Ranil Shriyan Wickremasinghe

কর্মের আকুতি ও তার বেতাল প্রত্যুত্তর

রনিল বিক্রমাসিংহে

২০১৫-০৫-১৫ ইং

মিল-অমিল দুই-ই রয়েছে তরুণ সমাজ আর রাজনীতিকদের কর্মকাণ্ডে। পার্থক্যটা হলো, কর্মক্ষেত্রে তরুণদের লড়তে হয় এমন মার্কেট শেয়ারের লক্ষ্যে, যেটি বৈচিত্র্যময় এবং পরিপূর্ণ না হলেও সেখানে সিংহভাগ প্রতিযোগীর সংকুলান সম্ভব। অন্যদিকে রাজনীতির ময়দানে মার্কেট শেয়ার সীমিত। ফলে নিজের ভাগ রক্ষা ও বৃদ্ধির মধ্যেই করতে হয় দিনাতিপাত। এখানে ক্লান্তির সুযোগ নেই। কেননা বিরতিহীনভাবে খেলা চলতে পারে রাউন্ডের পর রাউন্ড। বহু বছর আগে রাজনীতিতে হাতেখড়ির সময় সকাল-সন্ধ্যা এত বেশি প্রশিক্ষণ নেয়া হয়েছে যে, ঘটনাগুলো সামলাতে তেমন সমস্যা হয় না আজ। যাক, তরুণ ও রাজনীতিকদের ভাবনায় একটা মতৈক্যের জায়গা হলো কর্মের সংস্থান।

বয়সে ৩০ না পেরোনো শ্রমবাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা অনেকে মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করেন, পড়াশোনা শেষে ভালো কাজ পাব তো? তাদের চাওয়াটা বিরাট কিছু নয়। একটু উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা আর নির্ভরযোগ্য চাকরির নিশ্চয়তা। বিবাহিত ত্রিশোর্ধ্বদের দুশ্চিন্তার বিষয়বস্তু আবার ভিন্ন। তারা জানতে চান, কর্মীর যথাযোগ্য মজুরি নিশ্চিত হচ্ছে কিনা। এদের একদল হয়তো সুবিধাজনক স্থানে আপন বাড়ি নির্মাণের চেষ্টা করছেন কিংবা সন্তানকে অপেক্ষাকৃত উন্নততর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াতে চান। ফলে কিছুটা ‘ভালো’ বেতন না পেলেই নয়। কর্ম প্রত্যাশীদের এসব প্রশ্নের উত্তর আমি তৃতীয় পক্ষ তথা বেসরকারি খাতের নিয়োগদাতাদের মধ্যে খুঁজি। তাদের ঝটপট জবাব আরো বিমর্ষ করে আমাকে, কাজ করানোর মতো উপযুক্ত কর্মী কই?

কর্মসংস্থান সৃজন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যে যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবেন— সেটাই স্বাভাবিক। ফলে আমার মতামতের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের বক্তব্যে পার্থক্য থাকবে। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান ধরে এগোতে চাই। স্পষ্টত জনশক্তি রফতানির ওপর ক্রমেই বাড়ছে শ্রীলংকার কর্মসংস্থান নির্ভরতা। অর্থাত্ অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্সের তাত্পর্য বাড়ছে অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রে উন্নতির চিত্রই লক্ষণীয়। দেখা যাচ্ছে, ২০০০ সালে অভিবাসীরা পাঠিয়েছেন ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স। সংখ্যাটি ৬ বিলিয়ন ডলার দাঁড়ায় ২০১২ সালে। কার্যত গত দেড় দশকের কম সময়ে শ্রীলংকার রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে আনুমানিক পাঁচ গুণ। নিঃসন্দেহে তা বিরাট বৃদ্ধি। এদিকে ২০০০ সালে কিন্তু আমাদের সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত ছিল তৈরি পোশাক ও বস্ত্র শিল্প। ওই সময়ে এটি আয় করত ৩ বিলিয়ন, যা বর্তমানে ৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তার মানে, এখানেও বৃদ্ধি প্রায় ২৫ শতাংশ। অবশ্য জিএসপি স্ট্যাটাস না হারালে এবং বৈশ্বিক আর্থিক সংকট সৃষ্টি না হলে তৈরি পোশাকে আরো প্রবৃদ্ধি হতো আমাদের। শ্রীলংকার রফতানি আয়ের তৃতীয় নির্ভরযোগ্য উত্স হলো চা। শিল্পটি থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম আয় হয়েছে গত বছর। চায়ের পর রাখতে হবে কাঁচা ও মূল্য সংযোজিত রাবার পণ্যকে। সেখান থেকে আয় হচ্ছে ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। ২০০০ সালের পর এখন পর্যন্ত এখানেও রফতানি আয় বেড়েছে প্রায় চার গুণ। আমি বিশ্বাস করি, উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে এসব খাতের সম্ভাবনার অধিক সদ্ব্যবহার সম্ভব।

