From 2011-15

জিদে চিড়া ভিজলো না বলে-

কিম জং ইলের পর উত্তর কোরিয়ার দায়িত্ব নেন তার ছোট ছেলে কিম জং উন। তাকে ঘিরে একেক জনের প্রত্যাশা ছিল একেক রকম। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশা ছিল- সুইজারল্যান্ডে পড়াশুনা করা উন পিতাকে অনুসরণ করবেন না; তার শাসনামলে পশ্চিমের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কোন্নয়ন ঘটবে। ইলের সময়ে প্রধানত দক্ষিণ কোরিয়াকে চাপে রাখতেই বেশ কয়েকবার সামরিক মহড়া চালানো হয় কোরীয় উপদ্বীপে। সে সময় পারমাণবিক শক্তিও অর্জন করে বিশ্বের একমাত্র সমাজতান্ত্রিক এ দেশটি। উন ক্ষমতা নেয়ায় সেটি রহিত হবে এবং উন সামরিক শাক্তির বদলে অর্থনৈতিক শক্তি অর্জনেই বলে ভেবেছিলেন দক্ষিণ কোরীয় নেতারা। কেউ কেউ এমন কল্পনাও করছিলেন, এবার মুক্ত অর্থনীতিতে প্রবেশ করবে উত্তর কোরিয়া; আর তাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করবেন এশিয়ান মিরাকল দক্ষিণ কোরিয়ার ধনাঢ্য বিনিয়োগকারীরা। তেমন কিছু দেখা যায় এখনো।

উনকে ঘিরে উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষের কী প্রত্যাশা ছিল ও আছে, জানা যায় নি তাও। সেটি জানা বেশ কঠিন। দেশটিতে সরকারি অনুমতি ব্যতীয় গণমাধ্যমে মত প্রকাশ করা দণ্ডনীয়; তা প্রচার করা তো বটেই। তবে উন ক্ষমতায় আসার পর গণমাধ্যমে সাধারণ মানুষের যে প্রতিক্রিয়া নেয়া হয়েছিল তাতে বোঝা গেলো, তারা চান- কিম জং ইল যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলেন উন তার চেয়েও বেশি উচ্চতায় তুলে ধরবেন উত্তর কোরিয়ার ঝাণ্ডা। সেটি কীসের ঝাণ্ডা- সামরিক না অর্থনৈতিক সেটি অবশ্য খোলাসা হচ্ছে না এখনো। এদিকে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা চেয়েছিল- উন তাদের বেতন-ভাতাদি বাড়াবেন; পদস্থ কর্মকর্তারা সম্ভাবত চেয়েছিলেন- তাদের তরুণ নেতা এমন কিছু করে দেখাবেন যাতে দক্ষিণ কোরিয়াসহ সমগ্র বিশ্ব চুপ মেরে যায়। বর্তমানে দেশটির নীতিনির্ধারণে আরেকটি পক্ষ রয়েছে, যারা সাধারণ মানুষের সামনেও তেমনভাবে আসেন না। এরা হলেন, কিম জং উনের বোন ও তার স্বামী। বলা হয়, তরুণ উনের ওপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব তাদেরই।

সম্প্রতি দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয় হতে ও জনগণের আস্থার্জনে এদের প্ররোচনাতেই নাকি মহাশূণ্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঘোষণা দেন উন। আর ঘোষণাটি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে যায় গোটা বিশ্বে। এতে যথারীতি প্রথমেই নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র; পরে রাঙ্গায় চোখ। দক্ষিণ কোরিয়া যে ভয় পেয়েছে তা তাদের বক্তব্য শুনেই বোঝা গেলো। আতংক প্রকাশ করল জাপানও। উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংয়ের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যেই ছোঁড়া হচ্ছে রকেটটি। ওই বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্যতা পেলো না জাপানীদের কাছে- স্যাটেলাইট ক্যাপস্যুলে নেতার পোস্টার না দিয়ে যদি পারমাণবিক বোমা বসিয়ে দেয় উত্তর কোরীয়রা? ফলে ঝুঁকি না নিয়ে অব্যাহত নিন্দাবাদ চালানোর পাশাপাশি তারা প্রস্তুত রাখল, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা তাদের ক্ষেপনাস্ত্র বিধ্বংসী মিসাইল ব্যাটারিগুলোকে।

