫০ শতাংশের কাছাকাছি। দাম বৃদ্ধির প্রভাব এখন বেশি করে পড়বে ল্যাপটপ কম্পিউটারের ওপর। তবে সরকারি তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতকৃত ‘দোয়েলে’র ওপর এ প্রভাব কেমন হবে সেটি অনুমান করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে দ্রুত অনুসন্ধান করা দরকার, অন্যদেশের তুলনায় এখানে দাম এত বেশি বাড়ার কারণটি।

এ ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি ল্যাপটপ উৎপাদনকারীদের। বাজারে এটির দাম কমছিল। এখন দাম বাড়ানো হলে বিক্রি পড়ে যাবে। আবার না বাড়ালে তা বেচতে হবে লোকসান দিয়ে। অবশ্য বিপদ বুঝতে পেরে ডেলের মতো বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রচলিত ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল ড্রাইভের বদলে তারা সলিড স্টেট (এসএসডি) হার্ডড্রাইভ ব্যবহার করার। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় এতদিন এসএসডি থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন ব্যবসায়ীরা। অবশ্য এদের ধারণা পরিমাণ বাড়লে কমে আসবে উৎপাদন খরচ।

নিয়াজ মাখদুম

বিমানবন্দরে নিরাপত্তা

গোড়ার দিকে তেমন কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বিমানবন্দরে। এটি ছিল অনেকটাই বাস সার্ভিসের মতো। শিথিল নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাটি চোখে পড়লো ১৯৭৬ সালের ৬ অক্টোবর। এ সময় বার্বাডোজ থেকে জ্যামাইকাগামী একটি কিউবানা বিমানে কয়েক জন সন্ত্রাসী লাগেজে বোমা ও হালকা অস্ত্র নিয়ে ওঠেন সুযোগ পেয়ে। সে হামলায় মারা যান ৭৩ জন বেসামরিক যাত্রী। এরপর বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা একটু উন্নত করা হলো। শুরু হলো লাগেজ চেকিং। যাত্রীদের হাতব্যাগ চেক করা হতো না তখনও। তবে আধুনিক স্ক্রিনীং সিস্টেম না থাকায় খুব একটা কঠিন ছিল না কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দেয়া। নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনীকিকরণের তাগিদ প্রথম অনুভব করল ভারত ১৯৮৫ সালে। দুর্বল বন্দর নিরাপত্তার সুযোগে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালালো এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২’তে। এতে মারা গেলেন যাত্রীসহ ৩২৯ জন। সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরালো করা হয় এ ঘটনার পর থেকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৯/১১। ছিনতাইকরা বিমানের আঘাতে ধ্বংস হলো যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার। এ ঘটনার পর থেকে আরও সতর্ক হয়ে গেছে বিশ্বের বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষগুলো।

কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন ডিপার্টমেন্ট বিমান বন্দরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই বলে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমানচলাচল কর্তৃপক্ষকে তাদের তালিকায় ‘এ’ থেকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে নামিয়ে আনে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনস্ট্রেশনের (টিএসএ) অনুমতি না মেলায় কয়েকটি আধুনিক বোয়িং বিমান কেনা হলেও চালু করা যাচ্ছে না নিউইয়র্ক টু ঢাকা ফ্লাইট রুটটি। সতর্ক করে দেয়ার পরও পদক্ষেপ না নেয়ায় সিগনিফিকেন্ট সেফটি কনসার্নের (এসএসসি) তালিকায় চলে গেছে এ দেশের নাম। বলা হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে আগামীতে সিগনিফিক্যান্ট সিকিউরিটি কনসার্নের (এসএসইসি) আওতায় পড়তে পারি আমরা। এসএসইসির তালিকায় নাম চলে গেলে আন্তর্জাতিক যাত্রীরা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তবে এ ক্ষেত্রে সুখবর হলো, সম্প্রতি বিমানবন্দরে মানসম্মত নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রনালয়কে প্রস্তাব দিয়েছে কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল ডিফেন্স ইনকরপোরেশন (ভিডিআই)। তাদের দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশে বায়োমেট্রিক স্বয়ংক্রিয় প্রবেশনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপনের কথা। স্পর্শকাতর এলাকায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে সীমানা প্রাচীরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে স্থাপন করা হবে পেরিমিটার ইন্ট্রুডার ডেকেটশন সিস্টেম (পিআইডিএস)। এতে অ্যালার্ম সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। কাউকে হয়রানি না করে হাতব্যাগ ও লাগেজ তল্লাশির আধুনিক কেবিন স্ক্যানিং, প্যাসেঞ্জার স্ক্যনিং ডিটেকশন, বিশেষত ধাতব-অধাতব বিস্ফোরক এবং বিপদজনক বস্তু চিহ্নিত করার ব্যবস্থা রাখা হবে এতে। এর সঙ্গে বিদ্যমান নিরাপত্তা কর্মসূচীর উন্নয়ন ও সমন্বিত পরিচালনা পদ্ধতির কথাও বলেছে তারা। ভিডিআইয়ের পক্ষে থেকে বলা হয়েছে, যন্ত্রপাতি বসানো শেষ হলে এগুলো পরিচালনার জন্য স্থানীয় কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে। এ ক্ষেত্রে তারা বিনিয়োগ করবে ৩০০ কোটি টাকা। এ অর্থ তোলা হবে ২৫ বছরে। এয়ারলাইন্স থেকে বহির্গমন যাত্রীর ক্ষেত্রে মাথাপিছু আড়াই হাজার টাকা হারে ফি নেয়া হবে। প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, আদায়কৃত ফির ১৫ শতাংশ নেবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। তাহলে বর্তমানে যে হারে এ বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রী চলাচল করে, তাতে প্রতি বছর এখান থেকে রাজস্ব আহরণ করা যাবে আনুমানিক দেড়শ’ কোটি টাকা। যাত্রী বাড়লে সংখ্যাটিও বাড়বে অবশ্য।

যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ছাড়া বিমানের যাত্রীদের অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হয় অন্য দেশেও। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে জেদ্দা এয়ারপোর্টে এমন একটি ঘটনা ঘটে জেএমজি এয়ারলাইন্সের বেলায়। নানা দিক বিবেচনা করলে বিমানবন্দরের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভিডিআইয়ের দেয়া প্রস্তাবটি যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রশ্ন হলো, এ ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান করা হলো না কেন? এ ধরনের নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপে আপত্তি থাকার কথা নয় কারো। অথচ দুর্নীতির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখন উচিৎ হবে এ ক্ষেত্রে সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, তাতে স্বচ্ছতা যেন বজায় থাকে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

পরিবর্তনশীল মাদক ব্যবসার কৌশল

কয়েক মাস আগে কেরানীগঞ্জ থেকে চুড়িওয়ালা ছদ্মবেশে এক পাইকারি ফেনসিডিল ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করল র‍্যাব। তিনি চুড়ির বদলে ঝোলাতে করে বিক্রি করছিলেন ফেনসিডিল। তাতে একেবারে চুড়ি ছিল না, তা নয়। কিছু চুড়ি ছিল ওপরের কার্টনে। মোট ১৫০ বোতল ফেনসিডিল ছিল এর নীচে। দেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলায় প্রতি বোতল ফেনসিডিল তিনি কিনেছিলেন এক থেকে দেড়শ’ টাকায়। ঢাকায় এসে ক্রেতার কাছে ১২ থেকে ১৪শ’ টাকায় বিক্রি করছিলেন এটি। ক্রেতাদের অধিকাংশই ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে কেবল ফেনসিডিল নয় গাঁজা-হেরোইন-ইয়াবাও ছড়িয়ে পড়ছে এভাবে। নিম্নবিত্তের অনেকে আসক্ত হয়ে পড়ছে জুতা তৈরীর সলিউশন ডান্ডিতে। মনে হয় জড়িত ব্যবসায়ীরা তাদের সবটুকু উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন মাদক পরিবহনে। বড় গ্যাস সিলিন্ডারের তলা কেটে তাতে পাওয়া গেলো ফেনসিডিল গত মাসে। মোটা বৈদ্যুতিক তারের রোলের ভেতরে, গাড়ির সিটের নীচেও বহন করা যায় এটি। সড়কে বেশি চেকিং থাকলে অনেক সময় ভোজ্য ও জ্বালানি তেলের বড় ড্রামও ব্যবহার করা হয় এ ক্ষেত্রে। তবে ফেনিসিডিলের তুলনায় ইয়াবা ও হেরোইন পরিবহন করা সহজ। বিশেষভাবে কাটা মিষ্টিকুমড়া, নারকেল ও লাউয়ের মাঝে এ দুই বস্তু প্রাপ্তির খবর আগে পাওয়া যেতো মাঝে মাঝেই। শার্টের কলার, মোজার ভেতর ও বাজারের ব্যাগেও বহন করা হতো এগুলো। হেরোইন গুলিয়ে দইয়ের মতো করে নিরাপদেই আনা হতো রাজধানীতে। এভাবে বিভিন্ন সৃজনশীল কৌশলে পরিবহন হয় মাদক। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুরের জয়দেবপুরে। এম্বুলেন্সে করে, কফিনের মধ্যে ৪০০ বোতল ফেনসিডিল পরিবহন করছিলেন মাদক ব্যবসায়ীরা। তাতে রোগীর ভান ধরে একজন শুয়েও ছিল। স্বভাবতই সিরিয়াস কেস মনে করে আশেপাশের গাড়িগুলো একে রাস্তাও ছেড়ে দিচ্ছিল। ড্রাইভারের আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় এম্বুলেন্সটি তল্লাশি করে র‍্যাব। শেষে কফিনে পেয়ে যায় ফেনসিডিল। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় ভূয়া রোগীসহ বাকিদের।

