From 2011-15

জীবাণূমুক্ত মুদ্রা!

একটা সময় পর্যন্ত দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে ধাতব মুদ্রা ভিন্ন ভাবা যেতো না। এখন অবশ্য পরিস্থিতি তেমন নয়। এখন রয়েছে কাগুজে মুদ্রা; আছে অদৃশ্য ডিজিটাল মানি। গত শতকেই ধাতব মুদ্রা হারিয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল কারও কারও। ওসব মিথ্যা করে দিয়ে এখনো টিকে আছে ধাতব মুদ্রা। তবে অস্বীকার করা যাবে না, ধীরে ধীরে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কমছে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার।

আসলে ধাতব মুদ্রা ব্যবহারের বিশেষ কিছু অসুবিধা রয়েছে। প্রথমে ধরা যাক, এর ওজন। ব্যাংক থেকে কেউ যদি ৫০ হাজার টাকা তুলতে যান। তিনি যদি মুদ্রা সংগ্রাহকও হন, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ১, ২ এমনকি ৫ টাকা মূল্যমানের ধাতব মুদ্রাও নিতে চাইবেন না। ৫ টাকা মূল্যমানের দুই ধরনের ধাতব মুদ্রা রয়েছে দেশে। এগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ওজন হলো ৭ দশমিক ৮৭ গ্রাম। এখন কেউ যদি ৫ টাকা মূল্যমানের ৫০ হাজার টাকার ধাতব মুদ্রা নিতে চান তাকে ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি পর্যন্ত বহন করতে হবে কমপক্ষে ৭৮ কেজি ধাতু। ১ বা ২ টাকার ধাতব মুদ্রা হলে এ ওজন আরোও বেড়ে যাবে। অথচ ১ হাজার টাকার নোট নিলে বহন করতে হবে সর্বোচ ৬০ গ্রাম! ধাতব মুদ্রা ব্যবহারের অন্যান্য সমস্যা হলো, এটি সহজে জাল করা যায় বা বিভিন্ন দ্রব্য তৈরিতে এগুলো ব্যবহার করা যায় সহজেই।

এখন ধাতব মুদ্রা ব্যবহারে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হিসেবে যেটিকে উল্লেখ করা হচ্ছে তাহলো, ধাতব মুদ্রার দ্বারা রোগের জীবাণু পরিবাহিত হয়ে জনস্বাস্থ্যে হুমকি সৃষ্টি। দেখা গেছে নিম্নবিত্তের মাঝে ধাতব মুদ্রার ব্যবহার বেশি। এ দেশের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, ধাতব মুদ্রা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় রিকশাচালক, মাছবিক্রেতা, ফেরীওয়ালা, মুদি দোকানদারের মাঝে। পরিবেশগত কারণেই এতে সহজে ধাতবমুদ্রাগুলো জীবাণূ বহন করে অনেক বেশি। তার সঙ্গে একটি বৈজ্ঞানিক কারণও রয়েছে। দেখা গেছে, ফেরোম্যাগনেটিক (যেসব ধাতু চৌম্বক দ্বারা সহজে আকৃষ্ট হয় ও যেগুলোকে সহজে চৌম্বকে পরিণত করা যায়) পদার্থে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কলোনি (স্ট্রেইন আকারে) স্থাপনের প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে কাগজের চেয়ে ধাতব মুদ্রার মাধ্যমে রোগজীবাণু পরিবাহিত হয় বেশি। এসব দিক বিবেচনা করে অনেক দেশেই ধাতব মুদ্রা ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিশেষত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে কয়েকটি দেশে আবার ব্যবহার করা হয়, জীবাণুমুক্ত ধাতব মুদ্রা। কিছুদিন আগে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারও। বলা হয়েছিল, ২ বিলিয়ন টাকা মূল্যমানের জীবাণুমুক্ত ১ ও ২ টাকার ধাতব মুদ্রা ছাড়া হবে বাজারে। এখন পর্যন্ত দরপত্র সংক্রান্ত জটিলতায় এ বিষয়ে অগ্রগতি থেমে রয়েছে। তবে আশা করা যায়, দ্রুতই এর নিষ্পত্তি হবে।

কথা হলো, জীবাণুমুক্ত ধাতব মুদ্রা কী? ধরলাম, কোনো উপায়ে জীবাণুমুক্ত করে ধাতব মুদ্রা ছাড়া হলো বাজারে; ঘুরে-ফিরে সেটি আবার যাবে সে রিকশাওয়ালাদেরই হাতে। সে ক্ষেত্রেও কী এটিতে কোনো জীবাণু থাকবে না? একেবারে থাকবে না তা নয়। তবে থাকবে অনেক কম পরিমাণে। সাধারণত দু উপায়ে এ ধরনের মুদ্রা তৈরি করা হয়। এক, ফেরোম্যাগনেটিক পদার্থের পরিমাণ কমিয়ে। দুই। অতিবেগুণী রশ্মি প্রয়োগ করে। এ ক্ষেত্রে পলিমারের মুদ্রার প্রচলন করা যায় কিনা, তা নিয়ে গবেষণা এখনো চলতে। দেখা গেছে, এগুলোও একটি নির্দিষ্ট সময় পর জীবাণু আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। তারপরও সাধারণ ধাতব মুদ্রার তুলনায় ওগুলো স্বাস্থ্যের জন্য কম ক্ষতিকর।

