From 2011-15

সুচির সামনে সুযোগ

সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা অনেক দেশেই রয়েছে। দীর্ঘকালীন সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতাও কম নয়। তারপরও এ ক্ষেত্রে খানিকটা ব্যতিক্রম মিয়ানমার। কারণ এ দেশটির মতো মোটামুটি সফল সামরিক শাসনপন্থা থেকে গণতন্ত্রের প্রতি ঝোঁকার নাটকীয়তা অন্যত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

গোড়া থেকেই বিশেষত পশ্চিমা দেশের চাপ সহ্য করে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরাসরি ক্ষমতায় ছিলেন বহুদিন। এভাবে ক্ষমতায় থাকার প্রধান কারণ ছিল- মিয়ানমার-চীন সম্পর্ক ও দেশটির বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। মজার বিষয় হলো, ১৯৪৯ সালে যখন কমিউনিস্ট পার্টি চীনের ক্ষমতায় বসল, তখন দুই প্রতিবেশির মধ্যে সম্পর্ক ছিল অনেকটাই বৈরী। এর মধ্যে মিয়ানমারে এলো সামরিক শাসন; অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠতে লাগল চীন। প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের জ্বালানি চাহিদা বাড়ছিল তখন। এ সময় মধ্যপ্রাচ্যের বাজার থেকে অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রও কিনতো জ্বালানি। তবে চীনের উত্থান টের পেয়েই বোধকরি মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে নিজেদের আধিপত্য ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে মার্কিনীরা। বাধ্য হয়ে চীন জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে ইরানের মতো দেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কম, সেসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ায়। এ জ্বালানির ৮০ শতাংশ তখন আসতো মালাক্কা প্রণালী হয়ে। যাতে প্রতিপক্ষ হিসেবে তার অবস্থান শক্ত করতে না পারে সে লক্ষ্যে চীনের ওপর চাপ বাড়াতে মালাক্কা প্রণালীর নিকটবর্তী ইন্দোনেশিয়ার আচেহ দ্বীপে সামরিক উপস্থিতি বাড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। ততদিনে সামরিক শাসন জেঁকে বসেছে মিয়ানমারে। ক্ষমতায় আসা এ জেনারেলরা রাজনীতিকদের চেয়ে বেশি বাস্তজ্ঞান রাখতেন। তারা বুঝেছিলেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে বাইরের সহায়তা লাগবেই। এ দিকে চীন তখন চাইছে যেকোনো উপায়ে তার জ্বালানি তেলের রুট নির্বিঘ্ন করতে। এতে পুরনো আবেগ ভুলে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে দু’দেশের মধ্যে। ১৯৮৯ সালে নামমাত্র মূল্যে মিয়ানমারকে আনুমানিক ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দেয় চীন। বন্ধুত্ব হওয়ার পর চীন দেখলো, মার্কিনীদের চাপ ঠেকানোর ক্ষমতা ছাড়াও অনেক গুণ রয়েছে তার বন্ধুর; খনিজ, বনজ ও মৎস সম্পদে ভরপুর এ দেশটি। এতে কয়েক দশকে মোটামুটি দ্রুতই মিয়ানমারের বিভিন্ন খাতে বাড়ছিল চীনা বিনিয়োগ। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় দেশটির জেনারেলরা উপলব্ধি করলেন কিছু পরে। তারা দেখছিলেন, বন্ধু চীনের প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে, প্রচুর চীনা বিনিয়োগ সত্ত্বেও মিয়ানমারের চেহারে তেমনভাবে ফিরছে। তাছাড়া একমাত্র বন্ধু হওয়ায় মাঝেমাঝেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে মনোপলির সুযোগ নিতে চাইছে দেশটি; বোঝানোর চেষ্টা করছে চীন ছাড়া মিয়ানমার অচল। অথচ তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে বিভিন্ন দেশ। সমস্যা হলো, ওইসব দেশ গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া অন্যদের সঙ্গে অর্থনৈতিক-কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে অনিচ্ছুক। এসব নানা দিক হিসাব-নিকাশের পর মিয়ানমারের জেনারেলরা সিদ্ধান্ত নিলেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন; তবে তার ওপর সামরিক শক্তি যাতে ছড়ি ঘোরাতে পারে সে ব্যবস্থাও রাখা হবে। তার ধারাবাহিকতায় জাতীয় নির্বাচনের ডাক দিলেন তারা। একে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে মুক্তি দেয়া হলো ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসীর (এনএলডি) নেত্রী অং সান সুচিসহ অনেক রাজনৈতিক বন্দীকে। তবে নির্বাচনটি সাজানো বলে মন্তব্য করে, এতে যোগ দিলেন না সুচি।

সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে কয়েকটি আসন খালি হয়েছে। এ জন্য স্বাভাবিকভাবেই ডাকা হয়েছে উপনির্বাচন। খুশির খবর হলো, এতে অংশ নিতে এনএলডির বাতিল হয়ে যাওয়া নিবন্ধন এরই মধ্যে নবায়ন করেছেন সুচি। আসলে তিনি উপলব্ধি করেছেন, আবেগ দিয়ে রাজনীতি চলে না; ফলে যতটা সুযোগ পাওয়া যায় তার মধ্যে দিয়েই মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাতে হবে। তবে জেনারেলরা দেশটিকে এখনই পূর্ণ গণতন্ত্রের হাতে ছেড়ে দেবেন বলে মনে হয় না। তা সত্ত্বেও আপাতত যে সুযোগটি মিলেছে এর সঙ্গে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক সহায়তাকে সমন্বয় করা গেলে আসছে দশকে মিয়ানমারে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কঠিন হবে না আপোষহীন, সংগ্রামী ও জনপ্রিয় সুচির পক্ষে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

সেলাই ছাড়া পোশাক-আশাক!

নতুন কাপড় থেকে সেলাইয়ের সুতা বেরিয়ে আসার ঘটনা জীবনে একবারও ঘটে নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কথা-বার্তা নেই, সেলাই ফেঁসে গেলো এমন অভিজ্ঞতাও বিরল। সেলাইহীন চামড়া পরার বিকল্প ছিল না প্রস্তর যুগে। এর পর মানুষ কৃষিকাজ শিখল। শিখল কাপড় উৎপাদন ও বুনন। কাপড়ের টুকরা সেলাই করে জোড়া দিয়ে পোশাক তৈরি জনপ্রিয় হয়নি তখনই। সে সময় সেলাইয়ের প্রয়োজনটা ছিল পোশাককে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে ও সামরিক ক্ষেত্রে পোশাকের সঙ্গে বর্মের মতো উপকরণ জুড়ে দিতে। শীতপ্রধান দেশে পশু চামড়া পোশাক হিসেবে ব্যবহার করতেও লাগত সেলাই। এসবের বাইরে তৎকালীন সভ্যতাগুলো যেমন মিশর, ইরাক, ইরান, আমেরিকা ও ভারতে সাধারণ মানুষের পরিধেয় বস্ত্রে সেলাই দেখা যায় না তেমনভাবে। তার একটি বড় কারণ ছিল, সেলাই করা পোশাক আঁটোসাঁটো; পড়তে সেলাইহীন পোশাকের চেয়ে আরামদায়ক নয়। সেলাইকর্ম সূচিশিল্পে পরিণত হয় মধ্যযুগে; যখন প্রয়োজনের চেয়ে পোশাক হয়ে ওঠে ফ্যাশনের বস্তু। এরপর গত কয়েক শতাব্দীতে সেলাই করে পোশাক বানানোই জনপ্রিয় হয়ে পড়ে ক্রমে। এতে সেলাই ছাড়াও যে জামা-কাপড় তৈরি করা যায়, সেটি আমরা ভুলে গেছি যেন! সেলাইহীন পোশাকের চল পুনরায় বেড়ে উঠেছে অগ্রসর দেশগুলোয়। সেলাইহীন টি-শার্ট, জার্সি থেকে আন্ডার গার্মেন্ট সেখানে হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। আমাদেরও আনন্দের খবর রয়েছে এ ক্ষেত্রে। সম্প্রতি দেশেই চালু হচ্ছে সেলাইবিহীন পোশাক তৈরির মেশিন বলে খবর রয়েছে বণিক বার্তায়।

সেলাইহীন পোশাকের ক্ষেত্রে কয়েকটি কাপড়ের টুকরা অ্যাডহেসিভ সহযোগে আল্ট্রাসাউন্ডের সহায়তা জুড়ে দেয়া হয়। তবে এ দেশে আল্ট্রাসাউন্ডের বদলে ব্যবহৃত হবে তাপ। তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের দেশে বেশ শ্রমঘন। এ অবস্থায় কেউ কেউ আশংকা প্রকাশ করছেন, মেশিনটি জনপ্রিয় হয়ে পড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যেতে পারে। তবে তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। কারণ জার্সি ও আন্ডার গার্মেন্ট সেলাই ছাড়ার তৈরি করা গেলেও, উন্নত প্রযুক্তির কারণে এসব পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের নির্ভর করতে হবে বিদেশী অর্ডারের ওপর। সেটি পাওয়া সহজ হবে না। প্রচলিত প্রযুক্তিতে তৈরি পোশাক উৎপাদনে আমাদের বিশেষ সুবিধা ছিল- সস্তা শ্রম। উন্নতর প্রযুক্তিতে যে এমন সুবিধা পাওয়া যাবে না, তা মাথায় রাখা প্রয়োজন। এ অবস্থায় সাময়িক সমাধান হতে পারে স্থানীয় বাজার। তবে এখনো প্রাথমিক ও মাঝারি মানের আন্ডার গার্মেন্ট তৈরি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্য স্থানীয় বাজারে চালাতেও কষ্ট করতে হবে অনেক। তবে আমাদের ক্রীড়ামোদীদের জন্য বাজারে জার্সি ছাড়া হলে, সেটি ভালোই চলবে বলে আশা করা যায়। কিছুদিন পর শুরু হবে বিপিএল। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে সেলাইহীন জার্সি সরবরাহ করতে পারেন উদ্যোক্তারা। স্থানীয় বাজারের মনোভাব পরোক্ষভাবে যাচাই হয়ে যাবে এতে। কোনো কারণে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে না পারলে, এ অভিজ্ঞতা কাজে দেবে। সে ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে স্থানীয় বাজারে চালাতে চাইলে, এসব পণ্যের মান ধরে রেখে দাম রাখতে হবে সাধ্যের নাগালে। অগ্রসর দেশে জার্সি সাধারণত ড্রাইওয়াশ ও কাপড় পরিষ্কারের অন্যান্য কম ক্ষতিকর পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এ দেশে কাপড় পরিষ্কারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় (সেটি হোক জার্সি, আন্ডার গার্মেন্ট বা অন্য কিছু) কড়া ডিটারজেন্ট। নিম্নমানের সাবান দিয়েও পরিষ্কার করা হয় পোশাক। অনেক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা জামা-কাপড় ভিজিয়ে রাখা হয় সাবান-ডিটারজেন্টের পানিতে। অনিয়ন্ত্রিত গরম পানির ব্যবহারও রয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। এমন অবস্থায় জার্সিতে ব্যবহৃত অ্যাডহেসিভ অকার্যকর হয়ে পড়লে, ড্রাইওয়াশ করালেন না কেন বলে- ভোক্তাকে অভিযুক্ত করা কঠিন। বরং এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুতকারীদেরই নিশ্চিত করতে হবে পোশাকের নির্ভরযোগ্য অ্যাডহেসিভ।