বাংলাদেশ একই সঙ্গে মাদকের রুট ও বাজার। অভিযোগ রয়েছে, সীমান্তঘেঁষা অনেক এলাকায় রাতে প্রকাশ্যেই মাদকের হাট বসে। জড়িদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত। এরা মাদক পরিবহন ও বিপণন করে থাকে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছে এ দেশের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ। এদের মাঝে নারী ও শিশুর সংখ্যা ৩৫ হাজার। মাদকসেবীদের ব্যাপারে হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায় কম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন। ৭৫ শতাংশ মাদকসেবী ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী। মাদক গ্রহণের ক্ষেত্রে এরা সবাই মিলে বছরে খরচ করে আনুমানিক ৪৭০ মিলিয়ন টাকা।

এ দেশে অধিকাংশ মাদক আসে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে। ফেনসিডিল আসে ভারত থেকে। অভিযোগ রয়েছে, সীমান্তে বেশ কয়েকটি ফেনসিডিল কারখানা থাকার ব্যাপারে সতর্ক করা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না ভারত। থাইল্যান্ড সীমান্তে মিয়ানমারের সান প্রদেশে বেশ কয়েকটি ইয়াবা তৈরীর কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে নাফ নদী হয়ে মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারে এ দেশে প্রবেশ করে ইয়াবা। ভারতের মতো মিয়ানমারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে, তারা নাফ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ইয়াবা তৈরীর কারখানা স্থাপন করেছে। সম্প্রতি এটির পাচার বন্ধে মিয়ানমারের ২৫ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। দেশটিতে থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, আমাদের দেশে অধিকাংশ মাদক ব্যবসায়ীই আকস্মিকভাবে ধরা পড়ে যান; শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সৌভাগ্যক্রমে ধরে ফেলেন। মাদক ব্যবসা একটি সংগঠিত অপরাধ। এ ক্ষেত্রে চক্র ধ্বংস না করে কেবল মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ধরে তেমন লাভ হবে না। এ জন্য সীমান্তে নজরদারি কঠোর করা চাই। যাতে করে উৎস থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ে দেশময় ছড়িয়ে দিতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার করতে হবে সীমান্তেই এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত।

নিয়াজ মাখদুম

আমাদের নারীদের জন্য পৃথক বাহন

মালয়েশিয়া সরকার তাদের কর্মজীবি নারীদের সুবিধার্থে আলাদা ট্রেনের ব্যবস্থা নিয়েছিল অনেক আগে। মুসলিম দেশ হিসেবে অগ্রাহ্য করা যায় না সেখানকার সমাজ ব্যবস্থায় রক্ষণশীলতার বিষয়টিকে। তবে এটি ছাড়াও পুরুষদের ভীড়ে কষ্ট করে যেন ট্রেনে উঠতে না হয় ও নির্যাতনের সুযোগ কমে যায়- মূলত এমন ধারণা থেকেই দেশটির নারীদের জন্য চালু করা হয় গোলাপী ট্রেন। অবশ্য নারীদের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ, শিশু ও অক্ষম যাদের পক্ষেও ভীড় ঠেলে ওঠা কঠিন, তারাও গোলাপী ট্রেনে চড়ার সুযোগ পেতেন। এ ব্যবস্থাটি অপ্রতুল মনে হওয়ায় কয়েক বছর আগে গোলাপী বাস সার্ভিসও চালু করে মালয়েশিয়া সরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছিল এও যথেষ্ঠ নয়। যেসব নারীদের একাকী ভ্রমণ করতে হয় ও যাদের নিজস্ব গাড়ি নেই, তাদের অনেককে গন্তব্যে পৌঁছাতে গিয়ে নানা রকম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ কারণে সম্প্রতি দেশটি উদ্যোগ নিয়েছে নারীদের পৃথক ট্যাক্সি ব্যবস্থাও চালু করার। প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে, এর আওতায় আপাতত রাজধানী কুয়ালালামপুরের রাজপথে নামানো হবে ৪০০ ট্যাক্সি। এগুলোর চালক হিসেবেও থাকবেন নারীরা। এরই মধ্যে ৫০ জন চালক পাওয়াও গেছে। আগ্রহী নারীরা ফোন করে প্রাপ্যতার ভিত্তিতে এসব ট্যাক্সিতে চড়তে পারবেন। অবশ্য বেশি রাত পর্যন্ত এ ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না- নারী চালকদের নিরাপত্তার স্বার্থে।

১৯১২ সালে নারীদের পৃথক ট্রেনব্যবস্থা প্রথম চালু হয় জাপানে। তখন কমিউটার ট্রেনে করে কর্মজীবি নারী ও ছাত্রীরা আসতেন রাজধানী টোকিওতে। তারা পুরুষ যাত্রীদের হাতে নির্যাতিত হতেন নানাভাবে। অনেকে লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও চাইতেন না। আবার কেউ কেউ অভিযোগ করতেন পুলিশের কাছে। তাতে লাভ হতো খুবই কম। এর প্রথম কারণ, নির্যাতনকারীরা ট্রেন থেকে নেমে কোথায় চলে যাচ্ছেন তা অভিযোগকারী বা পুলিশের পক্ষে খুঁজে বের করা কঠিন ছিল। ওই সময় সংখ্যা কম থাকায় অধিকাংশ ট্রেনে সারাক্ষণ ভীড় লেগে থাকত। এতে করে নির্দিষ্টভাবে দোষীকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া ছিল প্রায় অসম্ভব বিষয়। আসলেই নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন কিনা, সে ব্যাপারে একটি জরিপ চালায় টোকিও মেট্রোপলিটান পুলিশ ও ইস্ট জাপান রেলওয়ে যৌথভাবে। ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায় তাতে। জরিপটিতে দেখা যায়, নারী যাত্রীদের ৬০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সে সময় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করে টোকিও পুলিশ। তাতে আশানুরুপ ফল না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে আলাদা ট্রেনের ব্যবস্থা করে জাপান সরকার। ট্রেনটির নাম ছিল হানা-ডেনশা (ফ্লাওয়ারট্রেন)। পরবর্তীকালে সেখানে নারীদের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পৃথক যানবাহন সরবরাহের আইন প্রণয়ন করা হয়। জাপানকে অনুসরণ করে এ ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা বর্তমানে চালু রয়েছে মিশর, ভারত, ইরান, তাইওয়ান, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিফাইন এবং দুবাইতেও।

বাংলাদেশে কর্মজীবি নারীদের সংখ্যা বাড়ছেই। এর মাঝে কয়েক লক্ষ নারী শ্রমিক রয়েছে গার্মেন্টস শিল্পে। এ ক্ষেত্রে যারা অফিস-আদালতে কাজ করেন, তাদের বেলায় অনেক সময় অফিস থেকে পৃথক যানবাহনের ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে গার্মেন্টসের নারীশ্রমিকদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটি অপ্রতুল। তারপর রাতের শিফটে যারা কাজ করেন তাদের নিরাপদ যাতায়াত সুবিধা দেয়া হয় না বললেই চলে। অথচ নিম্নবিত্ত ও নারী হওয়ায় এরা নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিতে থাকেন বেশি। সাধারণত রাতের বেলা কাজ শেষ করে দলবেঁধে বাড়ি ফেরেন তারা। তবে কোনো কারণে একাকী যেতে হলে প্রায়শই শোনা যায় বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের কথা। সাধারণ পরিবহনে চড়তে গেলেও নানা বিড়ম্বনা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয় এদের। অথচ সদিচ্ছা থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই এ ব্যবস্থাটি করে দিতে পারেন।

