By Name

কী লাভ, কার ক্ষতি

যেকোনো সমর-সম ক্রিয়ার, এমনকি সাধারণ হুমকি-ধামকিরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। সম্প্রতি ইউরোপের সীমানায় ইউক্রেনে উদ্ভূত পরিস্থিতি ঘিরে উত্তেজনা নিয়ে কেউ কেউ বলছেন, দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো বলে। কারো কারো মতে, যেহেতু এটা রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্ব, ইউক্রেনের অস্থিরতা হলো দ্বিতীয় স্নায়ু যুদ্ধ। তবে এসব মন্তব্য ঘটনার অতিসরলীকরণ মাত্র। কেননা হিসাব-নিকাশ শুধু এ নয় যে, ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে যাবে না ইউরোপের সঙ্গে থাকবে। জাতিগত বিভেদ রেখার যেসব সমীকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে, সে ছাঁচেও ঠিক ফেলা যায় না ঘটনাটিকে। সমস্যা হলো, ইস্যুটিকে ইউক্রেন, রাশিয়া ও ইউরোপ-আমেরিকা কীভাবে নিচ্ছে, তাঅ যথেষ্ট পরিষ্কার নয়। ফলে এটি নিছক আঞ্চলিক সংঘাত নাকি ২০০৮ সালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের পর বিশ্ব পর্যায়ে নতুন ভারসাম্যকরণের অবতারণা, হলফ করে বলা কঠিন।

রুশপন্থীরা মনে করেন, ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার স্বাভাবিক ‘হক’ আছে। এর স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য ক্রিমিয়ায় দীর্ঘদিন রাশিয়ার শাসন বজায় ছিল; ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত নিকিতা ক্রুশ্চেভ অঞ্চলটিকে ইউক্রেনের হাতে তুলে দেয়ার আগ পর্যন্ত। চিন্তার কথা, ইউক্রেন ঘিরে পুতিনের পরিকল্পনা কী? সমর অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধ কলাকৌশলে তিনি সমৃদ্ধ। ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার সমর শক্তি অনেক বেশি। তার ওপর ব্ল্যাক সি ফ্লিট রয়েছে সেখানে; স্থানীয় সহায়তাও মিলবে পর্যাপ্ত। তবু ইউক্রেনে বেশি জোরাজুরি করলে গত তিন বছর বৈশ্বিক কূটনীতিতে অন্যতম অর্জন সিরিয়া ও ইরান ইস্যুতে পুতিনের মুষ্টি খানিকটা শিথিল হবে। এতে আন্তর্জাতিকভাবেও ঘৃণার পাত্র হবেন তিনি। আরেকটি পয়েন্ট, ১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ায় পুনর্দখল নেয়ার পর স্থানীয় তাতারদের তাড়িয়ে দেয় রেড আর্মি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে ওরা আর ফিরতে পারেনি জন্মভূমিতে। ছোট-খাট সংঘর্ষ হলেও এ যুদ্ধবাজ সম্প্রদায়ের গোটাটাই হয়তো চলে যাবে রুশদের বিপক্ষে। পুতিন এসব ঝুঁকি সহজে নেবেন বলে মনে হয় না। এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপ বিশেষত জার্মানীর সম্পর্ক জটিল। সেক্ষেত্রে একটা অপশন থেকে যায় টেবিলে। সেটি হলো, ইউক্রেন চাপ ব্যবহার করে পশ্চিমাদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা দায় করা। তাহলে অবধারিতভাবে এসে যায় বৈশ্বিক পর্যায়ে পুনঃভারসাম্যকরণ এবং রাশিয়া সেটি কখন ও কীভাবে চাইছে- সে প্রশ্ন। তবে পুতিনের এ মনোবাঞ্ছা সত্য হলে বলতে হয়, বারাক ওবামা অত ‘টাফ’ না হলেও নানা কারণে দরকষাকষিতে বেশি সুবিধা পাবে না রাশিয়া।

ইউক্রেন ইস্যুতে কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে ইউরোপ। অর্থনীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা তার একটি কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম দুর্বলতা হলো, দেশটিকে ভালোভাবে বোঝে এমন দক্ষ কুটনীতিকের সংখ্যা কম। তাই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের মতো অনেক আমেরিকানকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে পুতিনকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো কয়েকজন অবশ্য সতর্ক করেছে, কাউকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করার অপচেষ্টা একটি অকার্যকর কূটনৈতিক কৌশল। যাহোক, অন্তত দুটি কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে পিছু হটবে না যুক্তরাষ্ট্র; প্রথমত. বন্ধু ইউরোপের আহ্বান; দ্বিতীয়ত. হৃত গর্ব ফিরে পাওয়ার সুযোগ।

এ যাত্রায় সফল হতে চাইলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ মাথায় রাখা জরুরি। পশ্চিমাদের দেখা উচিৎ, ন্যাটোকে না জড়িয়ে কার্যোদ্ধার এবং ইউক্রেনকে ফিনল্যান্ডের মতো উপায়ে স্থিতিশীল করা যায় কিনা। দ্রুত অগ্রগতির জন্য এ আলোচনার ভালো মাধ্যম হতে পারেন দিমিত্রি মেদভেদেভ। অবশ্য সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত দিতে হবে পুতিনকেই। সেজন্য তার অনুধাবন দরকার, ইতিহাস যেন একবিংশ শতাব্দীর ‘বৃদ্ধ আইভান দ্য টেরিবল’ হিসেবে স্মরণ না করে তাকে। ‘গ্র্যান্ড প্রিন্স’ দু’জন ভিন্ন ভিন্ন আইভান কিন্তু রয়েছে রাশিয়ার ইতিহাসে।

উদ্ভূত সংকট নিরসনে বড় দায়িত্ব ইউক্রেনীয়দেরও। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত অল্পবয়সী অধিকাংশ দেশের (বাংলাদেশকেও এখানে রাখা যায়) বেলায় দেখা গেছে, এরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় সত্তা-স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সমঝোতা করতে পারে না। কামনা করি, এ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠুক ইউক্রেন। ক’দিন আগে ইংরেজি ভাষাভাষী মিডিয়ায় ‘দ্য ইউক্রেন’ সম্বন্ধ করায় ক্ষিপ্ত হতে দেখা গেছে দেশটির অনেক নাগরিককে। তাই ইউক্রেন কাভারে ব্যস্ত সব সাংবাদিককে এ বিষয়ে নির্দেশনাও দিয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও গার্ডিয়ান মিডিয়া। খালি ইউক্রেন আর দ্য ইউক্রেনের মাঝে অর্থনৈতিক পার্থক্য না থাকলেও ‘দ্য’ শব্দটির রয়েছে সাংঘাতিক রাজনৈতিক গুরুত্ব। আর আপাত সংকটের মাঝে এ দেশাত্ববোধটা এক বড় সুলক্ষণ।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

বেইজিংয়ে বাঘ শিকার

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

মূলত দুই কারণে গত শতাব্দীতে লাফিয়ে লাফিয়ে কমেছে বাঘের জনসংখ্যা। প্রথমত. বাঘের হিংস্রতা। এতে আবার শিল্পায়ন ও নগরায়নের রয়েছে পরোক্ষ অবদান। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা রয়েছে- সে কুসংস্কারেও বেড়েছে বাঘ পাচার। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর এ প্রাণীটির সংখ্যা বর্তমানে চার হাজারের কম। বাংলাদেশে নাকি রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে অর্ধসহস্রের মতো; চীনা বাঘের প্রকৃত সংখ্যা পঞ্চাশের নীচে বলেই অনুমান। এর মাঝে বেইজিংয়ে বাঘে শিকারে স্বয়ং নেমে গেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং- বন্দুক নয়, আইন দিয়ে; মানুষখেকো নয়, সমাজখেকো বাঘ শিকারে। উচ্চ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতায় আসীন সরকারি কর্মকর্তারাই হচ্ছেন বাঘ, যাদের অব্যাহত কামড়ে ক্ষতবিক্ষত দেশ!

প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিনপিং অফিসে বসেছেন চীনা ক্যালেন্ডার অনুসারে সর্পবর্ষে; ২০১৩ সালের মার্চে। এখন চলছে অশ্ববর্ষ। তার মাঝে কেবল গত বছরই শিকার হয়েছে ১৭টি বাঘ; যাদের কেউই উপমন্ত্রী পদমর্যাদার নীচে নন। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিনপিংয়ের অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতা নেয়ার আগেই। তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আর দেরি করেন নি। তবু বহির্বিশ্বের অনেক বিশ্লেষকের শঙ্কা ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়তো পারবেন না জিনপিং। তাদের এ ধারণার ওপর প্রথম আঘাতটা আসে সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী বো শিলাইয়ের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতি মামলার বিচার শুরুর পর। সম্প্রতি জিনপিং সমালোচকদের আরো অবাক করেছেন রাঘব বোয়াল চৌ ইয়াংক্যাংকে ধরে। কয়েক মাস আগেও ভাবা যেত না, ইয়াংক্যাংকে কেউ স্পর্শ করতে পারে। ফাইনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা একবার তাকে উল্লেখ করেছিল, ‘চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি’ হিসেবে। আরেক বিশেষজ্ঞ তাকে বলেছিলেন- আধা সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি; আধা সাবেক এফবিআই প্রধান জে এডগার হুভার। ক’বছর আগেও চীনা জ্বালানি শিল্পে কার্যত একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ইয়াংক্যাংয়ের। শোনা যায়, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাজেটের এক ইয়েনও পাশ হতো না তার সম্মতি ছাড়া। গোপনীয়তার স্বার্থে চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাজেট জনসম্মুখে উপস্থাপন করা হয় না। তবে কারো কারো অনুমান, সেটি ভিয়েতনামের জিডিপি ছাড়ায়ই ইয়াংক্যাংয়ের তত্ত্বাবধানে। নিঃসন্দেহে নিজ ক্ষমতা গ্রহণের আগে ইয়াংক্যাং কর্তৃক চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরো থেকে অবসর নেয়াটা বিরাট সুবিধাজনক ছিল জিনপিংয়ের জন্য।

বলা যাবে না, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে জিনপিং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করার খেলায় মেতেছেন। সেটি চাইলে গোপনেই তিনি করতে পারতেন- অনেক শাসক যেভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধীদের তাড়ায়। জিনপিংয়ের বিচক্ষণতার পরিচয় মেলে, দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচিতে নেমে সরাসরি সেন্ট্রাল কমিটি ফর ডিসিপ্লিন ইনসপেকশনের দ্বারস্থ হন তিনি। ওয়ান কিশ্যাং কমিটির বর্তমান সেক্রেটারি। জিনপিং সিসিপি সেন্ট্রাল কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পদে আসীন হন কিশ্যাং। গোল্ডম্যান স্যাকসের সাবেক সিইও ও চেয়ারম্যান এবং সাবেক মার্কিন রাজস্ব মন্ত্রী হ্যাঙ্ক পলসনের পর্যবেক্ষণ মতে কিশ্যাংয়ের দেশপ্রেম ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কঠিন। তদুপরি তিনি এখন জিনপিং সংস্পর্শে অনুপ্রাণিত। ফলে কিশ্যাং ইদানীং কেন্দ্র থেকে নিয়মিতভাবে নজরদারি কর্মকর্তা পাঠাচ্ছেন স্থানীয় সরকার পর্যায়ে। প্রতিনিধিরা সরাসরি তার কাছে প্রতিবেদন পাঠান। এর মধ্য দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের নামে গোপন নথি পাঠানোর রেওয়াজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আগে বহু বড় কর্মকর্তা বেইজিংয়ের বাইরে গ্রামে পথে পা ফেলতেই চাইতেন না। কিশ্যাংয়ের তাগাদায় তাদের অনেকে এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও অবস্থান করেন। কিশ্যাং মামলা তৈরিতেও এনেছেন কিছু গুণগত পরিবর্তন। এক ইয়াংক্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র উত্থাপনের আগে আত্মীয়-স্বজন, ড্রাইভার-মালিসহ ইয়াংক্যাংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আর্থিক সম্পর্ক ছিল এমন ৩০০ জনকে জেরা করেন তার প্রেরিত কর্মকর্তারা।

যে কোনো দেশে বড় দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করার রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয় ক্ষমতাসীনদেরই। তাই আগ্রহ নিয়ে এ দায়িত্ব কেউ পালন করতে চায় না সাধারণত। জিনপিং নিশ্চয়ই বোঝেন সেটা। এও নিশ্চয়ই জানেন, বড় বাঘ চলে গেলে পার্টি ক্ষমতায় কেমন পরিবর্তন আসবে এবং চীনে পার্টি ক্ষমতা হ্রাসের অর্থ কী। তবু তার মনে সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। জনগণও ওসব দৃষ্টান্তকে গ্রহণ করছে উষ্ণ আন্তরিকতায়। অবশ্য এ ধরনের অতিঝুঁকিপূর্ণ মৃগয়া যত দ্রুত সম্পন্ন করা যায় ততই ভালো। তাতে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম বেগবান হবে। সেক্ষেত্রে চীন প্রতিবেশীদের সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিরোধ মেটানোর চিন্তা-ভাবনা করার বাড়তি সময় পাবে হয়তো মর্কটবর্ষ থেকেই।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপট

একবিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতায় ঝুঁকি

ক’দিন আগে বর্বর আইএস সদস্যদের হাতে প্রাথমে সাংবাদিক জেমস ফলি ও পরে স্টিভেন সটলফের ট্র্যাজিক মৃত্যুকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। এখানে সেটি সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ রাখাই ইচ্ছা। নমুনা হিসেবে এ ঘটনার সহায়তায় একবিংশ শতাব্দীতে সংবাদ সংগ্রহ ঝুঁকির সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক উভয় চিত্রই মূল্যায়ন করা যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুখ্যাত কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে ধরা পড়ার পর সাংবাদিক বুদ্ধি খাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে, এমন ঘটনা নিয়ে বেশ কিছু সিনেমাও হয়েছে হলিউডে। একটি বড় কারণে এক দশক সন্ত্রাসীদের কাছে মাথা হারানোর ভয় ছিল কম। সেটি হলো, নিজেদের মতাদর্শ প্রচার, আরো সোজা ভাষায় বিজ্ঞাপন। বস্তুত সে ভরসাতেই সাংবাদিকরা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকারও নিতে পেরেছিলেন। আস্তানার সাংবাদিক নেয়ার ঝুঁকি সন্ত্রাসীদের আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে এক্ষেত্রে কাগজ-কলম সাংবাদিকদের রক্ষাকবচ তথা দর কষাকষির ক্ষমতা হারাতে বসেছে, পরিহাসবশতঃ সামাজিক গণমাধ্যমগুলোর প্রভাবে। উগ্র গোষ্ঠীগুলো আজ জানে, ‘স্টোরি’ প্রচারের জন্য সাংবাদিক নিয়ে আসার দরকার নেই; কাণ্ড ঘটিয়ে ইউটিউব, ফেসবুক প্রভৃতিতে তুলে দিলেই হলো। সেজন্যই দেখা যায়, আল-শাবাব, আল-কায়েদা থেকে আইএস পর্যন্ত প্রায় সব জঙ্গিগোষ্ঠীই অনলাইনে যথেষ্ট সক্রিয়।