স্পষ্টতই ধাতু ও কাগজের মুদ্রা উভয় কম-বেশি সক্ষম ও নির্বীজ জীবাণু বহন করে সর্বাবস্থায়। তাহলে কী, পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত কোনো মুদ্রা নেই? এ অবস্থায় অনেকেই বলেন, ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার বাড়ানোর কথা- কারণ জীবাণু দ্বারা এটির আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহার নিয়ে সংশয় রয়ে যায় একটি কারণে। আর তাহল, ডিজিটাল মুদ্রায় বায়োলজিক্যাল রোগজীবাণুর ঝুঁকি না থাকলেও এ ক্ষেত্রে জটিলতা হলো ‘আর্টিফিসিয়াল ভাইরাস’।

নিয়াজ মাখদুম

বাংলাদেশী নারীর জয়যাত্রা

সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন চীন থেকে বাংলাদেশ হয়ে সফর করেন ভারত। অনেক বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা অনুমান করছেন- ২০৫০ সালের মধ্যে এটিই হয়ে উঠবে এশিয়ার ‘নিউ সিল্করুট’। সফরকালে এ দেশের নারী জাগরণে নিজের আনন্দ ও বিস্ময়ের কথা জানিয়েছেন হিলারি; ধন্যবাদ জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের কথা। এভাবে বিভিন্ন উপায়েই বিশ্বাঙ্গনে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। কয়েকদিন আগেই টাইমস ম্যাগাজিনের প্রভাবশালীদের তালিকায় প্রথম সারিতে স্থান পেলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সালমান খান। ক্রিকেট, তৈরি পোশাকের কারণেও আমাদের ব্র্যান্ড ইমেজ দাঁড়াচ্ছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশী নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণের ঘটনাটি আরও উজ্জ্বল করেছে গড়ে উঠতে দেশের ভাবমূর্তি।

একটা সময় পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনেকের ধারণা ছিল- এখানকার নারীদের অবস্থা সোমালিয়া, নাইজেরিয়ার মতোই হবে। সে ধারণা দূর হতে থাকে নানা আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা মাথায় নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ সহায়তায় গ্রামীণ পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও গার্মেন্ট শিল্পে বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থান জোগানোর ঘটনায়। পাশাপাশি উচ্চতর দক্ষতাপূর্ণ কর্মক্ষেত্রেও নিজের অবস্থান গড়ে তোলেন শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত নারীরা। তাদের অনেকেই সাফল্য দেখাচ্ছেন সংসার ও কর্মক্ষেত্রে সমানভাবে। এসব পরিবর্তনে অলীক ধারণা দূর হতে থাকলেও, সেটি গুড়িয়ে দিয়েছে বাঙ্গালী নারীর এভারেস্ট জয়ের মতো ঘটনা। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় আজ ফলাও করে প্রচার হচ্ছে এটি। আফ্রিকান বলি কেন, এশিয়ারই বা কতজন নারী আজ পর্যন্ত এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছেন? অথচ সেটিই করে দেখালেন নিশাত মজুমদার। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বকে বার্তা দিলেন বাংলাদেশী নারীর যোগ্যতা ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে; অনুপ্রাণিত করেলেন স্থানীয়দের।

তুলনা করা সমীচীন হবে না, তবু চিন্তার খোরাক জোগাতে একটা হিসাব তুলে ধরা যায় এ ক্ষেত্রে। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০১০ সালে এভারেস্টের শীর্ষে উঠেন মুসা ইব্রাহীম- ১৯৫৩ সালে হিলারি-তেনজিংদের এভারেস্ট জয়ের প্রায় ৫৭ বছর পর। তারপর মুহিতও উঠেছেন এভারেস্টে। নিশাত এ কাজটিই করে দেখালেন আনুমানিক ২ বছরের মাথায়। নারী হিসেবে প্রথম, এক জাপানী এভারেস্ট জয় করেন ১৯৭৫ সালে। এ ক্ষেত্রে নিশাত সারা বিশ্বের নারীদের চেয়ে পিছিয়ে ৩৭ বছর; আর মুসা-মুহিতদের চেয়ে ২০ বছর এগিয়ে!