মজার বিষয়, এত বড় ঘটনায় অন্য দেশের ক্ষেত্রে ঘটলে ব্যাপক প্রক্রিয়া দেখিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এবার তেমনটি দেখা গেলো না। সম্ভবত তারা নজর রাখছিল, উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র ও কারিগরি সহযোগী রাশিয়ার ওপর। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এলেও এবারে রাশিয়া কিন্তু তাদের এক প্রকার বারণই করেছিল সরাসরি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে না যেতে। কয়েকজন রাশিয়ান বিজ্ঞানী বলেছিল, মহাশূণ্যযান কেন দূরপাল্লার মিসাইল তৈরিতেও সক্ষমতা হয় নি উত্তর কোরিয়ার। উন রকেট সায়েন্স তেমন বোঝেন না; বুঝতে চানও না। তিনি জেদ ধরলেন, তিনি যেহেতু ঘোষণা দিয়েই ফেলেছেন যত শীঘ্র সম্ভব রকেট ওড়াতে হবে।

রকেট ওড়ানো হল। উৎক্ষেপণের ১০ মিনিটের মাথায় বিস্ফোরিত হলো সেটি। তার এক টুকরা উদ্ধার করা গেলো। কিন্তু নেতা কিম ইল সাংয়ের পোস্টার সম্বলিত রকেটের টুকরাটি খুঁজতে বেগ পেতে হচ্ছ এখনো। আর কী লাগে? কিম জং উনের আনাড়িপনা ও জেদ নিয়ে হাসাহাসি পড়ে গেলো পশ্চিমে; দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান ফেলল স্বস্তির শ্বাস। জিদে চিড়া ভেজাতে না পেরে উন হলেন ‘বিব্রত’।

নিয়াজ মাখদুম

অভিমান নয় তো?

বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে জিমি সিডন্সের পর ২০১১ সালের জুলাইয়ে দায়িত্ব নেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার স্টুয়ার্ট ল। দায়িত্ব নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাফল্য পান নি তিনি; বরং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-দর্শক নির্বিশেষে তার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন তখন। কারণ একই বছরের আগস্টের তার তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ দল টেস্ট ও ওয়ান ডে ম্যাচে হারে জিম্বাবুয়েতে। বিসিবি, নির্বাচকমণ্ডলী ও কোচের মধ্যে সমন্বয়হীনতার আভাষও মেলে সে সময়। দলের মধ্যেও ঘটে শৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো কয়েকটি ঘটনা। কয়েকজন ক্রিকেটার বাজে আচরণও করেন স্টুয়ার্টের সনে। এদিকে দলীয় শৃংখলা বজায় রাখতে কিছু ক্ষেত্রে গো ধরে বসেন তিনি। আর এতেই নাকি তার ওপর নাখোশ ছিলেন বিসিবি সভাপতি।

অধিকাংশ মানুষ এসব ভেতরের রাজনীতি বোঝেন না, বুঝতে চানও না। তারা শুধু দেখতে চান, বাংলাদেশ দল জিতেছে। ফলে জিম্বায়ুয়ের কাছে হারায় সাধারণ দর্শকদের অনেকেই কোচ হিসেবে স্টুয়ার্ট লকে পুনর্বিবেচনা করে দেখার দাবি জানিয়েছিলেন। এ দেশের ক্রিকেটপাগল দর্শকের সঙ্গে কম-বেশি মিল রয়েছে ইতালিয়ান ফুটবলপ্রেমীদের। তাদের সম্বন্ধে কিছু কথা প্রচলিত আছে। সেগুলো হলো, এরা কেবল দলের জয় দেখতে চান; কোনো কারণে দল পরাজিত হলে তাতে সত্যিই খেলোয়াড়-কোচের গাফিলতি ছিল কিনা, তাও শুনতে চান না; ফলে দল পরাজিত হলে এরা অবলীলায় মুন্ডুপাত করেন খেলোয়াড় ও কোচের। খানিকটা হলেও এ ধরনের গঞ্জনা স্টুয়ার্টের জুটেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জিম্বাবুয়ে সফরে।

তখন কোনো রকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান নি তিনি। সম্ভবত পদত্যাগের সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন তখনই। তবে পরাজয় মেনে নিয়ে দায়িত্ব ত্যাগ করা আত্ম-অবমাননার শামিল। ফলে তিনি হয়তো চাইছিলেন নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই পদত্যাগ করবেন। তার ক্ষমতার স্বাক্ষরতা স্টুয়ার্ট রাখলেন ২০১২ সালের এশিয়া কাপে। এতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করল বাংলাদেশ দল। ক্রিকেটারদের পাশাপাশি প্রশংসা হলো কোচেরও। ওই সাফল্যের রেশ কাটতে না কাটতেই গত সোমবার কোচের পদ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেছেন স্টুয়ার্ট ল। বলেছেন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। একজন পেশাদার ব্যক্তিগত আবেগে দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন- কতটা বিশ্বাসযোগ্য এ কথা? অবশ্যই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোটা মানুষের জিওন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছেড়ে না গিয়ে এখানেই পরিবারকে নিয়ে থাকতে পারতেন তিনি? তাছাড়া এমন তো নয় যে, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে কোচের দায়িত্ব পালন করতে করতে তিনি ক্লান্ত। তাই সাফল্য ছেড়েও এখন উতলা হয়েছেন পরিবারের সঙ্গে থাকতে? ফলে সন্দেহ হচ্ছে, এ দেশের খেলোয়াড়-দর্শক-বিসিবির ওপর অভিমান করেন নি তো স্টুয়ার্ট?