ইদানীং পেশা ‘ফ্রিল্যান্সার’ উল্লেখ করে, মৌলিক শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধাবস্থার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে সংবাদ সংগ্রহে নেমে আনাড়িপনা অনুশীলন করতে দেখা যায় একশ্রেণীর নবাগত ‘সাংবাদিক’কে। একবিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকতা প্রেক্ষাপটে এও এক লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন বৈকি। জেমস ফলিও ফ্রিল্যান্সার ছিলেন। তবে তাকে আনাড়ি বলা বোধহয় ভুল হবে। শিক্ষকতা থেকে সরে আসার পর প্রায় ছয় বছর যেসব স্থানে তিনি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েছেন, তার সবগুলোই অত্যন্ত বিপদজনক। ফলি বেশ কিছুদিন ছিলেন আফগানিস্তানে। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি আটকের এক ভিডিও-তে দেখা যায় তাকে। সেখানে বেশ কিছুদিন উগ্রপন্থী এক গ্রুপের হাতে অপহরণের আটকও ছিলেন। মুক্ত হয়ে চলে আসেন সিরিয়ায়। তার মাঝে ঘটে ওই ট্র্যাজেডি।

বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন ফলি। অনেকে সমালোচনা করছেন, এ যুগে মাঠে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজন কী। স্থানীয় কাউকে আউটসোর্স করলেই হতো। উপায়টা মন্দ না। কিন্তু একাধিক গুরুতর সমস্যা রয়েছে এর। প্রথমত. সাময়িকভাবে নিয়োজিত স্থানীয় প্রতিনিধিদের দৃষ্টি ও সাহস প্রায়ই দেখা যায় ধী ও লেখনী শক্তির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এদের পাঠানো প্রতিবেদন ঠিক সংবাদপত্রোপযোগী হয় না। দ্বিতীয়ত. অনেক সময় সেগুলো অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে। তৃতীয়ত. সে অনুবাদই মেরামত করতে হয় ডেস্ককে। তার মানে মূল ঘটনার কিছু সত্য হারায় অনুবাদে; কিছুটা ডেস্কে এসে। তার পর প্রতিবেদন হয় কোনোদিকে বেশি হেলে পড়ে, নয়তো এমন নিরপেক্ষ হয় যে তার অবস্থানই টের পাওয়া যায় না। দীর্ঘদিন স্থানীয় পর্যায়ে সংবাদ সংগ্রাহক আউটসোর্স করার পর এই হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর সাধারণ অভিজ্ঞতা। আবার অনেকের সাধ্যে কুলোয় না দেশে দেশে স্থায়ী প্রতিনিধি নিয়োগ বা প্রেরণ। এদের মাঝে তাই আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধায় বিপদজনক স্থানে ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক প্রেরণের প্রবণতা বাড়ছে; তাদেরই একজন ছিলেন জেমস ফলি।

দ্য টেলিগ্রাফের প্রধান বৈদেশিক প্রতিবেদক কলিন ফ্রিম্যান সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে অপহৃত হন। বন্দী ছিলেন কয়েক বছর। তিনি লিখেছেন, ওমন পরিস্থিতিতে নিজের চেয়ে পরিবারকে নিয়ে ভাবনাটাই হয় বেশি। তার আরেকটি পর্যবেক্ষণ হলো, একবিংশ শতাব্দীতে অন্যদের চেয়ে বেশি চাপে থাকেন সাংবাদিকদের স্বজনরা। এসব বিবেচনায় ‘সরেজমিন প্রতিবেদন’-এর সময় শেষ হয়ে আসছে বলে মন্তব্য অনেকের। সুযোগ থাকার পরও শুধু একটু বেশি সত্য জানার জন্য বাড়তি ঝুঁকি কে নেবেন? তবে নিজ সাহসিকতা দিয়ে বাকিদের অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য, কমপক্ষে তাদের প্রাণ স্পর্শ করার মতো হয়তো কেউ না কেউ সব সময়ই থাকবেন জেমস ফলির মতো। সব কিছু জানার পরও কোন বিবেচনায় ছেলেকে সিরিয়ায় থাকতে দিলেন, এক মানবাধিকার সংগঠনে গিয়ে সম্প্রতি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হন জেমসের বাবা, জন ফলি। তিনি সজল চোখে পাল্টা জানতে চেয়েছেন, ঘর-বাড়ি জ্বলছে জেনেও কেন সেখানে দমকল কর্মীরা ঢোকে?

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

তর্কসাপেক্ষ

তোলপাড়ে আড়াল বিশ্লেষণ

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে (আবদুল করিম) খন্দকার রচিত গ্রন্থ ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ‘তোলপাড়’ কম হয় নি দেশে। সে রেশ এখন পুরোপুরি তিরোহিত- তাও বলা যাবে না। মজার বিষয়, বাসি রাজনৈতিক রেসিপির উপকরণ হিসেবে বইটি যতটা ব্যবহার হয়েছে, এর কার্যোপযোগী বিশ্লেষণ হয়েছে কম।

খন্দকার সাহেব দীর্ঘদিন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন; বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রতিষ্ঠার পেছনে তার শ্রম অনস্বীকার্য। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক। স্বভাবতই বইটিতে মুক্তিযুদ্ধকে বহুলাংশে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন তিনি। তাই সমালোচনার বেলায় রাজনৈতিক তথ্য-বিবরণ-মন্তব্যের কুতর্কে প্রবৃত্ত না হয়ে ভদ্রলোকের স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ থেকে বইয়ের সাফল্য-ঘাটতি বিচার করা শ্রেয়। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, কিছু ত্রুটি-দুর্বলতা-অব্যবস্থাপনা সরিয়ে রাখলেও খন্দকার সাহেবের ভাষ্যে ফুটে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র নিঃসন্দেহে অনবদ্য। তীব্র প্রতিকূলতার মাঝে সে সময় আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা যে অপ্রাকৃতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, সেটি যথেষ্ট গর্বের। অবশ্য বইয়ে খন্দকার সাহেব কম উচ্চারিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যান নি- যা অনিচ্ছাকৃতও হতে পারে; যেমন- পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ।

আমাদের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী কেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না? কেন যৌথ বাহিনীও নয় সরাসরি ‘চিরশত্রু’ ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন পাকিস্তানীরা? তথ্য অনুসারে, তখন সিলেট মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করছিলেন ওসমানী সাহেব; উপ-সর্বাধিনায়কের বারণ সত্ত্বেও। এটি কী অস্বাভাবিক নয়? ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) অনুষ্ঠিত মন্ত্রীপরিষদ সভায় আক্রমণ চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী। তাতে ভীত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক আশ্রয় নেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) রেড ক্রসের কাছে। পরদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিল মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। সর্বাধিনায়কের পক্ষে এর পরও যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়। সিলেট থেকে ঢাকার দূরত্বও ওত বেশি কী? এ বিষয়ে আমাদের আলোকিত করেন নি খন্দকার সাহেব। তবে বাজারে এ নিয়ে দুটি ধর্তব্য তত্ত্ব আছে; এক. জেনারেল ওসমানী নাকি ‘প্রটোকল সচেতন’ ছিলেন। তিনি চান নি তিন তারকা জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা’র সঙ্গে বসতে; তার প্রত্যাশা ছিল ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’কে। দ্বিতীয় তত্ত্ব যুদ্ধের মনস্তাত্বিক লড়াই সংক্রান্ত। শোনা যায়, কোনো কোনো ভারতীয় জেনারেল নিয়াজিকে ভয় দেখান, বাংলাদেশীরা পেলে পাকিস্তানীদের কচুকাটা করবে! অনেকের আরো প্রশ্ন, তখন যৌথ কমান্ড এড়িয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক আত্মসমর্পণ আয়োজনের অবস্থান সমর্থনযোগ্য কিনা। কারো কারো ধারণা, এখানে কোনো কুমতলব ছিল না ভারতীয়দের। কেননা, তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব নিজ ভবিষ্যৎ পরিচালনায় বাংলাদেশকে চালকের আসনে বসান। এতে তারও অভ্যন্তরীণ চাপ কমবে। এদিকে বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে সইকারী দেশ না হওয়ায় ভারত ভিন্ন অন্যদের কাছে যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সুবিচার চাওয়া সম্ভব ছিল না পাকিস্তানীদের পক্ষে।

এসব বিস্তারিত ইস্যুতে খন্দকার সাহেবের মত পেলে ভালো হয় বৈকি। আর সে সুযোগ ফুরোয় নি। নতুন তথ্য কিংবা বিশ্লেষণের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পেলে বইয়ের পরিবার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশের নজির বিরল নয়। খন্দকার সাহেবের তেমন চিন্তা-ভাবনা থাকলে অনেক কৌতূহলী পাঠকও আশান্বিত হবেন বৈকি।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

মহাকাশে সাফল্য

ঝুঁকি মাড়িয়ে জানার তৃষ্ণা

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

রাস্তাটা নাতিদীর্ঘ ছিল না। গন্তব্যে পৌঁছুতে পাড়ি দিতে হয়েছে আনুমানিক ৪০০ কোটি মাইল। সময়ও কম পার হয় নি; এক দশকের কিছু বেশি। ১০০ কেজি ওজন নিয়ে রোজেটার সঙ্গে ল্যান্ডার ফিলি পৃথিবীর স্পর্শের বাইরে চলে যায় ২০০৪ সালের মার্চেই; নামল এই ১২ নভেম্বর। উদ্দেশ্য ছিল, ৬৭পি/শুরয়ুমোভ-গেরাশিমেনকোয় আস্তানা বসানো। সেখানে মানবজাতির পুরনো কয়েকটি জটিল প্রশ্নের হিসাব মেলানো। ‘সুবিধাজনক’ মনে হওয়ায় মহাবিশ্বের ভ্যাগাবন্ড ধূমকেতুগুলোর মধ্যে ৬৭পি’কে বেছে নেন বিজ্ঞানীরা। এখানে ‘সুবিধাজনক’ শব্দটাকে ‘সহজ’ থেকে দূরে রাখা বিশেষভাবে দরকার। কেননা রোজেটা মিশনের সাফল্য অর্জনের পথে যে মাত্রায় ঝুঁকি ছিল, সেটি মহাশূন্য যাত্রায় নিঃসন্দেহে অনন্য।

চলতি বছরটা মহাকাশ প্রযুক্তিবিদদের জন্য ঠিক সুখকর ছিল না। ভারতীয় মঙ্গলযানের সিদ্ধি বাদ দিন। বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এ বছর। ক’সপ্তাহ আগে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশ্য রওনা দিয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভেঙ্গে পড়ে মনুষ্যবিহীন এক যান। এর পর মাটি থেকে ৪৫ হাজার ফুট ওপরে চালানো এক পরীক্ষামূলক ফ্লাইটে কয়েক টুকরো হয়ে গেল এক ভার্জিন গ্যালাকটিকো শিপ। ফলে রোজেটা তার মিশন সম্পন্ন করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল শেষ পর্যন্ত। তার ওপর ঘণ্টায় ১ লাখ ৩৫ হাজার কিলোমিটার বেগে ছুটে চলা ধূমকেতুকে ধাওয়া করে কাছে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। ১৯৭৮ সাল থেকেই কিন্তু ধূমকেতু মিশন পাঠানো হয় একাধিক। তবে সেগুলো ধূমকেতুর আশাপাশ দিয়ে উড়েছে কেবল। সঙ্গত কারণেই কাছে যাওয়ার দুঃসাহস দেখায় নি কেউই।

খেয়াল করার মতো বিষয়, দুর্ঘটনায় পতিত দুটি মিশনই বেসরকারি খাত পরিচালিত। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) ও নাসার পাশাপাশি রোজেটা মিশনেও বিরাট ভূমিকা রয়েছে একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অনুমান করা চলে, মিশনটি সফল হওয়ায় বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি অনেক ব্যবসায়ীই স্বস্তি ও আনন্দের নিঃশ্বাস ছেড়েছেন।

২০১৪ সালের মুদ্রামান অনুযায়ী গোটা রোজেটা মিশনে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ইউরো। স্বভাবত উঠতই, ইউরোপের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করলে আরো বেশি করে প্রশ্ন ওঠে, এত বিপুল ব্যয় কীজন্য? এর সোজাসাপ্টা উত্তর, জানার তৃষ্ণা মেটাতে। তত্ত্ব আছে যে, দূর অতীতে (কয়েক বিলিয়ন বছর আগে) পৃথিবীর বুকে সমুদ্র সৃষ্টির পেছনে অবদান রেখেছিল ধূমকেতু। সৌরজগতের জন্মের আগে থেকেই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এ অংশে যাতায়াত সেগুলোর। তবে তত্ত্ব দুটির সত্যতা কখনো যাচাই করা যায় নি। এখন ফিলির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বুঝতে সৃষ্টি করবেন, সৌরজগত সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায় কেমন ছিল। পানিতে হাইড্রোজেনের সঙ্গে এর আইসোটোপ ডিউটোরিয়াম অণু থাকে। ৬৭পি’র থাকা হাইড্রোজেন-ডিউটোরিয়াম অনুপাতের সঙ্গে পৃথিবীরটা মিলিয়ে দেখা যাবে, আদৌ কোনো ধূমকেতু পানি বয়ে এনেছিল কিনা? কিংবা সেই সঙ্গে প্রাথমিক প্রাণের উপাদানও?