হিলারি-তেনজিংয়ের সময় একটি সুবিধাজনক দিক ছিল, ওই সময় পর্বতারোহনে শরীরের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও আর্থিক বিপত্তি ছিল এখনকার চেয়ে কম। তখন প্রযুক্তির ব্যবহারো ছিল কম; কম্পাস, অল্টিমিটার, অক্সিজেন বোতল, ক্লাইম্বিং গিয়ার, খাদ্য-পানীয় ছাড়া প্রয়োজনও হতো না বেশি কিছুর। তবে ব্যয় কম হলেও সে সময় পর্বতারোহণে ঝুঁকি ছিল বেশ। এখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে; এদিকে যন্ত্রপাতি ছাড়াও পর্বতারোহণের অনুমতি পেতে নেপাল সরকারকে দিতে হচ্ছে জনপ্রতি (অবস্থাভেদে) ১০ থেকে ২৫ হাজার ডলার। আমাদের মধ্যবিত্ত ও সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা পর্বতারোহীদের জন্য কম চিন্তার বিষয় নয় এগুলো। তাদের চিন্তা করতে হয়, স্পন্সর মিলবে কিনা? মিললেও সেখান থেকে কতটা অর্থ জোগাড় হবে? প্রভৃতি। এ ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়েও নারীদের চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। ফলে ধারণা করে নেয়া যায়, এভারেস্ট চূড়ায় ওঠার আগে সেটিও ভালোভাবে মোকাবেলা করতে হয়েছে নিশাতকে। তার ওপর এভারেস্ট জয়ের আগে তার প্রচার-প্রচারণাও দেখা যায় নি খুব একটা; যেটি দেখা গেছে আরেক বাংলাদেশী নারী পর্বতারোহী ওয়াসফিয়া নাজরীনের ক্ষেত্রে। যাত্রাপথের এসব অন্তরায় দূর করে সফলভাবে এভারেস্ট শীর্ষে উঠেছেন নিশাত; বাংলাদেশ ও এর নারীকে সঙ্গে নিয়েই। এখন দেখার রইলো, নাজরীন কবে নাগাদ এভারেস্ট জয় করতে পারেন। আগে উঠতে পারলেন না বলে তার আফসোস করার কিছু নেই। তিনি জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশী নারীদের বিশ্বের সামনে তুলে ধরাই তার পর্বতারোহণের উদ্দেশ্য। এমন অবস্থায় দ্রুত ও দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করতে পারলে তার উদ্দেশ্য বিফল হবে না; যদি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর আসে- এভারেস্ট চূড়ার দখল ছাড়তে চাইছে না বাংলাদেশী নারীরা!

নিয়াজ মাখদুম

টিপস অ্যান্ড ট্রিকস

হোটেল-রেস্টুরেন্টের ওয়েটিং স্টাফ নিয়ে একটা জোকস হয়তো সবারই জানা। এক ওয়েটার কয়েক মাস ধরে বেতন নিচ্ছেন না; মালিকের সঙ্গে দেখাও করছে না। ডেকে পাঠানো হলো ওয়েটারকে। মালিক জিজ্ঞেস করলেন, বেতন নিচ্ছ না কেন? যেন আকাশ থেকে পড়লেন ওয়েটার- বেতনও দেয়া হয় জানতাম না তো? আমি তো কেবল টিপস আশা করেছিলাম! আর তা তো আমি পাচ্ছিই। বেতনের চেয়ে টিপস যদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি হলে বেতনের দরকার কী? আর টিপস দেয়া যদি কাস্টমারের জন্য হয় বাধ্যতামূলক? নিউইয়র্কের কিছু হোটেলে কিন্তু এমন নিয়ম আছে। আপনি বসে থাকলেও টিপস দিতে হবে। কিছু খেলেও তা দিতে হবে- অর্ডারকৃত খাবারের প্রকৃত মূল্যের ১০ থেকে ২৫ শতাংশ করে। কোনোক্রমেই ১০ শতাংশের নীচে টিপস দেয়া যাবে না। সার্ভিস ভালো লাগলে ২৫ শতাংশের বেশি দিতে পারেন। তবে মাথায় রাখতে হবে, এ থেকে ওয়েটারের কাছ থেকে কমিশন কিন্তু রাখবে হোটেল কর্তৃপক্ষ।

সর্বত্র এমনটাই ঘটবে, তাও নয়। আসলে এটা নির্ভর করে ওয়েটার-মালিক সম্পর্কের ওপর। অনেক ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টে ওয়েটারদের সব টিপস জমা থাকে মালিকের কাছে। কাজ শেষে তিনি সবাইকে তা গুরুত্বভেদে ভাগ করে দেন। নিজেও রাখেন খানিকটা। এতে করে যে মানুষটা খাবার সার্ভ করে না, তৈরি করে- সেও পায় টিপস। এক ধরনের আয়বন্টনও হয় এতে। পশ্চিমা রেস্টুরেন্টে টিপস পাওয়ায় ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হলো, সেখানকার কাস্টমাররা প্রায় নিয়মিত ও ভালো পরিমাণে টিপস দেন ওয়েটারকে। সম্প্রতি জানা গেলো, টেক্সাসে দুই কাস্টমার মিলে এক ওয়েটারকে দিয়েছেন ৫ হাজার ডলার টিপস; ওই ওয়েটার নাকি তাদের সামনে আফসোস করছিলেন- এ পরিমাণ অর্থ থাকলে তিনি একটা গাড়ি কিনতে পারতেন!

টিপস দেয়ার রীতি এ দেশে কী করে- জানা মুশকিল। একে ঔপনিবেশিকতার দৃষ্টিতে দেখার সুযোগও কম। পর্তুগাল, স্পেন, ব্রিটেন, ফ্রান্সে টিপস দেয়ার সংস্কৃতি ছিল না। যতদূর জানা যায়, ইউরোপ এটি ‘আমদানি’ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তারপরের অবস্থা অনেকটা এমন- কয়েক দিন আগে ইতালির রোমে হানিমুনে যান ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ। সেখানে ‘টিপস সংস্কৃতি’ নেই। ফলে রেস্টুরেন্টে খেয়ে টিপস দেন নি তিনি। আর এতেই ক্ষুব্ধ ওয়েটার ঘটনাটি জানান গণমাধ্যমে। রোমের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন- টিপসের সংস্কৃতি কী এখানে আছে? ওয়েটারের জবাব ছিল- কিন্তু মার্কিনিরা তো টিপস দেয়! যাহোক, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে টিপস অবশ্য সংস্কৃতি। হংকং, তাইওয়ান, ম্যাকাওতে টিপস চালু থাকলেও একে এশিয়ার সংস্কৃতিতে ঢালাওভাবে ফেলা যায় না। জাপানে টিপস প্রদান ইতিবাচক তো নয়ই- বরং রীতিমতো অপমানজনক।