ফাহমিদা ফেরদৌস

ইতিহাস, শিল্প ও বিজ্ঞানে মুদ্রা

সামাজিক বিজ্ঞানের একটি উপশাখা হলো নুমিসম্যাটিকস। এর অধীত বিষয়, বিনিময়ের যেকোনো মাধ্যম। হোক তা কাগুজে নোট, মেটাল কয়েন বা বিটকয়েন (ডিজিটাল পয়সা)। সিগারেটসহ কিছু ‘সুলভ’ কিছু মাদকদ্রব্যের বিশেষ কয়েকটি ব্যবহারও নুমিসম্যাটিকসের অন্তর্গত। অবাক হওয়ার কিছু নেই। জেলখানার ‘অর্থনৈতিক কর্মকান্ড’ তথা দ্রব্য বা সেবার বিনিময় মাধ্যম হিসেবে এসব বস্তুর ব্যবহার রয়েছে বলে এগুলো নুমিসম্যাটিকসের অংশ। ‘নুমিসম্যাটিকস’ শব্দটিকে ফরাসী ধরা হলেও এটি মূলত মৃত ল্যাটিন। এর উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে; গ্রীক দ্বীপ অ্যাজাইনাতে। নুমিসম্যাটিকসের মাতৃশব্দ নোমসমাস। এটিকে আদতে শব্দ নয় বাক্যাংশ (ফ্রেজ), মূল ল্যাটিনে যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘আই ডিসপেন্স, ডিভাইড, অ্যাসাইন, কিপ অ্যান্ড হোল্ড’; অর্থাৎ আমি বন্টন করি, বিরোধ ঘটাই এবং নির্দেশ, সুরক্ষা ও আশ্রয় দেই। মুদ্রার এমন গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না।

কত বিচিত্রই না একেকটি মুদ্রার ইতিহাস! পরাক্রমশালী রোমান সেনাপতি জুলিয়াস সীজার বিপদে পড়েছিলেন ফ্রান্স অভিযানে গিয়ে। সিজার নিজেই বলতেন, সেখানে প্রায় হারতে বসেছিলেন তিনি। ফ্রান্স সংগঠিত দেশ নয় তখনো। ব্রিটেন জয়ের পর সিজারের ধারণা হলো, এটি আক্রমণ করি না কেন। শুরুর দিকে প্রায় বিনা বাধায় ফ্রান্সের খানিকটা অংশ জয় করলেনও। তবে এর পরই বাধা এলো ভারসিংগেটরিক্স নামে এক তরুণ গ্যল নেতার কাছ থেকে। গ্যলদের সঙ্গে ওই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সিজার জয়লাভ করেছিলেন বটে। তবে রোমান সেনাবাহিনী হতোদ্যম হয়ে পড়ে গ্যলদের সঙ্গে যুদ্ধে। সিজারও রোমে ফিরে শক্তি সঞ্চয়ের পর পুনরায় মনোযোগী হন সামরিক অভিযানে। ভারসিংগেটরিক্সের নৈপূণ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন সিজার। অবশ্য তার ফাঁসির আদেশ দেয় রোমের সিনেট। তারপর যে কারণেই হোক ভারসিংগেটরিক্সের নামে মুদ্রা চালু করেন জুলিয়াস সীজার। তার মৃত্যুর পর সিজারবিরোধীরা বাতিলও করে মুদ্রাটি। তবে কয়েকটি ফরাসি জাদুঘরে আজও সংরক্ষিত আছে ভারসিংগেটরিক্সের নামাঙ্কিত মুদ্রা।

ফরাসিদের সম্বন্ধে বলা হয়, এরা যেকোনো বস্তুকে বাইফোকাল লেন্স দিয়ে দেখে। একটি লেন্স ইতিহাস ও শিল্পকলার; অন্যটি বৈজ্ঞানিক (অধিকাংশ সময়ে গাণিতিক)। এ প্রেক্ষাপটে ফরাসিদের মুদ্রা প্রদর্শনীর বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। তাদের জাদুঘরগুলোয় মুদ্রা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এ সম্পর্কিত ইতিহাস যেমন লেখা থাকে তেমনি আগ্রহীদের জন্য মুদ্রার নানা বৈজ্ঞানিক দিকও তুলে ধরার চেষ্টা থাকে। এতে যিনি ইতিহাস পছন্দ করেন তার কাছে প্রদর্শনীকে আকর্ষণীয় মনে হয়; আবার বিজ্ঞানমনষ্করাও আগ্রহ হারান না। অনেক ফরাসি মুদ্রা প্রদর্শনীতে নাকি টস করে জাল মুদ্রা নির্ণয়ের ‘বার্নুলি ট্রায়াল’ শেখানো হয়; বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ইউলারের ‘ফিনাইট-টাইম সিঙ্গুলারিটি’ও (তত্ত্বটি ‘বিগ ব্যাং’ থিওরি রচনায় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকে অনুপ্রাণিত করেছিল) শেখানো হয় সংক্ষিপ্তাকারে। ঐতিহাসিক বস্তু প্রদর্শনকালে সেটির রেপ্লিকাসহ সিডি-ডিভিডি-বুকলেট বিক্রয় ফরাসি সংস্কৃতিতেও পরিণত হয়েছে এরই মধ্যে।

সম্প্রতি রাজধানীস্থ জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনী গ্যালারিতে শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক মুদ্রা প্রদর্শনী। বেশ কয়েকদিন ধরে চলবে এটি। এতে দেখানো হচ্ছে বাংলাদেশসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ধাতব ও কাগুজে মুদ্রা। এমন উদ্যোগের প্রশংসা না করে উপায় কী? স্থানীয় ইতিহাস এতটা সহজে জানবারই বা সুযোগ কোথায়? তবে নতুন প্রজন্মকে ব্যাপকভাবে যুক্ত করে একে আরও কার্যকরের পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে আয়োজকরা রাজধানী ও রাজধানীর আশেপাশের স্কুল থেকে শিশুদের এখানে আনার ব্যবস্থা করতে পারেন। অবশ্য স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকেও নেয়া যেতে পারে এমন উদ্যোগ। এটি করা গেলে শিশুরা সহজে ও স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধে ধারণা নিতে পারবে। এর সঙ্গে পরবর্তী মুদ্রা প্রদর্শনীতে রেপ্লিকা মুদ্রা রাখা যায় কিনা, সেটিও ভাবা যেতে পারে। তাতে ইতিহাস সম্বন্ধে মানুষের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা যাবে; বাণিজ্যও হবে খানিকটা।

রুয়াইদা হাসান

গল্পের ঘোরে বেহেড

জোর-জবরদস্তিমূলক নীল চাষের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন হয় ঢাকায়। মঞ্চে আলোক সম্পাত ছিল অপ্রতুল; শব্দ ব্যবস্থাপনাও ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের। তা সত্ত্বেও উপস্থিত ছিলেন বহু দর্শক; যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্থানীয় কৃষকের ওপর ব্রিটিশদের বর্বর নির্যাতনের দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল নাটকের এক পর্যায়ে। নিবিষ্ট মনে সেটি দেখছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। দেখতে দেখতে বাস্তবজ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়লেন তিনি। চিৎকার করে উঠলেন; জুতা ছুড়ে মারলেন নীলকরের ভূমিকায় অভিনয়কারীর মুখে। ঈশ্বরচন্দ্র যথেষ্ট যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তবুও নাটকটির দৃশ্যায়ন তাকে এতোটাই আন্দোলিত করে যে কল্পনা ও বাস্তবতাকে মিলিয়ে ফেলেন তিনি। যার পরিণাম- ওই ‘দুর্ঘটনা’।

গল্প শুনে ও সেটি বিশ্বাস করে এমনটি ঘটানোর নজির আরও রয়েছে। এ নিয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। তাতে দেখা গেছে কিছু মানুষের অদ্ভূত ক্ষমতা রয়েছে। গল্প শুনিয়ে মানুষকে আচ্ছন্ন করতে পারেন তারা। আর যিনি সম্মোহিত অবস্থায় চলে যান, পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা ভুলে যান তিনি; ওই গল্পকেই ‘প্রকৃত বাস্তব’ মনে হয় তার কাছে। মনোবিজ্ঞানে এ ক্ষমতার নাম দেয়া হয়েছে রিয়েলিটি ডিস্টর্টিং পাওয়ার। মজার বিষয়, কিছু গবেষক দেখেছেন এটি সহজাত হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আবার সরাসরি সংস্পর্শে না থেকেও বিপুল মানুষকে প্রভাবিত করতে কাউকে কাউকে অর্জনই করতে হয় এটি। যেমন রাজনৈতিক নেতা, সাধু-সন্ন্যাসী, গল্প লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক প্রভৃতি।