গভীর মহাশশূন্যের এ মিশনটির নাম ‘রোজেটা’ দেয়ার কারণও তাই। কোনো নারীর নাম থেকে নয়, প্রাচীন মিশরীয় রোজেটা ফলক অনুসারে এর নামকরণ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন হায়ারোগ্লিফিক্সের মর্ম উদ্ধার করতে পারছিলেন না, তখন তাদের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা যায় রোজেটা ফলক। আর এ ফলকের কাছে প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিয়ে গিয়েছিল ফিলি স্মৃতিস্তম্ভ। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই রোজেটা মিশনকে দেখেছেন ইএসএ’র বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা। তাদের আশা, সৌরজগতে রচিত প্রাণ বিকাশের দলিলের কিছু অংশ অন্তত পড়তে সহায়তা করবে ফিলি ল্যান্ডার। আগামী বছর এ সময়টায় সূর্যের সবচেয়ে কাছে চলে যাবে ৬৭পি। এর কিছু পরে মিশন শেষ হয়ে যাবে রোজেটারও। তবে নিঃসন্দেহে বড় অনুপ্রেরণা হয়ে রইবে এটি। কেননা মহাকাশে এখন পর্যন্ত এটিই তো সবচেয়ে দূরে মানুষের সক্রিয় হস্তক্ষেপ।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

একনায়কত্ব পরীক্ষার পাস-ফেল

ঘটনা এরই মধ্যে ঘটে গেছে। উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন প্রভাবশালী সামরিক ব্যক্তিত্ব চ্যাং সং থায়েকের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেই বসে থাকেন নি, রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বিশ্ববাসীর সামনে তার ফুফার চরিত্রও উন্মোচন করেছেন। সে ভাষ্যমতে, মানুষটি ছিলেন কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট। চ্যাং দণ্ডিত হওয়ার কারণ একাধিক- অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, নারীলিপ্সা, নেশাগ্রস্ততা প্রভৃতি। প্রথম দুটি দোষ উত্তর কোরিয়ার অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তির মাঝে আছে বলে শোনা যায়; পরের দুটি নাকি উনের মাঝেও কম নেই। অবশ্য চ্যাং নিজে বলে গেছেন, কুপ্রবৃত্তির বশে মহান নেতাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। যাহোক, চ্যাংয়ের ওমন মৃত্যুতে ঘাবড়ে গেছে কিছু মানবাধিকার সংস্থা; মুষড়ে পড়েছেন অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক। বেশকিছু পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী উত্তর কোরিয়ার এ বালক নেতার মতিগতি না বুঝে জো আছে?

ঘটনাটিকে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, একনায়কত্বের পরীক্ষা হিসেবে; যাতে পাস-ফেলের ওপর নির্ভর করছে রাষ্ট্রক্ষমতায় উনের থাকা না-থাকা। অর্থাৎ বিষয়টি খুবই সিরিয়াস। এক্ষেত্রে নবীন সর্বোচ্চ নেতাকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে শুরু করা যাক। ধরি, চ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ ছিল উনের হাতে। তার মানে পরামর্শদাতা ফুফার চেয়েও ঘনিষ্ঠ কেউ ছিল তার। এটি একনায়কের পরিণত হওয়াকে ইঙ্গিত করছে। উত্তর কোরিয়ার প্রচলিত ক্ষমতা বলয়ের বাইরে আস্থাভাজনদের নিয়ে নিজস্ব চক্র গড়ে তুলতে চাইছেন উন। ক্ষমতা সংহতকরণের এ কৌশল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসারী রাজনৈতিক দলেও দেখা যায়।

উনের মূর্ত উদ্দেশ্যও আছে। আসলে উত্তর কোরিয়ার ‘সিংহাসনে’ বসার কথা ছিল তার বড় ভাই কিম জং নামের। এক ‘দুর্ঘটনা’য় তিনি ছিটকে পড়েন ক্ষমতার ময়দান থেকে। ভদ্রলোকের এখনকার দৈনন্দিন রুটিন হলো ছোট ভাইয়ের নিন্দা বলে বেড়ানো। তাই ফুফার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে উন বড় ভাইকে সতর্কবার্তা দিলেন, ভাই হলেও খাতির করব না কিন্তু- যদি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বপ্নে দেখো। আরেকটি বিষয়, ২০১২ সালের মার্চে কাঁচা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে এক গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়; ক’দিন আগেও গুজব রটে আরেকটির। এ অবস্থায় চ্যাংয়ের মৃত্যু সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকদের জন্য এক বিশেষ বার্তা উনের পক্ষ থেকে।

উন হয়তো পারিবারিক ইতিহাস ঘাঁটছেন ইদানীং। সম্ভবত এখন পড়ছেন দাদা কিম ইল সাংয়ের জীবনী। ১৯৬৮ সালে নর্থ কোরিয়ান পিপলস আর্মির তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ এবং নিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী চো কোয়াংয়ের বিরুদ্ধে দলদ্রোহিতার অভিযোগ তোলেন সাং। তবে উনের মতো মৃত্যুদণ্ড নয় অদৃশ্য করে দেন চো-কে। দাদার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরো জানলে কিম নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন, কী যাদু-মন্ত্র বলে দুই দশক পর চো আবার ফেরত এসেছিলেন উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে। ফুফাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বার্তা গিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়াতেও। মিলেছে তার প্রত্যুত্তরও। চ্যাংয়ের হত্যাকাণ্ডকে নগ্ন উস্কানি হিসেবেই দেখছেন প্রেসিডেন্ট পার্ক কুন-হে।

কয়েকবার ব্যর্থতা সত্ত্বেও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা থেকে এ পর্যন্ত একেবারে খারাপ নৈপুণ্য দেখায় নি বালক নেতা। তবে তার উচিৎ ছিল বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের (যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া) সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে আঞ্চলিক রাজনীতির বাকি তিন অংশগ্রহণকারী (দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন) দেশের ওপর সাম্প্রতিক ঘটনাবলী কেমন প্রতিক্রিয়া ফেলে সেটি গভীরভাবে চিন্তা করা। আরো কিছু ইতিহাস বই পড়লে তার কাছে পরিষ্কার হবে জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বাবা শিনতারো আবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক ব্যক্তিত্ব পার্ক চুন-হের; যিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট পার্ক কুন-হের বাবা। অর্থাৎ বহির্শক্তি চাইলে উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে আরো ঘন করতে পারে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্ককে। এখন পর্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় থাকলেও ছোট ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে বেশ চীন বিরক্ত। বিশেষ তথ্য হলো, চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন, তাদের খ্যাতি রয়েছে বাস্তবাদী কমিউনিস্ট হিসেবে। কিছু ইস্যুতে শি জিনপিংয়ের বাবা শি ঝনশুংয়ের নমনীয়তা দেং জিয়াংপিংকে অধিক সন্তুষ্ট করলেও দলের কারো কারো সন্দেহ ছিল, তিনি প্রতিবিপ্লবী কিনা। শি জিনপিং সে উত্তরাধিকার ধরে রেখে বলেই মনে হয়। ফলে উত্তর কোরিয়ার বাড়াবাড়ি চীন কতক্ষণ এবং কতটা সহ্য করবে সেটি ভেবে রাখা উচিৎ একনায়কত্বের ‘কঠিন’ পরীক্ষা দিতে বসা উনের।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ইন্টারস্টেলার

মহাযাত্রার কাব্য

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

গণিতজ্ঞ স্টিফেন হকিংয়ের পরিচিতি সাধারণ্যে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞনী হিসেবে বেশি। কৃষ্ণগহ্বর সংক্রান্ত তার এক সমীকরণ সর্বকালের সৌন্দর্যমণ্ডিত গাণিতিক সূত্রগুলোর মধ্যে গণ্য। তালিকার বাকি সমীকরণগুলোর আবিষ্কারকদের কেউই জীবিত নেই। ওমন জটিল গাণিতিক যুক্তি যার পেশা ও নেশা, প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছায়াছবি দেখাকে বিলাসিতা মনে হওয়ায় অস্বাভাবিক নয় তার কাছে। আবার বয়সও তার জন্য কোনো অনুপ্রেরণা নয়। ঘটনা হলো, সেসব যুক্তি সত্ত্বেও গত কয়েক সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দুটো সিনেমা দেখে ফেলেছেন হকিং; একটা তার আত্মজীবনী নিয়ে জেমস মার্শ পরিচালিত ‘দ্য থিওরি অব এভরিথিং’, আরেকটা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ইন্টারস্টেলার’।

তর্কবিতর্ক থামছে না, ‘ইন্টারস্টেলার’কে চলচ্চিত্রের কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়। কারণটা চিত্রনাট্য রচয়িতারা (দুই ভাই- জোনাথান ও ক্রিস্টোফার নোলান) নন, বরং চিত্রনাট্যের পেছনের মানুষ ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির আইনস্টাইন মেডেল পাওয়া পদার্থবিজ্ঞানী কিপ থর্ন। আপেক্ষিকতার ধারণার আলোকে দীপ্ত থর্নের দীর্ঘ সমীকরণের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে ‘ইন্টারস্টেলার’। ফলে ছায়াছবিটিকে সায়েন্স ফিকশন বলা চলে না। ভাগ্য হস্তক্ষেপ না করলে ছবিটি সাই-ফাই হতে পারত অবশ্য। আসল প্রজেক্টটি ছিল হলিউডের ‘বিগ সিক্সে’র অন্যতম প্যারামাউন্ট পিকচারস করপোরেশনের। এটিই স্পিলবার্গের প্রতিষ্ঠান ড্রিমওয়ার্কসের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা সারে। ড্রিমওয়ার্কস ২০০৯ সালে প্যারামাউন্ট থেকে দ্য ওয়াল্টডিজনি কোম্পানিতে চলে গেলে ঘটনাক্রমে কাজ পেয়ে যান নোলান। খারাপ হয় নি তাতে। প্রযুক্তির প্রতি স্পিলবার্গের আকর্ষণ হয়তো সায়েন্স ফিকশনে পরিণত করত ছায়াছবিটিকে। এদিকে হলিউডে প্রাযুক্তিক সম্ভাবনা ব্যবহারের দিক থেকে যেসব পরিচালক পিছিয়ে আছেন তাদের মধ্যে পিটার জ্যাকসন ও ক্রিস্টোফার নোলান আলোচিত। একটু সিনিয়র বলে জ্যাকসনকে ছাড় দেন অনেকে; কিন্তু ৪৪ বছর বয়সী নোলান কেন ই-মেইল, সেলফোন ব্যবহার করেন না তা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে ব্যাপক। তবে বোধহয় এ ‘আশীর্বাদে’ই নোলানের হাতের মানবিক স্পর্শ পেয়েছে ‘ইন্টারস্টেলার’। সেজন্য নভোচারী কুপার (ম্যাথিউ ম্যাকনহের চরিত্র) অন্যান্য গল্পের নায়কের মতো প্লটে নিজের বিশিষ্ট অবস্থান ধরে রাখতে পারেন নি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠেছেন দর্শক আবেগের প্রতিনিধি।

ইন্টারস্টেলারের আবহ সঙ্গীত নিয়ে কিছু না বললেও চলবে, কেননা হ্যানস জিমার আছেন। তবে সিনেমাটি দেখার সময় অভিজ্ঞ দর্শক অনুভব করবেন, কিছু ক্ষেত্রে সাউন্ড ইফেক্ট হিসেবে কুশীলবদের সংলাপ ব্যবহারের দুঃসাহস নোলান দেখিয়েছেন সফলভাবে। পূর্বের অভিনয় ইমেজ ভেঙ্গে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য অক্ষত রেখে নতুন চরিত্র রূপ দানের বিষয়ে ‘কুখ্যাতি’ রয়েছে ছবির পরিচালকের। সেক্ষেত্রে রোবট চরিত্রে ‘ইন্টারস্টেলারে’র অসাধারণ সংযোজন টারস। টারস মানে টিএআরএস নয়, নিছক টারস। রোবটটি বিভিন্ন মানবিক গুণাবলীর আনুপাতিক সংমিশ্রণে তৈরি অ্যালগরিদমে পরিচালিত হয়। মজার বিষয়, পঞ্চম মাত্রিক পরিবেশে সে তথ্য আদান-প্রদান করতে না পারলেও সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম। পঞ্চম মাত্রিক স্থান-কালে প্রেমের ভূমিকা রাখলেও যন্ত্রের কেরামতি কার্যত অবরুদ্ধ করেছেন সম্ভবত নোলানই। নতুন নতুন অভিনয় দক্ষতা অর্জনকে মানদণ্ড ধরলে সে বিচার করলে প্রফেসর জন ব্র্যান্ডের চরিত্রে অভিনয়কারী মাইকেল কেইনের চেয়ে লক্ষ্যণীয়ভাবে উন্নতি হয়েছে তার মেয়ে অ্যামেলিয়া তথা অ্যানা হ্যাদাওয়ে। নোলানের প্রতিটি ছবিতে বিশেষ এক রঙের সূক্ষ্ম আধিক্য থাকে। ইন্টারস্টেলার এ নিয়মের মধ্যেই পড়ছে।

সিনেমাটি দীর্ঘ এবং ক্যামেরা মুভমেন্ট হিন্দি সিরিয়াল, এমনকি হলিউডে প্রচলিত সাই-ফাই ছবির মতো অস্থির নয়। তার একটি কারণ, নিজ পরিচালিত ‘ট্রানসেনডেনসে’র (জনি ডেপ অভিনীত) নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ‘ইন্টারস্টেলারে’ সময় দিতে পারেন নি নোলানের অন্যান্য ফিল্মের সিনেমাটোগ্রাফার ওয়াল্টার পিফিস্টার। তার বদলে কাজ করেছেন ‘টিঙ্কার টেইলর সোলজার স্পাই’ খ্যাত ডাচ-সুইডিশ ভ্যান হয়েতিমা। দ্বিতীয় কারণটি হলো, পরিচালকের পয়েন্ট অব ভিউ। বাংলাদেশের একশ্রেণীর চলচ্চিত্রকারের আফসোস- একাধিক ক্যামেরা ব্যবহারের জন্যই হলিউডের মুভি এত আকর্ষণীয়! দেয়ার মতো তথ্য হলো, ভিজুয়াল ইফেক্টের প্রয়োজনে একেবারে বাধ্য না হলে একাধিক ক্যামেরা চালান না নোলান। চলচ্চিত্র নির্মাণের এসব বুদ্ধিভিত্তিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তার সঙ্গে পরিবেশনগত ত্রুটিও অপসারণ করা বাঞ্ছনীয়। ‘ইন্টারস্টেলার’ ছবিটি ঢাকার এক ‘নামী-দামী’ প্রেক্ষাগৃহ এসেছে। অথচ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ক্ষীণদৃষ্টিই হোক বা দুর্বৃত্তপরায়ণ মানসিকতার জন্যই হোক- প্রদর্শন সময় ও টিকেটের দাম বিচারে মধ্যবিত্তের পক্ষে হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখা কঠিন। অথচ উন্নতি করতে চাইলে অন্যান্য ব্যবসার মতোই উৎপাদন ও বিপণনের দিকে সমান নজর রাখতে হবে চলচ্চিত্রকে।