অনেকে বলছেন, তিনি চলে যাচ্ছেন জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়াতে কোচের চাকুরি পাওয়ায়। এমন যদি হতো তিনি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের কোচ হচ্ছেন, তাহলে উক্তিটি আরও বিশ্বাসযোগ্য হত। কারও কারও ধারণা, এশিয়া কাপের সাফল্য স্টুয়ার্টকে লোভী করে তুলেছে। তিনি এবার বেশি দামে অন্য দেশের কোচ হবে। মন সায় দেয় না এতেও। বাংলাদেশী দর্শকদের যে উষ্ণতার কথা বারাবার উল্লেখ করতেন তিনি, আরও বেশি আয়ের প্রলোভনে ত্যাগ করবেন সেটি? কেউ কেউ বলছেন, স্থানীয় ক্রিকেটের নোংরা রাজনীতি ঢুকে পড়ছে। এ পরিবেশে স্টুয়ার্টের পক্ষে থাকা সম্ভব ছিল না। এশিয়া কাপের আগেই তো বিসিবি সভাপতি ও প্রধান নির্বাচকের মাঝে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল। শেষ পর্যন্ত জটিলতা নিরসনে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। এ ধরনের কিছু ‘সমস্যা’ স্টুয়ার্টের সঙ্গেও এক বা একাধিক ব্যক্তির হয়ে থাকতে পারে।

একেবারে উড়িয়ে দেয়া যান না এমন অভিযোগ। এসবের সত্যতা যাচাই করাও জরুরি তাই। স্টুয়ার্ট ল যাচ্ছেন, তার পরে অন্য কেউ আসবেন ক্রিকেট দলের কোচ হয়ে। তার ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। ফলে কোনো সমস্যা থাকলে এখনই সেটি দূরীকরণে মনোযোগী হওয়া দরকার।

ফাহমিদা ফেরদৌস

ক্রীড়া অর্থনীতি

পেতে চাইলে বিনিয়োগ করুন অলিম্পিকসে

আজই শেষ হচ্ছে লণ্ডন অলিম্পিকস (মূলত সামার অলিম্পিকস; একই স্থানে কিছুদিন পর শুরু হবে প্যারাঅলিম্পিকস), ২০১২। এরই মধ্যে এটি থেকে অর্থনীতিবহির্ভূত তো বটেই অর্থনৈতিক প্রত্যাশা-প্রাপ্তির খেরোখাতা নিয়েও বসে গেছেন আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীরা। এত বড় একটা আয়োজন ঘিরে ব্যবসাপাতি ভালো হওয়ার কথা। আয়োজকদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠা নিরুদ্বেগ বলছে, মন্দ হয় নি ব্যবসাটা। তবে সেটি আশানুরূপ কিনা, জানা যায় নি এখনো। প্রতিটি অলিম্পিক গেমসেই স্বতন্ত্র কিছু খোঁজা হয়- সম্ভবত যাতে সুবিধা হয় মনে রাখতে। লণ্ডনেও তেমন ঘটনাও রয়েছে বেশ কিছু। বেইজিং অলিম্পিকসে আশানুরূপ ভালো করে নি টিম ইউএসএ। তার কারণ হিসেবে অনেকে তুলে ধরনের অদ্ভূত সব যুক্তি (অধিকাংশই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব)। চীন নাকি সিংহভাগ ভেন্যুতেই এমন ব্যবস্থা রেখেছে যাতে পদক না পায় যুক্তরাষ্ট্র; পেলেও তা যেন স্বর্ণপদক না হয়। অবশ্য মূলধারার মিডিয়া বলছিল, অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনে নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারছে না চাপা থাকা মার্কিন ক্রীড়াবিদরা। তবে সেসব উক্তি অগ্রাহ্য করে সুইমিং পুলে অসামান্য নৈপূণ্য দেখান মাইকেল ফেলপস। লণ্ডনে ইতিহাস গড়েছেন তিনি; অলিম্পিকসে রেকর্ডসংখ্যক মেডেল জিতে।

বেইজিংয়ে একশ্রেণীর মার্কিন মিডিয়ার দেয়া যুক্তির একটা উপযোগীতা অবশ্য মিলল এবারের অলিম্পিকে। ১৯৯৪ সালের পর থেকে অলিম্পিকস ও ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সুবিধা করতে পারছে না এক সময়কার হকির দুই পরাশক্তি ভারত ও পাকিস্তান। লণ্ডনে ভারত বিদায় নিয়েছে কারও সঙ্গে না জিতে। আর পাকিস্তান দেশে ফিরেছে ৭-০-তে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হেরে। হারার পেছনে ‘ভালো’ যুক্তি দেখানো হয়েছে, নতুন টার্ফে নাকি এশিয়ানদের পক্ষে হকি খেলা কঠিন!