এমন ব্যক্তিরা সৃষ্টি করতে পারেন রিয়েলিটি ডিস্টর্শন ফিল্ড। ফলে এরা কিছু বললে, তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। এতে মনে সৃষ্টি হয় এক ধরনের ‘ডিপ ইমপালস’ বা গভীর অনুপ্রেরণা। এটি মানুষকে স্বতঃপ্রণোদিত করে তোলা ভালো-মন্দ, নিরপেক্ষ বিভিন্ন কাজে। মানসিকভাবে এসব ‘উদ্দীপ্ত’ মানুষ সমাজের উপকার করবে না ক্ষতিকর- সেটি নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। এক শ্রেণীর ‘উদ্দীপ্ত’ মানুষ সুখানুভব করেন অপরকে কষ্ট দিয়ে; অন্যরা নিজেকে বঞ্চিত করে, কষ্ট দিয়ে। রিয়েলিটি ডিস্টর্শন ফিল্ডের প্রভাবে যারা সম্মোহিত হন তারা এ থেকে বেরুতে পারেন না সাধারণত। গল্প তথা কল্পনাই তাদের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় তখন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে ক্রিস্টোফার নোলান পরিচালিত ব্যাটমান সিরিজের তৃতীয় ও সর্বশেষ ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’ ছবির প্রদর্শনী চলাকালে মুখোশধারী এক আততায়ীর গুলিতে নিহত ও আহত হন বেশ কয়েকজন। এ ঘটনায় নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখেছেন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিক্যান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বারাক ওবামা ও মিট রমনি; অনেকের বিমূঢ়তা কাটে নি এখনো। শুরতে কারও কারও শঙ্কা ছিল, আততায়ীর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্ক রয়েছে কিনা। এরই মধ্যে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তেমন কিছু নয়; নিজেকে ব্যাটম্যান সিরিজের ভিলেন ‘জোকার’ ভেবেছিলেন আততায়ী। জোকার যেমন খুন বা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর স্বাভাবিক ভঙ্গীতে বলত, হোয়াই সো সিরিয়াস, সান- তারও এমনটি বলার ইচ্ছা ছিল। তবে ‘দুর্ভাগ্য’ ডায়ালগটি দেয়ার আগেই তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

কেউ কেউ বলছেন, এ ঘটনায় বিরাট ক্ষতি হয়ে গেলো পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের (ছবিটির প্রযোজনায় যুক্ত আছেন তিনি)। কলোরাডোর ঘটনায় অনেক দেশেই ছবিটির প্রিমিয়ার স্থগিত রাখা হয়েছে এরই মধ্যে। তবে অনেকের ধারণা, এটি নোলানের এক ধরনের সাফল্যও। গল্প শুনিয়ে মানুষকে সম্মোহিত করতে পেরেছেন তিনি। অবশ্য ঘটনাটির নিন্দাই জানিয়েছেন সবাই। দোষীর বিচারের পাশাপাশি মার্কিন তরুণ সমাজের সাইকি পরিবর্তনে এসব ছায়াছবি কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে জোর গবেষণা চালানোর কথাও বলা হচ্ছে। তারা দেখতে চাইছেন, মানুষ সর্বোচ্চ কতটা রিয়েলিটি ডিস্টর্শন পাওয়ার অর্জন করতে পারে। আর ওই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে গল্পের ঘোরে বেহেড মানুষকে ক্ষতিকর কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা যায় কিনা।

ফাহমিদা ফেরদৌস

নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে নকিয়া!

ফিনিশ প্রতিষ্ঠান নকিয়ার যাত্রা ১৮৬৫ সালে। কোম্পানীটি ১৯৭০’র দশকে তৈরি করে প্রথম নেটওয়ার্কিং ডিভাইস নকিয়া ডিএক্স২০০। সাড়া জাগাতে পারে নি সেটি। ১৯৯২ সালে বিক্রির হিড়িক পড়ে যায় প্রথম জিএসএম সেলফোন নকিয়া১০১১ বাজারে এলে। তবে প্রতিষ্ঠানটি অভূতপূর্ব সাড়া পায় নকিয়া ১১০০ মডেলে। এটি দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেক সেলফোন ব্যবহারকারীরই প্রথম ফোনোসেট; বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রিত সেলফোনের মডেলও নাকি এ ১১০০। এ মডেলটির সঙ্গে সঙ্গে সেলফোনের বাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে নকিয়া। এখনো প্রায় লক্ষাধিক মানুষ কাজ করছে এতে। তারা ফোনসেট বিক্রি করছে ১৫০টি দেশে। এরই মধ্যে পরিবেশ দূষণ রোধে ইতিবাচক ভূমিকার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও লাভ করেছে তারা; পেয়েছে এনার্জি স্টার (অনেকের মতে এটি শক্তি বা জ্বালানি দক্ষতা নির্ণয়ের সর্বোচ্চ মানদণ্ড) সার্টিফিকেট। তারপরও বিশেষত বছরদুয়েক ধরে নকিয়া তেমন সুবিধা করতে পারছে না বাজারে। কর্মী ছাটাই অব্যাহত রয়েছে; বন্ধ করা হয়েছে অনেক আউটলেট। নামছে হেলসিংকি, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নকিয়ার শেয়ারদর। স্পষ্টত নানা পদক্ষেপ নিয়েও লোকসান থামানো যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলেন, তার কারণ মূল সমস্যার দিকে নজর দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।

প্রথম সমস্যা হলো, ব্যবসা বেশি বড় হয়ে পড়ায় খুঁটিনাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই দৃষ্টি দিতে পারছে না নকিয়া। ১৯৯০’র দশকে সেলফোনের বাজারে আসার পর তাদের দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সনি-এরিকসন, সিমেন্স ও মটোরোলা। পরবর্তীতে নকিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে সিমেন্সের; গড়ে তোলা হয় নকিয়া-সিমেন্স নেটওয়ার্ক নামের যৌথ উদ্যোগ। এরই মধ্যে নকিয়ার বাজার বাড়ছিল; ধীরে ধীরে কমছিল মটোরোলা ও সনি-এরিকসন সেলফোন বিক্রি। তখন স্যামসাং মোবাইলস বাজারে এসেই প্রধানত বাহারী স্মার্টফোন দিয়ে এক রকম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় নকিয়ার সামনে। তবে এদিকে দৃষ্টি দেয়ার আগেই ২০০৭ সালে বাজার মাত করে তোলে আইফোন। উচিৎ ছিল, অ্যাপলের সঙ্গে শত্রুতায় না গিয়ে স্যামসাংয়ের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। তা না করে আইফোনের গায়ে দাঁত বসাতে গিয়েই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় নকিয়া। অ্যাপলের বাজার বাড়তে থাকে; যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপে সংকুচিত হয় নকিয়ার বাজার। তার স্থান দখলে এগিয়ে আসে স্যামসাং।

নকিয়ার দ্বিতীয় সমস্যা, ‘বন্ধু’ মাইক্রোসফট। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে উইন্ডোজ ফোন তৈরির চুক্তি হয় ২০১১ সালে। তবে প্রায় সব বাজারেই কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে ব্যর্থ হয় নকিয়া লুমিয়া। নকিয়া মোবাইলসের ওপর আগেই ছিল মাইক্রোসফটের নজর। এ ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র তত্ত্বও রয়েছে। মাইক্রোসফট নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে নকিয়াকে বিপদে ফেলে দিয়েছে যাতে কম দামেই কেনা যায় এটিকে। এর সত্যতা জানার উপায় নেই। অবশ্য নকিয়া মোবাইলস কিনতে দুইবার প্রস্তাব দেয়া হয় মাইক্রোসফটের পক্ষে থেকে। তৃতীয় সমস্যা, নকিয়া সিমেন্স নেটওয়ার্ক কেলেংকারি। এ প্রতিষ্ঠানটি নাকি ইরানের বাজারে নকিয়া মোবাইলসকে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দিতে স্থানীয় বৃহত্তম সেলফোন অপারেটরের কাছে বিক্রি করে সিপিআই প্রযুক্তি। এর সহায়তায় নজরদারী থেকে শুরু করে সেলফোন ব্যবহারকারীর তথ্যও পরিবর্তন করা সম্ভব। ঘটনাটি ফাঁস হয়ে পড়লে দ্রুত পড়তে থাকে বিশেষত নকিয়া স্মার্টফোনের বিক্রি। অনেক ক্রেতাই ভুল ধারণা পোষণ করতে থাকেন- নকিয়া কিনলেই প্রাইভেসী থাকবে না।

প্রশ্ন হলো, এমন পরিস্থিতি আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারবে কিনা নকিয়া? পারলেও কেমন সময় লাগবে? অনেকে মনে করেন, দুটি পথে হৃত বাজার পুনুরুদ্ধার করতে পারে নকিয়া। এক. স্যামসাংয়ের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে গিয়ে। দুই. উইন্ডোজ মোবাইল দিয়ে বাজার মাত করার আশা পরিত্যাগ করে অ্যান্ড্রয়েড সেলফোন উৎপাদনের মাধ্যমে। এর জন্য সময় লাগবে কিছুটা। নকিয়ার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ‘যেভাবেই’ হোক বছরখানেকের মধ্যেই পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে নকিয়া। এ প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সংশয় অবশ্য রয়েছে কারও কারও।

ফাহমিদা ফেরদৌস

বিবর্তনের ধারায় টেলিভিশন

রোববারের বণিক বার্তায় খবর রয়েছে, দেশে সিআরটি টেলিভিশন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ অর্থনৈতিক বিবর্তনে (মানুষের চাহিদার প্রেক্ষিতে) অভিযোজন ঘটাতে পারছে না এটি; ক্রমেই পরিণত হচ্ছে অলাভজনক প্রযুক্তিতে। এর স্থান করে নিচ্ছে এলসিডি-এলইডি-প্লাজমা টিভি। এতদিন সিং ভাগ সিআরটি আমদানি করা হতো মালয়েশিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের একটি বন্ধ হয়েছে মার্চে। আরেকটি সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যবসা গুটাবে বলে ঘোষণা রয়েছে। স্থানীয়ভাবে সিআরটি উৎপাদন করা হয়তো যেতো। কিন্তু এ দেশেও সিআরটি টিভির জনপ্রিয়তা পড়তির দিকে। নতুন প্রজন্ম ঝুঁকছে এলসিডি-এলইডি-প্লাজমা টিভি কেনায়।