লেখকঃ সাংবাদিক

রাশিয়া

পঞ্চম স্তম্ভে অদৃশ্য সাম্রাজ্যের বিস্তার

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ঘটনায় প্রতিক্রিয়া মানুষের ধাত ও মনোরাজ্য অনুধাবনের সুযোগ দেয়। সেদিক থেকে এটি বেশ প্রণিধানযোগ্য। ১৯৮৯ সালে কেজিবির শাখা ছিল পূর্ব জার্মানির ডেসডেনে। বার্লিন দেয়ালের পতনের পর একদল অবহিত লোক সেখানে হামলা চালায়। সেদিন বারবার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ চেয়েও সাড়া পান নি কেজিবি সদস্যরা। সম্ভবত ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দেয়া হত তাদের জীবন। সৌভাগ্যবশত তাদের মধ্যে অন্তত একজন ওই বিপদেও ঘাবড়ান নি। তিনি দ্রুত সব নথি পুড়িয়ে গেলেন এবং কৌশলে সহকর্মীদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন অফিস থেকে। ব্যক্তিটি রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন।

সনদ দেখানোর প্রয়োজন নেই। ঠান্ডা মাথায় কৌশল প্রণয়নের ক্ষমতা না থাকলে লেনিনগ্রাদের এক দরিদ্র পরিবারের সদস্য পুতিনের পক্ষে রুশ সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ সম্ভব হত না। উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে ৪৩ বছর বয়সে হয়তো যাত্রা করতেন না মস্কোর দিকেও। কথা হলো, এ বলিষ্ঠ বাস্তববাদীর যুক্তি যেন মেলে না তার গত দু’বছরের কর্মকাণ্ডে। গণভোটের মধ্য দিয়ে হলেও রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ সুনজরে দেখেন নি অনেক প্রতিবেশীই। উপরন্তু পরিস্থিতি ল্যাজেগোবরে হয়ে পড়ে ইউক্রেনের রুশ নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে নিক্ষিপ্ত মিসাইলে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এক যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস হলে। তার এক পর্যায়ে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে শায়েস্তা করতে। সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্যহীন, এলোমেলো পদক্ষেপ দেখে কেউ কেউ ‘উন্মাদ’ বলে অভিহিত করছেন পুতিনকে। তাদের তত্ত্ব হলো, স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার বেদনা তিনি ভোলেন নি এবং বর্তমানে ক্ষণস্থায়ী অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কাঁথায় শুয়ে প্রাচীন জারদের মতো রুশ সাম্রাজ্য প্রত্যাবর্তনের স্বপ্নে মশগুল। যোগ্যতা ও উচ্চাভিলাষের সঙ্গে অতৃপ্তির অবস্থান মনে বিকৃতি সৃষ্টি করতে পারে বৈকি। তবু পুতিনের মতো একজন বাস্তববাদী মানুষের কাছে বিষয়টা কি খাপছাড়া মনে হয় না? সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় চিন্তা ধারায় অগ্রসর হওয়া উত্তম। পুতিনের আপাত উদ্দেশ্যহীন কর্মকাণ্ডগুলো কুশলী ধোঁকা নয়তো? কেজিবি স্কুলে তিনি নিশ্চয়ই শিখেছেন, শত্রুকে বিশ্বাস করাতে হবে- তোমার দুর্বলতা আসলে তোমার শক্তি।

এ পথে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়। কেননা এতে রয়েছে পঞ্চম স্তম্ভের মধ্য দিয়ে পুতিনের অদৃশ্য সাম্রাজ্য বিস্তারের ছাপ। লক্ষ্যণীয়, (অনিবার্য কারণ না ঘটলে) উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন আসছে ৯ মে রেড স্কয়ার থাকবেন বার্ষিক বিজয় দিবসে। এখন পর্যন্ত সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী রাশিয়া। জ্বালানি তেল ও অস্ত্র লেনদেনে মস্কো-কারাকাস সম্পর্ক নাকি এখনো অটুট। রাশিয়া প্রায় বছর পাঁচেক আগে ইরানের সঙ্গে এয়ার ডিফেন্স মিসাইল বিক্রি চুক্তি রদ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আপত্তিতে। ক’দিন আগে সেটি আবার টেবিলে উঠেছে। কিছুদিন আগে পুতিনের মিশর সফরও ইঙ্গিত দেয় তার অদৃশ্য সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের। ওই সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি কর্তৃক কালাশনিকভ সহকারে সমাদৃত হন তিনি।

অবশ্য অভ্যন্তরে রাশিয়ার পঞ্চম স্তম্ভ নিয়েই ইউরোপ অধিক চিন্তিত বলে প্রতীয়মান। অভিযোগ, অতি-দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানে হাত রয়েছে ক্রেমলিনের। সেজন্যই হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওবান উদার গণতন্ত্র ত্যাগে ইচ্ছুক। একই কারণে গ্রীসের সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর সিরজা পার্টির আলেক্সি সিপ্রাসের সঙ্গে সাক্ষাত পাওয়া প্রথম কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম রুশ রাষ্ট্রদূত। প্রশ্ন উঠতে পারে, গত শরতে রাশিয়ায় গেলেন কেন ফ্রেঞ্চ ফ্রন্ট ন্যাশনালের নেতা মেরিন লা পেইন? সেখানকার কে-ইবা তাকে দিল কয়েক মিলিয়ন ইউরো ঋণ? ভেতরে ভেতরে অনেকে গলদঘর্ম। মেরিন বেশ এগিয়ে জনমত জরিপে। আগামীতে তিনিই যদি ফরাসি সরকারের প্রধান হন?

ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো নিয়ে কমনওয়েলথের মতো কিছু একটা গড়ার কথা বহুদিন ধরে বলছেন পুতিন। হতে পারে, ইউরোপের চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে সুবর্ণ সুযোগ মনে হয়েছে তার। ফলে ইউক্রেন অঞ্চলে এক ধরনের গৃহবিবাদ জিইয়ে রেখে প্রতিরক্ষা সংস্থা নেটোকে দুর্বল রাখতে চাইছেন তিনি। তার মূল লক্ষ্য অন্যত্র। তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে পশ্চিমাদের মাথায় রয়েছে নিশ্চয়ই- জোসেফ স্টালিন শাসন করেছেন তিন দশক; লিওনিদ ব্রেজনেভ দুই দশকের মতো। ভ্লাদিমির পুতিনের বয়স এখনো ‘তেমন বেশি’ নয়; স্বাস্থ্যও সুঠাম। এদিকে রুশবাসী তার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত বলেও মনে হয় না। ফলে আসন্ন বছরগুলোয় পুতিন গৃহীত কৌশলের বিপরীতে পশ্চিমা দেশগুলো কেমন ব্যবস্থা নেয় তা দেখার অপেক্ষায় নিঃসন্দেহে থাকবেন কেউ কেউ।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

মধ্যপ্রাচ্য

সমঝোতার নতুন সমীকরণ

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

মধ্যপন্থার জয় বিরল কিন্তু সৌভাগ্যজনক ঘটনা। আবার এতে উল্লাস করা কঠিন। ফলে আগে থেকে কোনো পক্ষে বসে থাকা অনেকের কাছে সেটি মনে হয় সমাধানের অযোগ্য ধাঁধাঁ। সম্প্রতি পরমাণু শক্তির ব্যবহার বিষয়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বোঝাপড়ার গুরুত্ব হয়তো সেজন্যই তেমনভাবে প্রতিভাত ও আলোচিত নয় এখনো। বরং এরই মধ্যে প্রচেষ্টাটি নিন্দা কুড়িয়েছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের উগ্রপন্থীদের। তাই সাধারণ ইরানীদের প্রতিক্রিয়া স্বস্তির; অতিরক্ষণশীলদের কাছে- ইরানের গরু মেরে আমেরিকার জুতো দান! এক্ষেত্রে কট্টরপন্থী ইসরায়েলীদের আচরণেও অমিল ঠেকবে সামান্যই। আর সৌদি আরবের ডানপন্থীদের প্রতিক্রিয়া? সেখানকার এক উজির ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মত দিয়েছেন, ইরান অনুমতি পেল, এবার রিয়াদ পারমাণবিক চুল্লী বসাতে দেরি করে কেন?

সেক্ষেত্রে সতর্ক আশাবাদ ব্যক্ত করাই মঙ্গলজনক। যেহেতু চূড়ান্ত চুক্তি হয় নি; এর আইনি রূপরেখা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো গেছে মাত্র। পরবর্তীতে থাকল এটি বাস্তবায়নের প্রশ্ন। তা সত্ত্বেও কান খাড়া করা দরকার মূলত দুটি কারণে; প্রথমত. গ্রহণযোগ্য মীমাংসার অভাবে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে বছরের পর বছর এবং দ্বিতীয়ত. সমঝোতার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অলঙ্ঘনীয় শর্ত দেয়া হয়- সব পয়েন্টে সম্মত না হলে ইরান কোনো পয়েন্টেই সম্মত নয় বলে ধরা হবে! এর বাইরে উস্কানিদাতার অভাব কোনোকালেই ছিল না। কথাটি বারাক ওমাবার বেলায় রিপাবলিকান সহকর্মীদের নিয়ে যেমন সত্য, হাসান রুহানির কট্টর প্রতিপক্ষের বেলায়ও তা খাটে।

ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে পারস্পরিক আস্থার ঘাটতিই অধিক লক্ষ্যণীয়। সেজন্য মার্কিন নাগরিকদের প্রেসিডেন্ট ওবামাকে আশ্বস্ত করতে হয়েছে, চুক্তিটির বাস্তবায়ন ইরান কর্তৃক পরমাণু অস্ত্র তৈরির সব পথ বন্ধ করে দেবে। সমঝোতার পর পরই তিনি পুরনো মিত্র সৌদি বাদশাহকে ফোন দিয়েছিলেন কুয়াশা কাটাতে (অবশ্য ‘তাড়াহুড়ো’ করে বিস্তারিত জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি ক’দিন আগে ওয়াশিংটনে ওবামাবিরোধী ইন্তিফাদার নায়ক বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুকে)। তবু সংশয় রয়ে গেছে অনেকের, যদি মাঝপথে নৌকা দোলানো শুরু করে ইরানীরা? নিতান্ত অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না একে। দেখার বিষয়, ইরানে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির সূত্রপাত ১৯৫০’র দশকে; যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। আর এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের মনোমালিন্যের সূচনা ১৯৭৯ সালে; বিপ্লবের পর থেকে। মজার কথা, পরমাণু অস্ত্র নিয়ে গোপন গবেষণার কথা জানার পর তৎকালীন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা মরহুম আয়াতুল্লাহ খোমেনীর প্রাথমিক ফতোয়া ছিল, অনৈতিক বিধায় শরীয়তের দৃষ্টিতে পরমাণু অস্ত্র হারাম। ওই অবস্থান বদলাতে সময় লাগে নি খুব। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতিও ঘটে তুলনামূলক দ্রুত গতিতে। তাই পদক্ষেপ নিতে ইরানের দিকেই মানুষ তাকিয়ে থাকবে বেশি। সেজন্য রুহানি সরকারের উচিৎ সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার কাছ থেকে প্রতিপাদন সম্পাদন এবং প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনা। শেষোক্তটি নিষেধাজ্ঞার প্রতিশ্রুত অপসারণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে সহায়ক হবে বলে ধারণা। একই সঙ্গে ওবামা প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে যেন চুক্তি বাস্তবায়নে বাগড়া না দিতে পারে কেউ।

সাম্প্রতিক সমঝোতাটি যুক্তরাষ্ট্রের এক উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক অর্জন। ঘটনাটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি পরিবর্তনেরও ইঙ্গিতবাহী। লক্ষ্যণীয়, শুধু জ্বালানি তেল দিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল রাখার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা কঠিন। উল্টো নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত কয়েক বছরে উপসাগরীয় তেলের ওপর নির্ভরতা ব্যাপকভাবে কমিয়ে এনেছে আমেরিকানরা। অতিরিক্ত স্বনির্ভরতাটুকু দেশটির পররাষ্ট্র নীতিতেও প্রভাব ফেলেছে নিশ্চয়ই। না ফেললে, ইয়েমেনে ‘কষ্ট স্বীকার’ করতে হতো না সৌদি আরবকে; বাড়তি ‘আশকারা’ও হয়তো পেত ইসরায়েল। এটি সৌদি শাসকরা ভেবে দেখেছেন নিশ্চয়ই। নেতানিয়াহু’রও টনক না নড়ে পারে না। তিনি ভুলবেন কীভাবে, তার ‘আলোচিত’ ভাষণ নিয়ে খোদ ইসরায়েলে প্রতিবাদ হয়েছে; প্রায় দশ হাজার সাধারণ নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে তেল আবিবের রাস্তায় নেমেছিলেন গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক সাবেক প্রধান। ইরান নিয়ে ইসরায়েলবাসী নিঃশঙ্ক বিষয়টি তা নয়; বরং ইরান প্রশ্নে নেতানিয়াহুর কট্টর অবস্থান সমর্থন করতে পারেন নি তারা। মধ্যপ্রাচ্যের এমন পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে সমঝোতার নতুন সমীকরণ কী প্রভাব ফেলে আগামীতে তার জবাবই খুঁজতে হবে ইরানের আচরণ এবং বিশ্বশক্তির অবস্থানে।