পুরুষদের ঠেলে নারীরা সিট দখল করছে- এ দৃশ্য মেনে নেয়ার মানসিক্তা কমই থাকে রক্ষণশীল সমাজে। নারী-পুরুষে শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক থাকলে না হয় কথা ছিল। পূর্বে ইংল্যান্ডেও নারীদের জন্য পৃথক ‘লেডিস অনলি’ বাস ও ট্রেনের বগি ছিল। এটিও করা হয়েছিল ইভটিজিং থেকে ব্রিটিশ নারীদের রক্ষা করতে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত হয়েছে, এটা নিশ্চিত করে ও জোরদার নারী আন্দোলনের মুখে ‘লেডিস অনলি” যানবাহন লন্ডনে বন্ধ করে দেয়া হয় ১৯৭৭ সালে। এশিয়ার অন্যত্র অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, আমাদের দেশে বিষয়টিকে দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের ওপর ছেড়ে দেয়া চলে। তাই বলে সেটি গুরুত্বহীন, তা নয়। তবু এর সঙ্গে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন ও আলাদা ট্রেন-বাস-ট্যাক্সির ব্যবস্থা রাখা ছাড়া নারী নির্যাতন রোধ করা কঠিন এখানে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

Published in Bonik Barta, April 2015

প্রবাসীদের মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট

উৎকণ্ঠা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নিন

কোনো কোনো সূত্রমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশীর সংখ্যা এখন ৯১ লাখের কিছুটা বেশি। এক হিসাবে, বর্তমানে আমাদের ৬০ শ্রমিক নিযুক্ত আছেন আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে। উল্লেখযোগ্য খবর হলো, হাতে লেখা পাসপোর্টের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যাবে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। অর্থাৎ আর মাত্র কয়েক মাস পর হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ অথবা বিদেশে অবস্থান করা যাবে না। সেটাই আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থার (আইকাও) নিয়ম। সমস্যা হলো, প্রবাসী বাংলাদেশীদের সিংহভাগই এখনো মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) হাতে পান নি বলে গতকাল বণিক বার্তার এক শঙ্কিত প্রতিবেদনে প্রকাশ। আরো চিন্তার বিষয়, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হাতে লেখা পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন জানানো হয়েছিল। সেখানে দুই বছরে ২৫ শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশীর হাতে এমআরপি পৌঁছানোর তথ্য জানিয়ে বাকি ৭৫ শতাংশের জন্য ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে কিছু করার নেই বলে অপারগতা জানিয়েছে আইকাও। সুতরাং আলোচ্য সময়ের মধ্যে প্রবাসী শ্রমিকদের এমআরপি দেয়া না গেলে সত্যই ঝামেলায় পড়তে হবে আমাদের। ফলে এ ইস্যুতে কোনো রকম উদাসীনতা দেখানোর সুযোগ নেই। একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত আমাদের প্রতিবেদকের কাছে মত দিয়েছেন, যেহেতু আরো ক’মাস সময়ে রয়েছে, এর মধ্যে এমআরপি প্রদানের গতি পর্যাপ্তভাবে বাড়াতে পারলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে। সবাই প্রত্যাশা করেন, তেমন পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব করবে না সরকার। কেননা বাংলাদেশের জিডিপিতে বিশাল অবদান রেখে চলা জনশক্তি রফতানি খাতে ২০১৩ সাল থেকেই কিছুটা ভাটা পড়তে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারণে। ফলে ২০১২ সালে যেখানে বার্ষিক গড়ে ৫ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন দেশে যেতেন, আজ জনশক্তি রফতানির হার তার চেয়ে বেশ কম।

রেমিট্যান্স অর্জনকারী এ খাতে স্থিতিশীলতা ও উন্নতি নিশ্চিতকরণে ২০০৭ সাল থেকেই অব্যাহত পদক্ষেপ দেখা গেছে। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে শ্রমিক প্রেরণ এবং সৌদি আরবের শ্রমবাজার নতুন করে আমাদের সামনে খুলে যাওয়াটা আমাদের জন্য সাফল্য বটে। কিন্তু তার পরও বিকল্প শ্রমবাজার অন্বেষণ এবং বিদ্যমান শ্রমবাজারে নিজ অবস্থান অধিক শক্তিশালী করে তোলার গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। খুবই দুঃখজনক হবে, যদি সেক্ষেত্রে সময়মতো এমআরপি না পাওয়াটা এক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই মধ্যে এ বিষয়ে আশ্বাস বাণী শুনিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী। তার কথায় আস্থা রাখতে চাইবেন সবাই। পাশাপাশি এও দেখতে চাইবেন, এমআরপি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্ব সুসমন্বিতভাবে পালিত হচ্ছে। এখানে সমন্বয়ের অভাব থাকলে দৈনিক ৪০ হাজার এমআরপি প্রিন্ট দিয়েও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে। এরই মধ্যে কিছু অভিযোগ উঠেছে এমআরপি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক বিদেশী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সেসব অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখা দরকার। আরেকটি বিষয়, শুরুতে বাংলাদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসীদের এমআরপি দেয়া হতো। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পাসপোর্ট প্রদান শুরু হয়। উভয় পদ্ধতিরই সুবিধা-অসুবিধা আছে। দ্রুত এমআরপি প্রদানের কৌশল নির্ধারণে বিষয়টি মাথায় রাখা দরকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়ম

ব্যয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক শাখার আয়-ব্যয় এবং প্রাপ্ত সম্পদ ব্যবহারের হিসাব নিরীক্ষাপূর্বক সরকারের স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদফতর কর্তৃক উত্থাপিত অর্ধশতাধিক আপত্তির খবর ছাপা হয়েছে গতকালের বার্তায়। আগ্রহী পাঠকের নজরে তার বিস্তারিত বর্ণনাও এসে থাকবে। খেয়াল করার মতো বিষয়, আপত্তিগুলোর প্রায় দু’ডজনই প্রথম বর্ষ সম্মানে ভর্তি সংক্রান্ত। ২০১৩-১৪ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদন মতে, প্রাপ্য না হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন অনুষদকে দেয়া হয়েছে অর্থ; আর সে বরাদ্দে শিক্ষা উপকরণ থেকে শুরু করে রয়েছে সীমানাপ্রাচীরের পূর্ত কাজ পর্যন্ত। উপরন্তু অনিয়মের ধরনে দেখা যাচ্ছে, তালিকায় শিক্ষকদের শ্রান্তি ও বিনোদন, গবেষণা, জ্বালানি, যোগাযোগ, পোশাক ও সেলফোন ভাতাকে। প্রাপ্য না হওয়া সত্ত্বেও সরকারি আদেশ অমান্য করে সেসব ভাতা প্রদান করা হয়েছে বলে অভিযোগ। সামনে আসা অভিযোগগুলোর একটির জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এক দায়িত্বশীল ব্যক্তি আমাদের প্রতিবেদককে বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড়ে বিলম্ব প্রভৃতি ইস্যুর দিকে ইঙ্গিত। একে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সে কথা বলা যাবে না অবশ্য। তা সত্বেও জোর দিয়ে বলা দরকার, সামরগিক প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬১ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম একেবারে ছোট ঘটনা নয়। তার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির প্রশ্নও অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। এমন পরিস্থিতিতে উপার্চায যেমনিভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন, তার সঙ্গে দ্রুততা ও স্বচ্ছতার প্রত্যাশাই করবেন সবাই।