ডারউইন বলেছিলেন, প্রকৃতিতে টিকে থাকে কেবল যোগ্যতমই। দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের এ তত্ত্বটি প্রাযুক্তিক বিবর্তনেও প্রযোজ্য। রঙ্গিন সিআরটি টিভির এক রকম ভক্তই ছিল ১৯৮০-৯০ দশকের প্রজন্ম। এদিকে রুচির বিবর্তনে একবিংশ শতাব্দীতে এসে ধীরে ধীরে সরে পড়ছে এটি। স্লিম ও ফ্ল্যাট এলসিডি-এলইডির সামনে টিকতে পারছে না পুরনো যুগের মোটা, ভারী ও বেশি জায়গা দখলকারী সিআরটি। আরও কয়েকটি কারণে রয়েছে সিআরটি টিভির এমন প্রস্থানের। টিভিতে যে ধরনের কাচ ব্যবহৃত হয়, সেটি বাঁকিয়ে ৩০ ইঞ্চির বেশি ডিসপ্লে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। তার মানে, এ দৈর্ঘ্যের বেশি সিআরটি মনিটর বানানো যায় না। এদিকে সাম্প্রতিককালে ৩০ ইঞ্চির বেশি টিভি না থাকাটাই অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিবিমুখতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। সিআরটি থেকে উচ্চমাত্রার তরঙ্গ বিকরিত হয়, যেটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপর এ ধরনের টিভির গড় আয়ু কম। নিকট অতীতে বিদ্যুতের নতুন সংযোগ নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হতো। তবে লোডশেডিং নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না; টিভিতে কতটা বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে সেদিকেও দৃষ্টি ছিল না অধিকাংশেরই। এসব বিবেচনায় কিন্তু সিআরটির চেয়ে উপযুক্ত এলসিডি-প্লাজমা টিভি। আরেকটি বিষয় রয়েছে। তাহলো, পরিবেশ সচেতনতা। সিআরটির যুগে বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও পণ্যের পুনঃব্যবহারযোগ্যতা- এসব শব্দের ব্যবহার ছিল না তেমন। ফলে সিআরটির পুনঃব্যবহারযোগ্যতা আছে কিনা বা এর ইলেক্ট্রন গান বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি করছে না- কে ভাবতেন! আর এখন প্রযুক্তিপণ্য কিনতে গেলে অনেকে প্রথমেই বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে- এ টিভি-ফ্রিজ পরিবেশবান্ধব তো?

এসব সত্ত্বেও কিছু কিছু মানুষের মন থেকে কখনোই হারিয়ে যাবে না স্মৃতিময় সিআরটি টিভি। তাদের কাছে আসলে টিভি বা রঙ্গিন টিভি বলতে তো তা-ই। অবশ্য ভাষার বিবর্তনের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে, অধিকাংশ মানুষ এখনো টিভি বলতে সিআরটি ডিসপ্লেকে বুঝে থাকেন। বলার সময় তারা সিআরটিকে এমনভাবে উল্লেখ করেন যাতে মনে হয় এলসিডি-প্লাজমা, টিভি নয়- ভিন্ন কিছু। ফলে বাজার থেকে হারিয়ে গেলেও সিআরটি রয়ে যাবে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের অমোচনীয় চিহ্ন। এর থাকাটা কেমন হবে, সে বিষয়ে অনুমান করা যায়। ফাউন্টেন পেনের চল উঠে গেলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ব্যাকরণ বইতে রচনা দেখা যেতো- ‘একটি ফাউন্টেন পেনের আত্মজীবনী’। সিআরটি বিলুপ্ত হলেও এটি ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য লেখা থাকবে- একটি রঙ্গিন টিভির আত্মকাহিনী।

এটি ছাড়াও ভিন্ন রূপে কিন্তু সিআরটি প্রযুক্তি তার ব্যবহারোপযোগীতা প্রমাণ করতে পারে। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুসারে, প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটলেও একেবারে ধ্বংস হয় না। বরং পিছিয়ে পড়া অনেক প্রজাতি কিছু ক্ষেত্রে হাজির হয় নতুন কিছু নিয়ে। সিআরটির ক্ষেত্রেও এটি ঘটতে পারে। কারণ এলসিডি-প্লাজমার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা রয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে সিআরটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যেমন কয়েক বছর চলার পর এগুলোর রঙ ফিকে হয়ে আসে; টিভি পুরোপুরি চালু হতেও কিছু সময় লেগে যায়। এ ক্ষেত্রে সিআরটি ডিসপ্লের ইনপুট লেগ সামান্যই। আবার সিআরটি টিভির সমমানের অ্যাসপেক্ট রেশিও আছে খুব কম এলসিডি-এলইডি-প্লাজমার। ছবি জীবন্ত মনে হবে কিনা সেটি কিন্তু নির্ভর করে কোন টিভির অ্যাসপেক্ট রেশিও কত বেশি, তার ওপর। এসব চিন্তা করলে মনে হয় সিআরটি টিভি হয়তো আগামীতে আবার ফিরে আসবে; স্লিম ফিগার ও দীর্ঘায়ু নিয়ে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সহকারে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

হাসির খবর

হেরোটোডাসের পরিচিতি মূলত- ইতিহাসের জনক। তবে নিজেকে দার্শনিক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টাই তিনি করতেন বেশি। তার ব্যক্তিত্বটা ছিল সিরিয়াস ধরনের। হাসি-ঠাট্টা তেমনটা পছন্দ করতেন না; হাস্যোৎফুল্ল মানুষকে দেখতেন অবজ্ঞার চোখে। তার মতে তিনটি কারণে হাসতে পারে মানুষ। এক. ঘাবড়ে গিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্দেহভাজন ব্যক্তি অপরাধী নন- কিন্তু নিজের ওপর তেমন আস্থাও নেই তার। ফলে অভিযোগ তোলা হলে অনেক সময় ঘাবড়ে গিয়ে তারা হাসেন নার্ভাস হাসি। দুই. পাগলামীর কারণে। হেরাটোডাসের মতে, এ ধরনের হাসি নিয়ে চিন্তা করাও অনর্থক। তার পর্যবেক্ষণে তৃতীয় যে কারণে মানুষ হাসে তা হলো- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।

হেরাটোডাসের যুগে হাসিকে দেখা হতো মানুষের হালকা ও নেতিবাচক আবেগ হিসেবে। যে কারণে অ্যারিস্টটল তার ‘পোয়েটিকস’ বইতেও লিখেছেন- ট্রাজেডী হচ্ছে উচ্চতর আবেগ। আর কমেডী? অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিতে- ভাঁড়ামোতাড়িত রাগ মোচন। অবশ্য তিনি মানব সমাজে হাসির প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তাতে। এটির দার্শনিক ও সামাজিক গুরুত্ব বাড়ে ইংল্যান্ডে আলোকিত যুগ চলাকালে। দার্শনিক টমাস হবস উচ্চ প্রশংসা করে লেখেন, হাসি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কৌশল; এটি ব্যক্তির নিজের ওপর আস্থাশীলতারও প্রমাণ। হবসের মতকে এগিয়ে নেন জার্মান দার্শনিক শোপেনআওয়ার। তার প্রসিদ্ধ বই ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড রিপ্রেজেন্টেজশন’-এ হাসি সংক্রান্ত দীর্ঘ অধ্যায় লেখার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে নীটশে আরেক ধাপ এগিয়ে ঘোষণা করেন, হাসির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। যুক্তি ও নৈতিকতার আবদ্ধে ক্লান্ত মানুষ থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করে ইতিবাচক হাসিকে। এদিকে অপরের দুর্দশায় অনেকে যে হাসি হাসেন, সেটিই হলো নেতিবাচক। এমন হাসি সমাজে সাংঘর্ষিক উপাদান বাড়িয়ে তোলে।

হাসি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তার বেশ কিছু মজার পর্বেক্ষণ রয়েছে এ ক্ষেত্রে। যেমন, শিশুরা দৈনিক (এমনকি ঘুমিয়েও) হাসে গড়ে ৩০০ বার; প্রাপ্তবয়স্করা ২০ বার। সে ক্ষেত্রে হাসির মাত্রা ও কম্পাংক (দিনে কতবার) আবার নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। হাসি নিয়ে ফ্রয়েডের একটি বিখ্যাত তত্ত্ব রয়েছে যাকে বলে ‘রিলিফ থিওরি’। এতে তিনি বলেছেন, হাসির মাধ্যমে দুশ্চিন্তা ও সাইকিক এনার্জি (যে শক্তি মানকে উত্তপ্ত করে তোলে) থেকে মুক্ত হয় মানুষ; মনের অবচেতনে। এ তত্ত্ব প্রকাশের পর থেকে হাসি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের মনোভাব পরিবর্তিত হয় অনেকটাই। তারা বোঝার চেষ্টা করেন, হাসির সঙ্গে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক আসলে কতটুকু; হাসিকে কাজে লাগিয়ে মনোরোগের প্রতিরোধ ও আরোগ্য সম্ভব কিনা প্রভৃতি। এদিকে হাসি নিয়ে ভিন্ন ধরনের গবেষণাও শুরু হয় রিলিফ থিওরি প্রকাশের পর। কেউ কেউ বোঝার চেষ্টা করেন- মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী হাসে কিনা। সমস্যা হলো, মানুষের হাসি সহজেই বোঝা যায়। অন্যদের হাসি চিহ্নিতকরণের উপায় কী? শেষ পর্যন্ত অনেক পরিশ্রমের পর এক ধরনের সনোগ্রাফ আবিষ্কৃত হয়েছে, যে যন্ত্রটি বিশ্লেষণ করে দেখেছে মানুষ বাদে ইঁদুর ও কুকুরাও হাসে। নানা মিথ থাকলেও এ পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিতভাবে ফেল করে হায়েনা। এক সময় হাসি গবেষণায় এগিয়ে আসেন ভাষাবিদরা। তারা দেখেন, মানুষের হাসির সাধারণ প্যাটার্ন হলো দুটি। এক. ‘হা হা হা’; দুই. ‘হো হো হো’। তবে তারা বিশ্লেষণ করে পান, ওই দুটি ছাড়া ‘হা হা হো’ বা ‘হো হো হা’ করেও হাসতে পারে মানুষ। তবে স্বরতন্ত্রের গঠনই এমন যে, ‘হা হো হা হো’ শব্দ করে হাসা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।