লেখকঃ সাংবাদিক

zayed097@yahoo.com

আরবে বসন্তের বাতাস

জলবায়ু সব সময়ই চরম আরবে। দিনের বেলার প্রচন্ড গরম। বেশ ঠান্ডা রাতে। চরমভাবাপন্ন আবহওয়ার কারণে এ অঞ্চলটিতে ঋতুর সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে তিনটি- গ্রীষ্ম, শরৎ বা হেমন্ত এবং বসন্ত। প্রতি ঋতুর স্থায়িত্ব গড়ে চার মাস। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, মানসিকতা, আরও বড় করে দেখলে সমাজের ওপর ঋতুর প্রভাব রয়েছে যথেষ্ঠ। তবে ঋতু পরিবর্তন বা এর স্থায়িত্বের সঙ্গে খুব বেশি মেলানো যায় না সমাজ পরিবর্তনকে। সাম্প্রতিক আরব বসন্ত অন্তত তা-ই বলছেন।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে জেসমিন বিপ্লব শুরু হলো তিউনিসিয়ায়। বসন্ত শুরু হলো আরবে। আবহাওয়া অনুকূল না হওয়ায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবেদিন এবন আলি। ঋতু পরিবর্তনের এ বিষয়টি ধরতে পারলেন না মিশর শাসক হোসনী মোবারক। অবশ্য হতে পারে তিনি ভেবেছিলেন, বসন্ত আর কয়দিন থাকবে? কয়েকটা মাস ধৈর্য্য ধরি। তাহরির স্কয়ারে উৎপত্তি লাভ করা বসন্ত সওয়া গেলো না ১৮ দিনের বেশি। ফেব্রুয়ারীর ১১ তারিখ ক্ষমতা ছাড়তেই হলো তাকে। এরই মধ্যে বসন্তের ছোঁয়া লাগল লিবিয়াতে। দেশটি অবশ্যই আরব। তবে আফ্রিকান প্রভাবের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যায় না সেখানে। কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফী আফ্রিকান স্পিরিট নিয়ে ঠেকাতে চাইলেন আরব বসন্ত। বিক্ষোভের সুযোগ না দিয়ে জনগণকে সোজা পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধের ময়দানে। গ্রীষ্মকাল আর দেখা হলো না গাদ্দাফীর। ২৩’শে আগষ্ট প্রতিপক্ষ গোত্র ও সাধারণ মানুষের সহায়তায় গঠিত ও পশ্চিমা মদদপুষ্ট ন্যাশনাল ট্রানজিশনারি কাউন্সিলের (এনটিসি) বাহিনী দখল করে নিলো বাবআলআজিজিয়া। আরব বসন্ত গাদ্দাফীর প্রাণ কেড়ে নিলো গত ২০ অক্টোবর।

আরবে একনায়কতান্ত্রিক শাসন নতুন নয়। কিন্তু অভূতপূর্ব এ বসন্ত শঙ্কিত করে তুলল অনেককে। কেউ কেউ দুঃখজনক পরিণতি বরণের চেয়ে আগে ভাগে সরে যাওয়া উত্তম মনে করলেন। এদের মধ্যে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশিরও রয়েছেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ২০১৫ সালে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। ইরাকে নুর আল মালিকির বিরুদ্ধে কম-বেশি প্রতিবাদের খবর পাওয়া যাচ্ছিল কয়েক মাস ধরে। আরব বসন্ত দেখে তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেলো। তিনি বুঝতে পারলেন, ২০১৪ সালের পর কঠিন হবে ইরাক শাসন করা। বেশি আতংকে ছিলেন সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ। জানুয়ারীতে ছোট-খাট বিক্ষোভ হলো রিয়াদে। আন্দোলন যাতে বেগ না পায়, সে জন্য বাদশাহ কয়েকটি খাতে ভর্তুকির ঘোষণা দিলেন। কিছু শর্ত গোপন রেখেও বললেন সৌদি নারীরা ২০১৪ সালের পৌর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কথাও শোনা গেলো তার মুখে।

বসন্ত হটিয়ে দিলো ১৯ বছরের জরুরী অবস্থা, আলজেরিয়া থেকে। লেবাননে বেশি কিছু না হলেও বসন্তে সেখানকার শ্রমিকের বেতন বাড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে বসন্তের প্রভাব ঠেকাতে আংশিকভাবে সফল হয়েছে জর্ডান, বাহরাইন, কুয়েত ও মরোক্কো। তবে ঠেকাতে গিয়ে ধরাশায়ী হয়েছেন ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহ। এ ক্ষেত্রে বসন্তের আগমন ব্যহত করতে নৃশংস উপায় বেছে নিয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। ধরপাকড়, হয়রান করেও কিছু হচ্ছে দেখে গণহারে নরহত্যার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। দেশটি থেকে প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে কারো না কারো নিহত হওয়ার খবর। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বসন্তের ঝড় ঠেকাতে পারবেন কি না, সেটি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বৈকি। এদিকে প্রায় ১০ মাস পর মিশরে নতুন করে দেখা দিয়েছে বসন্ত। জনগণ আবার তাহরির স্কয়ারে চলে এসেছে গণতন্ত্রের দাবিতে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সমঝোতা হয়েছে; আগামী জুনে নির্বাচন হবে দেশটিতে।

জাতীয়তাবাদের কথা শুনিয়ে অনেক শাসকই দীর্ঘদিন শাসন করেছেন বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র। তবে আরব ঐক্যের সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের দিকটি ভাবতে পারেন নি এরা। তাদের হয়তো ধারণাও ছিল না, উইকিলিকসের মত একটি প্রতিষ্ঠান একের পর এক ফাঁস করতে থাকবে তাদের অপকর্ম; ফেইসবুকের মতো সাইটগুলো শক্তিশালী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরিণত হবে ও এতে আরবে বইবে বসন্তের বাতাস; আর তাতেই কুপোকাত হয়ে যাবেন তারা।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

এ পথ থেকে ফিরবো না!

বন্দে আলি মিয়ার একটা গল্প পড়েছিলাম ছেলেবেলায়। অনেকেই পড়ে থাকবেন তা। নদীবিধৌত এক এলাকায় কাহিনী। নতুন চর জাগলেই তা দখলের জন্য আদা-জল খেয়ে লাগেন দুই জমিদার। কার্যসিদ্ধির প্রথম উপায় মামলা। এটিতে কাজ না হলে স্বীয় শক্তমত্তা প্রদর্শনপূর্বক চর দখল। তবে আকস্মিকভাবে নয়, পরস্পরকে জানান দিয়ে; নিজ নিজ গ্রামে ঘোষণা করে- অমুক তারিখ তমুক সময় চর দখল দেয়া হবে। এ উপলক্ষ্যে লাঠিয়াল হিসেবে খোঁজ করা হয় বলবান পুরুষদের। তাদের খাওয়ানো হয় ভালো মতো। উৎসাহিত করতে পরিবারগুলোকে দেয়া হয় কিছু টাকা-পয়সাও। টাকায় কাজ হয়; লাঠিয়ালরা নিরুদ্বেগে জান বাজি রাখেন জমিদারের স্বার্থ উদ্ধারে। একবার এক গ্রামের জমিদারের লাঠিয়ালরা মেরে ফেলল অপর পক্ষের লোককে। মামলায় লাশটি যেন বেওয়ারিশ হিসেবে থানায় লিপিবদ্ধ হয়, সেজন্য তখনকার দিনে এ ধরনের সহিংসতায় লাশের মাথা কেটে ফেলার রীতি ছিল। তাতে দুর্বল হয়ে পড়তো মামলাটি। দুর্ভাগ্যবশত প্রথমোক্ত জমিদারের লাঠিয়ালরা সেটি করতে ব্যর্থ হন। এতে স্বভাবতই মামলার ফল নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন জমিদার। এমন অবস্থায় নায়েব পরামর্শ দেন, নিজ পক্ষের একটা লাশ দেখাতে পারলে, মামলায় শক্তিশালী হবে তাদের অবস্থানও। জমিদার উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, খাসা বুদ্ধি। প্রশ্ন হলো, কাকে লাশ বানানো হবে? গ্রামটির সীমানায় থাকতেন নিঃসন্তান, সম্বলহীন, রোগগ্রস্ত ও বৃদ্ধ দম্পতি। জমিদারের বিবেচনায় এ কাজে সেই উপযুক্ত। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক রাতে জমিদারের লাঠিয়ালরা তাকে ডেকে নিয়ে যান চরে। তাকে স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রস্তাব দেন জমিদারটি- তোমার আয়ু শেষ, টাকা-পয়সা নেই, হাঁপানিতে কষ্ট করছ; গ্রামের উপকার হবে, ১০০ টাকাও পাবে। মরতে অসুবিধা কী? বৃদ্ধের সোজাসাপ্টা জবাব ছিল, জমিদারদের রাজনীতি বুঝতে চান না, তবে কষ্ট হলেও বেশীদিন বাঁচতে চান তিনি।

গল্পটি মনে পড়লো, রোববার ঢাকা ও সিলেটে দুই ব্যক্তির নিহত হওয়ার খবর দেখে। রাজধানীর মতিঝিলে হাতবোমা বিস্ফোরণে মারা গেছেন এক যুবক। এরই মধ্যে ঘটনাটি নিয়ে সরকার-বিরোধী উভয় পক্ষ থেকেই বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া হয়েছে। অবশ্য তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে পরিবার। তবে দলগুলো গতানুগতিকভাবে লাশ নিয়ে খেলা শুরু করেছে। কেউ নিজের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে; কয়েকজন বিপদের আশংকায় হয়তো চাইছে আরেকজনের দিকে ঠেলে দিতে। এমন টানাহেঁচড়ায় শোক প্রকাশও কঠিন। এ দিকে সিলেটে বাসে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। মাঝপথে এতে গান পাউডারসমেত আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েক তরুণ। ভয় পেয়ে তাড়াহুড়া করে নামছিলেন যাত্রীরা, আহত হলেও মৃত্যু যেন না হয়- এ আশায়। অন্যদের সঙ্গে হয়তো নামতে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধও। তবে শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারেন নি। ততক্ষণে দাউ দাউ করে জ্বলছে বাস। আগুন ধরে গেছে শরীরে। পরনে শীতের কাপড় থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতই। জানালা দিয়েও একবার নামার চেষ্টা করেছিলেন বোধকরি। তবে পারেন নি। বিভৎসভাবে বাসের ভেতরেই পুড়ে কয়লা হয়ে যান বৃদ্ধটি। মৃতের পক্ষে জীবিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা প্রায় অসম্ভব। নইলে দেশের রাজনীতি সম্বন্ধে নিজের দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরতে পারতেন তিনি।

বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিরাট পরিবর্তন এসেছে সাম্প্রতিককালে। মধ্যপ্রাচ্যের রুক্ষগুলোয়ও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবীতে রাজপথে নামছে মানুষ। এককালে ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপে’র উদাহরণ টানা হতো আফ্রিকা থেকে। স্বৈরতন্ত্র থেকে সেখানকার অনেক দেশই এখন পা বাড়াচ্ছে আলোচনা ও অহিংসার পথে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, এখানকার রাজনৈতিক দলের ইস্যুগুলো এতই বড় ও মহৎ এবং সমাধানের পথ এতটাই সংকীর্ণ যে, ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ তথা সহিংস পদ্ধতি ভিন্ন উপায় নেই। অবশ্য এটা দেশের একপেশে চিত্র। এ অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে চ্যালেঞ্জ নিয়েই বাংলাদেশ ভাল করছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে। আগামী দশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি আমরা। শক্তিশালী ও বড় উদ্যোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে এখানে। তৈরী হচ্ছে বিশ্বমানের জনসম্পদ। ব্যাপকভাবে বেড়েছে রফতানি আয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা দেশের ইমেজের ওপর ব্যবসার অনেক বিষয় নির্ভর করে। প্রশ্ন জাগে, বিদেশে ব্যবসায়ীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে, তারা কী জবাব দেন? আন্দাজ করা যায় উত্তরের ধরন, অসংস্কৃত আত্মীয়কে বন্ধুদের সঙ্গে মানুষ যেভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় অনেকটা তেমনই। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতেও তো এমন সাংঘর্ষিক রাজনীতি বন্ধ করা জরুরি। এরপরও যদি কেউ ভাবেন, মানুষের সামনে দলীয় আদর্শ উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরা দরকার, গতবার মেক্সিকোতে জলবায়ু সম্মেলনে যা হয়েছিল সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেন। সম্মেলনটিতে জলবায়ু সংক্রান্ত একটি কার্যকর চুক্তির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে আগুনে আত্মাহুতি দেন দক্ষিণ কোরিয়ার এক ব্যক্তি।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

সময়ের ব্যবহার ও এর ব্যবস্থাপনা

সময় প্রসঙ্গে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কথা আসেই। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শব্দটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন তিনি। অনেকের ধারণা রয়েছে, যে ব্যক্তি এতটা বিশ্লেষণাত্মকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন, তিনি নিশ্চয় সারা জীবনই সময়ের সদ্ব্যবহার করেছেন? মজার বিষয় হলো, খেয়ালী এ মানুষটিকে তার ঘনিষ্ঠজনেরা বরাবরই উল্লেখ করে এসেছেন সময়ের ব্যাপারে উদাসীন হিসেবে। তবে তার আক্ষেপ ছিল, জীবনকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলেন না বলে। এ জন্য সময়ের অব্যবস্থাপনা ও খ্যাতিকেই দায়ী করতেন তিনি। ক্যারিয়ারে সফলতা লাভের পরও অনেকের মাঝেই দেখা যায় এমন আক্ষেপ। যদি সত্যি টাইম মেশিন তৈরি হতো, এরা কী করতেন? সম্ভবত মধুর ও সফলতার স্মৃতিতেই যেতে চাইতেন তারা। আবার যারা জীবনে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না, তাদেরও আক্ষেপ রয়েছে- জীবনটা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলাম না বলে। কী হবে যদি তারা কোনো উপায়ে টাইম মেশিনে চড়ায় সুযোগ পেতেন? হয়তো জীবনের যেসব সিদ্ধান্তকে তারা ভুল বলে মনে করেন, সেগুলো সংশোধনের চেষ্টা চালাতেন। আর চেষ্টা করতেন যাতে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে ভালোভাবে কাজে লাগানো যায়।