মূলত এ ক’টিই শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বলতে দ্বিধা নেই, হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের (এবং আরো অনেক দেশের) প্রধান রফতানিসামগ্রী ছিল ধান, মসলা, চা, রাবার, নারকেল প্রভৃতি কৃষিপণ্য। ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্য রফতানির উপলব্ধি জাগ্রত হয় সত্তরের দশকে এসে। খেয়াল করার মতো বিষয়, উন্নয়ন মইয়ে শ্রীলংকার যাত্রারম্ভ একেবারে তলানি থেকে; যার ভালো নাম তৈরি পোশাক শিল্প। তা থেকে দ্রুত বাড়ছিল রফতানি আয়। পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় জনশক্তি রফতানি। ১৯৮৩ সালের ওই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মধ্যে রেমিট্যান্স আগমনের ঘটনা ছিল দেশবাসীর কাছে খুবই সমাদৃত। তবে এরই মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের অন্ধকার দিকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৯০ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনায়। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার লংকান শ্রমিক ফেরত পাঠানো হয় কুয়েত থেকে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বিকল্প অনুসন্ধান কেমন কঠিন, সেটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি তখন। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা ড. এএস জয়বর্ধন ও আমাকে জাপান পাঠালেন। দেশটির সরকার সে সময় যেভাবে হাত বাড়িয়েছিল, আজো তা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

কথা হলো, রেমিট্যান্স এখন বৈশ্বিক ঘটনা। শুধু শ্রীলংকা কেন, অনেক দেশের সুখসমৃদ্ধি ইদানীং ব্যাপকভাবে রেমিট্যান্সনির্ভর, কেউ কেউ অতিনির্ভরশীল। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, রেমিট্যান্সের ওপর অতিনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে শ্রমঘন ও নিম্ন মজুরির শিল্পোদ্যোগের পাশাপাশি পুঁজিঘন আধা-দক্ষ মানবসম্পদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়, যেন এর সহায়তায় পর্যায়ক্রমে দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলা যায়। ভারতের ও প্রযুক্তি খাতকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারি সেক্ষেত্রে। লক্ষণীয়, নিম্ন মজুরির শ্রমঘন শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির ওপর তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছে ভারত। আর আমরা? উন্নয়নের কোন মডেল অনুসরণ করছে শ্রীলংকা?

দেশের অর্থনীতির দিকে যখন তাকাই, এক দশক আগের চেয়ে তেমন কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। এখনো আমাদের রফতানি আয়ের বিপুলাংশ জুড়ে আছে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়। তৈরি পোশাক ঘিরে নির্ভরশীলতা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য রাসায়নিক পণ্য তৈরি হচ্ছে আগের মতো। বিশ্ববাজারে যাচ্ছে লংকান খাদ্যপণ্য ও পানীয়। এসবের বাইরে সেভাবে কোনো প্রযুক্তি পণ্য উত্পাদন ও রফতানি করি আমরা? উত্তর হলো, না। গাড়ির যন্ত্রাংশ বানাই? না। তাহলে তো আগের অবস্থানেই আছি আমরা। জানি, অনেকের কাছে অনেক রকমের যুক্তি আছে। কিন্তু চলমান বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। এগোচ্ছে ভারত-চীন-সিঙ্গাপুর; এদিকে আমরা স্থির। অনেকের মূল ফোকাস স্থানীয় অর্থনীতির সেবা খাতে। সরকারের তীক্ষ দৃষ্টি আবার স্টক এক্সচেঞ্জের ওপর। এরই মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) থেকে অর্জিত হয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, চূড়ান্ত বিচারে শ্রীলংকার প্রাপ্তি কী? সার্বিকভাবে এখনো আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলো সরকারি ব্যয়। প্রায় দুই দশক (মাঝখানে সম্ভবত ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সাল বাদে) বরাদ্দের বেশির ভাগ গেছে প্রতিরক্ষা খাতে। আর বর্তমানে প্রথম স্থান অধিকার করেছে অবকাঠামো নির্মাণ। এতে বেসরকারি খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ পর্যাপ্তভাবে জোগানো যাচ্ছে না।