লণ্ডনে সার্বিকভাবে ভালোই করেছে চীন। স্টেফানি রাইসদের (রায়ান লকটিকেও) বিস্মিত করে স্বর্ণ জিতেছে ইউ শিয়েন। তবে ওই সবগুলো পদকও যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে থাকার জ্বালা-যন্ত্রণা মেটাতে পারবে কিনা, বলা মুশকিল। গতির নতুন রেকর্ড না গড়লেও এরই মধ্যে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছেন উসাইন বোল্ট; দেখিয়ে দিয়েছেন জ্যামাইকান নারী অ্যাথলিটরাও। দীর্ঘদিন পর হোমগ্রাউন্ডে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পদক এবার পেলো গ্রেট ব্রিটেন। অবশ্য সেখানকার অলিম্পিক কমিটি ইচ্ছা, আরও পাওয়া উচিৎ ছিল। এদিকে প্রত্যাশা সম্পূর্ণ পূরণ করতে না পারা ইলিনা ইসিনবায়েভার মতো কেউ কেউ বলেছেন, এতেই চলবে। রাশানদের সম্বন্ধে বলা হয়, জিমন্যাসটিকস না থাকলে তারা স্বর্ণপদক পেতো না। মারিয়া শারাপোভা সম্ভবত এটি ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন; পারেন নি। লণ্ডন ট্রাকেই দৌড়ালেন প্যারাঅলিম্পিক থেকে আসা প্রথম মানব অস্কার পিস্টোরিয়াস। অলিম্পিকসে প্রথমবারের মতো এবার দেখা গেলো সৌদি নারীদের। এতে উইমেন্স বক্সিং ইভেন্টও শুরু হলো এখানে।

তবে লণ্ডন অলিম্পিকসকে ভিন্নভাবে দেখতে চান যুক্তরাজ্যের ক্রীড়া অর্থনীতির অধ্যাপক ডেভিড ফরেস্ট। তিনি এক গবেষণায় দেখেছেন, এতে পদকপ্রতি রাষ্ট্রীয় ব্যয় হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। বিষয়টি মজার বটে। ডেভিড হিসাব করে দেখছেন, বিশ্ববাজারের দাম অনুযায়ী এবারের অলিম্পিকসে প্রতিযোগীদের দেয়া স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক তৈরিতে খরচ পড়েছে যথাক্রমে ৫৫ হাজার, ২৮ হাজার ও ৫ শত টাকার কাছাকাছি। ব্রোঞ্জ পদকের দাম এত কম পড়ার অন্যতম কারণ, এটিতে প্রচুর পিতল ছাড়াও রয়েছে সামান্য দস্তা ও টিন। এটি কিন্তু ব্রোঞ্জবিজয়ীদের আরেকবার মনোভঙ্গের কারণ হতে পারে।

ডেভিড পরবর্তী গবেষণা চালান, এসব পদক অর্জনে প্রতিটি দেশকে কী মাত্রায় আর্থিক ব্যয় স্বীকার করতে হয়। তাতে উঠে এসেছে মজার সব তথ্য। দেখা গেছে, অশ্ব পরিচালনা, শুটিং, টেবিল টেনিস, ভারোত্তোলন, তায়কোয়ান্ডো, ওয়াটার পোলো প্রভৃতি ক্রীড়ায় পদক পেতে খরচ করতে হয়েছে সবচেয়ে কম; স্বর্ণ-রৌপ্য-ব্রোঞ্জ পদকভেদে গড়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে অতীতের তুলনায় বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে সাঁতার ও সিনক্রোনাইজড সাঁতার। উভয় ক্ষেত্রে পদক পেতে খরচ করতে হচ্ছে গড়পড়তা ৮৫ কোটি টাকার মতো। তবে সবচেয়ে খরুচে হয়েছে সম্ভবত হকি খেলা। অনেক দেশ ১২০ কোটি টাকা খরচ করেও পায় নি কোনো পদক। এদিকে মোটামুটি ৪৫ কোটি টাকা খরচ করলেই প্রবলভাবে বেড়ে যাচ্ছে জুডো ও তায়কোয়ান্ডোতে খোদ স্বর্ণপদক পাওয়ার সম্ভাবনা। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, এসব হিসাবই করা হয়েছে এক অলিম্পিক থেকে অন্যটির মধ্যবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দকৃত শুধুই রাষ্ট্রীয় ব্যয় হিসাব ধরে; ভেন্যুতে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া প্রভৃতি খরচ যোগ করা হয় নি এতে। অলিম্পিকফেরত, ওয়াইল্ড কার্ডধারী আমাদের ক্রীড়াবিদদের জন্য সান্ত্বনার বস্তু হতে পারে গবেষণাটি। তবে ডেভিড অবশ্য বলছেন, কেবল উন্নত দেশগুলোই বেশি বিনিয়োগ করবে আর তিনরঙ্গা পদক থলেতে ভরবে, বিষয়টি তেমন নয়। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেরও অলিম্পিকসে পদক জয়ের সুযোগ রয়েছে যদি তারা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে শুটিং, কুস্তি, জুডো ও জিমন্যাস্টিকসে সুবিধামত বিনিয়োগ বাড়াতে পারে।