সম্প্রতি টিপস আদায়ের ট্রিকসও শেখানো হচ্ছে ইউরোপের কয়েকটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে; যাকে বলা যায় কাস্টমার পটানোর বিদ্যা। আর তাতে প্রথম পাঠ হলো- মানিব্যাগের পাশাপাশি কাস্টমারের মনের অবস্থাও বোঝার চেষ্টা করুন। বিষয়টিকে ভুল বুঝবেন না। এখনো মন্দা চলছে ইউরোপে। ফলে ওয়েটারদের শেখানো হচ্ছে, কোনো কাস্টমারের সামনেই যেন জাঁকালো পোশাক, অলংকারাদি প্রভৃতি পরে না যাওয়া হয়; কারণ কাস্টমার আর্থিক সমস্যায় থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তিনি জাঁকালো পোশাক দেখে বিরক্ত হতে পারেন। এসব দেশে অবশ্য ওয়েটিং স্টাফ প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমারদের ‘ইউজার ম্যানুয়াল’ও দেয়া হয়; যাতে লেখা থাকে- আপনি অমুক রেস্টুরেন্টের ওয়েটারের কাছ থেকে কতটা সেবা পেতে পারেন।

আমাদের দেশে কিছু মানসম্মত ও অভিজাত রেস্টুরেন্ট বাদ দিলে এসব বিষয়ে ওয়েটার ও কাস্টমার উভয়েই উদাসীন। এখানে একজন ওয়েটার ১০-১৫ জনকে একসঙ্গে সার্ভ করলেও কাস্টমারের কোনো আপত্তি নেই। আবার কাস্টমারের চড় খেয়েও ‘রা’ করেন খুব কমই ওয়েটার। অথচ এসব বিষয়ে দ্রুত নজর দেয়া প্রয়োজন। এজন্য ওয়েটিং স্টাফ প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার। তাহলে এ ক্ষেত্রে দেশেও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে; বিদেশে যারা পড়াশুনার পাশাপাশি কাজ করতে আগ্রহী সুবিধা হবে তাদেরও।

ফাহমিদা ফেরদৌস

কলুষিত মাংস আর ভোক্তা সচেতনতা

কোনো নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নয়, কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন ভোক্তারা। পশ্চিমা দেশে কাঁচা মাংসের গ্রেড হলো চারটি- প্রাইম, চয়েস, সিলেক্ট ও স্টান্ডার্ড। সম্প্রতি ইউরোপের চয়েস ও স্ট্যান্ডার্ড গ্রেডের কিছু ভোক্তা ১০০% বীফ লেখা মোড়কীকৃত মাংস কিনে দেখেন, সেটি খেতে নরম আর খানিকটা মিষ্টি। শুরুতে সন্দেহের তীর ছোঁড়া হয়- মেয়াদোত্তীর্ণ মাংস গছিয়ে দিয়েছে দোকানী। বিক্রেতা এমন অভিযোগ অস্বীকার করলে দানা বাঁধে সংশইয়। মাংসের মেয়াদ আছে অথচ খেতে মিষ্টি আবার চর্বিও নেই। তার মানে ঘোড়ার মাংস মেশানো নেই তো এতে? শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো এ শঙ্কাই সত্য। অতিমুনাফার আশায় একশ্রেণীর মাংস ব্যবসায়ী গরুর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ঘোড়ার মাংস। এমন ঘটনায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। অবশ্য হৈ চৈ এখন ফ্রান্সেই হচ্ছে বেশি। ডিএনএ পরীক্ষা থেকে শুরু করে নানা হুলস্থুল পড়ে গেছে সেখানে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, ঘোড়ার পাশাপাশি শতভাগ গরুতে গাধার মাংস পাওয়ায়ও। সুপার চেইন শপের আকার ও কর্মপরিধি বিস্তৃত হয়েছে ইউরোপে। বেড়েছে মাংস জাতীয় ফাস্টফুড পরিভোগও। তাই জনরোষে পড়ার আগেই কাঁচা প্যাকেটজাত মাংস সরবরাহকারী একাধিক বড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলছে ফরাসি সরকার। সব কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর নাকি ‘কালেক্টিভ অ্যাকশনে’ যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নও।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ঘোড়ার মাংস নিয়ে বিশেষত ফরাসি ভোক্তাদের আপত্তি কোথায়? ম্যাগডালিয়ন যুগ (আনুমানিক ১৬ হাজার বছর আগে) থেকেই তো ঘোড়ার মাংস খাচ্ছে এরা। মধ্যযুগে পোপ এটি নিষিদ্ধ করেছিলেন বটে। তবে সে আইনও শিথিল হয়ে আসে বিশেষত ফরাসি বিপ্লবে। রুচি পরিবর্তন নয়, এ সময়ে সাধারণ ফরাসিরা ঘোড়ার মাংসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ‘রাজনৈতিক সচেতনতা’বশত। তখন ঘোড়া ছিল আভিজাত্য তথা বড়লোকের প্রতীক। বিপ্লবের শুরুতে তাই কমনার’রা ঘোড়ার মাংস খাওয়া শুরু করে ধনীর ওই সম্পদ ধ্বংসের অভিপ্রায়ে। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সে খাদ্য সংকট দেখা দিলে, ঘোড়ার মাংস হয়ে পড়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আমিষের অন্যতম উৎস। বিষয়টির সঙ্গে পরিশীলন যুক্ত করেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধকালে সৈনিকদের আরবীয় ঘোড়ার মাংসে তৈরি সুস্বাদু সুপ পরিবেশনের আদেশ দেন তিনি। এর একটা সুন্দর নামও বেরোয় তার৫ মাথা থেকে- বুফ আ লা মদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালেও ইউরোপে বেড়ে ওঠে ঘোড়ার মাংস বিক্রি। প্রাচীন ভারতেও ঘোড়ার মাংস খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। জাপানে তো এখনো একটি বিশেষ খাবার হলো শাকুরা নিকি; যেটি তৈরি হয় ঘোড়ার মাংস দিয়ে।