লক্ষ্যণীয়, দেশের সব পর্যায়ে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধাদি সন্তোষজনক নয়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এ বৃত্তের মধ্যেই পড়েন। আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তুকি দেয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধির সহজ উত্তর অনেক সময়ই থাকে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে। স্পষ্টত একদিকে পেশা হিসেবে শিক্ষকতা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক আকর্ষণ কমছে; অথচ অন্যদিকে দায়িত্বরতদের ওপর বাড়ছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন নাগরিকদের চাপ। সেজন্যই নাকি অনেক সময় বিভিন্ন তহবিল একটু এদিক-ওদিক করে শিক্ষকদের ‘নানা চাহিদা’ মেটানোর চেষ্টা করা হয়। খুবই দুঃখজনক যে, যাদের প্রতিটি প্রজন্মের সামনে অনুপ্রেরণা ও আদর্শ নিয়ে দাঁড়াবার কথা, তাদের মধ্য থেকেই একশ্রেণীর ব্যক্তিরা আজ জড়িয়ে পড়ছেন আর্থিক অনিয়মসহ বিভিন্ন দুষ্কর্মে। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষের উচিৎ হলো, তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা। নইলে ঘটনাটি একটি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

ইয়েমেনে আটকে পড়া বাংলাদেশী

দ্রুত ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিন

ইয়েমেনের পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে গড়াতে পারে সে আভাস মিলেছিল কয়েক সপ্তাহ আগেই। কিন্তু গত সপ্তাহের আগে বোধকরি বোঝা যায় নি, কতদূর নামতে পারে ঘটনা। উপরন্তু জটিলতা হলো, অবস্থা আরো মন্দ হতে পারে বলে শঙ্কা। এর মধ্যে দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সেখানকার বাংলাদেশীদের অবস্থা শোচনীয়ই বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। বাইরে বেরুনোর সুযোগ কম। রান্নায় ব্যবহার্য গ্যাস মিলছে না; তাই অনেককে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে শুকনো খাবার খেয়ে। স্বভাবতই বন্ধ রয়েছে অফিস-আদালত ও আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশীদের জন্য বাড়তি দুশ্চিন্তা হলো, ইয়েমেনে আমাদের কোনো দূতাবাস নেই। একজন অনারারি অনারারি কাউন্সিলর থাকলেও যুদ্ধের পর থেকে নাকি তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ফলে সেখানকার বাংলাদেশীদের দেখভাল করা হচ্ছে বাংলাদেশের কুয়েতস্থ দূতাবাস থেকে। এর মধ্যে গতকালের বণিক বার্তায় প্রকাশ একটি খবর অত্যন্ত হতাশাজনক- দেশটিতে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাবই নেই সরকারের কাছে! হিসাবটি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুমানে তিন হাজার ছাড়ায় নি। তবে সেখানে অবস্থানরত অনেকের মতে, সংখ্যাটি দশ হাজারের কম হবে না। কথা হলো, সংখ্যা যা-ই হোক, ইয়েমেন থেকে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সরকারের অধিক সক্রিয় দেখতে চাইবেন সবাই।

এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি, সে কথা অবশ্যই বলা যাবে না। কিন্তু ঝুঁকির দিকটি বিবেচনায় নিয়ে যতটা সক্রিয়তার সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ ছিল, তা ঘটে নি বলে অনেকের অভিযোগ। খেয়াল করার মতো বিষয়, পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে ভারত তার নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশীদের যেতে হচ্ছে ভারতীয় দূতাবাসে! যেখানে আমাদের নিকটস্থ দূতাবাস কুয়েতে, সেখানে গোড়া থেকেই ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তা নিলে কী এমন অশুদ্ধ হতো- প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। জানা কথা, সৌদি আরব ও ওমানে মানব পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইয়েমেন। মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ বিকাশের কুখ্যাত প্রডাকশন লাইনও এটি। এদিকে সাদ্দাম হোসেন কর্তৃক কুয়েত দখল ও তার পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরব-ইয়েমেন সম্পর্ক এবং বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান সচেতন পাঠকের দৃষ্টির সামনেই আছে। সেসব যুক্তি আপাতত তুলে রেখে আটকে পড়া বাংলাদেশীদের দ্রুত ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক।

ওসমানী বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট

নিরবচ্ছিন্ন সেবার নিশ্চয়তা চাই

প্রবাসীঅধ্যুষিত সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থানীয়দের কাছে স্বপ্ন বৈকি। প্রধানত তাদের এ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যেই ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা করা হয় ওসমানী বিমানবন্দরকে। তবে বাস্তবায়নের পথে স্বপ্নটি ঝুলে ছিল প্রায় ১৭ বছর; বিমানবন্দরে রিফুয়েলিং ব্যবস্থা না থাকায়। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মহাজোট সরকার তা নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকল্পের কাজ সম্পন হওয়ার কথা ছিল; ২০১৩ সালের জুন মাসের মধ্যে; অর্ধশতাধিক কোটি টাকায়। নির্দিষ্ট সময়ে প্রাক্কলিত ব্যয়ে এ দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘটনা খুবই কম। এক্ষেত্রেও সময় ও ব্যয় দুটোই বাড়াতে হয়। সুবিধাটি চালুর পর প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও গত ১ এপ্রিল এক বিদেশী এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ অবতরণ-উড্ডয়ন পর বিমানবন্দরটিতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে খবর গতকালের বণিক বার্তার। এমন পরিস্থিতিতে সচেতন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তবে কি কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রিফুয়েলিং স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছিল একবার উড্ডয়ন-অবতরণের জন্য? এ প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া জরুরি- শুধু সিলেটবাসীর আকাঙ্ক্ষা পূরণে নয়; সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের জন্যও।

খেয়াল করার মতো বিষয়, ওসমানী বিমানবন্দরে বারবার ব্যাহত হয়েছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের চলাচল। কুয়াশার কারণে সিলেট-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ হয়ে যায় ২০১১ সালের ডিসেম্বরে। জানা যায়, পরবর্তীতে লন্ডন থেকে কিছু ফ্লাইট সিলেটে এলেও সিলেট থেকে কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ছেড়ে যেতে পারে নি। কেউ কেউ বলছেন, এবার যে অজুহাতে সেবাটি বন্ধ হলো তার নাম ‘গ্রাউন্ড সার্ভিস’। ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ সেবা প্রদানের ক্ষমতা নাকি একমাত্র বাংলাদেশ বিমানের। যে এয়ারলাইনসটি ১ এপ্রিল ফ্লাইট চালুর করেছিল, তাদের জন্য সমস্যা হলো- বাংলাদেশ বিমানের কাছে গ্রাউন্ড সার্ভিস চেয়েও নাকি তা পায় নি তারা। এতে করে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস তো বটেই চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। বিপাকে পড়ে সিলেট থেকে বিদেশগামী সিংহভাগ যাত্রীকে সড়ক পথে ঢাকায় এসে ধরতে হচ্ছে ফ্লাইট। আবার বিদেশ থেকে আগমনেচ্ছু যেসব যাত্রী ভেবেছিলেন সরাসরি সিলেট নামবেন, ঢাকায় এসে তাদের করতে হচ্ছে যানবাহন বদল। এক্ষেত্রে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশ বিমানের অবস্থান পরিষ্কার- চুক্তি ছাড়া কখনোই গ্রাউন্ড সার্ভিস দেয়া সম্ভব নয়; বিদেশী এয়ারলাইনসটিও কোন ভরসায় অনুমতি না নিয়েই ফ্লাইট চালু করতে গেলো বোধগম্য নয়। উপরন্তু একদিন (অর্থাৎ ১ এপ্রিল) নিয়ম ভেঙ্গে ফ্লাইট পরিচালনা করতে দেয়ায় তাদের অনেকে হয়তো ধন্যবাদও প্রত্যাশা করে থাকবেন। ষড়যন্ত্র তত্ব শোনা যায়, ওসমানী বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বিদেশী ফ্লাইট বন্ধের ব্যাপারে নাকি বাংলাদেশ বিমানের একশ্রেণীর কর্মকর্তার হাত রয়েছে; স্বার্থ উদ্ধার না হওয়াতেই নাকি এমন কাজ করেছেন তারা। ১৭ বছর পর শুধুমাত্র এমন একটি কারণে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সেবা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে তা হবে আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে সিলেটের প্রচুর প্রবাসী রয়েছেন। এদের সুবিধা-অসুবিধার দিকটি এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। জানা যায়, আরেকটি এয়ারলাইনস নাকি গ্রাউন্ড সার্ভিসের অনুমতি চেয়েছে বাংলাদেশ বিমানের কাছে। উদ্ভূত জটিলতার দ্রুত নিষ্পত্তি শেষে সরাসরি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পুনরায় চালু হোক, এমনটাই এখন দেখতে চাইবেন সবাই।

ফাইলবন্দী মাস্টারপ্ল্যান!