কিছু বিষয় ডেভিডের গবেষণায় বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, পদক জিততে তো ক্রীড়াবিদের প্রতিভা, শারীরিক সামর্থ্য ও জোরালো মনোবলও প্রয়োজন। এটি অস্বীকারের উপায় নেই অবশ্য। স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত অনেক দেশেই রয়েছে এমন দৃষ্টান্ত। তবে সেগুলো ব্যতিক্রম। পদক অর্জন করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগও হতে হয় যথাযথভাবে। পশ্চিমা দেশসহ চীন-জাপানের দিকে তাকালেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে অলিম্পিকসে বিনিয়োগের বিষয়টি। অলিম্পিকসে এখনো কিছু পাই নি আমরা। এ অভাব দূর করতে অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয়ের সঙ্গে পর্যাপ্ত বিনিয়োগেও মনোযোগী হওয়া দরকার।

ফাহমিদা ফেরদৌস

খেলার মাঠে সহিংসতা

২০০০ সালের ঘটনা। সিডনি অলিম্পিক চলছে। টিভিতে পুরুষ হকি দেখাচ্ছিল একদিন। নেদারল্যান্ড বনাম জার্মানীর টান টান উত্তেজনার খেলা। গ্রুপের অন্য দল পাকিস্তান এরই মধ্যে দ্বিতীয় পর্বে উঠেছে। তাদের সঙ্গী হতে এ খেলায় জিততে হবে জার্মানীকে। নেদারল্যান্ডকে ড্র করলেও চলবে। ভালোই খেলছিল দু’পক্ষ। খেলা শেষ হওয়ার তখন ১০ মিনিটের মতো বাকি। নেদারল্যান্ড গোলপোস্টের কাছে পেনাল্টির আবেদন করল জার্মানরা। রেফারি গ্রাহ্য করলেন না এটি। কয়েকজন জার্মান খেলোয়াড় বাকবিতন্ডা জুড়ে দিলেন তার সঙ্গে। রেফারির পক্ষে কয়েকজন নেদারল্যান্ডের খেলোয়াড়কেও দেখা গেলো। এক পর্যায়ে বাকযুদ্ধ শুরু হলো জার্মানী বনাম রেফারি বনাম নেদারল্যান্ডের মধ্যে। মাঠে দর্শক তেমন ছিলেন না- ৫০ জনের বেশি হবে না। হঠাৎ রেফারি ক্ষিপ্ত হয়ে উভয় দলেরও দু’জনকে দেখালেন লাল কার্ড। কিছুক্ষণ মাঠ স্তব্ধ। একটু পর দেখা গেলো হকিস্টিক উঁচিয়ে জার্মানী ও নেদারল্যান্ডের খেলোয়াড়রা তেড়ে আসছে রেফারির দিকে। সে বেচারা প্রাণ বাঁচাতে ভোঁ দৌড়। অনেক খেলায়ই এমন ঘটনা ঘটে। তবে কিছু ক্ষেত্রে উত্তেজনা মোড় নেয় সহিংসতায়। অবশ্য সহিংসতা বাড়তে বাড়তে কিছু খেলার অলিখিত সংস্কৃতিতে পরিণত হতেও দেখা যায়। যেমন আইস হকি। এতে কেবল চোখ ছাড়া প্রতিপক্ষের শরীরে স্থানে আঘাত করা যায়; হকিস্টিক দিয়েও। একবার ৬ জন আইস হকি খেলোয়ার নিহতও হন এভাবে। এ ক্ষেত্রে সহিংসতা রোধে নেয়া হয়েছে অনেক ব্যবস্থাই। হকিস্টিক এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে আঘাতপ্রাপ্তরা না মারা যান। কঠোর আইন করা হয়েছে; আরও বাড়ানো হয়েছে খেলোয়াড়ের দেহসুরক্ষা। দর্শক ও খেলোয়ারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যাতে তারা ক্রীড়াসুলভ মনোভাব দেখান। এসবের পরও অনেক সময় স্টেডিয়ামে খেলোয়াড় ও দর্শকরা মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। আচরণ দেখে মনে হয়, পৈত্রিক সম্পত্তি উদ্ধারে খেলা দেখতে ও খেলতে এসেছেন তারা।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আগ্রাসন মৌলিক ও অন্তর্গত মানব বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, খেলার মাঠে সহিংসতার পেছনে দর্শক-সমর্থকদের উস্কানিই বেশি। তাতে খেলোয়াড়রা সাড়া না দিতে পারলেই বোধকরি সমর্থকরা নিজেরা দায়িত্ব নেন; নেমে যান রণক্ষেত্রে। প্রতিপক্ষের সমর্থক ও খেলোয়াড়ের ওপর চড়াও, দাঙ্গা এবং নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা এভাবে ঘটে। এমনই একটি ঘটনা দেখা গেলো গত বুধবার মিশরের পোর্ট সৈয়দ স্টেডিয়ামে। সমর্থকদের বাঁধানো সহিংসতায় নিহত হলেন অন্তত ৭৪ জন। অনেক সময় উত্তেজিত সমর্থকদের মাঝে বাধা হিসেবে থাকে শক্ত রেলিং। সে ব্যবস্থা ছিল না এতে। শুরুতেই উত্তেজনা দমন করতে পারলেও হয়তো এতদূর গড়াত না পরিস্থিতি। এ ক্ষেত্রে মিশরের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের অভিযোগ, এটি সেনাবাহিনীর কারসাজি; নইলে দাঙ্গা দমনে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতটা নিস্পৃহ ছিল কেন। অবশ্য মাঠে অ্যাকশনে না গিয়ে ভালোই হয়েছে সম্ভবত। ২০০১ সালে ঘানায় এ ধরনের দাঙ্গায় টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হলে মানুষজন আতংকিত হয়ে বেরুনোর চেষ্টা করেন ও পদপিষ্ট হয়ে মারা যান ১২৬ জন। আসলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শক্ত রেলিং ও পর্যাপ্ত নির্গম পথ রাখা হয় স্টেডিয়ামে।