বর্তমানে অনেক দেশেই ঘোড়ার মাংস বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে এ যুক্তিতে যে, যুদ্ধ-যোগাযোগ-বিনোদনে ঘোড়া আসলেই মানুষের সঙ্গী। ফলে এর মাংস খাওয়া নৈতিকভাবে সমর্থযোগ্য নয়। এমন সহানুভূতি ইউরোপে প্রবল বা এ কারণেই গরুতে ঘোড়ার মাংস পাওয়ায় তারা চটেছে, বিষয়টি এমনও নয়। ফরাসি ভোক্তাদের প্রথম অভিযোগ হলো, ঘোড়ার মাংসই যদি মেশাবে তাহলে প্যাকেটের গায়ে ১০০% বিফ লিখল কেন? এটা প্রতারণা। দ্বিতীয় উদ্বেগ হলো, ঘোড়ার মতো যেসব প্রাণীকে মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে লালন-পালন করা হয় না, জ্বরের মতো অসুখেও তাদের ওপর প্রয়োগ করা হয় ফিনাইল বিউটাজন নামক রাসায়নিক। স্বভাবতই এমন ঘোড়ার মাংস খেলে প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে মানবদেহে। বিশেষত ওই ধরনের মাংস প্রচুর ও নিয়মিতভাবে খাওয়া হলে কিডনি বিপর্যয় দেখা দেয়াও অস্বাভাবিক নয়। তবে কোনো কোনো ব্যবসায়ী বলছেন, এমনটি ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে; এটি বাড়াবাড়ি রকমের ভোক্তা সচেতনতা! ফরাসি ভোক্তাদের তড়িৎ জবাব, খাদ্য ও ওষুধের মানের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয় তারা। আফসোস জাগে এটি ভেবে যে- আহা, কবে এমন সচেতন হয়ে উঠবেন স্থানীয় ভোক্তারা? অতটা না হোক তার চেয়ে কম হলেও তো চলত আমাদের।

ফাহমিদা ফেরদৌস

হোমো আরবানাস বৃত্তান্ত

দু’পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করেছিল হোমো হ্যাবিলিজ। ব্যবহার বেশি ছিল বলে দেহের অনুপাতে অস্বাভাবিক বড় ছিল হাত। হোমো হ্যাবিলিজ-এর অর্থও তাই হাতের কাজে পটু যে মানুষ। পারফরম্যান্সের দিক থেকে এর কৃতিত্ব ছাপিয়ে যায় হোমো (মানুষ) গ্রুপের অপর সদস্য হোমো ইরেক্টাস (খাড়া মানব)। সমাজ ব্যবস্থার সূচনাটা এদের হাতেই; মানব জাতির অভিবাসনও বাড়ায় এরা। তবে শেষে এসেও চমক দেখায় হোমো স্যাপিয়েন্স (জ্ঞানী মানুষ)। এরা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। শারীরিক পরিশ্রম কমিয়ে বাড়িয়ে তোলে মস্তিষ্কের ব্যবহার। আর সে বলেই ৪০ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা শুরু করে বাণিজ্য- তার পরে ব্যবসা; ১০ হাজার বছর আগে কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে সভ্যতা। এতে পরিবর্তন ঘটে মানুষের বৈজ্ঞানিক নামের; হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স (জ্ঞানী রুচিশীল মানুষ) হয় তখন। এসব তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খতা নিয়ে বির্তক থাকলেও বৈজ্ঞানিকদের মাঝে মতবিরোধ কম যে, বিবর্তনবাদ এক গতিশীল প্রক্রিয়া এবং তা অব্যাহত রয়েছে এখনো। সম্প্রতি পারমাণবিক জিন গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, আমাদের জৈবিক বিবর্তন চলমানই রয়েছে। দেখা গেছে, খাদ্যাভাসজনিত কারণে যেসব অঞ্চলে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের প্রকোপ বেশি যেখানে অতি ধীরে হলেও মানবদেহে এমন কিছু জিনগত পরিবর্তন আসছে যাতে কোলেস্টেরল, রক্তচাপ ও রক্তে চিনির পরিমাণ নিজে থেকেই কমে যায়! এদিকে কয়েকজন জৈব-সমাজ বিজ্ঞানী (বায়ো-সোশিওলোজিস্ট) লক্ষ্য করেছেন, বিভিন্ন দিকের মধ্যে মানুষের জীবনধারা তথা তার সামাজিক সম্পর্কের বিবর্তনই ঘটছে বেশি; বিশ্বজুড়ে মানুষ দ্রুত পরিণত হচ্ছে নগরবাসীতে। এমন মানুষের নতুন বৈজ্ঞানিক নামও ঠিক করে ফেলছেন তারা- হোমো আরবানাস অর্থাৎ নগরবাসী মানুষ। এদের কয়েকটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যও চিহ্নিত হয়েছে। নিতান্ত প্রয়োজনেও হোমো আরবানাস দ্রব্য বিনিময় প্রথায় যেতে চায় না। অথচ তারা শত্রুর সঙ্গেও শিথিল সম্পর্ক রাখে; অতীতের জ্ঞানী মানুষের মতো শারীরিক শক্তি প্রয়োগে লেগে পড়ে না।