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিলম্ব নয়

সর্বশেষ ২০১০ সালে আয়োজিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি) নির্বাচনের ক’দিন আগে নাকি জলমগ্ন হয়ে পড়ে নগরী। সেজন্যও (অনেকের মতে) নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে তীব্র হয়ে ওঠে জলাবদ্ধতা নিরসন নামক ইস্যুটির ভূমিকা। চলতি মাসের শেষে পরবর্তী সিসিসি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এরই মধ্যে প্রার্থীরা জলাবদ্ধতা দূরীকরণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব রেখে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন; নানা প্রতিশ্রুতি-অঙ্গীকারের কথা শোনা যাচ্ছে। একে অস্বাভাবিক বলা যায় না এ কারণেও যে, জলাবদ্ধতা চাটগাঁবাসীদের বহুদিনের সমস্যা। সমুদ্র, পাহাড় ও নদী ঘনিষ্ঠ অঞ্চল হওয়ায় স্বাভাবিক জোয়ারেই সেখানকার অধিকাংশ অঞ্চলে দীর্ঘ সময় পানি আটকে থেকে জন ও পণ্য চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৯৯৫ সালে ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কথা বলছে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ। ৩ হাজার কোটি টাকা বাস্তবায়ন ব্যয় ধরে সেটি অনুমোদিতও হয় ১৯৯৯ সালে। ওই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি বছর। গতকালের বণিক বার্তায় প্রকাশ এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুসারে এখন পর্যন্ত তার কিছুই হয় নি বলা যাবে না। তবে সেটির অগ্রগতি ৫ শতাংশের বেশি নয় বলে জানাচ্ছেন আমাদের প্রতিবেদক। এমন পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টরা আন্তরিকতার সঙ্গে পদক্ষেপ নেবেন বলেও আমাদের বিশ্বাস।

নিঃসন্দেহে মাস্টারপ্ল্যানটি বাস্তবায়নের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন সেটি এককভাবে সিসিসির পক্ষে বহন করা কঠিন। কিন্তু এতগুলো বছরে যথাযথ প্রচেষ্টা নেয়ার পরও চট্টগ্রামের মতো একটি বাণিজ্য নগর কর্তৃপক্ষ ৫ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন করতে পারল না, সে কথাও মানা শক্ত। অথচ পরিকল্পনাটি সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়নের তাগিদ অনুভব করেন না এমন নগরবাসী নেই বললেই চলে। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে একশ্রেণীর ব্যক্তি সিসিসি’র পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নিয়ে প্রচারণা চালান- মাস্টারপ্ল্যানের আংশিক বাস্তবায়ন; অথচ সেগুলোর সিংহভাগই পরিকল্পনাটির অংশ নয়। এতে ভোটাররা বিভ্রান্ত হন নিশ্চয়ই। আসছে সিসিসি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের বিষয়টি স্মরণে রয়েছে বলে প্রত্যাশা। কথা হলো, এ অবস্থায় শুধু নগর কর্তৃপক্ষের ওপর মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের ভার ছেড়ে না দিয়ে সরকারের বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে কিনা দেখা উচিৎ। এর সুফল নগরবাসী তো বটেই, অর্থনীতিও পাবে বলে মনে হয়। তাছাড়া ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যানটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) অংশ। সেদিক থেকেও সিসিসি পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগ দেবে, এমনটাই কাম্য সবার।

বাংলাদেশের অবস্থান শেষ দশে!

পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ান

হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস (এইচঅ্যান্ডপি) নামক যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রণীত ভিসা রেস্ট্রিকশন্স ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান বিষয়ে যে খবর প্রকাশ হয়েছে গতকালের বণিক বার্তায় তা অত্যন্ত হতাশাজনক। বিশেষত ইস্যুটির সঙ্গে রেমিট্যান্স উপার্জনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকে মিলিয়ে দেখলে দুঃখ আরো বাড়ে বৈকি। বৈশ্বিক শ্রমবাজার থেকে রেমিট্যান্সের অন্তর্মুখী প্রবাহ বিবেচনায় আমাদের অবস্থান শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যেই রয়েছে বলে জানা যায়। ওদিকে আলোচ্য সূচক অনুসারে, ৯৩টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান উত্তর কোরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ৮৫ তম। আর আমাদের নীচে উল্লেখযোগ্য দেশের মধ্যে রয়েছে, পাকিস্তান, সোমালিয়া ও আফগানিস্তান। খেয়াল করার মতো বিষয়, এ সূচক তৈরিতে এইচঅ্যান্ডপি’র সঙ্গে ছিল ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ)। প্রতিষ্ঠানটির মতামতের গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে সারা বিশ্বের ধনী শ্রেণীর মধ্যে। উপরন্তু জানা যায়, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) প্রবাহের ওপরও এইচঅ্যান্ডপি প্রণীত সূচকের মূল্য রয়েছে যথেষ্ট। ফলে সবাই প্রত্যাশা করবেন, ইস্যুটিকে যথাযথভাবে আমলে নিয়ে তদানুযায়ী কর্ম সম্পাদনে সক্রিয় হবে সরকার।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরও অবস্থা এতটা শোচনীয় ছিল না বলে আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত। সুতরাং ঘটনার কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন। দেখার বিষয়, সূচকটি প্রণয়নে দেশগুলোর ভ্রমণনীতি, সাময়িক ভিসা অব্যাহতি, ভিসার মেয়াদ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি ভ্রমণকারীদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত স্থানীয় আরেক বিশেষজ্ঞ সেজন্য ব্যাপকভাবে দায়ী করেছেন দেশে সুশাসনের অভাবকে। স্পষ্টত পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে নির্ভর করে বহির্বিশ্বে ওই দেশের রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপরও। আর সেক্ষেত্রে কোনো দিককার পরিস্থিতিই সন্তোষজনক নয়। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিদেশে গিয়ে অবৈধভাবে থেকে যাওয়া বাংলাদেশীদের ওপর এর বিরাট দায় চাপিয়েছেন। বিষয়টি বোধকরি এতটা সরল নয়। সম্প্রতি নেদারল্যান্ডসে প্রশিক্ষণরত এক বাংলাদেশী কূটনীতিকের বিরুদ্ধে আনীত ইলেকট্রনিক যন্ত্র চুরির ঘটনা এরই মধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। সেগুলোর কোনো প্রভাব আমাদের পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর পড়ছে না, তা হলপ করে কে বলবেন? আবার এ বাস্তবতাও অনস্বীকার্য, অনেক ক্ষেত্রে বুঝে না বুঝে অন্যদের দুষ্কর্মের ভাগিদারও হতে হয় বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের। এ থেকে উত্তরণে সম্মিলিতভাবে কৌশলপূর্ণ উপায়ে অগ্রসর হওয়া চাই যেন দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল তথা আমাদের পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।

ফিটনেসহীন ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান

ভেসেল ও রুটের ওপর নজরদারি বাড়ান

নদীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ভোলা জেলায় বিপজ্জনক মৌসুমে নৌরুটের ‘ডেঞ্জার পয়েন্ট’-এ ট্রলার-ছোট লঞ্চের মতো নৌযান ওপর চলাচল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এটি স্বাভাবিক পদক্ষেপ বৈকি। অস্বাভাবিক হলো, এর বিপরীতে একশ্রেণীর নৌযান মালিকের বেপরোয়া আচরণ। তারা শুধু ওসব পয়েন্টে ট্রলার ও লঞ্চই চালাচ্ছেন না, সেগুলোর সিংহভাগ ফিটনেসবিহীন তথা ঝুঁকিপূর্ণ বলে গতকালের বণিক বার্তার খবর। তা যাত্রী ও পণ্যের জন্য কতটা বিপদজনক, সে কথা বলাই বাহুল্য। আর এমন চিত্র যে সারা দেশের জন্যই বাস্তব, সেটিও সহজে অনুমেয়। খেয়াল করার মতো বিষয়, একটা সময় পর্যন্ত নৌদুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চোখ বুজে দায়ী করা হয়েছে ঝড়ো হাওয়াকে। সম্প্রতি ঝড় ছাড়াই শুধু ‘প্রবল স্রোতে’ও লঞ্চডুবির খবর মিলছে। নৌদুর্ঘটনা সংঘটনের পর সরকারের পক্ষ থেকেকোনো পক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না, তাও নয়। বরং অতীতের অনেক প্রেক্ষাপটই আজ পরিবর্তিত। এ সত্ত্বেও বাস্তবতা হলো- নৌদুর্ঘটনা ঘটছে, তদন্ত হচ্ছে কিন্তু ফল শূন্য। এ পরিস্থিতির অবসান প্রয়োজন। নিঃসন্দেহে নৌপথের গুরুত্ব অতীতের মতো নেই; এর উন্নয়নে মনোযোগও সেভাবে দেখা যায় না। তবু যতটা নৌচলাচল বজায় রয়েছে, তার সুষ্ঠু নিরাপত্তা বিধানে সরকারকে অধিক সক্রিয় হয়ে উঠতেই দেখতে চাইবেন সবাই।