আমাদের আর্থিক খাত এখনো তেমন গভীর নয়, দুর্বলতা রয়েছে বেশকিছু। অন্যদিকে বিদ্যুতের দাম বেশি উপরে উঠতে না দেয়া, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতি ছাড়া সামগ্রিক উন্নয়ন মজবুত হবে না। ওসব গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিবেচনায় কিছু ক্ষেত্রে হয়তো নিম্নমুখী হচ্ছি আমরা। তবে আসল কথা হলো, সেগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর সেটি করা জরুরি এজন্যও যে, নইলে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চল হয়ে পড়বে; পরবর্তী ধাপে উন্নীত হতে পারবে না সমৃদ্ধি। ঠিক আছে মানছি যে, পুঁজিঘন আকর্ষণীয় কিছু শিল্পে আপাতত আমরা নামতে পারব না নানা কারণে। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিরাট সুযোগ তো বিদ্যমান। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলতে চাই, ৪০০ মিলিয়ন কেন, শ্রীলংকার আইসিটি খাতের আকার হওয়া উচিত কমপক্ষে ২ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক খাতে আরো ৬ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় বাড়ানো যায়। কাজটি করা গেলে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। ফলে নিরুপায় তাকিয়ে থাকতে হবে না বৈদেশিক কর্মসংস্থানের প্রতি।

আরেকটি বিষয়ের আলোচনা এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সেটি হলো, দক্ষ শ্রীলংকানরা থাকছেন না দেশে। দেখা যাচ্ছে, কলম্বোর নামি কোনো হোটেলে ক’বছর দক্ষতা অর্জনের পরই সার্টিফিকেট নিয়ে অনেকে ছুটছেন দুবাইয়ের মতো পর্যটন নগরে। তাদের অভিবাসনের কারণ অযৌক্তিক বলা যায় না। সেখানে বেশি মজুরিতে কাজ পাচ্ছেন তারা! তবে এতে দেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা হলো, কাজের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ পাচ্ছে না স্থানীয় বেসরকারি খাত। কেননা অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারে থাকছে প্রধানত অদক্ষরা। এখানকার দক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকের বিশাল অংশই কিন্তু বর্তমানে প্রবাসী। এ ধরনের অব্যাহত মেধা পাচার আমাদের জন্য কত বড় দুশ্চিন্তার তা বলে বোঝানো যাবে না। দলে দলে উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এমন প্রবণতা ঠেকাতে দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সামাজিক ব্যয় জোগাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতে পারে আমাদের।

করণীয় বিষয়বস্তু অনেকগুলোই। নিঃসন্দেহে আমাদের চ্যালেঞ্জ বিপুল, দুর্বলতাও অনেক। তা সত্ত্বেও আমি বিশ্বাস করি, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক বা দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যবান শ্রীলংকা। ভারতীয় মহাসাগরের মাঝখানটায় আমাদের অবস্থান। কৌশলগত দিক থেকে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি আমরা সহিষ্ণু জাতি। সহনশীলতা না থাকলে তিন দশকের যুদ্ধক্ষত ও দুই দশকের পুঁজি লোকসান নিয়ে কোনো দেশ আজ এভাবে আমাদের মতো দাঁড়াতে পারত না। কথা হলো, এখান থেকে অবস্থার দ্রুত ও ক্রমশ উন্নয়ন আবশ্যক। সেজন্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেশের উন্নয়নের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের একমত হতে হবে যে, উন্নয়নের স্বার্থে জরুরি আর্থসামাজিক ইস্যুতে আমরা কেউই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করব না; ভোটাভুটি কিংবা এ ধরনের মূল রাজনৈতিক কার্যক্রমে স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রেখেই। সেজন্য সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় প্রথমে তাকাতে হবে দলীয় রাজনীতির প্রতি এবং এর পর কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো অত্যাবশ্যকীয় আর্থসামাজিক চাহিদার জন্য স্থান সৃষ্টি তথা পরিবর্তন আনতে হবে দলীয় রাজনীতির রূপরেখায়।

লেখক: শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী

ওয়ার্ল্ড নিউজ থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তর জায়েদ ইবনে আবুল ফজল

Leave a comment