বৈজ্ঞানিক ওই নামটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বিষয়ে নাকি কথা-বার্তা চলছে এখন। যদি সেটি সম্পন্ন হয়েই যায় আমাদের জন্য ভালো-মন্দ দুটো খবরই অপেক্ষা করছে সম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে নগরায়ন। ফলে নামটি স্বীকৃতি পেয়ে গেলে আমাদের রাজধানী ঢাকা হোমো আরবানাসের অন্যতম বৃহৎ আবাসস্থল হিসেবে খ্যাতি পাবে। দুঃখজনক উত্তর আসবে, ‘সবচেয়ে বাসযোগ্য নগরী কোনটি’- প্রশ্নটি উঠলে। কী বলব আমরা? অনেক দেশের ‘জ্ঞানী মানুষ’কেই ‘নগরবাসী মানব’ হতে ‘জ্ঞানী ও রুচিশীল মানুষে’র ধাপটি পেরিয়েছে। সম্ভবত কোনোক্রমে ওটি ডিঙ্গিয়েই ‘নগরবাসী মানবে’ পরিণত হয়েছে আমাদের মতো কিছু ‘সৌভাগ্যবান’। আর তাই ভীড়ে নির্বিকারভাবে অন্যকে মাড়িয়ে যাই আমরা; মোবাইল ফোনে উচ্চস্বরে কথা বলি বাসে। পরমহংস কথাটাই ভাবার্থ- যাকে জগতের কোনো কিছুই ব্যাকুল করে তোলে না। এখানকার অনেক নগরবাসীই সে অর্থে পরমহংস! তারা যত্রতত্র ময়লা ফেলা বা ফুটপাথে মোটরসাইকেল তুলে দিতে গ্লানি অনুভব করেন না। রাস্তায় হকার দেখলে তাদের মনে হয়- ঠিকই আছে, এরা কী করবে? আবার পাঁচ টাকার জন্য রিকশাওয়ালা বা বাস কন্ডাক্টরের সঙ্গে তুলকালাম বাঁধানোর পরও ভাবলেশহীন হয়ে যায়। এ নগরের যানজট মনে হয় স্থান ও সময় নিরপেক্ষ; পূর্বাভাষের ধারধারে না। ঢাকার হোমো আরবানাস লোডশেডিংয়ে; গ্যাস-পানির দুর্ভোগ মাসখানেক অতিক্রম না করলে তারা ক্ষুব্ধও হন না সেভাবে। বছর শেষে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি বা সরকারি সেবা নিতে গিয়ে হয়রান হওয়াটাও তাদের জীবনে স্বাভাবিক বৈকি। কথা হলো, এভাবে আর কতদিন? নাকি হাইওয়েগুলোতে আরেকবার জ্যাম বাঁধিয়ে মাটির টানে কি গ্রামে ফিরে যাব আমরা? বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ বলছে, সেটি সম্ভব নয়। উল্টো চলতি শতাব্দীতে দ্রুততর হবে নগরায়ন। তার কারণ- মানুষের অভাব অসীম ও সম্পদ সীমিত আর নগরে সম্পদ ব্যবস্থাপনা গ্রামের চেয়ে সার্বিকভাবে (পরিবেশ ইস্যু বাদ দিয়ে) আনুমানিক ২০ শতাংশ দক্ষ। আর তাই প্রাকৃতিক উৎস যে হারে ফুরিয়ে আসবে; নগরায়নও হবে যতটা দ্রুততর। এ অবস্থায় পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে নগর পরিকল্পনার ওপর নতুন করে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। জানি না, হোমো আরবানাসের কল্যানার্থে আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টিকে ওই অবস্থানের খানিকটা নিচু থেকেও দেখতে পারছেন কিনা।