সম্প্রতি ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী গবেষণায় দেখেছন, প্রকৃতপক্ষে হাসির উৎপত্তি মস্তিষ্কের অনেক গভীরে সাবকর্টেক্স অঞ্চলে যেটি আবার নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের রিফলেক্স অ্যাকশন, ভাষাজ্ঞান ও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ যৌক্তিকবোধ। আবার নিরাপদ উত্তেজক দ্রব্য প্রয়োগ করে এটির দক্ষতা বাড়ানো-কমানো সম্ভব। এ গবেষণার মধ্যে দিয়ে অবসাদগ্রস্ততা, অনিদ্রা, আলঝেইমারের মতো রোগ প্রতিরোধ নিয়ে একসঙ্গে কয়েক ধাপ পেরোলেন বিজ্ঞানীরা। তাদের প্রত্যাশা, গবেষণাটি সঠিকভাবে চললে আগামীতে অনেক মনোরোগেরই সহজ চিকিৎসা পদ্ধতি মিলবে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

স্থানিক সংক্রমণের আর্থিক ঝুঁকি

প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার ভাইরাস ছিল চলৎশক্তিহীন। এ যুগের ভাইরাস-ম্যালওয়ার চলাফেরায় সক্ষম; কয়েকটিতে রয়েছে উচ্চতর বুদ্ধিমত্তাও। সাম্প্রতিককালের ফ্লেইম ম্যালওয়ারের কথা ধরা যাক। একে বলা যেতে পারে উচ্চপ্রশিক্ষত ও ছদ্মবেশী স্পাই। সাধারণত ভাইরাস-ম্যালওয়ারের কোডিং হয় জটিল ও বড়। এ ক্ষেত্রেও স্বতন্ত্র ফ্লেইম; তার কোডিং লম্বা নয় মোটেই।

প্রস্তুতকারীরা অনেক সময় এমন সব ভাইরাস-ম্যালওয়ার তৈরি করেন যেটিকে তুলনা করা যায় চাঁদাবাজি করতে যুদ্ধাস্ত্রসহ কোনো সন্ত্রাসীকে পাঠানোর সঙ্গে। এরা ইন্টারনেটের শৃঙ্খলা দায়িত্বে নিয়োজিত সাইবার পুলিশের চোখে পড়ে যায় সহজে। আর অপরাধ সংগঠিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এগুলোকে নেয়া হয় রিমাণ্ডে তথা নিরাপদ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। সেখানে বাস্তব জগতের মতো জেরা হয় না; কোড খুলে বিশ্লেষণ করা হয় কেবল। এর মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয় হোতাকে। কাজটি কঠিন কিছু নয়। বর্তমানের সাইবার পুলিশের অধিকাংশই হয় ‘অবসারপ্রাপ্ত’ হ্যাকার নয়তো কোড অ্যানালিস্ট। আবার সাইবার অপরাধীদের মাঝে তাদের সোর্সও রয়েছে। এসব অপরাধীরা একাকী কাজ করতে পারে না বাস্তব জগতের মতোই। ১৯৮০’র দশকে স্টিভ ওজনিয়াকের সভাপতিত্বে ক্যালিফোর্নিয়ায় হ্যাকারদের বিরাট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অবশ্য তখন বিষয়টিকে সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো না। অপরের ক্ষতি করার ইচ্ছাও ছিল না ওজনিয়াকদের। পরবর্তীতে একশ্রেণীর কোড অ্যানালিস্ট সাইবার অপরাধী হয়ে উঠলেই কঠোর অবস্থান নেয় মার্কিন সরকার। এতে অধিকাংশ হ্যাকার আশ্রয় নেয় আন্ডারগ্রাউন্ডে (বাস্তবিক অর্থেও); গড়ে তোলে অনেকগুলো হ্যাকার ক্লাব। আর এসব স্থানেই রাখা হয়ে সাইবার পুলিশ সোর্স। এদের কাজ হলো, অপরাধ কার্যক্রম ও অপরাধীর গতিবিধির ওপর নজর রাখা। তারা নিয়মিত রিপোর্ট করে কোন হ্যাকার কী ধরনের কোড লিখতে পছন্দ করেন প্রভৃতি; যেমন করে ছিনতাইয়ের ধরন দেখে পুলিশ ধারণা করে নেয়- কে হতে পারে সম্ভাব্য অপরাধী? এভাবে ভাইরাস-ম্যালওয়ারকে রিমান্ডে নেয়ার পর সেটির প্রস্তুতকারককে সাইবার পুলিশের পক্ষে বের করা কঠিন নয়। এ ক্ষেত্রে অপরাধীর আস্তানাও চিহ্নিত করা হয় অপরাধ উৎসের রিয়েল আইপি অ্যাড্রেস লোকেটের মাধ্যমে। এ সহজ হিসাবটি ফ্লেইমের ক্ষেত্রে মোটামুটি অচল। কারণ সাইবার পুলিশ কেবল নয় ম্যালওয়ারটিকে দীর্ঘদিন গোপনে পর্যবেক্ষণ না করলে ঝানু সিস্টেম অ্যানালিস্টের পক্ষেও বোঝা কঠিন- এটি ক্ষতিকর না নিরীহ।

আকস্মিকভাবে ইরানে ফ্লেইম আবিষ্কার করে ইন্টারনেট সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি। এটির প্রস্তুতকারকে চিহ্নিত করা যায় নি এখনো। কয়েক দিন আগে এটির আরও অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে। কোড অ্যালিস্টরা ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে ইন্টারনেটের সংস্পর্শে আনতেই দেখা গেলো ম্যালওয়ারটি আত্মহত্যা করছে অর্থাৎ নিজেই নিজেকে ধংস করে ফেলছে। তার মানে এটির প্রস্তুতকারক ধরা পড়ার ভয়ে পরবর্তীতে সুইসাইডাল কোডও দিয়ে রেখেছিল ইন্টারনেটে।

ম্যালওয়ারটির কার্যক্রম আর্থিক তো বটেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে কয়েকটি শক্তিশালী সার্চ ইঞ্জিন ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং প্রতিষ্ঠানের মনে। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে নেটওয়ার্কনির্ভর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে যতটা প্রচেষ্টা নিতে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা ততটাই উদাসীন বলে ধারণা। অথচ বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফ্লেইমের মতো ম্যালওয়ার ঘটাতে পারে অকল্পনীয় ক্ষতি। এরই মধ্যে শুক্রবারের বণিক বার্তায় খবর রয়েছে, ভাইরাস ও ম্যালওয়্যারের স্থানীয় আক্রমণের ঝুঁকির দিক থেকে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। একে ‘আঞ্চলিক সংক্রমণ’ বলেও উল্লেখ করা যেতে পারে। আঞ্চলিক হলেও অস্বীকার করা যায় না, যতটা সতর্কভাবে অপারেটিং সিস্টেম, ওয়েব ব্রাউজার ও ইমেইল ব্যবহার করা উচিৎ, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তা করি না আমরা। অনেক দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও রাখা হয় ফায়ারওয়াল ব্যবস্থা। এ ধরনের উদ্যোগ কম এখানে। দ্রুত এসব গাফিলতি দূর করা প্রয়োজন। অতীতে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ‘স্ট্রোক’ শব্দটির সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষের পরিচয় ছিল না। সে সময় এতে কারও মৃত্যু হলে সেটিকে দেখা হতো খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও আকস্মিক মৃত্যু হিসেবে। নিরাপত্তা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন না থাকলে এটি ঘটতে পারে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও।

ফাহমিদা ফেরদৌস

চাঁদে ভ্রমণ,বাণিজ্য না দুটোই?

শূন্যে ভাসার আকাঙ্ক্ষা মানুষের অতিপ্রাচীন। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভারতীয় সভ্যতার নানা শিল্পকলার এর প্রমাণ রয়েছে অনেক। সম্ভবত এ আকাঙ্ক্ষা বেশি ছিল মায়া, ইনকা ও অ্যাজটেকদের। দশকখানেক আগে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেন এরিক ফন দানিকেন। তিনি প্রমাণের চেষ্টা করেন, মায়া-ইনকাদের দেবদেবীরা আসলে ছিলেন অ্যালিয়েন। দানিকেনের এ তত্ত্বের সঙ্গে মোটেই একমত নন মূলধারার প্রত্নো-ঐতিহাসিক ও প্রযুক্তিবিদরা। তারা বলেন, দানিকেন বুঝতে ভুল করেছেন, মায়া-ইনকা সভ্যতায় প্রাপ্ত ওসব দেবদেবীর শিল্পকলা কোনো অ্যালিয়েনের ছবি নয়; প্রাচীন মানুষের শূন্যে ভাসার আকাঙ্ক্ষাটিরই চিত্রিত রূপ!

বিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য প্রথম নাইটহুড পান স্যার আইজ্যাক নিউটন। শূন্যে ভাসার আকাঙ্ক্ষা ছিল তারও। আসলেই তা সম্ভব কিনা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্রিটিশ নেভির গোলাবর্ষণ পর্যবেক্ষণ করে তার বিশ্লেষণ দেখান ন্যাচারালিস প্রিনকিপিয়া ফিলোসোফিয়া ম্যাথমেটিকাতে। এতেই প্রথম নিউটন চালু করেন একটি শব্দ- ‘জিরো জি’ (জিরো গ্রাভিটেশনাল ফেনোমেনন)। অংক করে তিনি দেখান, ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার ফুট ওপরে যেতে পারলেও যেকোনো দর্শনার্থী শূন্য মাধ্যাকর্ষ শক্তি তথা বাতাসে ভেসে থাকার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন। বলাবাহুল্য, ওই সময়ে নিউটনের জিরো জি’র চিন্তা ছিল স্রেফ পাগলামি। বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে অনেক উঁচুতে উড্ডয়নে সক্ষম বিমান আবিষ্কারের পর। প্রথমে রাশিয়ান ও আমেরিকানরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মূলত নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা বিশ্বকে দেখাতেই শুরু করে মহাকাশ যাত্রা। বাণিজ্যিকভাবে প্রধানত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মহাকাশ যাত্রা শুরু হয় একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে; ভার্জিন গ্যালাকটিকোর ‘জিরো জি’ সেবার মধ্য দিয়ে। এখন আরেক মহাশূন্য ভ্রমণ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সও নাকি চালু করতে চাইছে একই ধরনের ট্রিপ। এরই মধ্যে সোমবারের বণিক বার্তায় খবর এলো, ২০১৫ সাল থেকে ১৫ কোটি ডলারে চাঁদে যাওয়ার টিকেট বিক্রির সম্ভাবনাটি যাচাই করে দেখছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এক্সক্যালিবার অ্যালমাজ। তবে ভার্জিন গ্যালাকটিকোর চেয়ে এক্সক্যালিবারের টিকেটের দাম অত্যাধিক বেশি। এছাড়া ‘জিরো জি’ অভিজ্ঞতা যত মোহনীয় কল্পনা করা হয়, বিষয়টি ততটা মজারও নয়। অনেকে এও বলেন, ভারজিন গ্যালাকটিকোতে চড়ার চেয়ে উচ্চগতির রোলার কোস্টারে ওঠা ভালো। সে ক্ষেত্রে এক্সক্যালিবারের টিকেটের দাম এত বেশি হওয়ার কারণ কী? প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা গ্যালাক্টিকোর মতো শুধু চন্দ্রপৃষ্ঠ দেখিয়েই ভ্রমণকারীদের ‘তৃপ্ত’ করতে চাইছে না; চাঁদের মাটিতে পর্যটকদের পা ছোঁয়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। এতে খরচটা তো বেশি পড়বেই! এ ক্ষেত্রে বাকি প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, এক্সক্যালিবার কী চাঁদের মাটিতে পর্যটকদের পা ছোঁয়াবে নাকি সেখানে রেখেও আসবে তাদের? ডজনখানেক মানুষের জন্যও যে ধরনের লেস (এলইএস বা লুনার এস্কেপ সিস্টেম) দরকার সেটিও কী আছে প্রতিষ্ঠানটিতে? অগ্রাহ্য করার মতো নয় এসব যুক্তি।