অনেকের ধারণা ১৯৮৪ সালের নৌযান আইনে বিদ্যমান দুর্বলতার সুযোগে দেশজুড়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে ফিটনেসবিহীন নৌযান। সেসব ত্রুটিপূর্ণ নৌযানের গাঠনিক আদল অত্যন্ত দুর্ঘটনাপ্রবণ। তাতে যাত্রীদের আসন বিন্যাস ব্যবস্থাও বিপদ বাড়ায় বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ায়। যাত্রীবাহী নৌযানে আবার ভারসাম্যপূর্ণভাবে পণ্যের সুষম বণ্টন হয় কমই। তদুপরি নৌযানের আকার সঙ্গে ইঞ্জিনের অশ্বশক্তির যে একটা সামঞ্জস্য রাখা দরকার সে প্রয়োজনও নাকি বোধ করেন না অনেক মালিক। চালক ও সহায়তাকারীর অদক্ষতা ও গাফিলতির কথা না হয় এখানে উহ্যই থাকুক। সমস্যা হলো, নৌপথের ট্রাফিক ও রুট ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। আরো কাহারাপ অবস্থা নৌযান তদারকির। নৌমন্ত্রী আশ্বাস দেয়ার পরও (অবৈধ নৌযান বাদ রেখে) বৈধগুলোর এক-দশমাংশ বার্ষিক নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষার আওতায় আসে না বলে অভিযোগ। অথচ এক্ষেত্রে তার অধিক সক্রিয়তাই প্রত্যাশিত। তিনি রাতারাতি সব বদলে দেবেন, এমনটা অবশ্যই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে দেশের নৌব্যবস্থা উন্নয়নে তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকাই কি কাম্য নয় সবার?

চসিক সেবার মান

দায়িত্বশীলদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন

পরিকল্পিত নগর বাস্তবায়নে রাজধানীতে যে অসুবিধা, তার অনেকগুলোই নেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক’)।শুরুর দিকেও এর সুনাম বৈ দুর্নাম শোনা যায় না। বরং এক সময় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চসিক’কে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হত অন্যদের সামনে। চসিক’র নিজস্ব ওষুধ কারখানা, বর্জ্য দিয়ে জ্বালানি প্রস্তুতের মতো কার্যক্রমের কথাও অনেকে জেনে থাকবেন। আরো জানা যায়, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকল্পের অধীনে ১৯৯৫ সালে পেয়েছিল ‘হেলদি সিটি’র মর্যাদাও। তবে এখন নগরীর যে অবস্থা তার সঙ্গে পূর্ব-রূপের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। ক’দিন আগে চালুর অপেক্ষায় থাকা চট্টগ্রামের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে খবর প্রকাশ করে বণিক বার্তা। গতকাল ছাপা আরেক প্রতিবেদনে দুরবস্থায় বিশদ বর্ণনা মেলে। অনেকের মতে, চট্টগ্রাম এখন আবর্জনার স্তুপ ও ময়লার ভাগাড়! সেখানে নগর স্বাস্থ্য সেবার মানেও ব্যাপক অবনতি ঘটেছে এরই মধ্যে। যথারীতি এক্ষেত্রেও ‘উপযুক্ত যুক্তি’ খাঁড়া করার চেষ্টা চলেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন, চসিকর সেবার মানে হ্রাসের প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। পাশাপাশি নগর ব্যয়ের প্রতিও কারো কারো ইঙ্গিত রয়েছে বলে প্রতীয়মান।

অনস্বীকার্য, নগরায়ন দ্রুততার সঙ্গেই ঘটেছে এখানে। কিন্তু সেজন্য এ কথা বলা আবার অসমীচীন হবে যে, গতিটি অস্বাভাবিক ছিল। খেয়াল করার মতো বিষয়, নগর সম্প্রসারণের চিন্তা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করা হয় ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ। আর এর বাস্তবায়নের প্রতি দৃষ্টি দিলেই চিহ্নিত হবে চসিক’র সেবার মান কমে যাওয়ার কারণগুলো। লক্ষ্যণীয়, এক্ষেত্রে নগর ব্যয়ের অপ্রতুলতার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করাও সঙ্গত নয়। কেবল ২০০০-০৫ সাল বাদ দলে ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বারই উন্নয়ন খাতে বেড়েছে চসিকের ব্যয়। কোথায় কোথায় খরচ হয়েছে তার ঠিকানাও মেলে- বাস-ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ, গার্মেন্ট পল্লী, বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট প্রভৃতি কর্মসূচি রয়েছে তার মধ্যে। তবু কারো কারো ধারণা, উল্লিখিত সময়ে ব্যয় বৃদ্ধির পরও ধারাবাহিকভাবে কমেছে বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে অগ্রগতি। সংশ্লিষ্ট এক পদস্থ কর্মকর্তা সেজন্য নাগরিক সচেতনতার ঘাটতিকেই অধিক দায়ী দেখাতে চেয়েছেন, দেখা গেলো। নিঃসন্দেহে নাগরিক সচেতনতার অভাব চসিকের দুরবস্থায় পেছনে অন্যতম কারণ। কিন্তু এটিকে একমাত্র কারণ বলা যাবে না। বরং এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বশীল যারা তাদের মধ্যে একশ্রেণী মানুষের গাফিলতি ও দক্ষতাই অধিক ভূমিকা পালন করেছে বলে ধারণা। এদের জবাবদিহিতার আওতায় না এনে চসিকের উন্নয়ন ঘটানো কঠিন হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর মহাপরিকল্পনা

দ্রুত প্রণয়ন ও অনুসরণ দরকার

আমাদের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ভূমিকা ও গুরুত্ব কেমন, তা নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তবে প্রসঙ্গত এ তথ্যটুকু যোগ করা যেতে পারে যে, ওই বাণিজ্যের ৯০ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যজনক যে, গত প্রায় ৫ বছর ধরে এখনো বন্দরটি মহাপরিকল্পনা ছাড়াই চলছে বলে গতকালের বণিক বার্তার প্রতিবেদন। অভ্যন্তরীণ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা শেষবার এর মহাপরিকল্পনা যুগোপযোগী করা হয় ১৯৯৫ সালে। তার সময়সীমা নাকি ২০১০ সালের মে পর্যন্ত বহাল ছিল। পরবর্তীতে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও আন্তর্জাতিক সম্ভাবনা বৃদ্ধি লক্ষ্যে করে এক খ্যাতনামা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয় তিন দশকের জন্য নতুন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রতিষ্ঠানটি তা সময়মতো সম্পন্ন করতে পারে নি বলে জানিয়েছেন আমাদের প্রতিবেদক। এক্ষেত্রে সীমা ছাড়িয়ে দেরি হয়ে গেছে সে কথা বলা যাবে না। তবে অধিক বিলম্ব যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে বন্দর কর্তৃপক্ষকে।