ফাহমিদা ফেরদৌস

ব্যয় ও শক্তি সাশ্রয়ী সংরক্ষণ

দুই পর্বতশ্রেণী হিমালয় ও কারকোরামের মাঝে এবং সিন্ধু নদের উঁচু উপত্যকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক লাদাখ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এখানে। গ্রীষ্মে গরমও থাকে মন্দ নয়। তবে শীতে মাঝে মধ্যেই তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের নীচে। ফসলের আবাদ কঠিন বলে শীতে লাদাখের ধান, গম, আলু, পেঁয়াজ ও শাকসবজির জোগানটা আসে বাকি সময়ে সংরক্ষিত ভাণ্ডার থেকে। প্রজন্মান্তরে এমন সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু রেখেছে তারা; যাতে গৃহেই বাঁধাকপি, মূলা, গাজরের সবজি রেখে দেয়া যায় ৫-৬ মাস পর্যন্ত। জমি থেকে এনেই ধুয়ে বাঁধাকপি রাখা হয় বাড়ির নীচতলায়; অন্ধকারাচ্ছন্ন কিন্তু মোটামুটি বাতাস চলাচলের উপযোগী স্থানে। ছত্রাকপ্রবণ সবজি পেঁয়াজ সংরক্ষিত হয় দড়িতে ঝুলিয়ে। বেশি পচনশীল সবজি লাদাখবাসীরা রাখেন মাটির নীচে; কম পচনশীলটি মেঝেতে ফেলে। এভাবে কিন্তু নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার কিছু দেশেও টমেটো সংরক্ষণ করা হয় মাসাধিককাল। মাটি থেকে তোলার পরও ওই টমেটো দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটা সংরক্ষিত ছিল। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগা সত্ত্বেও লাদাখের প্রান্তিক চাষীদের কাছে সবজি সংরক্ষণের এমন শক্তি ও ব্যয় সাশ্রয়ী পদ্ধতি আজও জনপ্রিয়। ভূগর্ভে টমেটো সং রক্ষণের এমন এক পদ্ধতির কথা জানা যায় নাইজেরিয়ার মতো আফ্রিকার কিছু দেশেও।

হিমাগার এবং আরও উন্নত পদ্ধতি চালু থাকার পরও প্রাকৃতিক উপায়ে সবজি সংরক্ষণের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসছে এজন্যও যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গোটা বিশ্বে লক্ষ্যণীয়ভাবে বেড়েছে সবজি উৎপাদন এবং তার বিপরীতে জ্বালানি-বিদ্যুতের চাহিদা। এদিকে উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত কেবল সংরক্ষণের অভাবেই অপচয় হচ্ছে বিপুল সবজি। এ ক্ষেত্রে ব্যয় সাশ্রয়ী উপায় জানা না থাকায় আবার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বেশি। মাঝে মধ্যে কম দামে এসব বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। আর ভোক্তার? নিরুৎসাহিত হয়ে কৃষক সবজি উৎপাদন কমিয়ে দিলে পরবর্তী মৌসুমে ভোক্তাকে তা কিনতে হচ্ছে বেশি দামে; কিছু ক্ষেত্রে অযৌক্তিক দামে। আমাদের দেশে নাকি মোট উৎপাদিত শাকসবজির ২৫ শতাংশই বিনষ্ট হয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায়। গতকালের বণিক বার্তায়ও রয়েছে এমন খবর। অথচ শীতকালেই যে পরিমাণ শাকসবজি উৎপাদিত হয়, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া গেলে সারা বছর ধরে সেটি পরিভোগ কঠিন নয় বলে অনেকের ধারণা; যা করে দেখিয়েছে করছে মালয়েশিয়ার মতো অনেক দেশ। বড় কথা, দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সবজি সংরক্ষণের।

ভালো হতো, সারা দেশে সবজি (এর সঙ্গে ফলও থাকতে পারে) প্রক্রিয়াকরণ খোলা গেলে। এজন্য উন্নয়ন ও গবেষ্ণার ওপর জোর দিতে হবে। তাতে পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতও। অথচ এদিকে স্থানীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের নজর কমই বলে মনে হয়। সরকারের উচিৎ, এ বিষয়ে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেখা গেছে, গবেষণা ও উন্নয়ন সঠিক পথে চললে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে খাদ্য সংরক্ষণের প্রবণতাও কমে যায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের। হিমাগারের সংখ্যা বাড়িয়ে সবজি সংরক্ষণ করাটা কার্যকর কৌশল বলে বিবেচিত হতো, যদি দেশ জ্বালানি-বিদ্যুতের সংকটে না থাকত। বিদ্যামান প্রেক্ষাপটে এটি ভাবার সুযোগ কম। মনে হচ্ছে, এ অবস্থায় সার্বিকভাবে কৃষক পর্যায়ে সবজি সংরক্ষণের ওপর জোর দেয়াই ভালো। এ ক্ষেত্রে মধ্যসত্বভোগীরা যেন সাপ্লাই চ্যানেল নির্বিঘ্ন রাখতে পারেন সে দিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। প্রচলিত ব্যয় সাশ্রয়ী উপায়ে সবজি সংরক্ষণ বাড়াতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে এগিয়ে আসতে পারে এনজিও। এভাবে পল্লী কর্মসংস্থানেও নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে তারা।