পর্যটকের কাছে যেমনই মনে হোক, মহাকাশ পর্যটনকে নিছক বিনোদন হিসেবে দেখতে চান না অধিকাংশ বিজ্ঞানী। তাদের কাছে বিষয়টি অনেকটা, ক্যাপ্টেন জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়া ‘ভ্রমণে’র শামিল। আগামী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে খনিজ সম্পদের সঙ্কটে ভুগবে পৃথিবী। আর চাঁদে রয়েছে সহজে উত্তোলনযোগ্য (ও পরিবহনের প্রায় অযোগ্য) লোভনীয় সব খনিজ পদার্থ। ধাতু উত্তোলনের লক্ষ্যেই নাকি কয়েক বছর আগে সীমিত পরিসরে চাঁদের জমি নিলামে তোলে নাসা। তাদের বক্তব্য, সেখানে জ্বালানি পাওয়া গেলে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকিয়ে রাখা যাবে। পরে কয়েকজন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের স্পেস-টাইম কার্ভেচার থিওরি উদ্ধৃত করে বলেন, মানব সভ্যতার ‘বৃহত্তর স্বার্থে’র খাতিরে উচিৎ হবে না চাঁদ থেকে খনিজ পদার্থের আহরণ। বরং পৃথিবীতে থেকে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেই কী করে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়া যায়, সেসব পদ্ধতি খুঁজতে হবে। কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলছেন, এ দুই পথেই অগ্রসর হওয়া যাক- জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের উপায় খোঁজা হোক; পাশাপাশি অতিমূল্যবান কিছু ধাতু আহরণ করা হোক চাঁদ থেকে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

দুর্ভোগে চট্টগ্রাম

অতিবর্ষণজনিত ভূমিধসের আশঙ্কা করা হয়েছিল গতকালের বণিক বার্তার সম্পাদকীয়তে। মর্মান্তিক যে, এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারে ভূমিধসে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির খবর মিলেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সিংহভাগই আবার দরিদ্র জনগোষ্ঠী। পরিস্থিতি এমন যে, তাদের সান্ত্বনা জানানোর মতো অবস্থাও নেই এখন। এ ক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে পর্যাপ্ত উদ্ধার ও ত্রাণ কার্য অব্যাহত রাখা দরকার। একই সঙ্গে উপদ্রুত এলাকাবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়েও সরিয়ে ফেলতে হবে।

২০০৭ সালের ১১ই জুন প্রায় একই ধরনের ভূমিধস ঘটে চট্টগ্রামে। সে সময়ে অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছিলেন, পাহাড় থেকে অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটা এবং সে স্থানে পাহাড়ী জমির উপযোগী ভূমিক্ষয় প্রতিরোধী বৃক্ষ রোপন করা না হলে অতিবর্ষণজনিত ভূমিধস রোধ করা কঠিন। এছাড়া কাটা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানরতদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরামর্শও দেন তারা। সত্য যে, আমাদের মতো দেশে যেখানে বাসযোগ্য জমির দুষ্প্রাপ্যতা রয়েছে, সেখানে পুনর্বাসনের বিষয়টি সহজ নয়। এটি বাদ দিয়ে অন্যান্য উপায় অবলম্বন করলেও হয়তো ভূমিধস রোধ করা যেতো। অথচ ২০০৭ সালের দুর্ঘটনার পরও এ ক্ষেত্রে যে উদাসীনতা দেখানো হয়েছে, তার প্রমাণ চট্টগ্রাম বিভাগের একাধিক স্থানে এ সাম্প্রতিক ভূমিধস। শোনা যায়, কেউ কেউ পাহাড়ের পাশে কংক্রিটের দেয়াল তৈরি করে বাসিন্দাদের এ বলে আশ্বস্ত করতে চাইছিলেন যে, স্থানটি অনিরাপদ নয়। আর সে কারণেই নাকি প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হলেও অনেকে ওসব ঝুঁকিপূর্ণ বাসস্থান ছেড়ে যান নি। যারা কংক্রিটের দেয়াল তৈরি করেছিলেন নিঃসন্দেহে সেটি ইতিবাচক মোটিভেশন থেকেই করা হয়েছিল। তারা সম্ভব জানতেন না, অতিবর্ষণে কাদামাটিতে একবার বড় আকারে ধস দেখা দিলে সেটিকে সাধারণ কংক্রিট দিয়ে রোধ করা প্রায় অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো, এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে একেবারেই না থাকা। থাকলেও পাহাড়ের কাটা স্থানে পর্যাপ্ত ভূমিক্ষয়রোধী বৃক্ষ রয়েছে কিনা, সেটি নিশ্চিত করা। এগুলো যথাযথভাবে করা হলে হয়তো জানমালের এত ক্ষয়-ক্ষতি দেখতে হতো না আমাদের। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এদিকে জরুরিভিত্তিতে দৃষ্টি দিতে হবে। এরই মধ্যে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন তাদের ভোগান্তি লাঘবের প্রতিও খেয়াল রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে উদ্ধার ও ত্রাণকার্য বিষয়ে চলনসই ধারণা দিতে হবে স্বেচ্ছাসেবকদেরও।

টানা ছয় দিনের রেকর্ড বর্ষণে বন্দরনগরী জলাবদ্ধতা বিরাজ করছে এখনো। জলাবদ্ধতায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম; বজ্র ও বিদ্যুতে স্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে এটি। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখায় বাড়ছে জনদুর্ভোগ। রানওয়েতে পানি ওঠায় সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে বিমান চলাচল। সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রায় অচল; একই পরিস্থিতি সমুদ্রবন্দরেরও। এদিকে পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে আসার খবর মিলছে না। বরং আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, অতিবর্ষণ চলতে পারে আরও কয়েকদিন। এ অবস্থায় বন্দরনগরীর প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে- জলাবদ্ধতা। যদিও ধীরে ধীরে পানি নেমে যাচ্ছে তবুও এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাহীন পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা লক্ষ্যণীয়। নানা তরফ থেকে বারবার বলা সত্ত্বেও এবং সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার পরও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ নগরীতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কী করে- বোঝা মুশকিল। অন্যান্য বিভাগীয় শহরে যখন দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার ঘটনা কমে এসেছে তখন চট্টগ্রামের এমন ঘটনা দুর্ভাগ্যজনকও বটে। সত্য যে, কয়েকদিন ধরে নগরীতে রেকর্ড বর্ষণ হয়েছে; আবার পানি নিষ্কাশনে সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তুতিরও ঘাটতি ছিল। এ ক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার সঙ্গে সঙ্গে পচনশীল ও অপচনশীল আবর্জনার মিশ্রণও অধিক স্থায়ী জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী বলে জানা যায়। এটি দূরীকরণে সিটি করপোরেশন তো বটেই জনসচেতনতাও বাড়িয়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে নগরোন্নয়নে সিটি কর্পোরেশন ও এর বাসিন্দাদের কমিটেড থাকারও কোনো বিকল্প নেই।

পুতিন-যুগের তৃতীয় পর্ব

গত বছর ডিসেম্বরে রাশিয়ার পার্লামেন্টারি ইলেকশনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ভ্লাদিমির পুতিন নিয়ন্ত্রিত ইউনাইটেড রাশিয়া। এ নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল দেশটির অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলে। পুতিনবিরোধীরা প্রহসনমূলক নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেন এটিকে। ফেসবুক, টুইটারের মতো কিছু সাইটতে পার্লামেন্টারি ইলেকশনে কারসাজি হয়েছে বলেও জনমত গঠনের চেষ্টা করা হয়। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রেমলিনের সামনে বিক্ষোভও প্রকাশ করেন কিছু মানুষ। এরই মধ্যে পুতিন ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তৃতীয়বারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে চান তিনি। সমালোচকরা ভেবেছিলেন, পুতিনের দিন শেষ; ২০১২ সালের নির্বাচনটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। ঘটনা ঘটে গেলো এর উল্টো। ৩ মার্চ ৯৯ শতাংশ রাশিয়ান ভোট দিলেন প্রেসিডেনশীয়াল ইলেকশনে; এর মধ্যে পুতিন পেলেন ৬৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের প্রবেশানুমতি না মিললেও এ নির্বাচনে ব্যাপক কারসাজি হয়েছে- এমন অভিযোগ বিরোধীরাও তেমন জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। তাদের কেউ কেউ বলছেন, পুতিন ভয় দেখিয়ে ভোট কেড়েছেন। আবার কারও কারও মতে, সূক্ষ্ম-কারচুপি হয়েছে এতে। রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে কিছু ঘাটতি হয়তো ছিল পুতিনবিরোধীদের। তাহল, শহরে পুতিন ইমেজ ততটা মহিমান্বিত না হলেও রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে তিনি বেশ জনপ্রিয়। এসব ভোটারা ঝেঁকে ভোট দিয়েছেন পুতিনকে। তাদের অনেকের ধারণা, বিশ্বের বুকে অতীতের মত বুক উঁচিয়ে চলতে চাইলে রাশিয়ায় পুতিনের শাসন দরকার।

এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক- পরপর দুইবার প্রেসিডেন্ট থাকার পরও আবার কেন ক্ষমতায় আসতে চান পুতিন? সমালোচকরা বলছেন, একে ক্ষমতার লোভ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। পুতিনের মতো হলো, তিনি দেশে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিকতা দেখতে চেয়েছিলেন, সে কাজ সম্পূর্ণ হয় নি। ফলে ক্রেমলিনে আসতেই হচ্ছে তাকে। তবে সমীকরণটি এতটাও সরলরৈখিক নয় বোধকরি। পুতিনের শাসনামলে দেশটিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ আসতে শুরু করে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বও বাড়ছিল তাদের। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মেদভেদেভের আমলে প্রশাসনে শৈথিল্য ও অর্থনীতিতে গতি কিছুটা কমে এসেছে। পুতিনের শাসনামলে মিত্রদের রক্ষায় কম-বেশি শক্ত ভূমিকাই ছিল রাশিয়ার। অথচ মেদভেদেভের আমলে একে একে দেশটির প্রভাব কমছিল লিবিয়াসহ বসন্তাক্রান্ত কয়েকটি আরব দেশে। সম্প্রতি আরেক মিত্র সিরিয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে পুতিনের উত্তাপ অনুপস্থিত মেদভেদেভের পররাষ্ট্রনীতিতে। সিরিয়া ইস্যুতে তাদের চেয়ে বরং চীনেরই কঠোর অবস্থান দেখা গেলো; যদিও এ দেশটির সঙ্গে সিরিয়ার সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক নেই। অথচ রাশিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার বৈদেশিক সম্পর্ক পুরনো ও বিস্তৃত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় রাশিয়ার প্রভাব বজায় রাখতেও কৌশলগত কারণে সিরিয়া তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

এখন পুতিন তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সম্ভবত নাখোশ হবেন তার পশ্চিমা প্রতিপক্ষরা। এমনিতেই সিরিয়ার সঙ্গে ইরান ইস্যু যুক্ত হওয়ায় জটিলতা বাড়ছিল। এ অবস্থায় পুতিন রাশিয়ার হাল ধরলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হবে। সমস্যা হলো, পুতিন ক্রেমলিনে আসবেন চলতি বছরের জুনে। এর আগেই সিরিয়ার ভাগ্যে কিছু ঘটে গেলে করারা থাকবে না। আবার সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বর্বরতার প্রতি সমর্থন জানানো রাশিয়ার যে নৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠছিল দুর্বল হয়ে পড়বে সেটি। অনেকের ধারণা এমন পরিস্থিতিতে পুতিনের কৌশল হবে, রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বেগবান করা; সিরিয়াকে বাদ দিয়ে ইরানকে সমর্থন জোগানো; ইউরোপ, চীন, ভারত ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করা। কেউ কেউ বলছেন, ডমিনো ইফেক্টের ভয় না করে, নেতৃত্ব নিয়েই পুতিনের উচিৎ হবে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কটিকে অধিকতর ফলপ্রসূ করে তোলা। সিরিয়ায় যাই ঘটুক না কেন ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তির যুদ্ধ বেঁধে গেলে, তার ফল হবে ভয়াবহ। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ইরানকে পূর্ণ সহায়তা দিলে, পরিস্থিতি যুদ্ধে মোড় নাও নিতে পারে; কেবল স্নায়ুযুদ্ধের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটতে পারে এর। কাজটি পুতিন সফলভাবে করতে পারবেন কিনা, সেটিই তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এখন।

ফাহমিদা ফেরদৌস

সড়ক-মহাসড়কে হালকা যান

বিশেষত গ্রামের দিকে বাহন হিসেবে চালক ও যাত্রী উভয়ের কাছেই বেশ জনপ্রিয় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নছিমন, করিমন, আলম সাধু ও ভটভটি। চালকের কাছে এর জনপ্রিয়তার কারণ- সহজ কাজের সুযোগ। এটি চালনার জন্য কোন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নেয়ার দরকার নেই; নেই গীয়ার মুখস্থ রাখার ঝামেলা। ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার চালানো মনোযোগ দিয়ে দেখলেই হলো। সঙ্গে বাইসাইকেল ও ট্রাইসাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা থাকলে আরও ভালো; ভটভটিতে ভারসাম্য রক্ষায় কাজে লাগে। ইঞ্জিন সম্বন্ধে বেশি জ্ঞান রাখার প্রয়োজন নেই এ ক্ষেত্রে। খুচরা যন্ত্রাংশ নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। ভাবনাটা শুধু চাকা পাংচার হয়ে গেলে। তবে বিপত্তিটা ঘটে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে। মোটরসাইকেলের মতো হালকা যানে যে ধরনের অ্যারোডিনামিক ডিজাইন মেনে চলা হয়, তাও অনুপস্থিত ভটভটিতে। এ কারণে এতে দুর্ঘটণার ঝুঁকি অনেক বেশি। অবশ্য অনেক চালক ও যাত্রীরও ভুল ধারণ রয়েছে যে, বাস-ট্রাকের চেয়ে নিরাপদ এটি। বাস-ট্রাক তো উল্টে গেলে চারপাশ থেকে আবদ্ধ, অসহায় যাত্রীর পক্ষে বাঁচার জন্য কিছু করা কঠিন। অথচ খোলা ভটভটিতে আর যাহোক লাফ দিয়ে বাঁচার একটা সুযোগ তো মেলে!

কোনো কোনো যাত্রী ভটভটিতে চড়া পছন্দ করেন অন্য কারণে। গ্রামাঞ্চলে এটি সহজলভ্য বাহন। অনেকে বাসে চড়তে চান না অস্বস্তিকর পরিবেশের জন্য। সেদিক থেকে ভটভটি বেশ খোলামেলা। ডিজেল হলো শ্যালো ইঞ্জিনচালিত এসব যানের জ্বালানি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি আবার হয়ে থাকে সেচকার্যে ভর্তুকি দেয়া ডিজেল। স্বভাবতই এতে পেট্রল বা সিএনজি চালিত বাহনের চেয়ে ভাড়া পড়ে কম। পণ্য পরিবহনেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় ভটভটি। ধরা যাক, কেউ ৫০ আঁটি ছন বা বিচালি হাটে গিয়ে বেচতে যান। এখন তিনি যদি মনুষ্যচালিত ভ্যানে তা পরিবহন করতে চান খরচ তো বাড়বেই এসব বহনও করতে হবে কয়েকবারে। এতে খরচ যা হবে মুনাফার অর্থ থেকে তা পরিশোধ করতে গেলে অবশেষ প্রায় কিছুই থাকে না। একবারে পণ্য পরিবহন করতে অর্থাৎ সময় বাঁচাতে মিনি ট্রাকের কথা ভাবতে পারেন তিনি। সমস্যা হলো, গ্রামে এ ধরনের যান পাওয়া বেশ কঠিন। আর যদি পাওইয়া যায়ও, পণ্য পরিবহনে খরচ পড়ে যায় অনেক। অথচ হাতের কাছেই রয়েছে ভটভটির মতো হালকা বাহন; যাতে কম খরচে পরিবহন করা যায় প্রায় মিনি ট্রাকের ধারণ ক্ষমতাতূল্য পণ্য।

এতসব সুবিধার পরও বাস্তবতা হলো, এ ধরনের যান মোটরসাইকেলের চেয়েও দুর্ঘটনাপ্রবণ। কিছু ক্ষেত্রে সড়ক-মহাসড়কে যানজট সৃষ্টির জন্যও দায়ী এটি। এসব বিবেচনায় গত বছর সড়ক উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, ধীরে ধীরে এ ধরনের হালকা যান চলাচল বন্ধের। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ঘোষণা দেয়া হয়, আগামী তিন মাসের মধ্যে দেশের মহাসড়কগুলোয় বন্ধ করা হবে ব্যাটারি ও ইঞ্জিন চালিত হালকা যান। এর কয়েক দিন পর নাটোরে ঘটল মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ট্রেন ক্রসিং পার হতে নিহত হলেন ভটভটিতে থাকা একই পরিবারের ছয় সদস্য। ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙ্গুলে দেখিয়ে দিলো, কেবল মহাসড়ক নয় সারা দেশ থেকেই নির্মূল করতে হবে এ ধরনের বিপদজনক যান।

এ ক্ষেত্রে চালক বা বাহনের লাইসেন্স বাতিল করা সমাধান হতে পারে না। কারণ এ ধরনের হালকা যানের ডিজাইনেই রয়েছে ত্রুটি। তবে দেশব্যাপী ভটভটি যে মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে অনেকের সন্দেহ জাগতে পারে- মহাসড়কেও দ্রুত এসব যান চলাচল সম্ভব কিনা। এ ক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে- ভর্তুকির ডিজেল অন্য কোথাও যাতে ব্যবহৃত হতে না পারে সেটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। এতে ভটভটি মালিকরা বাধ্য হবেন, ভাড়া বাড়াতে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেলে প্রতিযোগিতায় এমনিতেই পিছিয়ে পড়বে এটি; এক সময় হয়তো হারিয়েও যাবে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, যে বিরাট সংখ্যক মানুষ এসব হালকা যান সংশ্লিষ্ট কাজে নিজেদের কর্মসংস্থান জুগিয়েছিলেন তাদের কী হবে? সম্ভবত এরা পুনরায় ফিরে যাবেন কৃষিকাজে। এতে তাদের আয় কিছুটা কমলেও তারা পরোক্ষভাবে অবদান রাখবেন কৃষিশ্রমিকের মজুরি হ্রাসে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

পুরনো অবস্থান ও কৌশল আর নয়

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ডাকে মহাসমাবেশ হয়ে গেলো সোমবার। ওতে আসলেই নাশকতার আশঙ্কা ছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে অনেকের মনে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সমালোচিত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের মহাসমাবেশ ঠেকানোর কৌশল নিয়ে। ওই সমাবেশে দুটি বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট এখন। প্রথমত, সরকারি দলের দুশ্চিন্তা বেড়েছে বিরোধীদের নিয়ে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগে বিরোধী দলের যেমন ‘টাইপড’ ভূমিকা ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা। সন্দেহ নেই, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসায় পর কোনঠাসা বিরোধী দলকে অপ্রত্যাশিতভাবেই সহায়তা জুগিয়েছে সরকারের কিছু অজনপ্রিয় পদক্ষেপ ও সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। কোনঠাসা অবস্থানে থাকার কারণেই বোধকরি বিরোধী দল উপলব্ধি করছে, এক-দুই দশক আগের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের রাজনীতির প্রতি মনোভাব অনেকটাই পরিবর্তিত এখন। জনগণ সংঘাত-সঙ্ঘর্ষ আর প্রতিহিংসা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। দেশের অর্থনীতি যখন ইতিবাচক দিকে মোড় নিয়েছে তখন এসব খানিকটা বিরক্তিকরও বটে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের ধারাটি সরকারি দল বুঝতে পেরেছে কিনা, তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে বিরোধী দল এটিকে কতটা আমলে নিয়েছে তা বোঝা যাবে সামনেই।