এ দেশেও ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাকে কেন্দ্র করে মাঠ ও মাঠের বাইরে খেলোয়াড় এবং সমর্থকদের সৃষ্টি করা সহিংসতার ঘটনা রয়েছে। দৃষ্টান্ত রয়েছে এভাবে দু’গ্রামে দাঙ্গা বাঁধারও। এ ক্ষেত্রে মানুষ নিহত হওয়ার খবর অবশ্য কম। তবু এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিৎ আমাদেরও। আর এ ক্ষেত্রে প্রথমেই দরকার দর্শক ও খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্রীড়াসুলভ মনোভাব তৈরি ও খেলার মাঠে সেটির প্রদর্শন।

ফাহমিদা ফেরদৌস

হাইব্রিড মাছের বাম্পার উৎপাদন

সাতক্ষীরা অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিড কৈ চাষে খামারিদের আগ্রহ বাড়ছে বলে খবর রয়েছে গতকালের বণিক বার্তায়। এ ধরনের মাছ উৎপাদনে খামারিদের আকর্ষণের কারণ কয়েকটি। সাধারণত এসব প্রজাতি দেশীটির চেয়ে আকারে বড় হয়। এগুলো বাড়েও দ্রুত। তাছাড়া বাজারে এখন মাছের বিপুল চাহিদা। অথচ মাছের তেমন সরবরাহ আসছে না প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে। হাইব্রিড মাছ চাষে খরচ খানিকটা বেশিই হয়। অবশ্য মুনাফা আরও বেশি হওয়ায় পুষিয়ে যায় এটা। নিয়ম করে দিনে কয়েকবার খাবার দিতে হয় এ মাছকে। তবে রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম এগুলোর। বিদেশী মাছের সঙ্গে স্থানীয় জাতটির সংকরণে উৎপন্ন এসব মাছের চাষ দেশে বাড়ছে লক্ষ্যণীয়ভাবেই। খামারিরা এ থেকে লাভও করছেন প্রচুর। অবশ্য লাভ হবে না কেন- এক মৌসুমে প্রতি হেক্টর থেকে পাওয়া যায় টনখানেক হাইব্রিড জাতের কৈ!