ফাহমিদা ফেরদৌস

রাজা, নেতা আর সাধু

ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৪৮ সালের জানুয়ারীতে; যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। ফোরম্যান জেমস মার্শাল তার কারখানার অদূরে নদীর পানিতে ভেসে আসা চকচকে ধাতুর সন্ধান পান। খবরটা জানান কেবল বস জন শাটারকে। দু’জনে মিলে পরীক্ষার পর নিশ্চিত হন ধাতুটা স্বর্ণই। একদম নিখাদ। বুদ্ধিমান শাটার জানতেন দশ জন জেনে গেলে পরিস্থিতিতে সামাল দেয়া কঠিন হবে। ফলে মার্শালের ওপর নির্দেশ জারি হয়, কাকপক্ষী যেন টের না পায়। কেউ না জানলেও এমন ঘটনা নিজের পক্ষে হজম করা শক্ত। তবে উচ্চাভিলাসী মানুষ ছিলেন না শাটার। আমেরিকান রিভারে পাওয়া স্বর্ণ ঘিরে তার কল্পনার দৌড় ছিল, এগুলো বেচে যে ডলার পাবেন, তা দিয়ে কয়েকশ’ একর জমি কিনবেন। চাষবাস করবেন সেখানে। ভালো কয়েকজন কর্মী পেলে গরু এবং ঘোড়ার খামার দেয়ার ইচ্ছাও আছে তার। ভবিষ্যৎ নিয়ে সলা-পরামর্শ চললো মার্শালের সঙ্গে। মার্শাল জানালো তার কয়েক বন্ধুকে। শত একর জমি কেনার পয়সা কোত্থেকে আসবে- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেরুলো নদীতে স্বর্ণ পাওয়ার খবর। শুরু হয়ে গেলো ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত গোল্ডরাশ।

গোল্ডরাশের স্পিরিট নানা দেশ-মহাদেশ ঘুরে এখন এশিয়ায়; আরো সুনির্দিষ্ট অবস্থান- আমাদের প্রতিবেশী ভারতের উত্তর প্রদেশে। না, সেখানে নদীর তীরে স্বর্ণের তাল পান নি কেউ। খবর চেপেও রাখতে হয় নি। দণ্ডিয়া খেরা গ্রামের সাধু শোভন সরকার স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছেন তার আশ্রমের মাটির তলায় হাজার টন স্বর্ণ মজুত! স্বপ্নে নানা কিছু বাংলাদেশের কিছু ধ্যানী ব্যক্তিও পান। অবশ্য সে প্রাপ্তি অধিকাংশ সময় ধন্বন্তরী ওষুধ ও ধাতু মিশ্রণের অভূতপূর্ব ফর্মূলা ঘিরেই। মাঝে মাঝে কলস-দু’কলস স্বর্ণের স্বপ্ন দেখলেও তার সঙ্গে ইতিহাসের যোগসূত্র এখানে তেমন দেখা যায় না। ওদিক থেকে শোভনের স্বপ্ন বস্তু ঘনিষ্ঠ ও আধুনিক। তার ওপর অর্থনীতির ছোঁয়া আছে। হাজার টন স্বর্ণের বাজার মূল্য তো কম নয়। ওগুলোর ঐতিহাসিক মূল্যও যোগ করতে হবে তার সঙ্গে। একবারে না হলেও আন্তর্জাতিক নিলাম কেন্দ্রগুলোয় ধীরে ধীরে তোলা হলে, সুযোগ মতো বড় দানও মারা যাবে।

শোভন সরকারকে স্বপ্নে এ স্বর্ণের খোঁজ দিয়েছেন রাও বক্স সিং। তিনি ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হন। এত বছর পরে রাও বক্স কেন স্বর্ণের খোঁজ দিলেন তা একটা প্রশ্ন বটে। হয়তো যোগাযোগের ভালো উপায় তিনি পান নি এতদিন। কিংবা তার ভয় ছিল, স্বপ্নে বলে দিলেন আর ওই ব্যক্তি নিজ স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যবহার করলো স্বর্ণ। আরেকটি সম্ভাবনাও কিন্তু উড়িয়ে দেয়া যায় না। হয়তো কোনোভাবে ভারতের স্বর্ণ চাহিদা ও বাজেট ঘাটতির নিয়ে নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ টের পেরেছেন তিনি।

সমৃদ্ধি নিয়ে দুশ্চিন্তা অবশ্য উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদবেরও কম নেই। রাজ্য উন্নয়নের চিন্তায় তার ঘুম হারাম হয়ে যাবার জোগাড়। ফলে গোপনে নাকি তিনি দেখাও করেছেন শোভন সরকারের সঙ্গে। একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, রাও বক্স সিংয়ের স্বর্ণ রাজ্যের উন্নয়নে গেলে আপত্তি নেই শোভনের। এদিকে গ্রীন সিগন্যাল পেয়েই খোন্তা-কোদাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ও জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। আর পুরো ঘটনা চোখে চোখে রাখছে কেন্দ্র সরকার। তবে নিছক স্বপ্নাদেশ নয়। ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও আছে কিছু। স্বপ্নে ভুল করে হাজার টন বলে বসতে পারেন রাও বক্স। ঘুমের ঘোরে শুনতে ভুল হতে পারে শোভন সরকারেও। হাজার না হোক, শত- এমনকি অর্ধশত টন স্বর্ণও যদি ওঠে মাটির তোলা থেকে খারাপ কী? অর্থনৈতিক দিক থেকে মন্দ না। সমস্যা একটা আছে, তা রাজনীতি ঘিরে। ধরা যাক, স্বর্ণ পেয়েই কেন্দ্রীয় নির্বাচনে যোগ দিতে চাইলেন অখিলেশ সিং যাদব। কিংবা শোভন সরকার বলে বসলেন, টেকনোক্র্যাট একটা মন্ত্রীত্ব তার চাই-ই চাই। তখন? ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক অভিলাষ তো অনেকখানেই দেখা যায়।

ফাহমিদা ফেরদৌস

Leave a comment