তথ্য মতে, ১৯৭৭ সালে মাত্র ৬টি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডলিং পোর্ট হিসেবে বন্দরটির যাত্রা শুরু। সংখ্যাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ১০ লাখের নীচে নামে নি। অবশ্য যে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি নতুন মহাপরিকল্পনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের পূর্বাভাস হলো- ২০৩৬ সালে এখানে প্রমাণ সাইজের অন্তত ৫৬ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে। তার মানে বর্তমান সক্ষমতার ব্যবহার ৩ গুণ বাড়াতে হবে তখন। সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে, তেমন ভরসা কিন্তু মেলে না এখনকার অগ্রগতি দেখে। কর্তৃপক্ষের উচিৎ এর প্রতি মনোযোগ বাড়ানো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বন্দরের নানা কাজে সমন্বয় বৃদ্ধি। সমন্বয়হীনতার কারণেও কিছু ক্ষেত্রে বন্দর সক্ষমতার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় নি এবং যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। লক্ষ্যণীয়, নতুন মহাপরিকল্পনায় এর ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের কথা রয়েছে। বন্দর উন্নয়ন কার্যক্রমে ভাটা পড়ার পেছনে একশ্রেণীর প্রভাবশালীদের দ্বিধাও কাজ করে থাকতে পারে বলে কারো কারো ধারণা; সেজন্যই নাকি অজুহাতের অভাব হয় না। কেউই চাইবেন না, এ ধরনের মনোভাবের প্রভাব নতুন মহাপরিকল্পনার ওপর পড়ুক। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কবে চালু হবে, হলে তখন চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং কতটা হ্রাস পাবে- সে হিসাব আগাম কষাটা এক্ষেত্রে সেভাবে প্রাসঙ্গিকতা বহন করে না। গভীর সমুদ্র বন্দরটির তাৎপর্য কমিয়ে দেখানোর সুযোগ নেই। তবু কয়েক বছরের মধ্যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র চালু হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। অথচ উল্লিখিত সময়ে ব্যাপকভাবে বাড়বে চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব। সংশ্লিষ্টদের স্মরণ থাকার কথা, ক্রমে বাড়ছে বন্দরটির আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা। একে ঘিরে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে চীন ও মিয়ানমারের। আমাদের আরেক বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকেও ইস্যুটি ভাবায় নিশ্চয়ই। এ অবস্থায় বন্দর উন্নয়নে অবহেলা স্থানীয় অর্থনীতির ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে নতুন মহাপরিকল্পনা যত দ্রুত প্রণয়ন ও অনুমোদন হয় ততই মঙ্গল। কেননা এর পরই তো প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি অনুসারে কনটেইনার, কার্গো ও শিপ হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরকে।

ক্রেডিট রেটিং ব্যবসা

পরিদর্শন ম্যানুয়াল দ্রুত চূড়ান্ত করুন

ঋণমান সনদ নির্দেশ করে, কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির ব্যাংকঋণ পরিশোধের ক্ষমতা আছে কিনা এবং থাকলে কতটুকু। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির শর্ত হিসেবে প্রয়োজন হয় এ প্রতিবেদন। বাজারে বন্ড ছাড়ার প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্তকরণের এক ভালো উপায় এটি। তা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিদেশী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনুসন্ধান করা নথিপত্রের মধ্যেও অন্যতম। তদুপরি অনেকে এর সহায়তা নেন নিজ কোম্পানির অভ্যন্তরীণ অবস্থা বুঝতে। এর পর আর বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্থিক বাজার তথা অর্থনীতির ওপর ক্রেডিট রেটিংয়ের গুরুত্ব কতটুকু। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট আরো উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো, স্থানীয় বাজারে বর্তমানে আটটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ক্রিয়াশীল। অভিযোগ রয়েছে, আমাদের অর্থনীতিতে ক্রেডিট রেটিং কর্মকাণ্ডের চাহিদার তুলনায় সংখ্যাটি পর্যাপ্তের চেয়ে বেশি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা অসুস্থতার দিকে যাওয়াটা বিরল নয়। এখানে সে কারণেই ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলোর কাজের মান পড়ছে বলে অনেকের শঙ্কা। উদ্বেগ আরো বাড়ে, গতকাল বণিক বার্তায় ছাপা এক প্রতিবেদন পড়ে; ‘দুই বছরেও চূড়ান্ত হয় নি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির পরিদর্শন ম্যানুয়াল’- সেটির শিরোনাম। বিষয়টির তাৎপর্য অনুধাবনপূর্বক কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে, এমনটাও কাম্য সবার।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ক্রেডিট রেটিং ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাজে জবাবদিহিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই দু’বছরের বেশি সময় আগে পরিদর্শন ম্যানুয়াল তৈরির উদ্যোগ নেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি এখনো আলোর মুখে দেখে নি। আর তাতে বাজারে যেসব অপচর্চা শুরু হয়েছে তার একটি নমুনাই সচেতনদের সতর্ক করতে যথেষ্ট বলে ধারণা। সেটি হলো, একশ্রেণীর নতুন কোম্পানি বাজার ধরতে গিয়ে মাত্র কয়েক হাজার টাকায় ঋণমান প্রতিবেদন তৈরি করে দিচ্ছে দেখা যায় ইদানীং। নিজের পকেট থেকে যদি অর্থ ব্যয় না হয়ে থাকে, ওসব প্রতিবেদনের পেশাগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে সহজবোধ্য কারণেই। লক্ষ্যণীয়, এ দেশে ক্রেডিট রেটিং ব্যবসা শুরু হয়েছে এক যুগেরও বেশি। আলোচ্য সময়ের মধ্যে দেশে ক্রেডিট রেটিংয়ের চাহিদা বেড়েছে বৈকি কমে নি। আবার একই সঙ্গে একশ্রেণীর প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিম্ন মানের অনুশীলনের কারণে ক্রেডিট রেটিং সংক্রান্ত ঝুঁকিও বেড়েছে অর্থনীতিতে। এটি অত্যাসন্ন বলবেন না কেউ। কিন্তু এ ঝুঁকি জিইয়ে না রেখে নিয়ন্ত্রণের জন্য সত্বর পরিদর্শন ম্যানুয়াল চূড়ান্তের প্রতি মনোযোগ বাড়ানো উচিৎ বিএসইসি’র।

মাতারবাড়ী প্রকল্পের ক্ষতিপূরণ ব্যয়

নীতিমালা লঙ্ঘনকারীদের কোনো ছাড় নয়

মহেশখালী দ্বীপের মাতারবাড়ীতে বাস্তবায়নাধীন ব্যয়বহুল ১২০০ মেগাওয়াটের আল্ট্রা সুপারক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আলোচিত স্বভাবতই। প্রাক্কলন অনুসারে কেন্দ্রটির কর্মদক্ষতা হবে ৪২ শতাংশের কাছাকাছি যা স্থানীয় অন্যান্য তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় কর্মদক্ষতা থেকে প্রায় ৮ শতাংশ বেশি। আনুমানিক ৩৬ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকাই সহায়তা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এত বিপুল ব্যয়ের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ প্রত্যাশিত মাত্রায় থাকবে কিনা সে নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অবশ্য। তবু খেয়াল করার মতো বিষয়, কেবল বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, প্রকল্পটির আওতায় আরো কিছু অবকাঠামো কর্মসূচি রয়েছে। তাছাড়া জাইকার ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১০ বছর বাড়তি গ্রেস পিরিয়ডসহ ৪০ বছরে; দশমিক শূন্য ১ শতাংশ সুদ হারে। লক্ষ্যণীয়, মোটামুটি পরিকল্পনার শুরু থেকেই পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ইস্যুসহ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকল্পটির সমালোচনা হয়েছে নানা পক্ষে। অথচ এক্ষেত্রে সরকারের যে সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা দেখানোর প্রয়োজন ছিল সেটি দৃশ্যমান হয়েছে কমই। এ ধারাবাহিকতায় গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশ প্রতিবেদনটি আকস্মিক কিছু নয় বলা চলে। তাতে দেখা যায়, গত বছর আগস্টে প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমিসহ অন্যান্য খাতে ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু হলেও এখন পর্যন্ত তা পরিশোধের হার মাত্র ২৯ শতাংশ! উপরন্তু এগুলো প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। অথচ জাইকা নীতিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, অধিগ্রহণকৃত জমির মালিক ও ক্ষতিগ্রস্ত পেশাজীবিদের সময়মতো পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা। এ অবস্থায় নীতিমালা লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার এবং সেটি গ্রহণে সরকারকে বলিষ্ঠ ভূমিকায়ই দেখতে চাইবেন।

অনেক পাঠকের মনে রয়েছে নিশ্চয়ই, প্রাথমিক পর্যায়ে মাতারবাড়ী প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের জন্য অস্বাভাবিক বরাদ্দের সুপারিশ এসেছিল। পরে তা হ্রাস করা হয়। বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার ছোট উন্নয়নশীল দেশে জমি অধিগ্রহণের জটিলতা জাইকার মাথায় ছিল বোধকরি। সেজন্যই তাদের প্রতিনিধিরা কিন্তু এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেছেন ধারাবাহিকভাবে। তার পরও কোথায় গাফিলতি ছিল খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণই প্রত্যাশিত। একে তো পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে না, তদুপরি ক্ষতিপূরণ হচ্ছে আত্মসাৎ। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে আসা খবরাখবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সেখানে নাকি দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ‘উপদেশ’ মোতাবেক ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা। আবার প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে ‘কমিশন’ নেয়া হচ্ছে ৫-১০-১৫ শতাংশ হারে। আরো মারাত্মক জুলুমকারীদের এমন মনোভাব যে, নিচ্ছি জাইকারটা; সরকারের টা তো আর নিচ্ছি না! এক্ষেত্রে শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা ব্যতীত উদ্ভূত সমস্যার সুরাহা সম্ভব নয় বলে ধারণা। মাতারবাড়ী প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণে নানা কথা ওঠায় এর আগে একজন জেলা প্রশাসককেও বদলী করা হয়েছে জানা যায়। তা থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতি সংশ্লিষ্টদের উপলব্ধিতে আসতে হবে। সেজন্যও নীতি লঙ্ঘনকারীদের কোনো রকম ছাড় দেয়া যাবে না। সবাই এখন চাইবেন আলোচ্য বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব না হোক।