সময় যেন বিফলে না যায় সে জন্য অনেকেই দৈনন্দিন ডায়েরীতে লিখে রাখেন, আজ সারাদিন কী করবেন তিনি। যথাযথভাবে সময় ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে অনেক ব্যক্তি, আগামীকাল কী করবেন, গতকাল কী করেছেন- এসব দিকেও রাখেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বিবেচকের কাছে সময় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; ব্যস্ত মানুষের কাছে দুষ্প্রাপ্য সম্পদ। কোন কাজে কাজে কতটা সময় লাগছে, এটি জানা তাই মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার জনগণ কীভাবে তাদের সময়ের ব্যবহার করে থাকে, সেটিও রাষ্ট্রের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এটি জানতে অনেক রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক সংস্থা তত্ত্বাবধানে সময় ব্যবহার জরিপ হয়ে আসছে বিভিন্ন দেশে। মূলত জনগণকে দিকনির্দেশনা জোগানো ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতেই চালানো হয় এসব। জরিপের ভিত্তিতে দেয়া ওসব নির্দেশ্নার সব ফলই যে ইতিবাচক, তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে একবার সময় ব্যবহার জরিপে দেখা গেলো সেখানকার পুরুষরা দিনে ২ ঘণ্টা ৮ মিনিট ব্যয় করছেন টিভি দেখায়। পরে টিভি দেখায় নিরুৎসাহিত করতে, ইণ্টারনেটের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানো হল। এতে দেখা গেলো, টিভি ছেড়ে মানুষজন দৈনিক সাড়ে ৫ ঘণ্টা ব্যয় করছেন ইন্টারনেটে। অবশ্য সব ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে তা নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বিশেষত অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশ উপকারী এ ধরনের জরিপ।

সম্প্রতি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সময় ব্যবহার জরিপ শুরু হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ব্যবস্থাপনায়। এ লক্ষ্যে ৫ দিনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে তারা। এতে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ কীভাবে সময়কে ব্যবহার করে তার প্রকৃত চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করা হবে। এ থেকে নীতিনির্ধারণের দিকনির্দেশনাও মিলবে। ভালো হতো যদি এতে উল্লেখ থাকত- রাজধানীবাসী দৈনিক তাদের কতটা সময় পার করেন যানজটে; শিক্ষার্থীরা কতটা সময় ব্যয় করেন পড়াশুনা; জনকল্যাণে কতটা সময় ব্যয় করেন রাজনীতিকরা ও কতটা সময়ে দেন নিজেকে প্রভৃতি। আমাদের এখানে জরিপটি হচ্ছে বেশ ছোট পরিসরে, এ থেকে এতো তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আগামীতে আরও বড় আকারে জরিপটি করা হলে, এসব তথ্য তাতে মিললেও মিলতে পারে।

নিজেদের ভুল ত্রুটি চিহ্নিত করে তা শুধরানোর জন্যও সময় ব্যবহার জরিপটি কাজে দেবে। জীবনে পিছু ফেরার সুযোগ নেই। তাই সময়কেও আনা দরকার যথাযথ ব্যবস্থাপনায়। একে মানুষের স্বাধীনসত্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ বলে মনে হতে পারে অনেকের। দার্শনিক নীটশে অবশ্য মনে করতেন, মানুষের যেভাবেই সময়কে ব্যবহার করুক তা মূল্যবান; তবে কথা হলো, সময়ের অপব্যবহার ব্যক্তিসত্তায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। ফলে জীবনে স্থিতিশীলতা আনতে সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। তাছাড়া যত বেশি সুষ্ঠুভাবে সময় ব্যবহার করা যাবে, জীবনকে ততটাই বড় মনে হবে- আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ওয়েবে সামন্ত যুগের ষড়যন্ত্র

প্রথম এলিজাবেথের পর ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন প্রথম জেমস। তিনি ছিলেন প্রটেসট্যান্টবাদের সমর্থক। কুসংস্কারে অগাধ আস্থা ছিল তার। তিনি বিশ্বাস করতেন, এ পৃথিবীতে বাস করছে অসংখ্য ভূত-ডাইনীরূপী মানুষ। তার আরেকটি প্রিয় বিষয় ছিল ষড়যন্ত্র তত্ত্বে। প্রথম জেমস ছিলেন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। দুর্বল এ শাসক সন্দেহ করতেন, স্কটল্যান্ড তার বিরুদ্ধে ক্যু করে বসতে পারে। জেমসের সময় লন্ডনে মহামারী প্লেগ দেখা দেয় একবার। এক পরামর্শক তাকে বলেন- থিয়েটার থেকে ছড়াচ্ছে এসব। সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনের সব থিয়েটার বন্ধের হুকুম দেন জেমস। গ্লোব থিয়েটারের মালিক নাট্যকার শেকসপীয়ার তখনো বেঁচে। এলিজাবেথের সময় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেত গ্লোব। জেমসের সময় সেটি তো বন্ধ হয়েছিলই, তার ওপর নাটক প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা। জেমসকে পটানোর পরিকল্পনা নিলেন শেকসপীয়ার। লিখলেন- ম্যাকবেথ। এতে ভবিষ্যত বলতে পারে এমন ডাইনী আছে; আছে স্কটল্যান্ডের সেনাপতিদের ষড়যন্ত্রও। নাটকটি মঞ্চস্থ হলো রাজদরবারে। সেটি দেখে বিমোহিত ইংল্যান্ডের রাজা। তিনি সব থিয়েটার খোলার নির্দেশ দিলেন দ্রুত।

নিছক সন্দেহ থেকে নয়, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করার অন্য কারণও ছিল জেমসের। ১৬০৫ সালে তার বিরুদ্ধে করা হয় বিখ্যাত গান পাউডার প্লট। এটির পরিকল্পনাকারী ছিলেন গুইডো ফকস ও রবার্ট কাটসবি (প্রাচীন ও অভিজাত পরিবারের সন্তান তিনি। তার প্রায় সারা জীবনই কেটেছে বিভিন্ন ব্যর্থ বিপ্লবে অংশ নিয়ে ও ফেরারি অবস্থায়)। তারা চেয়েছিলেন, প্রটেস্ট্যান্ট রাজাকে সরিয়ে ক্যাথলিক কাউকে বসানো। কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থকও ছিল তাদের। ফকস ও কাটসবি বস্তা বস্তা গান পাউডার রেখেছিলেন হাউজ অব লর্ডসের বেজমেন্টে। মতলব ছিল, অধিবেশন চলাকালে এতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে; মারা যাবেন রাজাসহ প্রটেস্ট্যান্ট নেতারা। অজ্ঞাতনামা এক চিঠিতে প্রকাশ হয়ে পড়ে ষড়যন্ত্রটি। বারুদে আগুন ধরানোর অপেক্ষায় থাকা ফকস গ্রেফতার হন। পালিয়ে বাঁচেন কাটসবি। আদালতের রায়ে শিরোচ্ছেদ হয় ফকসের। রাজা জেমসের নির্দেশে মস্তকটি ঝোলানো হয় ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির প্রধান ফিটকে। ফকসের গুণমুগ্ধ চিত্রশিল্পীরা এঁকে রাখেন শুধু তার ঝুলন্ত মাথাটি। পরবর্তীতে এসব চিত্রের অনুকরণে তৈরি হয় মুখোশ। ইন্টারনেটে বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে বর্তমানে এটি ব্যবহার করছে হ্যাকার দল- অ্যানোনিমাস।

এরই মধ্যে ইয়াহু, বিং, ফেইসবুক, নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টেমেন্টের সার্ভার হ্যাক করেছে তারা। ওয়েব ডিকশনারিতে তারা যুক্ত করেছে নতুন শব্দ, হ্যাকটিভিজম। মাঝখানে এফবিআই ও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোপন ফোনকল হ্যাক করে তা প্রকাশও করে দলটি। এতে অনেকে ভাবছেন, উইকিলিকসের ভালো উত্তরসূরী হতে পারবে অ্যানোনিমাসের হ্যাকাররা। অবশ্য এটি হল্প করে বলা যায় না। উইকিলিকসের শ্লোগান ছিল ‘উই ওপেন গভর্নমেন্ট’। ওদিকে ‘ডু অ্যাজ ইওর উইশ’ হলো অ্যানোনিমাসের বচন। তাছাড়া সোপা-পিপা আইনের বিরুদ্ধে মুখোশ পরে তাদের প্রতিবাদ করতে দেখা গেলেও তাদের মূল লক্ষ্য সম্ভত ফেইসবুককে চাপে রাখা। অন্তত তাদের হ্যাকিংয়ের ধরন দেখে তাই মনে হয়।

ধারণা করা হয়, অ্যানোনিমাস আসলে একজন হ্যাকার জেনারেলের অধীনে কয়েকশ’ অভিজ্ঞ হ্যাকারের দল; যারা কাজ করে যৌথভাবে। এতে তারা যখন কোনো সাইট বা সার্ভারে অ্যাট্যাক করে যে, তখন কে মূল হোতা তা চিহ্নিত করার আগেই পদচিহ্ন মিলিয়ে যায় তাদের। তবে এ হ্যাকার দলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এবার যৌথ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এফবিআই, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ও ফেইসবুকের সমন্বয়ে। আবার তাদের ধরতে সহায়তা করছে শুনে ফেইসবুকের বিরুদ্ধে অভিযানে নামার ঘোষণা দিয়েছে অ্যানোনিমাস। তারা এর নাম দিয়েছে- অপারেশন গ্লোবাল ব্ল্যাকআউট। পরিকল্পনা অনুযায়ী, অচিরেই কোনো এক দিন এক সঙ্গে বন্ধ করা হবে ফেইসবুকের ৬০ হাজার সার্ভার। কারও কারও ধারণা, অ্যানোনিমাসের ক্ষেত্রে অপারেশন গ্লোবাল ব্ল্যাকআউট হয়ে উঠতে পারে গান পাউডার প্লট। তবে আসলেই তেমনটি ঘটবে কিনা, কে বলতে পারে!

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

নাশিদের পতন, ওয়াহিদের উত্থান; মালদ্বীপের কী?

বহির্বিশ্বে মালদ্বীপের পরিচিতি এতদিন অনেকটাই ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম ঝুঁকিপ্রবণ দেশ হিসেবে। এটির সিংহভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে। দেশটির ভূরাজনৈতিক গুরুত্বও নেই তেমন। এ কারণে অন্য দেশের রাজনৈতিক গোলযোগে যেমন অহরহই প্রতিবেশির ডাক পড়ে- সে রকম দৃষ্টান্ত খুবই কম এখানে। একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করতেন, আদৌ মালদ্বীপে নিজস্ব সেনাবাহিনী রয়েছে কিনা। জলবায়ু সংক্রান্ত বা সার্ক সম্মেলন ছাড়া দেশটির খবরও মিলত কম। দীর্ঘদিন পর মালদ্বীপ আলোচনায় এলো এসব কারণের বাইরে- দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়ায়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশিদ। তিনি ছিলেন দেশটির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। নাশিদের পদত্যাগে ক্ষমতা নিয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ ওয়াহিদ হাসান। নাশিদ বলছেন, মালদ্বীপে অভ্যুত্থান ঘটেছে; আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। এদিকে নতুন রাষ্ট্রপতি ও দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য দেয়া হচ্ছে সেগুলোর সারমর্ম অনেকটা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে নাশিদের দেয়া বিদায়ী ভাষণের মতই- রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে নাশিদ অব্যাহতি নিয়েছেন দেশের কল্যাণার্থে। তবে আসলেই কী ঘটেছে ও ঘটে চলেছে, তা অনেকটা ঘোলাটে এখনো। ঘোলাটে এ কারণে যে, বর্তমান পরিস্থিতি কাদের জন্য সুযোগ করে দিলো বা বিষয়টি আদৌ সুযোগ কিনা, সেটি পরিষ্কার নয়।

সাম্প্রতিক ঘটনার সূচনা মালদ্বীপ ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অপসারণকে নিয়ে। অপসারণের পর তাকে গ্রেফতারের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন রাষ্ট্রপতি নাশিদ। কিন্তু বিষয়টিকে সংবিধানের লঙ্ঘন হিসেবে নিয়ে হুকুম অমান্য করেন তারা। উল্টো এ নিয়ে ‘আলোচনায়’ বসেন নাশিদের সঙ্গে। এ অবস্থায় নাশিদের অবশ্য কিছু করার ছিল না। ‘আলোচনা’য় সেনাবাহিনী, বিরোধী দলের সঙ্গে তার উপরাষ্ট্রপতিও ছিলেন। ওদিকে তার সমর্থকদের সক্রিয় দেখা না গেলেও, বিরোধীদল রাজপথে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল তখন। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয় শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যও।

অনেকে বলছেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার মূল্য নাশিদকে দিতে হলো এভাবে অপসারিত হয়ে। সত্য যে, আগে দেশের জন্য অনেক আত্মত্যাগ করলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে শক্ত হাতে পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন তিনি; এমনকি সেনাবাহিনীকেও। তবে এটিই তার পতনের একমাত্র কারণ বলা যায় না। কেউ কেউ বলছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা মামুন আবদুল গাইয়ুমের ষড়যন্ত্র হতে পারে এটি। তিনি তক্কে তক্কে ছিলেন। প্রধান বিচারপতির গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তপ্ততা কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটে নিয়েছেন তিনি। অবশ্য এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দেয়া সহজ নয় বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষে। আগে একবার তিনি অভ্যুত্থানের আভাষ পেয়ে বিদেশি শক্তির সহায়তা চেয়েছিলেন। কারো কারো মতে, সম্প্রতি মালদ্বীপে ইসলামী উগ্রপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের মনক্ষুণ্ণ করবে, এমন কিছু কাজ এরই মধ্যে করে ফেলেছেন নাশিদ। এরাই চান না তিনি ক্ষমতায় থাকুন। কথা হলো, দেশটির সাধারণ মানুষের ইসলামী মনোভাব রক্ষণশীল হলেও উগ্রপন্থা বলা যায় না একে। মজার বিষয় হলো, এত সব বিচার-বিশ্লেষণের মধ্যে মধ্যে কেন যেন বোঝা যাচ্ছে না আরেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ফাতিমা দিয়ানা সাইদের ভূমিকা।

মালদ্বীপের ঘটনায় একটি বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। তা হলো, শক্তিশালী হয়ে উঠেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এ অবস্থায় অনেকের প্রশ্ন- নাশিদের পতন, ওয়াহিদের উত্থান; মালদ্বীপের কী? মালদ্বীপের গণতন্ত্রের ভাগ্যে কী রয়েছে, সেটি অনুমানের সুযোগ কম। তবে এটা বোঝা যায়, এখন থেকে দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব বাড়বে; আগে তেমন ছিল না যেটি। এ ক্ষেত্রে দেশটির গণতন্ত্রের জন্য সুখবর হলো, উদ্ভূত রাজনৈতিক গোলযোগের সুযোগে ক্ষমতা নিতে পারত সেনাবাহিনী। নিজেদের যথেষ্ট শক্তিশালী না মনে করেই হোক বা সদিচ্ছা থেকেই হোক, সেটি করেন নি তারা।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