এরই মধ্যে বিরোধী দল আগামী ১০ জুনের মধ্যে তত্ত্ববধায়ক পদ্ধতি পুনর্বহালের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকারকে। নইলে আবারও আন্দোলন-সমাবেশে নামবেন তারা। সে অধিকার তাদের আছে; এতে কাজ হয় না তাও বলা যাবে না। কথা হলো, এ ধরনের একটি জটিল ও স্পর্শকাতর ইস্যুর সমাধানে সরকার-বিরোধী কোনো পক্ষেরই আলোচনায় বসা ভিন্ন গত্যন্তর নেই। তত্ত্ববধায়ক ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা সম্বন্ধে তাদের ভালো জানার কথা। কয়েকদিন আগে রাষ্ট্রপতি ও তারও আগে নির্বাচন কমিশন এ বিতর্ক নিরসনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিরোধী দলের অনমনীয় অবস্থানের কারণে ফলপ্রস্যূ হয় নি পদক্ষেপগুলো। সত্য যে, নির্বাচন কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতায়িত ও নির্বাচনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দলীয় সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রযুক্তি ব্যবহার করেও মিলেছে মানুষের সাড়া। এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেটির সমাধান রাজপথে করা কঠিন।

বিরোধী দলীয় নেতা ১২ মার্চ মহাসমাবেশে দেশের অর্থনীতির সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো নিয়ে কতগুলো মন্তব্য করেছেন; কিছু আশ্বাসও দিয়েছেন মানুষকে। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে জনপ্রতিনিধিদের আরও ক্ষমতা প্রদান করা হবে; মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মাঝে রাখা হবে দ্রব্যমূল্য। সে দাম উল্লেখ না করায় উক্তিটিকে বিজ্ঞোচিতই বলতে হয়। কারণ দেশে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে কোনো পণ্যের দাম নির্দিষ্ট করে দেয়াটা আসলেই কঠিন। মহাসমাবেশে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, নতুন সংযোগসহ কলকারখানায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে তিনি ক্ষমতায় এলে। তিনি আরও বলেছেন, ‘কীভাবে দেব, সে টেকনিক আমাদের আছে। এখন বলব না। সময় হলেই বলব’। তিনি যেভাবে কথাটি বলেছেন, তাতে আমরা বিশ্বাস করতে চাই- এর সারবত্তা রয়েছে। এদিকে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে হিমশীম খাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় সরকারের উচিৎ, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানকল্পে আন্তরিকভাবেই বিরোধী দলের সহায়তা নেয়া। মেয়াদপূর্ণ করতে বর্তমান সরকারের লাগবে আরও প্রায় দুই বছর। উক্ত সময়ে জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদোধী দলেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। একে রাজনৈতিক কৌশল হাতছাড়া হয়ে গেলো ভাবা ঠিক হবে না। তারা উদারতা দেখালে তা জনমনে একটা প্রভাব নিশ্চয়ই ফেলবে। সেটি পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে যথেষ্টই সহায়তা জোগাবে তাদের।

আন্দোলন-সমাবেশের সে গতবাঁধা সরকার অপদস্তের কৌশল মানুষ আর বিরোধী দলের কাছ থেকে দেখতে চায় না। সরকারের সেই পুরনো অবস্থানও তারা প্রত্যাশা করেন না আর। সবাই চায়, জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যমত্য দেখতে; যেখানে সরকারি ও বিরোধী দল কাজ করবে একসঙ্গে।

নিয়াজ মাখদুম

বাংলাদেশ ও শচীনের দিন

শুক্রবার মিরপুর শেরেবাংলা নগর স্টেডিয়ামে ক্রিকেটপাগল প্রায় ২৬ হাজার দর্শক প্রাণভরে উপভোগ করলেন বাংলাদেশ বনাম ভারতের ম্যাচ। এর বাইরে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ টিভিতে দেখেছেন খেলাটি। অনুমান করা যায়, এটি তাদের কাছেও ছিল সমান উপভোগ্য। এ ম্যাচের একদিকে শচীন টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরী; আরেক দিকে বাংলাদেশের অপ্রত্যাশিত কিন্তু বলিষ্ঠ জয়। দুদিক থেকেই ঐতিহাসিক এ ম্যাচটি ছিল, উত্তেজনাকর।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীন এ সেঞ্চুরিটিই খুঁজছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। দর্শক ও মিডিয়ার চোখও ছিল এটির ওপর। দেখা যাক, কোথায় সফল হন তিনি? বিশেষত ভারতীয় ক্রিকেট দলের অস্ট্রেলিয়া সফরকালে এ আকাঙ্ক্ষা তুঙ্গে উঠেছিল। সেখানে ব্যর্থ হওয়ায় অনেকে বলছিলেন- বুদ্ধিমানের কাজ হবে শচীন যদি ওয়ানডে ছেড়ে দিয়ে টেস্টে এ কাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরী হাঁকানোর চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে শুরু হলো, এশিয়া কাপ। শঙ্কা আরও তীব্র হচ্ছিল। এ চ্যাম্পিয়নশিপের পর শচীন আর ওয়ানডে খেলতে পারবেন তো! যা করার তাকে এশিয়া কাপেই করে দেখা হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি এটি করে দেখালেন। সৌভাগ্যের বিষয়, তা ঘটল ঢাকাতেই। কারও কারও এ ক্ষেত্রে কিছুটা আক্ষেপ থাকতে পারে অবশ্য- কেন এ সেঞ্চুরীটি ঘটল বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই! খেলাটি শুরুর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অনেক সদস্যও কামনা করেছিলেন, শচীনের শততম সেঞ্চুরী যেন ঢাকাতেই হয়; এটি যেন হয় বাংলাদেশ ভিন্ন অন্য দলের বিরুদ্ধে। তবে খেলা শেষে এ ধরনের আক্ষেপ কারও ছিল বলে মনে হয় না।

মিরপুর স্টেডিয়ামে এখানকার দর্শকদের ক্রীড়াসুলভ যে মনোভাবটি দেখলাম, তা অতুলনীয়। কে বলবে, এদেরই কেউ কেউ গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ক্ষিপ্ত হয়ে ঢিল ছুঁড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলকে লক্ষ্য করে! শচীন ৮০ রান করার পরই দর্শকদের কাউন্টডাউন শুরু হলো। এ দেশে সাকিব আল হাসান জনপ্রিয় ক্রিকেটারদের অন্যতম। অথচ দেখা গেলো, তিনি বল করছেন স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক গল ফাটাচ্ছে ‘শচীন’, ‘শচীন’ বলে। সেঞ্চুরী করার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকরা দাঁড়িয়ে গেলেন তার সম্মানে। অন্য কোথাও নিজ দলের সঙ্গে খেলায় বিপক্ষ দলের একজন খেলোয়ারকে দর্শকরা এতটা সম্মান দেখান কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। টিভি কমেন্টেটররাও অভিভূত হয়েছিলেন এটি দেখে। একজন তো বলেই ফেললেন, শচীন তার হোমগ্রাউন্ড মুম্বাই স্টেডিয়ামে খেলছে।

হতে পারতো, শচীনের সেঞ্চুরী ও বাংলাদেশের পরাজয় দেখেই বাড়ি ফিরছেন দর্শকরা। তা হয় নি। বরং শচীনের শততম সেঞ্চুরীর কারণে ঐতিহাসিক এ ম্যাচ শেষে তারা ফিরেছেন প্রফুল্লচিত্তেই। তারা উচ্ছ্বসিত হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দুঃসাধ্য সাধন দেখে। অথচ ওই ম্যাচে ভারত যে টার্গেট আমাদের দেয়, অসম্ভব না হলেও পরে ব্যাটিং করে কিছুটা কঠিনই ছিল তা টপকানো। স্বপ্নের মতো তা-ই ঘটালো আমাদের দামাল ছেলেরা। ৪০ ওভারের আগ পর্যন্ত আশা থাকলেও স্পষ্ট ছিল না সেটি। তখন সাকিব ও নাসিরের দৃঢ়তায় রান জমছিল বেশ। মনে হচ্ছিল, এ ধারায় চলতে থাকলে ম্যাচ জেতা কঠিন হবে না। এরই মধ্যে আউট হয়ে গেলেন সাকিব। তখন একবার শঙ্কা জেগেছিল, আগে যেমনোতি দেখা গেছে তেমন উইকেট পতনের উৎসব না শুরু হয়ে যায়। তারপরন মুশফিক এলেন। তার পেটানো দেখে আরও ঘাবড়ে গেলেন সবাই। এই বুঝি গেলো আরেকটা উইকেট। তবে এসব শঙ্কা দূর করে শেষ পর্যন্ত মুশফিকের হাত ধরেই এলো বাংলাদেশের জয়সূচক রান। সারা দেশ ভাসলো আনন্দে। টিভি ছেড়ে রাস্তায় মানুষের জমায়েত বাড়তে থাকলো। আর যারা ছিলেন মিরপুর স্টেডিয়ামে? দেখে মনে হচ্ছিল, তারা সেখান থেকে বেরুতে চাইছেন না; বেরুলেই যদি শচীনের ঐতিহাসিক সেঞ্চুরী আর আমাদের বিজয়ের বেশ কেটে যায়! তারা সবাই বোধকরি চাইছিলেন, কিছুক্ষণ থেকে আরও কিছু স্মৃতি জমাতে। পরে মানুষের কাছে গল্পও তো করা যাবে- ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন ব্যাটসম্যানের শততম সেঞ্চুরী আমি কাছ থেকে দেখেছি; দেখেছি পিছিয়ে পড়েও বাংলাদেশকে জিততে।

ফাহমিদা ফেরদৌস

Leave a comment