বিদ্যালয়ের পাঠদানে আধুনিক প্রযুক্তি

সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত করতে হবে

‘মাল্টিমিডিয়া সুবিধার বাইরে ৯০% মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ শিরোনামে গতকালের বণিক বার্তায় প্রকাশ প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। খবরটির ভিত্তি বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইজ) ২০১২ সালের তথ্য। তাতে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আরো খারাপ অবস্থা লক্ষ্যণীয়। সেগুলোর ৯৭ শতাংশতেই নাকি এখনো পাঠদান করা হচ্ছে সনাতন পদ্ধতিতে। আরো উল্লেখ করার মতো বিষয়, পাঠদানে মাল্টিমিডিয়ার মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে বৈকি। কেননা কয়েকটি মৌল উদ্দেশ্য নিয়ে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের আওতায় কর্মসূচিটি চালু হয়। সেসবের প্রয়োজনীয় ফুরিয়ে গেছে সে কথা বলা চলমান বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। উদাহরণ হিসেবে পাঠদানকে যুগোপযোগীকরণের প্রসঙ্গ উঠতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া হ্রাস এবং সে উদ্দেশ্যে পাঠদান আনন্দময় করে তোলাও আলোচ্য কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। ফলে জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়ায় শিক্ষা প্রদানের যে বিরাট উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে, লক্ষ্য পূরণে তাকেই উদ্যোগী হতে হবে অন্যদের চেয়ে বেশি। অন্যথায় কর্মসূচিটির কার্যকারিতা হ্রাসের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

সরকার, বেসরকারি খাত, উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা- এদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গত ক’দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশে। তার ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের পর থেকে শিক্ষা খাত উন্নয়নে সরকারের বাড়তি প্রচেষ্টা স্পষ্ট। তা থেকে সুফল কেমন মিলছে, সেটি নিয়ে অনেকের সমালোচনা রয়েছে অবশ্য। পাশাপাশি অস্বীকার করা যাবে না, পাঠদানে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার পরিকল্পনার মতো সহজ নয়। বরং ক’বছরের মধ্যে রাতারাতি পরিবর্তবনের প্রত্যাশা করাটা অসঙ্গত। তবে একইভাবে উক্ত সময়ের মধ্যে ৯০ শতাংশ বিদ্যালয় মাল্টিমিডিয়া সুবিধার বাইরে থাকাটাও কর্মসূচি বাস্তবায়নের দুর্বলতাই নির্দেশ করে। ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিৎ এদিকে মনোযোগ বাড়ানো। ব্যানবেইজের তথ্যানুসারে আমাদের বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোয় মাল্টিমিডিয়া সুবিধার ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। এর কারণ হিসেবে এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে নজরদারির অভাবকে। কার্যত সরকারি বিদ্যালয়গুলোয় পরিদর্শনসহ বিভিন্ন মনিটরিং কর্মকাণ্ড প্রায় নিয়মিতভাবে সম্পন্ন হয়ে বিধায় সেখানে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার সুবিধা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে একে প্রকৃত চিত্রের খণ্ডাংশ বলা চলে। কেননা প্রথমত মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের সুবিধা এবং মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার এক কথা নয়। দ্বিতীয়ত. অবকাঠামগত, আর্থিক প্রভৃতি সুবিধাদি আমলে নিলে সরকারি বিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারিটির ব্যবধান সহজেই তুল্য। খেয়াল করার মতো বিষয়, একশ্রেণীর বিদালয়ে মাল্টিমিডিয়া যায় নি; অনেকের মাল্টিমিডিয়া সুবিধা থাকার পরও ব্যবহার করতে পারছে স্বতন্ত্র শ্রেণীকক্ষ, কম্পিউটারসহ নানা উপকরণের অভাবে। তদুপরি আমাদের এমন বিদ্যালয়গুলোও আমলে নেয়া উচিৎ যাদের বিদ্যুৎ সুবিধা এবং মাল্টিমিডিয়ায় শিক্ষা প্রদানের উপযুক্ত শিক্ষক নেই। সেদিক থেকে দেখলে শুধু নজরদারি বাড়িয়েই বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার বাড়ানো যাবে বলে মনে করেন না কেউ কেউ। মনিটরিং নিশ্চিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তার সঙ্গে কর্মসূচি বাস্তবায়নে পিছিয়ে থাকা বিদ্যালয়গুলোর অন্যান্য সমস্যার সমাধানেও এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইস্যুটি সার্বিকভাবে দেখে সমাধানের উদ্যোগ নিক, এমনটাই সবার প্রত্যাশা।

বীমা খাতে পেশা বেছে নিতে উচ্চশিক্ষিতদের অনাগ্রহ

বড় দায় নিতে হবে কোম্পানিকেই

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উচ্চশিক্ষিত তরুণদের কাছে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আকর্ষণীয় কর্মক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ গতকালের বণিক বার্তায় প্রকাশ খবর অনুযায়ী, পেশা বেছে নেয়ার বেলায় বীমা খাতকে তেমন আকর্ষণীয় মনে করছেন না তারা । মূল কারণ স্পষ্টই বলা চলে। মোটামুটিভাবে সেগুলো হলো আকর্ষণীয় বেতনের অভাব ও সুষম সাংগঠনিক কাঠামোর দুর্বলতা। আজকাল ব্যাংকগুলোয় ২০ হাজার টাকার নীচে তেবন নেই বললে চলে। অন্যদিকে সম পর্যায়ে বীমা খাতে একজনের বেতন ১০ হাজার টাকায় সীমাবদ্ধ বলে আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক উদ্যোক্তা। বীমা কোম্পানির বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোও খুবই নাজুক এবং কিছু দিক বিবেচনায় তা আর্থিক খাতের মধ্যেও সমাঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ অবস্থায় তরুণরা বীমা খাতে চাকুরি নিতে উৎসাহ বোধ করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। কথা হলো, এটা সুলক্ষণ নয়; বরং তা এ খাতে সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতিকূল। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে দেরী করা চলবে না।

বীমা খাতে কাঙ্ক্ষিত জনবল আকর্ষণের দায়িত্ব প্রধানত বীমা কোম্পানিগুলোর। সে দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে চলবে না। আর এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যথাযথভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা সেটি তদারকি করতে হবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ)। উল্লেখ করা দরকার, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনুশীলনের মাধ্যমে বীমা খাতের তদারকি এবং এর উন্নয়নে গতিশীলতা আনায়ন আইডিআরএ গঠনের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। সে দায়বদ্ধতা থেকে সব বীমা প্রতিষ্ঠানের অভিন্ন সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি কমিটিও গঠন করা হয় ২০১২ সালে। জানা যায়, মডেল উপস্থাপন এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশও করেছিল ওই কমিটি। কিন্তু সার্ভিস রুল পেশের পর তার আর কোনো অগ্রগতির খবর মেলে না। অথচ সুষম অর্গানোগ্রাম ছাড়া বীমা কোম্পানিগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা কঠিন। চাকরি বিধিমালা এলোমেলো থাকলে এবং কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট না হলে এর প্রতি উচ্চশিক্ষিতদের আগ্রহ বৃদ্ধিও কঠিন হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সেক্ষেত্রে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হবে বীমা ব্যবসা। কার্যত ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন ভিন্ন বীমা খাতের উন্নয়ন তথা অর্থনীতিতে এর অবদান বৃদ্ধি কঠিন। এজন্য নিজ দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত জনবল বাড়াতে বীমা কোম্পানি যেন মনোযোগ দেয় তার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে আইডিআরএকে।