বাংলা সিনেমার মান ও বাণিজ্যিক সফলতা

সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলা ছবি দেখতে দর্শকের ভীড় জমছে হলে। এটি শুভবার্তা তো বটেই। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো- এটি নাকি আর্ট ফিল্ম। এ দেশ কেন, সারা বিশ্বেই এ ধরনের সিনেমার দর্শক কম। একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, শৈল্পিক চলচ্চিত্র মানেই নীরস; আর বাণিজ্যিক ছবি মানে হালকা কিছু। এ দেখে অনেকে রায় দিয়েছে, ‘বাণিজ্য ও শিল্প খাপ খাইবার নয়’। সাধারণ মানুষ দেখে না সিনেমাটোগ্রাফি কেমন হয়েছে। তাদের কাছে মূল বিবেচ্য হলো- সেটির কাহিনী ও চরিত্রদের অভিনয়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে কেউ কেউ তুলে ধরেন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ধারাকে। এখানকার দর্শকদের অভিযোগ, হালের ছবিগুলো মানসম্মত নয়। এদিকে পরিচালক-প্রযোজকদের উষ্মা, অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার জন্য আর্ট ফিল্ম ঠিক আছে কিন্তু ও করে তো পেট চলে না! দর্শককে দোষ দেয়া যাবে এ ক্ষেত্রে। ছবি ব্যবসা সফল করার দায়িত্ব তাদের নয়। বরং পরিচালক-প্রযোজকদের কৃতিত্ব এখানে যে, তারা কী উপায়ে উভয় রুচির দর্শককে হলে টানবেন।

অসম্ভব কাজ মনে হয় না? চলচ্চিত্রের এক দিকপাল আলফ্রেড হিচকক একই সমস্যায় পড়েছিলেন। সস্তা ছবি তৈরিতে তার রুচিতে বাধত; আবার ব্যবসা সফল করতে না পারলে তাকে ছেড়ে দিতে হতো চলচ্চিত্র নির্মাণ। ভেবে-চিন্তে তিনি ঠিকই বের করলেন মধ্যপন্থা; তার অধিকাংশ সিনেমা ব্যবসা সফল ও দর্শক-সমালোচক কর্তৃক প্রশংসিত। হিচককের সিনেমা দর্শন ছিল, স্কিপ্ট দিয়ে আকর্ষণ করতে হবে কৌতুহলী মানুষকে; ছুঁতে হবে সাধারণ দর্শকের মন। একই সঙ্গে অভিনয় ও সিনেমাটোগ্রাফী হতে হবে এমন, যেটি দর্শকরা পছন্দ করবেন আবার সমালোচকেরো চিন্তার খোরাক জোগাবে। হিচককের দেখানো এ পথ অনুসরকারীর সংখ্যা কম নয় এখন। তার সিনেমাদর্শনে বিশ্বাসীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন, জর্জ লুকাস, রিডলি স্কট (বর্তমানে স্যার রিডলি স্কট), জেমস ক্যামেরন, স্টিভেন স্পিলবার্গ ও ক্রিস্টোফার নোলান। প্রধানত এরাই হলিউডের চলচ্চিত্রে মিলন ঘটিয়েছেন বাণিজ্য ও শিল্পের। ১৯৯৭ সালে টাইটানিক ও ২০০৯ সালে অ্যাভাটার মুক্তি দেন ক্যামেরন। এ দুটি ছবির প্রশংসা করেছেন বড় বড় সমালোচকরা। আর টাইটানিক ও অ্যাভাটার থেকে ক্যামেরন আয় করেছেন ৫০০ কোটির ডলারের কাছাকাছি। একই কথা খাটে, স্পিলবার্গের ই.টি., লুকাসের স্টারওয়ার্স, রিডলি স্কটের গ্ল্যাডিয়েটর সম্বন্ধেও। শংকা ছিল, এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের ধারা লুকাস-স্কটদের মধ্যেই শেষ। নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে বাণিজ্য-শিল্পের সমন্বয় করা কঠিন। তখনই ডার্ক নাইট, ইনসেপশনের মতো ব্যবসা সফল ও শৈল্পিক ছায়াছবি নিয়ে বাজারে আসেন ক্রিস্টোফার নোলান। ইনসেপশন সিনেমার প্লট ভাষাতত্ত্বের একটি জটিল তত্ত্বে নিহিত। সিনেমাটি সমালোচকদের এতটাই নাড়া দেয় যে, সে বছর তাকে সম্মানজনক রাইটার্স গিল্ড অ্যাওয়ার্ডও দেয়া হয়। তার সিনেমাদর্শনের সঙ্গে হিচককের মিল রয়েছে। তিনি বলেন, দর্শককে ফাঁকি দেয়া যায় না; তাদেরকে নতুন গল্প সূচারূভাবে উপস্থাপনার মাধ্যমে তাদেরকে বৈচিত্র্য দিতে হবে, বাস্তব-কল্পনায় ভাসাতে হবে। আপন সংস্কৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্য ও শিল্পের মাঝে সমন্বয় সাধনের এ গুণ সত্যজিৎ রায়েরও ছিল। আমাদের জহির রায়হান, খান আতারাও সীমিত পরিসরে চেষ্টা করেছেন এটি। তার কয়েক দশক পরই এ ধারার চলচ্চিত্রনির্মাণ ব্যাহত হয়। হালের অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতার প্রতিভা থাকলেও ঘাটতি রয়েছে ওই গুণটির। এ ক্ষেত্রে অনেক বাংলাদেশী চলচ্চিত্রনির্মাতা দাঁড় করান আরেকটি খোঁড়া যুক্তি- বাংলা সিনেমার বাজার তো আর হলিউড, বলিউডের মতো ব্যাপক নয় যে অধিক বিনিয়োগ করে মানসম্মত ছবি বানালেই তার অর্থ উঠে আসবে। তাদের চোখ মেলে দেখা উচিৎ, এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশেই রয়েছে বাংলা সিনেমার বিপুল দর্শক। তাদের কথাবার্তা মাঝে মাঝে বাংলাদেশ বিমানের পরিচালকদের মতো শোনায়। দেশি-বিদেশি বেসরকারি এয়াইলাইনসগুলো যখন চুটিয়ে ব্যবসা করছে তখন একমাত্র এদের কাছেই মেলে বিমান পরিবহনের নানা সংকটের চিত্র। একই হাল বাংলাদেশী চলচ্চিত্রেরও। এখানকার টিভি বিজ্ঞাপন, নাটক মোটামুটি মানসম্মত; অথচ এ থেকে যোজন দূরে পড়ে রয়েছে সিনেমা। এর প্রতিকার কী মিলবে না!

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে

নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়েছে বিরোধী দল। নীতিগত দিক থেকে যন্ত্রটি ব্যবহারে তাদের সমস্যা নেই অবশ্য। তবে প্রশ্ন রয়েছে এর নির্ভুলতা ও দক্ষতা নিয়ে। তার বলছে, কারসাজি করে নির্বাচনের ফল পাল্টানোর সুযোগ রয়েছে এতে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো গুটিকয়েক কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয় ইভিএম। সে ক্ষেত্রেও তোলা হয়েছিল প্রশ্নগুলো। তখন যে আশংকা করা হয়েছিল, ফল প্রকাশের পর দেখা গেলো বাস্তবে সেসবের কিছুই ঘটে নি। এটির সাহায্যে পরবর্তীতে হলো আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। একই শংকা ব্যক্ত করা হয় সেখানেও। এ নির্বাচনেও দেখা যায় নি ইভিএমের উল্লেখযোগ্য কোনো ত্রুটি। বরং যন্ত্রটি ব্যবহারে সে সময় সাড়া পড়ে জনগণ বিশেষত তরুণদের মধ্যে। ওসব অভিজ্ঞতা পুঁজি করে সম্প্রতি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হলো প্রতিটি কেন্দ্রে। ব্যাপকভাবে ব্যবহার হওয়ায় বর্তমান যন্ত্রটির কিছু সমস্যা অবশ্য দেখা গেলো এতে। যেমন, প্রার্থীর চিহ্নের পাশের লেখাটা বেশ ছোট। ফলে বয়ষ্কদের এটি পড়তে সমস্যা হয়। এতে করে ভুল প্রার্থীতে ভোট পড়ার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি তেমন সচেতনতামূলক কর্মসূচী না থাকায় কিছু ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েছিলেন অশিক্ষিতরাও। সার্বিকভাবে বিচার করলে অবশ্য দেখা যায়, এসব বিঘ্ন পরাজিত হয়েছে মানুষের কৌতুহলের কাছে ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের আনন্দে। তবে এ কথা সত্য, ইভিএম সম্পর্কিত প্রচারণা পর্যাপ্ত ছিল না এবারে। এ প্রযুক্তি একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত পরিচয় করিয়ে দেয়ার যে ধরনের ব্যাপক কর্মসূচী দরকার, ঘাটতি ছিল তাতে। আশা করি, এসব অভিজ্ঞতা পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় কাজে আসবে।

যে কোনো যুক্তিপূর্ণ ব্যক্তিই স্বীকার করবেন, শতভাগ নিরাপদ কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় নি আজ পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে ইভিএমের শতভাগ কার্যকারিতা বা নির্ভুলতার প্রশ্ন তোলাও অর্থহীন। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অনেক পর্যবেক্ষকও লক্ষ্য করেছেন এটির কার্যকারিতা। তাদের মতো হলো, সামগ্রিকভাবে এটি গ্রহণযোগ্য। এরপরও বিরোধী দলীয় কেউ কেউ গিয়েছেন গভীর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের দিকে। এরা বলছেন, যন্ত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে জাতীয় নির্বাচনে এর সাহায্যে কারচুপির আশ্রয় নেবে সরকার। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বরাবরই বলে আসছে, ইভিএমে কারসাজির বিষয়টি বিরোধী দলীয় প্রযুক্তিবিদরা প্রমাণের চেষ্টা করতে পারেন কমিশনে গিয়ে। এ আহ্বানে অবশ্য এখন পর্যন্ত তাদেরকে সাড়া দিতে দেখা যায় নি।

তবে অভিজ্ঞতা থেকে ইভিএম ব্যবহারে যেসব খুঁত নজরে এসেছে সেদিকে মনোযোগী হওয়া দরকার ইসিকে। যেমন, ইভিএমের ব্যবহৃত চিপে পরিবর্তন করা যায় ফলাফল। এতে যুক্ত করা উচিৎ ওয়ানটাইম ডিসপোজেবল চিপ। যন্ত্রটির আরেকটি ত্রুটি, ভোট আসলে কোথায় পড়ল তার ডকুমেন্ট থাকে না এতে। এ ক্ষেত্রে অটোমেটেড টেলার মেশিনের (এটিএম) মতো ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে যাতে ভোট দেয়ার পর ছোট কাগজে ভোটার ও ভোট সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য বিবরণী হিসেবে বেরিয়ে আসবে ইভিএম মেশিন থেকে। এ ক্ষেত্রে খরচ বাড়লেও বৃদ্ধি পাবে মানুষের আস্থা। দেশেই ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন তৈরি হচ্ছে এখন। এ অবস্থায় কঠিন হবে না স্থানীয়ভাবে এমন যন্ত্র তৈরি।

বিরোধী দলেরও উচিৎ হবে না, ইস্যু করতে গিয়ে ইভিএমের মতো একটি ভুল বিষয়কে ইস্যু করা। আমাদের নির্বাচনগুলোয় যে পরিমাণ খরচ হয় ও ভোট দিয়ে গিয়ে মানুষকে যত বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, সেসব দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে তাদের। ব্যাপকহারে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হলে নির্বাচনের খরচ তো কমবেই, মানুষও ভোট দিতে পারবে সহজে ও স্বল্প সময়ে। এটি পরীক্ষিতভাবে গ্রহণযোগ্য প্রযুক্তি। তারচেয়ে বড় কথা, জনস্রোত এখন ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। এ অবস্থায় যন্ত্রটি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখাটা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নয়।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

মাত্রাজ্ঞান হারানোর খেসারত দিচ্ছেন পাকিস্তানের রাজনীতিকরা

ঘটনার সূত্রপাত যুক্তরাষ্ট্রস্থ পাকিস্তানী দূত হোসেন হাক্কানীকে দেয়া প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিরি এক চিরকুট। এটির বিষয়বস্তু ছিল- পাকিস্তানী গণতন্ত্রের ধারায় সেনাবাহিনী খুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; তাদেরকে চাপে রাখতে মার্কিন সহায়তা প্রয়োজন। বাস্তবিকই ওই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা রাজনীতিকদের পক্ষে কঠিন ছিল। পাকিস্তানে মার্কিন ঘাঁটি ও তাদের ড্রোন হামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গন থেকে। এরই মধ্যে দেশটির সামরিক-বেসামরিক কোনো প্রশাসনকে না জানিয়ে ঘরের ভেতরে বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় ইউএস নেভী কমান্ডো। আরেকটি বিষয় রয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের চেয়ে জনগণের প্রতি বেশি কমিটেড (এ কারণে বোধকরি সুযোগ পেলেই তাদের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে চান তারা)। ফলে বিন লাদেনের এমন হত্যায় পাকিস্তানীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে বিষয়টি আরও উস্কে দেয় সেনাবাহিনী। মন্তব্য করা হয়- আরেকবার পাকিস্তানের অভ্যন্তরে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তার দায় নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। এ বক্তব্যে যতটা না ক্ষোভ না, অভিমানই ছিল বেশি। মাত্রাও বজায় ছিল এতে। এটি অবশ্য ধরতে পারেন নি রাজনীতিকরা। তারা ভেবেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়ার ইঙ্গিত বুঝি দিচ্ছে সামরিক প্রশাসন। ব্যস, চোখ-কান বুঁজে তারা উঠেপড়ে লাগলেন ওবামা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিন লাদেন ধরার অভিযান সেলিব্রেটও করতে দিলেন না ওয়াশিংটনকে। কড়া মন্তব্য করলেন প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি- পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে তারা; এখন ক্ষমা চাইতে হবে। মনে শান্তি এলো না এতেও। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারকে পাঠানো হলো যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি গিয়ে শাসালেন হিলারি ক্লিনটনকে। সেদিন কোনো জবাব দেন নি হিলারি। কয়েকজন পাকিস্তানী রাজনীতিক আরও আগ বাড়িয়ে ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্র এক সময় তাদের মিত্র ছিল বটে তবে জিগরি দোস্ত হলো চীন। ওয়াশিংটন জানত এদের দৌড়। বোধকরি সুযোগ খুঁজছিল তাই। সেটি অবশ্য করে দিলেন প্রেসিডেন্টই- ‘বিশ্বস্ত’ হাক্কানীকে দিয়ে ওই চিরকুট পাঠিয়ে। এ ভদ্রলোকের নাকি ভালো সম্পর্ক ছিল সিআইএ ও আইএসআইয়ের সঙ্গে (পরেরটি অবশ্য জানতেন না জারদারি)। এর পরের ঘটনা অনেকটা এমন। কিভাবে যেন ফাঁস হয়ে গেলো চিরকুট। নিজেই ইস্তফা দিলেন হাক্কানী। সেনাবাহিনী গেলো সুপ্রীম কোর্টে। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে আগে থেকেই ব্যবধান বাড়ছিল। এবার সেটি রুপান্তরিত হলো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে। আসলে ফাঁসটি খোলা ছিল। এতেই গলা এগিয়েছেন জারদারি। ফাঁস নিয়েই এখন চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রীকেও ফাঁসাতে।