ভোক্তা চাহিদার সঙ্গে বিশেষত হাইব্রিড তেলাপিয়া, পাঙ্গাস ও মাগুরের উৎপাদনও বাড়ছে দেশে। সত্য বলতে, এখানকার নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে আমিষের প্রধান উৎস এখন- ফার্মের মুরগি ও ডিম এবং চাষের মাছ। শুরুতে খাবার হিসেবে ফার্মের ডিমের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখালেও বর্তমানে কেউ কেউ এটি গ্রহণ করে আমিষের ভালো বিকল্প না পেয়ে। আবার কারও কারও রুচিতে এমন পরিবর্তন এসেছে যে, তাদের কাছে দেশীর চেয়ে ফার্মের মুরগী ও ডিমই ভালো। নরম ও বেশি মাংস পাওয়া যায় এসব মুরগী থেকে। এতে তা রান্নাও করা যায় নানাভাবে। ফার্মের ডিম দেশীটির চেয়ে বেশ বড়। এসব কারণে আগে ফার্মের মুরগী ও ডিমের সমালোচনা করা হলেও স্থানীয় ভোক্তাদের একটি বিরাট অংশ এটির ক্রেতা এখন। প্রকৃতপক্ষে ফার্মের মুরগী আমাদের রুচিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে; একটি প্রজন্মকে করেছে এর ওপর নির্ভরশীল।

ফার্মের মুরগীতে অনেকটা সহজেই অভ্যস্ত হয়েছিলাম আমরা। হাইব্রিড মাছের ক্ষেত্রে অবশ্য এটা দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত এ জন্য চাহিদা আরও বাড়তে হবে, যখন আমিষের অন্যান্য উৎসের তুলনায় এটি হয়ে উঠবে সহজলভ্য। সে যাইহোক, ফার্মের মুরগী নিয়ে শুরুতে যে ধরনের মিথ ছিল, সেটি দেখা যাচ্ছে হাইব্রিড মাছের ক্ষেত্রেও। বলা হচ্ছে, এগুলোর আকারই যা একটু বড়, কিন্তু একেবারে স্বাদহীন। অবশ্য সমালোচনার পরও এ জাতের মাছের চাহিদা ও বিক্রি কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে উপায়ও নেই। ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় দেশী কৈ পাওয়া যায় খুচরা বাজারে। এ দিকে হাইব্রিড জাতের কৈয়ের দাম কেজিপ্রতি মোটামুটি ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। সত্য যে, একেবারে স্বাদহীন না হলেও এসব মাছের স্বাদ কম। তার কারণ, যেসব জাতের সঙ্গে স্থানীয় মাছের সংকর ঘটানো হয়, সেগুলোর উৎপত্তিস্থলের পরিবেশ। এ অবস্থায় আমাদের রুচি অনুযায়ী হাইব্রিড জাতের স্বাদে পরিবর্তন আনাটা জটিল কিছু নয়। এজন্য দরকার গবেষণার মাধ্যমে বিদেশী ও স্থানীয় জাতটির কয়েক প্রজন্মের উন্মেষ। এ ক্ষেত্রে গ্রেগর মেন্ডেলের সূত্র প্রয়োগ করে গন্ধ বদলানোও কঠিন হবে না।

গবেষণায় জোর দিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল, উচ্চ উৎপাদনশীল ও কম রোগের ঝুঁকিযুক্ত এসব মাছ চাষে খামারিদের উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। সীমিত পরিসরে নদ-নদী, খাল বিলেও এমন মাছের চাষ সম্ভব। এর আগে লাখো বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে পোল্ট্রি শিল্পে। সে তুলনায় মাছ চাষের অবদান কম। এটি বাড়িয়ে তোলা যায় ব্যাপকভাবে হাইব্রিড মাছের চাষ করে।

নিয়াজ মাখদুম

সহিংসতার ছাত্ররাজনীতির অবসান হোক

কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে খানিকক্ষণ কথাই বলতে পারেন নি অর্জুন। একই বিশ্বরূপ আমরা দেখছি এ দেশের ছাত্ররাজনীতিতেও। মাঝে মাঝে শিক্ষাঙ্গনে এমন ঘটনা ঘটছে যে তাতে আতংকে কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমাদের। দলীয়-উপদলীয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে মারা পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। ধারালো অস্ত্র, লাঠি-সোঁটা এখন বুকশেলফের নীচেই থাকে; কখন কোনটার দরকার হয়! রাজনীতি করা শিক্ষার্থীদের কাছে বোমা-আগ্নেয়াস্ত্রও থাকে- প্রতিপক্ষকে হাতের নাগালে না পেলে ব্যবহারের জন্য।

মাসখানেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপদলীয় রাজনৈতিক কোন্দলে নিহত হলেন এক শিক্ষার্থী। কিছুদিন পরপরই সংঘর্ষ দেখে দিচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কয়েকমাসের মধ্যে বড় সংঘর্ষের খবর না থাকলেও ঢাকা-রাজশাহীতেও রয়েছে দলীয়-উপদলীয় কোন্দল। এরই মধ্যে ঘটে গেলো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা। দুই দলের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে নিহত হলেন দুই জন; আহত অনেক। অগ্নুৎপাত, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস কখন হবে, এটি যথাযথভাবে আভাষ দেয়ার প্রযুক্তি নাকি এখনো আবিষ্কার হয় নি। এ দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির অবস্থাও খানিকটা তাই। এগুলো কখন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরণ ও লাভার উদ্গীরণ শুরু করবে, অনুমান করা যায় না। আক্ষেপ হয়- এত তুচ্ছ কারণেও সহিংসতা ঘটে! মতাদর্শের কারণে সংঘাত বাধে না, বলা যাবে না। তবুও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘর্ষের কারণ- খেলার মাঠ-ক্যান্টিন-টিভি রুমের আধিপত্য, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, সিট দখল, অমুক উপদলের বড় ভাইকে তমুক কেন ‘সম্মান’ দেখালো না, এতদিন আমাদের সঙ্গে থেকে এখন কেন ওই দলে ভীড়ল, কেন আমাদের দেয়াল-ব্লকে লিফলেট-পোস্টার সাঁটানো হলো, কিছু ক্ষেত্রে হৃদয়ঘটিত জটিলতা প্রভৃতি। শিক্ষাঙ্গনে পেশীশক্তি ভিন্ন এসবের সমাধান হচ্ছে না দেখে বিবেচক যে কারো কষ্ট হবে। সহপাঠির পিঠে লাঠি ভেঙ্গে, বন্ধুকে কুপিয়ে, রুমমেটকে গুলি করেই কী এসব সমস্যার সমাধান করছে আজকের শিক্ষার্থীরা!

হলফ করে বলা যায় না, ভারতীয় উপমহাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে কখনোই সহিংসতা ছিল না। তবে একটা সময় পর্যন্ত রাজনীতিতে দলীয়-উপদলীয় কোন্দলকে ঘিরে সঙ্ঘর্ষ তেমন ছিল না। জাতীয় রাজনীতিকদেরও বিচক্ষণতা ছিল। তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভালো-খারাপ দুটোই করা সম্ভব, ফলে জাতীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা থেকে শিক্ষার্থীদের খানিকটা দূরে সরিয়ে রাখা হত তখন। ছাত্ররাজনীতির দুর্বলতা ও এর সাংঘর্ষিক দিকটি ফুটে উঠল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়; সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় রাজনীতির অঙ্গ ও সহযোগী হিসেবে ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হলে। ছাত্ররাজনীতিতে ব্যাপকভাবে অভ্যন্তরীণ সংঘাতও দেখা দেয় এ সময়। পরবর্তীতে বোধকরি মতাদর্শগত অবস্থান ভুলে গিয়ে তাদেরই অনুসরণ করে বাকিদলগুলো। কথা হলো, এমন ধারার রাজনীতির সমাপ্তি কী দেখা যাবে না শিক্ষাঙ্গনে? কন্টিনাম হাইপোথিসিসের মত অসীমকাল চলতে থাকবে এটি। অনেকে বলেন, এ সমস্যার সহজ সমাধান হলো জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়া; এটিকে পুরোপুরি শিক্ষামুখী করে ফেলা। এটি করতে গেলে এগিয়ে আসতে হবে রাজনীতিক-শিক্ষক-অভিভাবক- শিক্ষার্থী সবাইকেই।

বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই ১০০ বছরের বেশি পার করে নি। এ দিকে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান শুরু হয়েছে ১০৯৬ সাল থেকে। এর মধ্যে অসংখ্য বিপ্লব-সহিংসতা ঘটে গেছে দেশটিতে। কিন্তু কখনও অক্সফোর্ডের শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবস্থায় তাতে জড়িয়ে পড়েছে, শোনা যায় না। তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনগুলো ততটা রাজনীতি সচেতন নয়- কেউ বলতে পারবেন না। অথচ আমাদের দেশে ভাংচুর, মারামারির খবর শোনামাত্র যে প্রশ্নটি জাগে তা হলো- কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে? এ ধরনের ঘটনা আর দেখতে চাই না আমরা; যে কোনো মূল্যে সহিংসতা বন্ধ করে শিক্ষাঙ্গনে জ্ঞানার্জনের পরিবেশ দেখতে চাই।

ফাহমিদা ফেরদৌস

Leave a comment