অনেকে বলছেন, আবার ক্ষমতা দখল করতে পারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এমন সম্ভাবনা কম অবশ্য। বর্তমান সেনাপ্রধান তেমন উচ্চাভিলাসী নন। তাছাড়া পারভেজ মোশাররফের মতো এক সঙ্গে রাজনীতি, কুটনীতি, সেনাবাহিনী চালানো- তার ধাতে সইবে না। আইএসআই প্রধানের বেলায়ও খাটে একই কথা। তাছাড়া আগ্রহ থাকলে এ পরিস্থিতিতে আদালতে না গিয়ে শুরুতেই ক্যু করে ফেলতে পারতেন তিনি। এ অবস্থায় কেউ কেউ বলছেন ইউসুফ রাজা গিলানিকে সরিয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির আইতজাজ আহসানকে করা হতে পারে প্রধানমন্ত্রী। এটিও জোর দিয়ে বলা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যদি বদলাতেই হয় বেটার অপশন হলো ক্রিকেটার-টার্ন-পলিটিশিয়ান ইমরান খান। তবে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন আসলেই কোনো সমাধান কিনা বা এ পদে কাকে নেয়া হবে সেটি অনেকাংশে নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। জিগরি দোস্ত চীন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেই নাক গলায় না। আবার সেনাবাহিনী ও সুপ্রীম কোর্টের যৌথ চাপ সামলানো সম্ভব নয় ক্ষমতাসীনদের। এখন যুক্তরাষ্ট্রে মুখ ঘোরানো ভিন্ন উপায় কি! এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি সম্পর্কটি যেমনই যাক, নিজের স্বার্থ থেকেই এগিয়ে আসতে হবে মার্কিনীদের। পরিস্থিতির গুরুত্বানুযায়ী এ বিষয়ে আসতে পারেন হিলারি নিজেও; হিনাকে জবাবটা দিতে হবে তো।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

টি-২০ ক্রিকেটের পর বিপিএল ফুটবল!

বিশ্বকাপজয়ী ইতালি ফুটবল দলের অধিনায়ক ক্যানোভারো, আর্জেন্টিনার সোরিন ও ক্রেসপো, লিভারপুলের ফাওলার, ফ্রান্সের পাইরেস নিশ্চিত করেছেন তারা আসছেন কলকাতায়। আসার কথা রয়েছে জে-জে ওকোচা, মরিয়েন্তেস, মানিশের মতো আরোও কয়েকজন ফুটবলারেরও। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ধারে-কাছেও নেই এখনকার ফুটবল। এতে মনে হতে পারে, বিশ্বখ্যাত এ ফুটবলাররা আসছেন প্রদর্শনীতে অংশ নিতে। এতকাল এ-ই হয়ে এসেছে। অবশ্য ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) ফুটবলে খেলতে আসছেন তারা। তাদের অনেকে ভারতের নাম জানতেন। তবে দেশটিতে পশ্চিমবঙ্গ বলে একটা স্থান রয়েছে ও সেখানে বিপুল ফুটবলমোদীর বাস, সেটি জানা ছিল না। ক্যানোভারোদের উদ্বুদ্ধ করতে ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগ ম্যাচের ভিডিও নাকি পাঠানো হয় খেলতে আসার আমন্ত্রণের সঙ্গে। ঘটনাটি ভারতের ফুটবল দর্শক ও ফিফা র‍্যাংকিংয়ের ১৫৮তম (একই অবস্থান বাংলাদেশেরও) অবস্থানে থাকা দেশটির জাতীয় দলকে করে তুলেছে উজ্জীবিত।

ক্রিকেটের মতো না হলেও আইপিএল ফুটবলের জন্য প্রথম বছরের সম্ভাব্য বাজেট মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের। ক্রিকেট অধিক জনপ্রিয় জেনেও বিপুল অর্থের বিনিয়োগকে পাগলামি মনে হতে পারে কারও কারও। তবে বিনিয়োগকারীরা ফুটবলে জেনে-শুনেই; আইপিএল টি-২০ ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা থেকে। তারা বুঝছেন এ অঞ্চলের মানুষ যতটা ক্রীড়ামোদী তাতে যথাযথভাবে উপস্থাপন বড় খেলাকে পুঁজি করে লাভ ওঠানো কঠিন নয়। আইপিএলের কথা বললে এখন থেকে বিপিএল প্রসঙ্গ উঠবেই। কয়েক দিন পরই শুরু হবে ঘরোয়া এ টি-২০ ক্রিকেট। এর টিকেট বিক্রিও শুরু হয়েছে এরই মধ্য। ভেন্যু নির্ধারিত হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম। এ ক্ষেত্রে আইপিএলের সঙ্গে তুলনা করে কিছু বলা দরকার। সেটি লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, ভেন্যু নির্ধারণে আইপিএলে প্রাধান্য দেয়া হয় হোমগ্রাউন্ডকেই। মুম্বাই ইন্ডিয়ানস ও কলকাতা নাইট রাইডারসের মধ্যে খেলা- ভেন্যু হয় কলকাতা নয়তো মুম্বাই। এতে যে মাঠে খেলা হবে, তার নিজস্ব কিছু দর্শক থাকবেই। এ ক্ষেত্রে ম্যাচটি যদি রাজস্থানে হতো? দর্শক কমে যেতো অনেকটাই। কলকাতা কি মুম্বাই থেকে একই আবেগ রাজস্থান পর্যন্ত ধরে রাখা মোটেই সহজ নয়। বিপিএলেও এটি করা যেতে পারে (অবশ্য এবার নয়, সামনের বছর থেকে)। কিছু অবকাঠামোগত অসুবিধা থাকলেও আমাদের বিভাগীয় স্টেডিয়ামগুলো একেবারে অচলনসই নয়।

বিপিএলের সব খেলাই এবার অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ফলে খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট দলের ভক্তদেরও যেতে হবে সেখানে। বলা হতে পারে, যারা যেতে চান না তাদের জন্য তো টেলিভিশন রয়েছে। তা ঠিক। মাঠে দর্শক না এলে কেবল টিভিতে খেলা দেখিয়ে কিন্তু টুর্নামেন্ট সফল করা যাবে না। টেস্ট ক্রিকেটও লোকে টিভিতে দেখে; মাঠে দর্শক উপস্থিতি থাকে কম। তবে টেস্ট ক্রিকেটের আমেজ টি-২০’র ব্যবসা চলবে না। বহু অর্থ ব্যয়ে (ও আরও খরচের চিন্তা মাথায় রেখে) গঠন করা হয়েছে বরিশাল বার্নার্স, চিটাগং কিংস, ঢাকা গ্লাডিয়েটরস, খুলনা রয়েল বেঙ্গল, দুরন্ত রাজশাহী ও সিলেট রয়ালস। বিপিএলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য নিশ্চয়ই বিনিয়োগ করেন নি উদ্যোক্তারা। তবে তাদের মনে রাখা দরকার, এ ধরনের ক্রিকেট লীগ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হতে প্রয়োজন বিচক্ষণ পদক্ষেপ ও ধৈর্য্য। আইপিএলে বিনিয়োগকারীদের অভিজ্ঞতা তো তাই বলছে। এটি শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালে। প্রথম ২-৩ বছর এখানে লোকসানও করেছেন মুকেশ আম্বানি, বিজয় মালায়া, ল্যাকান মারডকের (রুপার্ট মারডকের বড় ছেলে) মতো বিনিয়োগকারী। অবশ্য বিপিএল উদ্যোক্তারা এসব হিসাব করেই নেমে থাকবেন। তাদের মতো আমরাও চাই উদ্যোগটি সফল হোক, জমে উঠুক বিপিএল। সে ক্ষেত্রে বিপিএল টি-২০ ক্রিকেটের পর এক সময়কার জনপ্রিয় ফুটবল খেলাকেও হয়তো পুনর্জীবন দিতে পারবেন বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

ভালো কিছুর আশায়

সদ্য পরিচিত ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম বা পদার্থবিজ্ঞানী হতেও পারেন, নাও পারেন। তবে যিনি আমাকে ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার এ কথাটাই শুধু একদম বিশ্বাস হতে চাইল না যে, তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সুযোগ ছেড়ে দিয়ে পড়ে রয়েছেন বাংলাদেশে- তাও আবার চট্টগ্রামে। কোথাও ভুল হচ্ছে না তো! ভদ্রলোককে দেখেও কিন্তু পাগলাটে ধরনের বিজ্ঞানী মনে হচ্ছে না। বরং আচার-আচরণে বেশ সৌম্য। যাহোক, একটু বাজিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে- দৌড় কতদূর। ইউরোপে সার্নের বিজ্ঞানীরা লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (এলএইচসি) ‘ঈশ্বর কণা’র অস্তিত্ব আবিষ্কারে আদাজল খেয়ে নেমেছে তখন। তাই জিজ্ঞেস করলাম, হিগস মেকানিজম (হিগম ফিল্ড থেকে যেভাবে ভর উৎপন্ন হয়) সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী? প্রথম পরিচয়ের কোনো রকম আড়ষ্টতা, ধারণাগত জড়তা ছাড়াই প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম শুরু করলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যাখ্যা। একটা কাগজ জোগাড় করে দেখাতে লাগলেন হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র। দ্রুতই ফিরলেন আইনস্টাইনের ভরশক্তি সমীকরণে। এ সূত্রটি আইনস্টাইন লেখেন ১৯০৫ সালে; প্রমাণ করতে পেরিয়ে যায় তিরিশের দশক। ভরশক্তি সমীকরণের আদৌ কোনো ব্যবহারিক দিক রয়েছে কিনা, সেটি বোঝাতে গিয়ে আইনস্টাইন বলেছিলেন- ঘটনাটি আসলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোনো বিরান শহরে পাখি শিকার করার মতো; যেখানে পাখি রয়েছে মাত্র দু’চারটি। হয়তো এমন পরিবেশে পাখি শিকারে নেমেছে এলএইচসিও। তাজ্জব হলাম তার জ্ঞানের গভীরতা দেখে। পরে আরো মুগ্ধ হলাম এটা জেনে যে, তিনি আদতে একজন জ্যোতির্পদার্থবিদ ও গণিতজ্ঞ। ক্যামব্রিজে তার অনেক সহকর্মীই পরবর্তী সময়ে কাজ করেছেন স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে।

গণিত ছিল তার অস্থিমজ্জায়। ফলে আকৃষ্ট হন পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে যেমন অর্থনীতিতে ব্যবহার্য গণিতের প্রতিও। সোশ্যাল চয়েস থিওরি নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। এগিয়ে নিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারোর জেনারেল পসিবিলিটি থিওরেমকে। অন্যদের মতো কেবল কার্টেসিয়ান কোঅর্ডিনেশন আর সেট থিওরির মাঝে সীমাবদ্ধ রাখেন নি তত্ত্বটিকে। জামাল নজরুল ইসলাম সোশ্যাল চয়েসকে ব্যাখ্যা করেছেন জ্যামিতি ও ভেক্টর বিশ্লেষণ দিয়ে। অর্থনীতি ভাসা ভাসা যতটুকু বুঝি, তাতে মনে হয়েছে ওনার ভেক্টর বিশ্লেষণটি খুবই কাজে আসতে পারে অর্থনীতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে; বিশেষত সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় এবং আয় পুনর্বণ্টনের মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচারে। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা ছিল। পরে সৌভাগ্যক্রমে ও কাতকাতালীয়ভাবে তার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল আরেকবার। তবে সমীকরণটির সম্ভাবনা নিয়ে কোনো কথাবার্তা হয় নি। সোশ্যাল চয়েসের গাণিতিক ব্যাখ্যা নিয়ে তিনি শুধু মজা করে বললেন যে, অ্যারোর সমীকরণ পড়লে বোঝা যায়- কেন বাংলাদেশে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে নির্বাচনের মাধ্যমে আসা ভিন্ন কারো ক্ষমতায় বসা প্রায় অসম্ভব। বলেছিলাম, সমীকরণটি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বসেন না কেন? ছোট্ট করে জানালেন, এখানে গণিত বোঝার লোক কম; সেটি প্রয়োগ করার মানুষ তো বিরল। ক্যামব্রিজ ছেড়ে জামাল নজরুল ইসলাম দেশে এসেছিলেন বিরাট কোনো পদ অধিকারের জন্য নয়; খ্যাতির মোহও তার মাঝে অনুপস্থিতই ছিল। তিনি সে অর্থে বড় গড়ে তুলতে চান নি। চেয়েছিলেন, এ দেশের মানুষ বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে নিজেরাই গড়ে উঠবে; তিনি সে প্রক্রিয়ায় সহায়তা জোগাবেন মাত্র। তা যে মনের মতো হয় নি, সেটি নিয়েও তার হতাশা ছিল না; ছিল- দুঃখ। একবার মনে হয়েছিল, অনেকের মতো জামাল নজরুল ইসলামেরও তরুণদের ওপর কোনো ক্ষোভ রয়েছে কিনা। প্রসঙ্গ তোলা মাত্র থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, তোমাদের আর দোষ কী? আমরাই পারিনি তোমাদের বোঝাতে। অবশ্য হাল ছাড়িনি; আমি আশাবাদী। এ বয়সেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাই। কে জানে, এসবের মধ্যে দিয়েই হয়তো দেশে ভালো কিছু হয়ে যাবে একদিন; বিজ্ঞানমনষ্কতা বাড়বে সবার।

জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

Leave a comment